পশুখামার (আট), মূল: জর্জ অরওয়েল, অনুবাদ: তীরন্দাজ

তীরন্দাজ এর ছবি
লিখেছেন তীরন্দাজ (তারিখ: বিষ্যুদ, ১৮/১০/২০১২ - ৩:১৪পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

ষষ্ঠ পর্ব

সারা বছর ধরে ক্রীতদাসের মতো খাটে পশুরা। কিন্তু কাজে খুব আনন্দ তাদের। কোনো ক্লান্তিই তাদের কাছে ক্লান্তিকর বলে মনে হয়না, কোনো কষ্টেই ম্রিয়মাণ হয় না ওরা। যা করছে, সবই নিজেদের ও তাদের পর নতুন যারা আসছে, তাদের জন্যে। কোনো কিছুই আলসে ও চোর স্বভাবের মানুষের করতে হয় না আর।

বসন্ত ও গ্রীষ্মের পুরো সময়ে সপ্তাহে ষাট ঘণ্টা করে কাজ করে ওরা। আগস্টের শুরুতে জানায় নেপোলিয়ন, রোববার বিকেলেও কাজ করতে হবে ওদের। যদিও বাধ্যতামূলক নয়, তারপরও যে সব অনুপস্থিত থাকবে, তাদের জন্যে অর্ধেক কমবে খাবারের বরাদ্ধ। তারপরও অনেক কাজই বাকি একে যায়। শস্যের ফলনও গতবারের চাইতে এবার কিছুটা কম ও যে গ্রীষ্মের দুটো ক্ষেতে মুলো চাষ করার কথা ছিল, লাঙ্গল চাষের কাজ সময়মত শেষ না হওয়ায় সেগুলো অনাবাদী থাকে। সামনের শীত যে কঠিন হবে, তারও পূর্বাভাস পাওয়া যায়।

বাতাসকল গড়তে গিয়েও করতে গিয়ে অপ্রত্যাশিত সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়। খামারের সীমানার ভেতরেই চুনাপাথরের গর্ত। পাশের একটি গুদামঘরে বালি আর সিমেন্টও যথেষ্ট পরিমাণে মজুত। দরকারি মাল-মশলার কোনো অভাব নেই। কিন্তু পাথরের টুকরোগুলো ভেঙ্গে ব্যবহারের উপযোগী আকারে আনা সমস্যা হয়ে দাঁড়ালো। গাইটি আর শাবল দিয়ে ভাঙ্গা যায় বটে, কিন্তু কোনো পশুর পক্ষে দুপায়ে দাঁড়িয়ে এ সব যন্ত্র হাতে কাজ করা অসম্ভব। প্রায় এক সপ্তাহের বিফল প্রচেষ্টার পর একজনের মাথায় মধ্যাকর্ষণ শক্তি ব্যবহারের বুদ্ধিটি এলো। গর্তে প্রচুর চুনাপাথরের বড়ো বড়ো টুকরো। কিন্তু টুকরোগুলো বর্তমান আকারে এই কাজে ব্যবহারের যোগ্য নয়। সুতরাং দড়ি দিয়ে বাঁধা হল এক একটা টুকরো। তারপর সবাই, গরু, ঘোড়া, ভেড়া, প্রায় প্রতিটি পশু, মিলে খুবই ধীরে ধীরে টেনে আনে গর্তের উপরে সব চাইতে উঁচু জায়গায়। কোনো কোনো জরুরী মুহূর্তে শুয়োরদেরকেও টানাটানিতে যোগ দিতে হয়। তারপর আবার কিনার বেয়ে সেই পাথর গড়িয়ে ফেলা হয় গর্তে। গড়ানোর পথে ভেঙ্গে যে টুকরোগুলো হয়, সেগুলো আকারে ব্যবহারযোগ্য ও আবার তুলে আনা হয় উপরে। এই কাজটি তূলনামূলকভাবে সহজ। গাড়ির পর গাড়ি বোঝাই পাথর উপরে আনে ঘোড়ারা। ভেড়ার দলও একটি একটি টুকরো করে টানে। এমনকি মুরিয়েল আর বেনজামিনও একটি ছোটো পুরনো গাড়ি টেনে টেনে কাজ করে যায়। গ্রীষ্মের শেষের দিকে যথেষ্ট পরিমাণে পাথর মজুত হবার পর শুয়োদের তত্বাবধানে নির্মাণের কাজ শুরু হয়।

কিন্তু পুরো কাজটিই অসম্ভব কষ্টসাধ্য ও ধীরগতির। অনেকসময় একটি মাত্র বড়ো পাথরের টুকরো গর্তের উপরের উঁচু জায়গা অবধি তুলতেই পুরো দিন শেষ। মাঝে মাঝে নিচে গড়িয়ে ফেলা পরও অক্ষত থাকে পাথর। বক্সার ছাড়া এ কাজ অসম্ভব! সে একাই বাকী সব পশুর সমান। অনেক সময় বড়ো বড়ো উপরে তোলার সময় নীচে গড়িয়ে যায়। তখন প্রতিবারই রশি টেনে থামানোর কাজ বক্সারই করতে পারে। কী শক্তিকে বিশাল এক পাথর একেকটা নি:শ্বাসে এক এক ইঞ্চি করে উপরে তোলে সে, বিশ্বাস যোগ্য নয়। মাটিতে পায়ের শক্তি-মদমত্ত আঘাত, শরীরে ঘাম, দেখে বিস্ময়ে অবিভুত সবাই। অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি না করার জন্যে মাঝে মাঝে তুলসীপাতা সাবধান করে তাকে। কিন্তু সেদিকে কান দেয়না সে। তার দুটোই মূলমন্ত্র: "আমাকে আরও বেশী খাটতে হবে" আর "নেপোলিয়নের কথা সবসময়েই সঠিক"। এটিই তার সবরকম সমস্যার উত্তর। আগে যে মোরগটি তাকে নির্দিষ্ট সময়ের চাইতে আধ ঘণ্টা আগে জাগিয়ে দিতো, তাকে তাকে অনুরোধ করে আর পনেরো মিনিট আগে ডাকার জন্যে। এমনকি কাজের সময়ের বাইরেও সে একা সে খাঁদায় গিয়ে ভাঙ্গা পাথরের টুকরো কারো সাহায্য ছাড়াই জমিয়ে টেনে আনে বাতাসকল স্থাপনের জায়গায়।

কঠিন পরিশ্রমের পরও এই গ্রীষ্মকাল ভালোই কাটে পশুদের। খাবার যা পায়, তা জোনসের সময়েই চাইতে বেশী না হলেও কম নয়। তবে এখন নিজেরাই নিজদের দায়িত্বে সবাই ও পাঁচজন অকর্মণ্য মানুষের কাছে সমস্ত পরিশ্রমের অর্জন বিলিয়ে দিতে হয়না তাদের। আর মাঝে মাঝে যে সব সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়, নিজেদের অর্জনের তুলনায় তা নিতান্তই নগণ্য। আর বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে অনেক কাজই মানুষদের চাইতে দক্ষ ও দ্রুত করতে পারে পশুরা। যেমন, আগাছা পরিষ্কার- এই কাজে মানুষদের চাইতে অনেক দক্ষতা তাদের। আরেকটা সুবিধা হল, কোনো পশুই চুরি করে না। সুতরাং মাঠ আর উর্বর ক্ষেতের সীমানায় কোনো বেড়ার প্রয়োজন হয় না। তাতে বেড়া আর ঝোঁপঝাপ দেখাশোনার কাজও কমে যায় অনেকখানি। কিন্তু গ্রীষ্মের সময়ে আরও কিছু দরকারি জিনিসের অভাব টের পাওয়া যায় হঠাৎ। প্যরাফিন তেল, তারকাটা, দড়ি, কুকুরের খাবার, ঘোড়ার ক্ষুরের জন্যে লোহা- বিভিন্ন টুকিটাকি দরকারি জিনিসপত্র, যা খামারে তৈরি করা যায় না, জরুরী হয়ে পড়ে। বীজ, কৃত্রিম সার ও বাতাসকলের জন্যে বিভিন্ন যন্ত্রপাতি আর কলকব্জাও প্রয়োজন। কোত্থেকে জোগাড় হবে এসব, এ নিয়ে কারো কোন ধারনাও নেই। কোনো এক রোববার সকালে সবাই জমা হয় তাদের কাজের নির্দেশ পাবার জন্যে। নেপোলিয়ন জানায়, খামারের রাজনীতিতে এক পরিবর্তন আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে। এখন থেকে প্রতিবেশী খামারগুলোর সাথে ব্যবসায়িক সম্পর্ক স্থাপন করা হবে। নিছক বাণিজ্যিক লাভের জন্যে এই ব্যবসায়িক সম্পর্ক নয়, বরং নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি জোগাড় করাই হবে এই সম্পর্কের উদ্দেশ্য। তার কথানুযায়ী, বাতাসকল স্থাপন সবচাইতে জরুরী। সুতরাং কয়েক স্তূপ খড় ও কিছু গম বিক্রি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে। পরে আরও টাকাপয়সা জোগাড়ের জন্যে উইলিংডনের বাজারে মুরগির ডিমও বিক্রি করা হবে। মুরগিরা বাতাসকলের জন্যে তাদের এই ত্যাগ যেন খুশী মনে মেনে নেয়।

আবারো সব পশুদের ভেতরে এক অবিশ্বাসের বাতাস বয়। কদিন আগেই তো জোনসকে তাড়ানোর পর পালন হল সেই বিজয়ের আনন্দে উদ্বেলিত দিন। সেদিনই আইন পাশ করা হল, "কোনো মানুষের সাথে কখনোই কোনো যোগাযোগ থাকবে না", "কখনোই কোনো ব্যবসা করা চলবে না", "টাকার ব্যবহার পুরোপুরি নিষেধ"! প্রতিটি পশুই সেদিনের সে ধারার প্রতিটি লাইন বলতে না পারলেও এধরনের কিছু যে ঠিক করা হয়েছিল, সেটি মনে করতে পারে। নেপোলিয়নের বক্তব্য শেষ হবার পর সেই চার যুবক বয়েসী প্রতিবাদী শুয়োর উঠে দাঁড়িয়ে কিছু বলার চেষ্টা করে। কিন্তু কুকুরগুলোর ভয়ঙ্কর ডাক শুনে স্তব্ধ হয়ে যায়। সাথে সাথেই ভেড়ার দল শুরু করে তাদের ত্রাহি চীৎকার, "চারপেয়েরা ভালো, দুপেয়েরা মন্দ”। প্রতিবাদের শেষ চিহ্নও উড়ে যায় সেভাবেই। সবাইকে শান্ত করার জন্যে সামনের পা দুটো তুলে জানায় নেপোলিয়ন, এর জন্যে দরকারি প্রতিটি পদক্ষেপই নিয়েছে সে। কোনো পশুকে যাতে কোনো মানুষের কোনো মানুষের সংস্পর্শে না আসতে হয়ে, সেজন্যে নিজের কাঁধেই সে দায়িত্ব তুলে নিয়েছে। মি: উইমপার নামে উইলিংডনের এক উকিলকে পশু ও বাইরের জগতের সাথে যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে কাজ করা দায়িত্বে নিয়োজিত করা হয়েছে। তার নির্দেশ নেবার জন্যে প্রতি সোমবার সকালে সে উকিল একবার করে পশুখামারে আসবে। প্রতিবারের মতোই "পশুখামার জিন্দাবাদ!" বলে বক্তব্যের সমাপ্তি টানে সে। তারপর একবার "ইংল্যান্ডের পশু" গাওয়ার পর শেষ হয় সভা।

পরে সমস্ত পশুদের মাঝে একপাক ঘুরে চাপাবাজ শান্ত করে পশুদের। সবাইকে নিশ্চয়তা দিয়ে বলে সে, ব্যবসা ও টাকাপয়সার সংক্রান্ত কোনো ধারা কথনই পাশ করা হয়নি। এমন কি এ নিয়ে কোনো আলোচনাই হয়নি আজ অবধি। এসব ধারা নিয়ে আলোচনা পুরো কল্পনাপ্রসূত ও শুধুমাত্র তুষারবলের ছড়ানো মিথ্যের ফানুস। কয়েকজন নিচু স্বরে তাদের সন্দেহ প্রকাশ করায় চাপাবাজ বলে, "হলফ করে বলতে পার, যে তোমরা স্বপ্ন দেখনি? এ সব ধারা পাশ হয়েছিল বলে কোনো প্রমাণ আছে তোমাদের কাছে? কোথাও লেখা আছে এসব?" আসলেই কোথাও এই ধারার কথা লিখিত নেই। সুতরাং চাপাবাজের কথা নিরেট সত্য হিসেবে মেনে নিয়ে নিজেদের ভুল স্বীকার করতে বাধ্য হয় ওরা।

মি: উইমপার কথামতো প্রতি সোমবারেই খামারে আসে। চাপদাড়ি মুখে ছোটোখাটো চেহারার ছোটো পশারের এক উকিল। তারপরও পশুখামারের জন্যে এক দালাল দরকার ও সেখানে রোজগার ভালোই হবে, এই কথাটি সবার আগে সে ই টের পায়। মনের ভেতরে অজানা এক ভীতিতে আচ্ছন্ন পশুরা তার আসাযাওয়া নজর প্রতিবারই নজর করলেও সরাসরি সাক্ষাত যতটা সম্ভব এড়ানোর চেষ্টা করে। তারপরও চারপেয়ে নেপোলিয়ন যে ভাবে দুইপায়ের এই লোককে বিভিন্ন নির্দেশ দেয়, সেটি দেখে বুক গর্বে ফুলে ওঠে ওদের। অন্ততপক্ষে নতুন নিয়মের একটি ভালো দিক দেখে স্বস্তি হয় ওদের।

পশুদের সাথে মানুষদের সম্পর্ক আর আগের মতো থাকে না। পশুরা উন্নতি করছে ধীরে ধীরে, তা দেখে তাদের প্রতি মানুষদের ঘৃণা কমে না, বেড়ে বেড়ে চূড়ান্ত পর্যায়ে। প্রত্যেকেই এই কথাটিই বিশ্বাস করতে ভালোবাসে যে, আজ বা কাল দেউলিয়া হতে বাধ্য পশুখামার। বিশেষ করে বাতাসকলের বাস্তবায়ন ব্যর্থ হতে বাধ্য। রেস্টুরেন্টে বসে নকশা এঁকে এঁকে একে অন্যকে প্রমাণ করা চেষ্টা করে, কতো দ্রুত ভেঙ্গে পড়বে বাতাসকলের স্তম্ভ। আর যদিও না ভাঙ্গে কখনোই ঘুরবে না পাখা। তারপরও পশুরা নিজদের কাজ নিজেরাই করে যাচ্ছে, সেটি ভেবে নিজেদের ইচ্ছের বিরুদ্ধেই পশুদের কর্মক্ষমতার প্রতি এক ধরণের সমীহ সৃষ্টি হয় তাদের ভেতরে। তাদের সমীহের প্রমাণ এতেই পাওয়া যায়, যখন তারা পশুখামারকে "পুরুষ খামার" না ডেকে সঠিক নামেই ডাকা শুরু করে। জোনসের প্রতি সমর্থনও প্রত্যাহার করে তারা। সেও তার খামার ফিরে পাবার আশা ছেড়ে দিয়ে দেশের অন্য কোথাও বাস খুঁজে নেয়। একমাত্র মি: উইমপার ছাড়া বাইরের অন্য কারো সাথে যোগাযোগ নেই পশুখামারের। তারপরও এই বলে শক্ত গুজব ছড়ানো শুরু হয় যে, নোপোলিয়ন "শেয়ালবন" খামারের মি: পিল্কিংটন ও "কোনাগড়" খামারের মি ফ্রেডেরিক, দুজনের সাথেই সরাসরি ব্যবসায়িক সম্পর্ক গড়ে তুলছে। সে ব্যবসায়িক সম্পর্ক যে একযোগে দুজনের সাথে নয়, এ বিষয়ে নিশ্চিত সবাই। মোটামুটিভাবে একই সময়ে শুয়োরেরা জোনসের বাসস্থানে ঢুকে সেখানে বসবাস শুরু করে। এ বিষয়ে একটি ধারা তৈরি করা হয়েছিল, সেটি মনে করার চেষ্টা করে বাকি পশুরা। এবারও চাপাবাজ তাদের এই ধারণাকে ভুল প্রমাণ করতে সক্ষম হয়। সে বলে, যেহেতু শুয়োরেরা খামারের মগজ হিসেবে কাজ করে, একটি শান্ত কর্মস্থলও তাদের জন্যে খুব জরুরী। নেতার প্রতি যথাযোগ্য সন্মানের প্রমাণ হিসেবেও নেপোলিয়নের শুয়োরের বাক্সের বদলে একটি বাসস্থান প্রাপ্য। গত কয়েকদিন যাবতই সে নেপোলিয়নকে নেতা ডাকা শুরু করেছে। তারপরও পশুরা যখন শোনে, শুয়োরেরা শুধুমাত্র রান্নাঘরে খাবার স্থান বা বসার ঘরটি অবসরের স্থান হিসেবেই ব্যবহার করায় সীমাবদ্ধ রেখে মানুষদের বিছানায় ঘুমোতেও যায়, তখন কেউ কেউ কিছুটা বিব্রত বোধ করে। "নেপোলিয়ন যা করে, তা সবসময়েই সঠিক", বক্সার এই কথাতে অটল থাকলেও তুলসীপাতা মানুষের বিছানা সম্পর্কিত ধারাটি মনে করতে পারে। আস্তাবলের পেছনে গিয়ে দেয়ালে লিখিত সেই সাতটি ধারা পড়ার চেষ্টা করে তখন। যখন দেখে, শুধুমাত্র কয়েকটি অক্ষর পড়ার যোগ্য, মুরিয়েলকে ডাকে সে।

"মুরিয়েল। চার নম্বর ধারাটা পড়ে দেখত! মানুষের বিছানায় কোনো পশু ঘুমোতে পারবে না, এমন একটি কথা ছিল না সেখানে?"

বানান করে করে খুব কষ্টে পড়ে মুরিয়েল। অবশেষে বলে,

"ওখানে লেখা, কোনো পশু চাদর বিছানো বিছানায় ঘুমোতে পারবে না।"

অবাক ব্যাপার! চাদরের কথাটি যে লেখা ছিল আগে, সেটি কিছুতেই মনে করতে পারে তুলসীপাতা। ঠিক সেই মূহুর্তে দু তিনটি কুকুর সাথে চাপাবাজ এসে পুরো বিষয়টি খোলাসা করে দেয়।

"কমরেড! তোমরা নিশ্চয়ই শুনেছ যে আমরা, শুয়োরেরা বাড়ির ভেতরে বিছানায় ঘুমাই। কেন নয়? তোমরা কি বলতে চাইছ, বিছানায় ঘুমানোর বিরুদ্ধে কোনো শমন জারী হয়েছিল? একটি বিছানা শুধুমাত্র একটি ঘুমানোর জায়গা। আস্তাবলের খড়ের গাদাও একটি বিছানা। শমন জারি হয়েছে মানুষের তৈরি চাদরের বিরুদ্ধে। আমরা বিছানার সব চাদর সরিয়ে শুধুমাত্র লেপের নিচে ঘুমাই। এটা সত্যি, বিছানায় ঘুমনো খুবই আরামদায়ক। কিন্তু এ কথাও তোমাদের জানা জরুরী যে, এ আরাম আমাদের জন্যে যতোটা দরকার, তা চাইতে সামান্যও বেশী নয়। যে সব মাথার কাজ আমাদের করতে হয়, তাতে আরামদায়ক, শান্ত পরিবেশ দরকার। তোমরা নিশ্চয়ই আমাদের শান্তি নষ্ট করতে চাওনা কমরেড। তাই না? তোমরা নিশ্চয়ই চাওনা যে, আমরা ক্লান্ত হয়ে আমাদের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হই। তোমরা নিশ্চয়ই কেউ চাওনা যে, জোনস আবার ফিরে আসুক খামারে!"

এই বিষয়ে চাপাবাজের কথা পশুরা সাথে সাথেই মেনে নেয়। এই নিশ্চয়তাও পাওয়া যায়, শুয়োরদের বিছানায় ঘুমানো ওদের জন্যে কোনো আলোচনার কোনো বিষয় না। তার কয়েকদিন পর যখন জানানো হল, শুয়োরেরা এক ঘণ্টা পরে ঘুম থেকে জাগবে, তখনও কারো কোনো প্রতিবাদ রইল না।

শরতের সময়ে পশুরা পরিশ্রান্ত থাকলেও সুখেই কাটায়। তাদের পেছনে ফেলে কঠিন একটি বছর। খড় ও শস্যের একটি অংশ বিক্রি হওয়ায় সামনের শীতের জন্যে পর্যাপ্ত খাবারের পরিমাণ অনেকটাই কম। কিন্তু বাতাসকলের গুরুত্ব বিচারে এসব সমস্যা নিতান্তই নগণ্য। কাজ আধাআধি শেষ। ফসল কাটা সমাপ্তির পর লম্বা সময় ধরে শুকনো ও সুন্দর আবহাওয়া। আগের চাইতেও দুর্দান্ত খাটে পশুরা। সারাদিন পাথর টেনে টেনে বাতাসকলের দেয়াল এক ফুট বাড়াতে পেরে যে সাফল্য, তার মূল্যমান তাদের কাছে নিজেদের খাটুনির অনেক উঁচুতে। এমন কি রাতের বেলাও বক্সার একা একা শরতের চাঁদের আলোতে কাজ করতে আসে। অবসরের সময়ে পশুরা বাতাসকলের স্তম্ভের চারপাশে ঘুরে ফিরে দেখে। দেয়ালের শক্তিশালী গড়ন, সোজা উপরে ওঠার নৈপুণ্য দেখে নিজেরাই অবাক হয় নিজেদের সাফল্যে। বেনজামিনকেই একমাত্র, যার কোনো আনন্দের প্রকাশ নেই। গাধারা অনেক দিন বাঁচে জাতীয় তার রহস্যময় মন্তব্যের হেয়ালী ছাড়া আর কিছুই নেই তার কথায়।

দক্ষিণের দুরন্ত ঝড় নিয়ে আসে নভেম্বর। বৃষ্টিতে সিমেন্ট ভিজে যাবার ভয়ে বন্ধ রাখতে হয় বাতাসকলের নির্মাণকাজ। এক রাতে ঝড় এক বেশী তীব্র যে, ভিত সহ কেঁপে ওঠে খামারবাড়ি। ছাদের কয়েকটি টালিও নিচে ভেঙ্গে পড়ে। একই সাথে সবাই মিলে স্বপ্নে দুর থেকে গুলির আওয়াজ শুনে ভয়ে চেঁচামেচি করে মোরগ মুরগির পাল। সকালে আস্তাবল থেকে বেরিয়ে এসে দেখে সবাই, তাদের পতাকার খাম কাত হয়ে পড়ে। ফলবাগানের গোঁড়ায় একটি ‌ঝাউগাছ যেন মুলোর মতো উপড়ে ফেলা হয়েছে। তবে একটি দৃশ্য দেখে সবাই চীৎকার করে ওঠে বেদনায়। বিমূঢ় হতাশা তাদের চাওনীতে, তাদের বাতাসকল দুমরে মুচড়ে মাটিতে ধূলিসাৎ।

সবাই মিলে ছোটে দুর্ঘটনাস্থলে। নেপোলিয়ন ছোটে সবার আগে আগে, যদিও আস্তে আস্তে চলতেই পছন্দ তার। হ্যাঁ, এখানেই ধূলিসাৎ তাদের সমস্ত পরিশ্রমে গড়া বাতাসকলের স্তম্ভ! চারিদিকে ইতস্তত ছড়িয়ে তাদের কঠিন পরিশ্রমে ভাঙ্গা পাথরের টুকরো। প্রথমে কোনো কথা ফোটে না তাদের মুখে, বেদনায় নিথর হয়ে তাকিয়ে থাকে ধ্বংসস্তূপের দিকে। নেপোলিয়ন একবার এদিক একবার ওদিকে যায়, মাঝে শুঁকে দেখে কোনো কোনো জায়গা। তার চক্রের মত লেজ শক্ত হয়ে এদিক ওদিক নড়ে। মনে হয় গভীর চিন্তায় মগ্ন সে। একসময় স্থির হয়ে দাঁড়ায়, যেন কোনো এক সিদ্ধান্তের দোরগোড়ায় পৌঁছে সে।

শান্ত স্বরে বলে, “বন্ধুরা, জান এর জন্যে কে দায়ী? এখনো টের পাওনি সে তোমরা, কোন শত্রু রাতের আঁধারে চুরমার করেছে আমাদের বাতাসকল? সে শত্রুর নাম তুষারবল!” বলে বজ্রস্বরে চীৎকার করে সে।

“তুষারবলই করেছে এসব। আমাদের ক্ষতি করার জন্যে, আমাদের পরিকল্পনাকে নস্যাৎ করার জন্যে এই কাজ করেছে সে। তাকে অপদস্থ করে যেভাবে তাড়িয়েছি আমরা, রাতের অন্ধকারের সুযোগ নিয়ে আমাদের এক বছরের পরিশ্রম বিনষ্ট করেছে সে। বন্ধুরা, আমি এই মুহূর্তে তার মৃত্যুদণ্ড দাবী করছি। যে তাকে খুন করবে, তার জন্যে খেতাব হিসেবে “দ্বিতীয় শ্রেণীর বীর” ও আধ ঝুড়ি আপেল পুরস্কার হিসেবে নির্ধারিত করা হল। যে তাকে জ্যান্ত ধরে আনবে, তার পুরস্কার এক ঝুড়ি আপেল।“

তুষারবলের কুকর্মের কথা শুনে স্তম্ভিত বিস্ময়ের আঘাতে চেঁচিয়ে ওঠে সবাই। ফিরে এলে তাকে কী ভাবে শাস্তি দেয়া হবে, এই নিয়ে জল্পনা কল্পনা শুরু করে সবাই। পরপরই টিলার কাছাকাছি কোনো শুয়োরের পায়ের ছাপ আবিষ্কার করে সবাই। বেড়ার এক ছিদ্র অবধি গিয়ে মিলে যায় সে ছাপ। খুব মনোযোগে শুঁকে শুঁকে সে ছাপ তুষারবলের বলে জানায় নেপোলিয়ন। তার বিশ্বাস, “শেয়ালবন” খামারের দিকে পালিয়েছে তুষারবল।

পায়ের ছাপ পরীক্ষা করে বলে নেপোলিয়ন, “আর দেরি নয় বন্ধুরা! এক্ষুণি, এই সকালেই বাতাসকল গড়ার কাজ আবার শুরু করতে হবে আমাদের। রোদ ও বৃষ্টিকে তোয়াক্কা না করে পুরো শীতকাল জুড়ে কাজ করে যাব আমরা। আমাদের প্রচেষ্টা নষ্ট করার ক্ষমতা তার নেই, এই বিশ্বাসঘাতককে আমরা তা শিখিয়ে ছাড়ব! মনে রেখ, আমাদের পরিকল্পনার কোনো পরিবর্তন যেন না হয়! ঠিক নির্ধারিত সময়েই কাজ শেষ করতে হবে আমাদের। এগিয়ে যাও বন্ধুরা! বাতাসকল জিন্দাবাদ! পশুখামার জিন্দাবাদ!”
চলবে………

পশুখামার (এক)
পশুখামার (দুই)
পশুখামার (তিন)
পশুখামার (চার)
পশুখামার (পাঁচ)
পশুখামার (ছয়)
পশুখামার (সাত)


মন্তব্য

তুলিরেখা এর ছবি

প্রতিটা পর্বই মন দিয়ে পড়ছি। এই বইয়ের নাম খুব শুনলেও কেন জানি আগে পড়া হয় নি। আপনার অনুবাদ ভালো লাগছে পড়তে।

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

সবুজ পাহাড়ের রাজা এর ছবি

সবগুলো পর্ব পড়েছি। আপনার অনুবাদের হাত দারুন। চলুক চলুক

অতিথি লেখক এর ছবি

চমৎকার অনুবাদ,,, পড়ে যাচ্ছি সবগুলোই চলুক

- নৃ

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।