সব কথা তো কথা নয়!

তীরন্দাজ এর ছবি
লিখেছেন তীরন্দাজ (তারিখ: শনি, ২৪/০৫/২০০৮ - ৪:০১অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

দুপরের গুমোট ভাবটি সামান্য কেটেছে। বাতাসও একটু হালকা হলো যেন। আবারও দুর থেকে কোকিলের ডাক শোনা গেলো, কুউ, কুউ। সে ডাকের সাথে সুর মিলিয়ে নিজেও জবাব দিলাম কুউ, কুউ…। একটু পর কোকিলও জবাব দিল আবার। চললো অনেকক্ষন একেবারে আলাদা দুই প্রাণীর ক্লান্তিহীন ডাকাডাকি। জানলার পাশের গাছটায় কে যেন ঢিল ছুড়লো হঠাৎ। কিচির মিচির করে উড়ে গেল একঝাক পাখী। ডানা ঝাপটানোর শরশর আওয়াজও শুনলাম। একটু পরেই আবার কিচির মিচির করতে করতে আবার বসলো গাছে। এই পাখিগুলো নিজেদের মাঝে কথা বলতে ভালবাসে। অন্যের ডাকের উত্তর দেয়না কখনো।

এধরনের বিষন্ন ও বিকল দুপুরে আমার প্রায়ই তুষারের কথা মনে হয়। তুষারও কি কিচির মিচির করা পাখীদের মতোই ছিল? একনাগাড়ে বলেই গেছে? কখনো কোন উত্তর দেয়নি? তার কথার বন্যায় তো ভেসে যেতাম আমরা। সকাল বেলা একসাথে ক্লাশে যাওয়ার সময় কথা, ক্লাসের ভেতরে বসে কথা, এমনকি খেলাধুলার সময়েও ওর কথা বলায় কোন ক্লান্তি ছিলনা। ক্লাস সিক্স থেকে শুরু করে ভার্সিটি অবধি একসাথে পড়াশোনা করেছি আমরা। দশ বছর ধরে তার অনেক অনেক কথা শুনলেও, কি বলতে চাইল সে, আজ অবধি জানা হলোনা আমাদের। ও কি কথা বলেছে, নাকি এই পাখীগুলোর মতো কিচির মিচিরই করেছে সারাক্ষন?

ভার্সিটিতে পড়ার সময়ই চার বন্ধুর সম্পর্ক আরো বেশী ঘনিষ্ট হয়। বাইরের পৃথিবীতে অনেক কিছুতেই অমিল থাকলেও ভেতরে কোথাও মিল না হলে বন্ধুত্ব হয়না। সুহাস আর অনিকের ভালো লেখার হাত। তুষার ও আমি গানের চর্চায়। অন্যদিকে রোমান্টিকতায় অনিক আর আমি। বাকী দু’জন সেজন্যে আমাদেরকে নানাভাবে খোঁচাতে ও জ্বালাতন মারতে ছাড়তো না। গানের জগতে বন্ধুত্বের বিস্তৃতি একটু বড়ই হয়। মেয়েদের সাথে বন্ধুত্বে একটু বেশীই রোমান্টিকতার আভাস থাকে। সেখানে আমাদের সৌভাগ্যে বাকী দু’জনের কিছুটা হলেও হিংসে হতো বৈকি!

সবার আগে প্রেমে পড়লো তুষার। তার প্রেমিকার সাথে পরিচয় করিয়ে দেবার আগেই নানাভাবে উল্টেপাল্টে সে কাহিনী শোনালো আমাদের। আমরা তুষারের কথা শুনেই শিউলীকে চিনে ফেললাম পুরোপুরি। শিউলীকে প্রথম দেখলাম ভার্সিটির চত্তরে। গাছের একটু আড়ালে তুষার শ্যামবরণ ছিপছিপে একটি মেয়ের পাশে ঘাসের উপর বসে। মেয়েটি অনর্গল বলে যাচ্ছে আর তুষার মনোযোগ দিয়ে শুনছে তার কথা। একটি কথাও বলছে না। আমাদের জন্যে একেবারে বিশ্বাস করার নয়! আরেকবার তাকিয়ে নিশ্চিত হলাম, এই আমাদের তুষার কি না। এই সে তুষার, যার কথার তোড়ে ক্লাশের টিচাররাও ভেসে যেতেন প্রায়! একটি মেয়ের পাশে চুপচাপ বসে!

শিউলীর সাথে পরিচয় হলো আমাদের অনেকটা দেরীতেই। সাধারণ বুদ্ধিমত্তার একটি মেয়ে। তবে ভালো গান জানতো। পাশে মেয়েদের একটি কলেজে পড়ে। দেখতে বেশ ভাল। মন প্রাণ জুড়ে তুষারকে সুখী করার জন্যে তৈরী। ওর সামনে দাঁড়ালে কেন জানি তুষার বেশী কথা বলতে পারতো না। পরে শুনলাম, শিউলীর আর তুষার, দু’জনেরই পরিবারেরই সমর্থন এই সম্পর্কের পেছনে রয়েছে।

কিন্তু আমাদেরকে হতবাক করে দিয়ে হঠাৎই একদিন ছাড়াছাড়ি হয়ে গেল ওদের। শিউলীর সাথে আমাদের আর দেখা হলোনা। তুষারকে খুব একটা অসুখী বলেও মনে হলোনা। তার কথার তোড় আগের মতোই রয়ে গেল। অনেক কথায় ঘুরিয়ে ফিরিয়ে আমাদেরকে ওদের ছাড়াছাড়ির কারণ জানালেও, মূল কারণটি বারবারই এড়িয়ে গেল। আমরা এ নিয়ে খুব বেশী ভাবলাম না। ওর ভেতর অস্বাভাবিক পরিবর্তন দেখলে হয়তো করতাম।

আকাশ থেকে মাঝে মাঝে খসে যায় কোন কোন তারা। পাশের তারাটি টেরও পায়না, অথচ অগুনতি বছর ধরে পাশাপশি। অনেকটা সেরকমই মাস কয়েক পর তুষার আমাদের কোন কিছু না বলেই চিরদিনের জন্যে নিজেই নীরব হয়ে গেলো। সিলিং ফ্যানে দড়ি ঝুলিয়ে আত্মহত্যা করলো সে। খবর পেয়ে তিনবন্ধু বেদনায়, কষ্টে বিমূঢ় হয়ে ওর বাবা-মার কাছে ছুটে গেলাম। সারা বাড়ী শোকে কাতর। তুষারে খাটে শোয়ানো তার নিথর শরীর। আমরা ওর ঘরে ঢুকে একবার ওকে দেখেই বাইরে বেরিয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লাম। মনে হলো, আমাদেরকে হেসে কিছু বলতে চাইছে সে।

কথা না বলেই থেকে সবার কাছ থেকে বিদায় নিল তুষার। জানাজার পর কবরস্থান অবধি গেলাম। বন্ধুকে কবরে নামিয়ে ঢেকে দিলাম স্তরের পর স্তর মাটিতে। ফেরার পথে ওর বাবা চোখের জল মুছতে মুছতে জানতে চাইলেন, ঘনিষ্ট বন্ধু হিসেবে আমরা কেউ তার কোন কষ্টের কথা জানি কি না। হয়তো সেটাই তার আত্মহত্যা কারণ। আমরা কি উত্তর দেবো? এতো কথা শুনলাম তুষারের, কিন্তু এ প্রশ্নের উত্তর তার কথায় ছিলনা। কথার পরে কথা বললেও, এই একটি কথা আমাদের কখনো বলে যায়নি তুষার।


মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

তীরন্দাজ ভাই, আপনার লেখাটা একেবারে তীরের মত বিধেছে বুকে। সত্যি খুব ভাল লাগলো।
...............................................................
" প্রেম মরে যায়...ক্ষয়ে গেলে দেহ
দিয়ে অপবাদ একথার প্রতিবাদ-
আগে করেছে কি কেহ?? "

আপনার কি অভিমত?

আশরাফ

তীরন্দাজ এর ছবি

অভিমত? একেবারে খাঁটি কথাটি বলেছেন আশরাফ! অনেক ধন্যবাদ!
**********************************
কৌনিক দুরত্ব মাপে পৌরাণিক ঘোড়া!

**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব

সৈয়দ আখতারুজ্জামান এর ছবি

আপনি চাইলে লেখাটিকে গল্পের ক্যাটাগরি থেকে তুলে কবিতার ক্যাটাগরিতেও ফেলতে পারেন। লেখাটা এতটাই কাব্যময়তায় পরিপূর্ণ মনেহয়েছে। চোখে ভাসছে দৃশ্যগুলো। অসাধারণ।

তীরন্দাজ এর ছবি

অনেক অনেক ধন্যবাদ আপনাকে ! আপাতত: গল্প হিসেবে থাকুক!
**********************************
কৌনিক দুরত্ব মাপে পৌরাণিক ঘোড়া!

**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব

রায়হান আবীর এর ছবি

উফফ!! কতো কষ্ট...মানুষ কেন যে এভাবে না বলে চলে যায়...তার এতো কথা সবাই শুনেছে এতোদিন কষ্টের কথাটাও তো শুনতো...সে কেন বললনা...

---------------------------------

তীরন্দাজ এর ছবি

আমারও এই একই কষ্ট। ঘটনায় সত্যতা আছে অনেকখানি।
**********************************
কৌনিক দুরত্ব মাপে পৌরাণিক ঘোড়া!

**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব

শাহীন হাসান এর ছবি

অলিখিত বেদনা রেখে যায় কেউ কেউ ... ,
জানি না কোন পূর্ণতা চায় মানুষ?
....................................
বোধহয় কারও জন্ম হয় না, জন্ম হয় মৃত্যুর !

....................................
বোধহয় কারও জন্ম হয় না, জন্ম হয় মৃত্যুর !

তীরন্দাজ এর ছবি

মৃত্যু ছাড়া পূর্ণতা বলতে কিছুই নেই শাহীন। তারপরও মানুষ তা চায় বলেই কষ্টের ভান্ডার ভরতে থাকে প্রতিদিন!

সহমত ও অনেক ধন্যবাদ!
**********************************
কৌনিক দুরত্ব মাপে পৌরাণিক ঘোড়া!

**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব

অতিথি লেখক এর ছবি

যেহেতু প্রেমের বিয়ে। কেন যে ছাড়াছাড়িটা হলো- স্বাভাবিক ভাবেই কিন্তু প্রশ্নটা এসে যায়। সেই সঙ্গে প্রশ্ন জাগা কি অসংগত যে, তুষার কেন আত্মহত্যার পথ বেছে নেবে?
-জুলিয়ান সিদ্দিকী

তীরন্দাজ এর ছবি

প্রথমত: ওদের বিয়ে হয়নি। ভালবাসা হয়েছিল। সেটাই ছিড়ে গেছে।
দ্বিতীয়ত: প্রশ্ন জাগা একেবারেই অসঙ্গত নয়। কিন্তু সব সঙ্গত প্রশ্নের কি উত্তর জানি আমরা। জানিনা বলেই তো এই গল্পের অবতারনা।
**********************************
কৌনিক দুরত্ব মাপে পৌরাণিক ঘোড়া!

**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব

পুতুল এর ছবি

এই একটি কথার জন্য তীরুদার লেখা এত ভাল লাগে!
অসাধারণ!

**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!

তীরন্দাজ এর ছবি

আন্তরিক ধন্যবাদ পুতুল!
**********************************
কৌনিক দুরত্ব মাপে পৌরাণিক ঘোড়া!

**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব

স্পর্শ এর ছবি

দুদিন আগেই আমার নিজের চোখের সামনে এরকম ঘটনা ঘটলো আরেকটা! মন খারাপ
আসলেই, দেখা যায় সবচেয়ে প্রানবন্ত মানুষ টাই সবচেয়ে বেশী অচেনা থেকে যায়।
-----------------------------
এখনো নজরবন্দী!


ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...

নিঝুম এর ছবি

আকাশ থেকে মাঝে মাঝে খসে যায় কোন কোন তারা। পাশের তারাটি টেরও পায়না, অথচ অগুনতি বছর ধরে পাশাপশি।

পছন্দের পোস্টে যুক্ত হলো। এরকম একটা লেখাই কেবল যুক্ত হতে পারে।
আপনি কি জানেন ? আপনি কত অসাধারণ একজন লেখক??
---------------------------------------------------------
পৃথিবীর সব সীমান্ত আমায় বিরক্ত করে। আমার বিশ্রী লাগে যে, আমি কিছুই জানিনা...

---------------------------------------------------------------------------
কারও শেষ হয় নির্বাসনের জীবন । কারও হয় না । আমি কিন্তু পুষে রাখি দুঃসহ দেশহীনতা । মাঝে মাঝে শুধু কষ্টের কথা গুলো জড়ো করে কাউকে শোনাই, ভূমিকা ছাড়াই -- তসলিমা নাসরিন

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।