পশুখামার (নয়), মূল: জর্জ অরওয়েল, অনুবাদ: তীরন্দাজ

তীরন্দাজ এর ছবি
লিখেছেন তীরন্দাজ (তারিখ: মঙ্গল, ৩০/১০/২০১২ - ২:০৩পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

সপ্তম পর্ব:
নিদারুণ শীত এবছর! দমকা ঝড়ো হাওয়ার পর প্রথমে বরফ-বৃষ্টি ও তারপর তুষারপাত। এরপর শুধুই কঠিন বরফ, যা ফেব্রুয়ারি অবধি জমাট বেঁধে থাকে। বাতাসকল পুনর্নির্মাণের কাজে সর্বশক্তিতে খাটে পশুরা। তাদের দিকে যে নজর সবার, সেটি অজানা নয় তাদের। নির্মম সত্য এই যে, তাদের যে কোনো ব্যর্থতায় জয়ের উল্লাসে ফেটে পড়বে হিংসুটে মানুষ।

বাতাসকলের স্তম্ভ তুষারবল ভাঙেনি বলে রটনা ছড়ায় মানুষ। তারা বলে, দেয়ালের গাঁথুনি যথেষ্ট পুরু করা হয়নি বলেই ভেঙ্গে পড়েছে স্তম্ভ। এসব রটনা মিথ্যে, জানে পশুরা। তারপরও আঠারো ইঞ্চির বদলে তিন ফুট পুরু দেয়াল তোলার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ফলশ্রুতিতে আরও অনেক বেশি পাথর যোগান দিতে হয়। শীতের সময়ে অনেকদিন ধরে কঠিন বরফে ঢেকে থাকে চুনাপাথরের গর্ত। কোনো কাজই করা সম্ভব হয় না। আবহাওয়া একটু শুকনো হবার পর কাজে সামান্য এগিয়ে যাওয়া সম্ভব হলেও সেটি চরম পরিশ্রমের। এসব কারণে পশুদের আশা-ভরসাও তলানিতে এসে ঠেকে। শুধুমাত্র বক্সার আর তুলসীপাতা নিজেদের প্রতি আস্থা বজায় রাখে। কাজে সন্মান, সেবায় আনন্দ নিয়ে চমৎকার বক্তৃতা দেয় চাপাবাজ। কিন্তু বক্সারের সেই এক ও অদ্বিতীয় কথা, “আমি আর বেশি কাজ করব” পশুদের এরচাইতে বেশি প্রেরণা যোগায়।

জানুয়ারিতে খাবারের অভাব দেখা দেয়। পশুদের জন্যে শস্যকণা কমিয়ে তার বদলে বাড়তি আলু বরাদ্ধের কথা বলা হয়। কিন্তু দেখা যায়, ভালো করে ঢেকে না রাখায় ঠাণ্ডায় জমে গিয়েছে সে আলু। পরে সে নরম হয়ে যায় আর গায়ে নোংরা দাগ লাগে। তার সামান্যই খাবার যোগ্য। মাঝে মাঝে এমনও দিন যায় যে, গাজর ও লতাপাতার আবর্জনা খেয়েই সারা দিন কাটাতে হয় পশুদের। মনে হয় কোনো ক্ষিদের তাড়নায় মরবে সবাই।

কিন্তু বেঁচে থাকার জরুরী তাগিদেই এ সব সত্য মানুষের সামনে গোপন রাখতে হয়। বাতাসকল ভেঙ্গে পড়ার সুযোগে অনেক মিথ্যে আর জল্পনা কল্পনার জাল ছড়িয়েছে মানুষ। এবার ছড়ানো হয়, ক্ষুধা আর অসুস্থতার মড়ক হয়ে লেগেছে পশুখামারে। সারাক্ষণই নিজেদেরই মাঝে যুদ্ধ, শিশুহত্যা আর একে অপরের মাংস খাওয়ার ধুম লেগেছে। উইমপার যদি এই অবস্থা টের পায়, তার ফলাফল পশুখামারের জন্যে বিপদজনক। সুতরাং নেপোলিয়ন সিদ্ধান্ত নিল, অবস্থার উল্টোটাই দেখাতে হবে উইমপারকে। প্রতি সপ্তাহের আনাগোনায় কোনো পশুরই সংস্পর্শে আসার সুযোগ হত না উইমপারের। এবার আগে থেকে ঠিক করে রাখা কিছু পশু, বিশেষ করে ভেড়ার দলকে পরামর্শ দেয়া হয় তার সামনা সামনি হবার। পরিস্থিতি বুঝে তাকে যেন দেখানো হয়, খাবারের বরাদ্ধ বাড়ানো হয়েছে। এর পাশাপাশি নেপোলিয়নের নির্দেশে প্রায় খালি খাবারের গামলাগুলো কিনার অবধি বালি ভর্তি করে উপরে শস্য আর ভুষি বিছিয়ে দেয়া হয়। কোনো এক অজুহাতে উইমপারকে নিয়ে যাওয়া হয় খাবার ঘরে, যাতে গামলাগুলো চোখে পড়ে তার। তাতে কাজ হয় ও বাইরের লোক জানতে পারে, পশুখামারে খাবারের কোনো অভাব নেই।

কিন্তু তারপরও জানুয়ারির শেষে বাইরে থেকে শস্য জোগাড় করা তীব্রভাবে জরুরী হয়ে পড়ে। এরকম সময়ে নেপোলিয়ন খুব কমই বাকীদের সামনে আসে। সারা দিন ও রাত খামারের বাড়িতেই কাটায় সে। বাড়ির প্রতিটি দরজায় বদমেজাজি কুকুরের পাহারা। কদাচিৎ বাইরে এলেও, আসে অনেকটা আনুষ্ঠানিক কায়দায়। ছয়টি কুকুর ঘন হয়ে ঘিরে থাকে তাকে। যে ই কাছাকাছি আসে, তাকেই চাপা গর্জনে শাসায় কুকুরের দল। বেশিরভাগ সময়েই রোববার সকালেও সে অনুপস্থিত থাকে। যা যা বলার, তা বলার জন্যে অন্য কোনো শুয়োর বা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে চাপাবাজকে পাঠায়।

রোববার সকালে চাপাবাজ জানায়, যে সব মুরগি ডিম পাড়ে, সে ডিম জমা দিতে হবে তাদেরকে। উইমপারের মধ্যস্থতায় প্রতি সপ্তাহে একশো ডিম পাঠাতে হবে বাজারে। যত টাকা আসবে, তার বিনিময়ে খামার টিকিয়ে রাখার জন্যে সামনের গ্রীষ্মে জীবনযাত্রার সহজ হওয়া অবধি যথেষ্ট পরিমাণে শস্য আর ভুষি কেনা যাবে।

শুনেই প্রচণ্ড চেঁচামেচি শুরু করে মুরগিরা। যদিও আগে থেকেই জানত তারা, এ ত্যাগ করতে হতে পারে তাদেরকে। তারপরও যে সত্যি সত্যিই করতে হবে, সেটা ভাবেনি তারা। বসন্তের আগে ডিমে তা দেয়ার জায়গা গোছানোয় ব্যস্ত তারা, এটা হত্যা বলে প্রতিবাদ জানালো সবাই মিলে। জোনসকে বিতাড়িত করার পর এই প্রথমবারের মতো সত্যিকারের বিদ্রোহ শুরু হয় খামারে। তিনটি অল্পবয়সী মিনরকা মুরগির নেতৃত্বে খুব দৃঢ়তার সাথে নেপোলিয়নের আদেশকে খণ্ডন করার চেষ্টা চালায় মুরগিরা। তাদের প্রতিবাদের পন্থা, পাখা ঝাপটে ঝাপটে মাচার অনেক উঠে ডিম পাড়া। সেখান থেকে মাটিতে পড়ে চুরমার সে ডিম। সাথে সাথেই নির্দয় পাল্টা ব্যবস্থা নেয় নেপোলিয়ন। মুরগিদের জন্যে খাবারের বরাদ্ধ বন্ধ করে দেয় ও কেউ যদি মুরগিদের একটি কণা গমও দেয়, তার মৃত্যুদণ্ড দেবে বলে হুমকি জানায়। তার এই হুমকি যাতে লঙ্ঘন না করা হয়, সে জন্যে কড়া পাহারায় থাকে কুকুরের দল। পাঁচদিন টিকে থাকে মুরগিরা ও তারপর আত্মসমর্পণ করে ফিরে আসে তাদের নির্ধারিত খোঁয়াড়ে। নয়টি মুরগি মারা যায় এই সময়ে ও ফলবাগানে কবর হয় তাদের। সবাইকে জানানো হয়, মুরগি-জ্বরে মরেছে ওরা। উইমপার এই ঘটনার কিছুই জানতে পারে না। এক ব্যবসায়ীর গাড়ি প্রতি সপ্তাহে একবার করে আসে খামারে ও নির্ধারিত সময়মত সে ডিম তুলে দেয়া হয় গাড়িতে।

পুরো সময়ে তুষারবলের কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া যায় না। গুজব শোনা যায়, শেয়াল-বন বা কোনাগড় খামারে আত্মগোপন করে সে। নেপোলিয়নের সাথে অন্যান্য খামারের মালিকদের সম্পর্ক আগের চাইতে অনেক ভালো। দশ বছর যাবত বার্ক গাছের ভালো কাঠ বেশ যত্নে জমা হয়ে ছিল খামারে। নেপোলিয়নকে সে কাঠ বিক্রির পরামর্শ দেয় উইমপার। পিকলিংটন ও ফ্রেডারিক, দুজনেই মুখিয়ে এই কাঠ কেনার জন্যে। নেপোলিয়ন এই দুজনের মাঝে দোদুল্যমান ও কারো পক্ষেই সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। ঠিক ফ্রেডারিকের সাথে ব্যবসায় যাওয়ার আগে মুহূর্তে শোনা যায় তুষারবল শেয়াল-বনে লুকিয়ে আর পিকলিংটনের সাথে যাওয়ার আগের মুহূর্তে শোনা যায় কোনাগড়ে লুকিয়ে সে।

বসন্তের শুরুতে হঠাৎ নতুন এক ঘটনায় সন্ত্রস্ত সবাই। তুষারবল নাকি রাতের অন্ধকারে লুকিয়ে খামারে এসেছিল! দুর্ভাবনায় রাতে ঘুমতে পারেনা পশুরা। বলা হয়, প্রতি রাতেই অন্ধকারের আড়ালে লুকিয়ে এসে ইচ্ছেমত ধ্বংসাত্মক কুকর্ম করে যায় তুষারবল। সে শস্য চুরি করে, দুধের বালতি উল্টে ফেলে, ডিম ভেঙ্গে চুরমার করে, নতুন বোনা ক্ষেত নষ্ট করে, ফলগাছের ডালপালা ছিঁড়ে ফেলে যায়। খামারে এরপর অস্বাভাবিক যাই ঘটুক না কোনো, যে কোনো দুর্ঘটনা, তার সবই তুষারবলের ঘাড়ে চাপানো নিয়মের মতোই হয়ে যায়। কে জানলার কাচ ভাঙ্গে বা ময়লা নিষ্কাশনের নালাপথ বন্ধ করে, তার উত্তর সবারই জানা। রাতের অন্ধকারে এ সব তুষারবলেরই কাজ। তারপর যখন গুদামের চাবি হারায়, তখন পুরো খামারের সবার দৃঢ় বিশ্বাস যে, তুষারবলই চাবি কুয়োয় ছুড়ে ফেলে। একসময় ভুষির বস্তার নিচে চাবিটি পাওয়া গেলেও কোনো এক আশ্চর্য কারণে সবাই আগের বিশ্বাসেই দৃঢ় হয়ে রইল। গরুরা একবাক্যে বলে, তুষারবল প্রতি রাতে লুকিয়ে গোয়ালে এসে ওদের ঘুমের সময় দুধ দোয়। এই শীতে খামারে ইঁদুরের সংখ্যা যণ্ত্রণাকরভাবে বেশী। তারাও নাকি তুষারবলেরই দোসর।

তুষারবলের কর্মকাণ্ড খুঁটিয়ে দেখার জন্যে দ্রুত ব্যবস্থা নেয় নেপোলিয়ন। কুকুরের দলকে সাথে করে পুরো খামার এলাকা পুঙ্খানূভাবে পর্যবেক্ষণের জন্য বেরিয়ে পরে। বাকি পশুরা সম্মানিত দূরত্ব রেখে তাদের পেছনে পেছনে চলে। প্রতিবারই কয়েক পা এগিয়েই থেমে দাঁড়ায় নেপোলিয়ন, মাটিতে শুঁকে শুঁকে তুষারবলের চিহ্ন খোঁজে। বলে, গন্ধ শুঁকেই তাকে চিনতে পারে সে। প্রতিটি কোণ আর প্রান্তের গন্ধ শোঁকে সে, আস্তাবল, গরুর গোয়ালঘর, মুরগির খোঁয়াড়, ফল বাগান, কিছুই বাদ দেয় না। প্রতিটি জায়গাতেই তুষারবলের গন্ধ রয়েছে বলে খুব দ্রুতই জানায় সবাইকে। শুঁড়ের মতো লম্বা নাকে বারবার মাটিতে শুঁকে শুঁকে বিকট আওয়াজে প্রতিবারই চীৎকার করে ওঠে সে, “তুষারবল! পরিষ্কার বুঝতে পারছি, এইখানেও এসেছিল সে“। তার মুখে “তুষারবল” শব্দটি শুনেই দাঁত বের করে হিংস্র-ভাবে গড়গড় করে কুকুরের দল।

পুরোপুরি ভীত হয়ে পড়ে পশুর দল। তাদে মনে হয়, তুষারবল এক অদৃশ্য শক্তি। এ শক্তি তাদের চারপাশের বাতাসে ভর করে তাদের সবরকম অনিষ্টের প্রয়াসে মত্ত। বিকেলেই নতুন খবর জানাবে বলে সবাইকে একসাথে ডাকে চাপাবাজ।

“বন্ধুরা”, বিচলিত ভঙ্গীতে এদিক সেদিক লাফাতে লাফাতে বলে চাপাবাজ, “খুব খারাপ একটি খবর শোনাচ্ছি তোমাদের। কোনাগড় খামারের ফয়সালায়ের কাছে নিজেকে বিক্রি করেছে তুষারবল। সে এখন ছুরিতে ধার দিচ্ছে আমাদেরকে আক্রমণ করে খামার দখল করার জন্যে। সে আক্রমণ শুরু হলে তার নেতৃত্বে থাকবে তুষারবল। তুষারবলের এই বিদ্রোহ নাকি তার গর্ব আর উচ্চাকাঙ্ক্ষার ফসল। কিন্তু ভুল আমাদেরই কমরেড! এর পেছনের আসল কারণ কি জানা আছে তোমাদের? প্রথম থেকেই জোনসের সাথে একজোট তুষারবল। জোনসের গোয়েন্দা হিসেবেই সে কাজ করেছে সারাক্ষণ। এই কথার সত্যতা প্রমাণ করে, এমন কিছু দলিলপত্র আমরা এইমাত্র আবিষ্কার করতে পেরেছি। আমার নিজের মতানুযায়ী, এই একটি কথাই অকাট্য প্রমাণ। আমরা কি দেখিনি, গোয়ালঘরের যুদ্ধে, যদিও এ কাজে ব্যর্থ সে, তারপরও কতোটা চেষ্টা করেছে সে আমাদের পরাজয় আর ধ্বংসকে ত্বরান্বিত করার?”

পশুদের মাথায় যেন বাজ পড়ল! এটা তো বাতাসকল ধ্বংসের চাইতেও অনেক বড়ো বদমায়েশি তুষারবলের! বিমূঢ় ভাব কাটিয়ে স্বাভাবিক হতে কিছুটা সময় লাগে ওদের। সবারই মনে পড়ে, বা অন্ততপক্ষে মনে পড়ে বলে বিশ্বাস করে, গোয়ালঘরের যুদ্ধে কতোটা বীরত্বের সাথে লড়াই করেছে তুষারবল। নিজের চারপাশের শত্রুদের প্রতিহত করে বাকী সবাইকে সাহস জুগিয়েছে। ছররা গুলিতে আহত হয়েও এক মুহূর্তের জন্যে পিছপা হয়নি। এই তুষারবলকে জোনসের দোসর হিসেবে ভাবতে বেশ বেগ পেতে হল ওদের। প্রশ্ন করার স্বভাব বক্সারের একেবারেই কম। তাকেও বেশ বিচলিত দেখাল। মাটিতে শুয়ে সামনের পা দুটো ভাজ আর চোখ বন্ধ করে নিজের ভাবনাকে স্থির করা চেষ্টা করে সে।

“আমার বিশ্বাস হয়না”, বলে সে। “গোয়ালঘরের যুদ্ধে খুব বীরত্বের সাথে লড়েছে সে। নিজের চোখে দেখেছি আমি। সেজন্যেই তো আমরা তাকে “প্রথম শ্রেণীর বীর” হিসেবে উপাধি দিলাম।“

“এটা আমাদের বিরাট ভুল কমরেড। কারণ, এখন আমরা জানি, যে গোপন দলিল আবিষ্কার করেছি, তাতে লেখাও আছে, আমাদেরকে ধ্বংস করাই ছিল তার আসল উদ্দেশ্য।“

“কিন্তু সে জখম হয়েছে। আমরা সবাই দেখছি, কতোটা রক্ত ঝরেছে সে জখম থেকে।“, প্রতিবাদে বলে বক্সার।

“এটাও তার ষড়যন্ত্রেরই একটা অংশ মাত্র।“, বলে চাপাবাজ। “জোনস এমনভাবে গুলি করেছে, যাতে তুষারবলের গায়ে শুধু আঁচড় লাগে। তোমরা যদি পড়তে পার, তাহলে তা ওর নিজের লেখা থেকে দেখাতে পারি। পরিকল্পনাটি এমনভাবে করা হয়েছিল যে, চরম এক মুহূর্তে তুষার বলের ইশারা পেয়ে যুদ্ধক্ষেত্রের দখল শত্রুদের হাতে ছেড়ে দিয়ে পালিয়ে যাবে পশুরা। এক চুলের জন্যে তার এই পরিকল্পনা পুরোপুরিই সফল হতো, যদি না আমাদের বীর নেতা নেপোলিয়ন সে মুহূর্তে হস্তক্ষেপ না করতো। তোমাদের কি মনে পড়ে না, যখন জোনস আর তার লোকজন উঠোনে ঢুকে পড়ার পর হঠাৎ কেমন ভাবে পিঠটান দিল তুষারবল? কিছু কিছু পশু দৌড়ল তার পেছনে পেছনে। তখনই তো “মানবজাতি মুর্দাবাদ” শ্লোগানে এগিয়ে এলো নেপোলিয়ন। দাঁত দিয়ে গুঁতো দিল জোনসের পায়ে। এটা তো তোমাদের মনে পড়ার কথা কমরেড! তাই না?”, বলে উপর নীচে শরীর দোলাতে লাগল চাপাবাজ।

চাপাবাজের চাক্ষুষ বর্ণনায় মনে হল সে ঘটনা কিছুটা হলেও মনে করতে পারে পশুরা। অন্ততপক্ষে এটি তাদের মনে পড়ে যে, যুদ্ধের চরম এক মুহূর্তে পিছুটান দিয়ে পালিয়ে যায় তুষারবল। কিন্তু বক্সারের ভেতরে কিছুটা অস্বস্তি রয়েই যায়।

অবশেষে বলে সে, “আমি বিশ্বাস করি না যে, তুষারবল প্রথম থেকেই বিশ্বাসঘাতক ছিল। পরে সে কি করেছে, সেটি অন্য কাহিনী। কিন্তু গোয়ালঘরের যুদ্ধে সে আমাদের একজন ভালো কমরেড ছিল, সে কথা পুরোপুরি বিশ্বাস করি আমি।“

“আমাদের নেতা, কমরেড নেপোলিয়ন”, ধীরে ধীরে খুব দৃঢ়তার সাথে বলে যায় চাপাবাজ, “স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে- একেবারেই স্থির সিদ্ধান্ত তার, যে প্রথম থেকেই জোনসের গোয়েন্দা হিসেবে কাজ করেছে তুষারবল। সেটি করে আসছে সে আমাদের বিপ্লবের চিন্তা শুরু করার অনেক আগে থেকেই।“

“নেপোলিয়ন যদি বলে থাকে, তাহলে অন্য কথা! তার কথা সবসময়েই সঠিক”, বলে বক্সার।

“এতক্ষণে আসল কথায় এলে”, বলে চাপাবাজ। কিন্তু বক্সারের প্রতি তার চতুর চোখের ক্রূর দৃষ্টি লুকোতে পারে না। যাবার পথে আবার ফিরে দাঁড়ায় সে। একটু সময় নিয়ে সবার দিকে তাকিয়ে উপদেশের ভঙ্গীতে বলে সে, “আমি এই খামারের প্রতিটি পশুকে চোখ কান খোলা রাখার পরামর্শ দিচ্ছি। তুষারবলের গোয়েন্দারা যে আমাদের ভেতরেও লুকিয়ে, সেটি ভাবারও যথেষ্ট কারণ দেখতে পাচ্ছি।“

চারদিন পর বিকেলে সমস্ত পশুকে একসাথে ডাকে নেপোলিয়ন। সবাই একসাথে জমা হওয়ার পর খামারের বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে সে। তার গায়ে দুটো পদক, “প্রথম শ্রেণীর বীর” ও “দ্বিতীয় শ্রেণীর বীর”। কদিন আগে নিজেকেই এই দুটো পদকে সম্মানিত করেছে সে। নয়টি বিশাল কুকুর পরিবেষ্টন করে তাকে। তাদের হিংস্র গড় গড় আওয়াজে ভয়ে লোম খাড়া হয়ে যায় পশুদের। বোবার মতো নিজেদের জায়গায় দাঁড়িয়ে ওরা। ভয়ঙ্কর কিছু ঘটতে যাচ্ছে আজ, সেটি বুঝতে পেরেছে সবাই।

এমন দৃষ্টিতে সবার দিকে তাকায় নেপোলিয়ন, যেন কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি পশুরা। পরমুহূর্তেই তীক্ষ্ণস্বরে বিকট ভাবে চেঁচিয়ে ওঠে। সাথে সাথেই লাফিয়ে সামনে ছোটে কুকুরের দলটি। চারটি শুয়োরের কান কামড়ে টেনে আনে নেপোলিয়নের পায়ের কাছে। ভয়ার্ত যন্ত্রণায় চেঁচায় চারটি শুয়োর। তাদের কান বেয়ে রক্ত ঝরে। সে রক্তের স্বাদে কয়েক সেকেন্ডের জন্যে দিশেহারা কুকুরগুলো। সবার অবাক দৃষ্টির সামনে লাফিয়ে তাদের তিনজন ছোটে বক্সারের দিকে। বক্সার আগে থেকেই টের পেয়ে তাদের একটিকে তার পায়ের শক্তিশালী ক্ষুরে লাফানো অবস্থা থেকেই মাটিতে শক্ত করে চেপে ধরে। মৃত্যুভয়ে ভীত কুকুরটি কাতর দৃষ্টিতে তাকায় বক্সারের দিকে, বাকী দুটো লেজ গুটিয়ে পালায়। ছাড়বে নাকি পিষ্ট করবে পায়ের নীচে, সেটি জানার জন্যে নেপোলিয়নের দিকে তাকায় বক্সার। মনে হল, রঙ পাল্টাল নেপোলিয়ন ও বক্সারের দিকে তাকিয়ে ক্রুদ্ধভাবে কুকুরটিকে ছেড়ে দেয়ার আদেশ দিল। বক্সার পা দুটো তোলার পর অবশ শরীরে কাতরাতে কাতরাতে সরে যায় কুকুরটি।

কিছুক্ষণের জন্যে শান্ত হয় পরিস্থিতি। অপরাধী চেহারায় করে ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে অপেক্ষা করে চারটি শুয়োর। এরা সেই চার শুয়োর, যারা নেপোলিয়নের রোববারের সভা বাতিল আদেশের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছিল। নেপোলিয়ন তাদেরকে অপরাধ স্বীকারের আদেশ দেয়। আর কোনো চাপ ছাড়াই অপরাধ স্বীকার করে ওরা। তুষারবলকে তাড়ানোর পর থেকেই ওর সাথে গোপন যোগাযোগ এদের। বাতাসকল ধ্বংসের কাজেও তুষারবলের সহযোগী ছিল এরা। তুষারবলের সাথে যোগসাজশে মিঃ ফ্রেডেরিকের হাতে পশুখামার তুলে দেয়ার ষড়যন্ত্রের সাথেও এরা যুক্ত। জোনসের গোয়েন্দা হিসেবে কাজ করার কথা নাকি ওদের সামনে নিজেই স্বীকার করেছে তুষারবল। অপরাধ স্বীকারের সাথে সাথেই গলার রগ কামড়ে ছিন্ন করে ওদেরকে হত্যা করে কুকুরগুলো। আর কারো কিছু বলার আছে কি না, ভয়ঙ্কর আওয়াজে জানতে চায় নেপোলিয়ন।

তিনটি মুরগী, যারা ডিম সরবরাহের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে অগ্রগামী ভূমিকা নিয়েছিল, স্বীকার করে নিজেদের অপরাধ। জানায়, স্বপ্নের মাঝে এসে তুষারবলই তাদেরকে নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার পরামর্শ দিয়েছে।

তাদেরকেও খতম করা হয়। একটি হাঁস স্বীকার করে, গতবছরের শস্য কাটার সময় ছয়টি গমের ছড়া চুরি করে রাতে লুকিয়ে খায়। একটি ভেড়া তুষারবলেরই প্ররোচনায় খাবার পানিতে মূত্রত্যাগ করেছে বলে স্বীকার করে। নেপোলিয়নের ঘনিষ্ঠ অনুগামী বৃদ্ধ এক ভেড়াকে হত্যা করেছে বলে স্বীকার করে দুই ভেড়া। তারা নাকি সেই ভেড়াকে বাগানের আগুনের ধোওয়ায় তাড়িয়ে বেড়িয়েছে। সবাইকে সেই মুহূর্তেই হত্যা করা করা হয়। নেপোলিয়নের পায়ের কাছে মৃতদেহের বিশাল এক স্তূপ জমা অবধি চলতে থাকে স্বীকারোক্তি। রক্তের গন্ধে ভারি বাতাস! জোনসকে বিতাড়নের পর থেকে আজ অবধি, এই প্রথম!

সভা শেষ হবার পর শুয়োর আর কুকুর ছাড়া একসাথে বেরোয় সবাই মিলে। ভয়ার্ত বিস্ময়ে স্তব্ধ করুন এক অবস্থার মাঝে নিজেদেরকে খুঁজে পায় পশুরা। কোনটি বেশি কষ্টদায়ক? তুষারবলের সাথে জোট বেঁধে পশুদের বিশ্বাসঘাতকতা, নাকি তাদের চোখের সামনে এই নির্দয় প্রতিশোধ, বুঝতে পারে না ওরা। এ ধরণের রক্তপাত আগেও ঘটেছে, কিন্তু নিজেদের মাঝে এই রক্তপাত আগের চাইতে অনেক বেশি ভয়ঙ্কর। জোনসকে বিতাড়নের পর থেকে আজ অবধি কোনো পশু কোনো পশুকে হত্যা করে নি, এমন কি একটি ইঁদুরও নয়। অর্ধনির্মিত বাতাসকলের উঁচু টিলাতে ওঠে ধীরে ধীরে জায়গা নেয় সবাই। কাছাকাছি ঘন হয়ে যেন একজন আরেকজনকে উত্তাপ দিতে চায়। তুলসীপাতা, মুরিয়েল, বেনজামিন, গরুর পাল, ভেড়ার দল, সমস্ত মোরগ, মুরগি আর হাঁস সবাই একসাথে শুধুমাত্র বিড়ালটি বাদে। সে নেপোলিয়ন সবাইকে একসাথে ডাকার আগেই উধাও। একমাত্র বক্সার দাঁড়িয়ে। সে এদিক সেদিক নড়াচড়া করে হতাশ ভঙ্গীতে, নিজের লেজ ঘুরিয়ে চাবুকের মতো নিজের আঘাত করে নিজের শরীরে ও মাঝে মাঝে বিস্ময়ের আওয়াজে শব্দ করে। অবশেষে বলে সে,

“কিছুই বুঝতে পারছি না। আমাদের খামারে এমন কিছু ঘটবে, তা আগে কখনোই বিশ্বাস করতে পারতাম না। কোথাও ভুল আমরা অবশ্যই করেছি। আমার দৃষ্টিতে এই ভুলের একমাত্র সমাধান, আরও বেশি কাজ করে যাওয়া। এখন থেকে প্রতি সকালে আরও এক ঘণ্টা আগে উঠবো আমি।“

কথা বলে ধীরে ধীরে ভারি পা ফেলে পাথরের গর্তের দিকে এগোয় সে। ঘুমোতে যাবার আগে পর পর দুবার ঠেলাগাড়ি পাথরে বোঝাই করে উপরে টেনে আনে।

কোনো কথা না বলে তুলসীপাতার শরীর ঘেঁসে বসে থাকে বাকীরা। যে টিলার উপর তারা বসে, সেখান থেকে খামারের অনেক দূর অবধি চোখ যায়। খামারের সবচাইতে বড়ো অংশটি তাদের দৃষ্টিসীমার মাঝে। বড় রাস্তা অবধি বিস্তৃত লম্বা ভূমি, বিশাল মাঠ, গাছপালা, পুকুর। লাঙ্গল দেয়া ক্ষেতে নতুন গমের ঘন সবুজ শীষ। সামনে খামার বাড়ীর লাল ছাউনির চিমনির ধোঁয়া। একটি সুন্দর বসন্তের বিকেল। তির্যক রোদের আলোয় ঘাস আর ফুলের কলিতে সোনালী রঙ। অবাক বিস্ময়ে অনুভব করে পশুরা, এই খামার এর আগে কখনোই নিজেদের কাছে এতটা আপন, প্রিয় মনে হয়নি। এটা তাদের নিজেদের খামার, এর প্রতিটি কোণ তাদের নিজেদের সম্পত্তি। টিলার পাদদেশের দিকে তাকিয়ে চোখে জল আসে তুলসীপাতার। তার ভেতরে কথা যদি প্রকাশ করতো সে, তাহলে বলতো, কয়েক বছর আগে মানুষ জাতিকে তাড়িয়ে দিয়ে যে লক্ষের দিকে এগিয়েছিল তারা, সেটি সফল হয়নি। বুঢ্ঢা মেজরের বক্তৃতা শোনার পর সেই রাতে যে আনন্দের সাথে বিপ্লবের পথে এগিয়েছিল ওরা, এই নিশৃংস হত্যাযজ্ঞ সে বিপ্লবের চাওয়া হতে পারে না। তার নিজের আঁকা ভবিষ্যতের ছবি যদি থাকত, সেটি হত চাবুক আর ক্ষুধামুক্ত এক পশুসমাজ। সেখানে সবাই সবার সমান ও প্রত্যেকেই নিজের ক্ষমতা অনুযায়ী কাজ করে। শক্তিশালীরা রক্ষা করে দুর্বলদের, যেমন ভাবে মেজরের বক্তৃতার রাতে সামনের পা ভাজ করে হাঁসের ছানাদের আশ্রয় দিয়েছিল সে। তার বদলে এমন পরিস্থিতি কি করে তৈরি হল? নিজস্ব মতামত প্রকাশের সাহস নেই কারো, চারিদিকে বন্য কুকুরের হিংস্র গড়গড় শাসন। দেখতে হয়, লজ্জাজনক অপরাধ স্বীকার করার পর কি করে টুকরো টুকরো করা হয় নিজেদের সাথীদের। কোনো আইন অমান্য বা বিপ্লবের কথা ভাবে না তুলসীপাতা। এখন পরিস্থিতি যেমনই হোক না কেন, জোনসের সময়ের চাইতে অনেক ভালো এখন তারা। তাছাড়া সবচাইতে বড়ো কথা, মানুষ যেন আর ফিরতে না পরে খামারে। যা ই হোক না কেন, সে সবসময়েই অনুগত থাকবে। নেপোলিয়নের নেতৃত্ব আর আদেশ মেনে কঠিন পরিশ্রম করে যাবে। তারপরও এই পরিস্থিতি তার ও তার সাথের সে পশুদের আশা আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন নয়, যে দিকে লক্ষ রেখে এগিয়েছিল সবাই মিলে। এই চাওয়ার জন্যে জোনসের গুলিকে অগ্রাহ্য করে এগিয়ে যায়নি ওরা। বাতাসকল স্থাপনে এতো পরিশ্রমও করেনি এই দিনের ভরসায়।

নিজের অনুভূতির সঠিক প্রকাশের পরিপূরক এই সময়ে “ইংল্যান্ডের পশু” গানটি মনে পড়ল তার ও ধীরে ধীরে গাওয়া শুরু করে। তার পাশে বসে থাকা বাকী পশুরাও একই অনুভূতির প্রভাবে তার সাথে গাওয়া শুরু করে গানটি। খুব গভীরভাবে, ধীরে ধীরে খুব করুণ স্বরে পরপর তিনবার গায় সবাই মিলে।

তৃতীয়বার গাওয়া শেষ করতেই দুই কুকুরকে সাথে নিয়ে খুব গম্ভীর চেহারা করে তাদের সামনে এসে দাঁড়ায় চাপাবাজ। জানায়, নেপোলিয়নের কোনো এক বিশেষ আদেশ বলে এই খামারে “ইংল্যান্ডের পশু” গানটি গাওয়া আজ থেকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।

বিকল বিস্ময় পশুদের মাঝে।

“কিন্তু কেন?”, জানতে চাইল মুরিয়েল।

পাথরের মতো চেহারা করে বলে চাপাবাজ, “এই গানটির প্রয়োজন ফুরিয়েছে কমরেড। ইংল্যান্ডের পশু” হচ্ছে বিদ্রোহের গান। বিদ্রোহের পথ পেরিয়ে এসেছি আমরা। আজ বিকেলে বিশ্বাসঘাতকদের খতম করে সে বিদ্রোহের শেষ কাজটি সমাধা করা হল। বাইরের বা ভেতরের, সব শত্রুই আজ পরাজিত। এই গানে আমরা এতদিন এক সুন্দর সমাজের ভবিষ্যৎ স্বপ্নের কথা প্রকাশ করে এসেছি। সে স্বপ্ন আজ বাস্তবে পরিণত। সুতরাং এটাই সত্য যে, এই গান এখন আর কোনো অর্থ বহন করে না।“

আঘাত যতো বড়োই হোক না কেন, হয়তো কেউ প্রতিবাদও করতো। কিন্তু নেই মুহূর্তে ভেড়ার দল শুরু করে তাদের ত্রাহি চীৎকার। “চারপেয়েরা ভালো, দুপেয়েরা মন্দ!” সবরকম আলোচনার পথ বন্ধ করে কয়েক মিনিট ধরে চলল তাদের এই শ্লোগান।

এভাবেই শেষ হল “ইংল্যান্ডের পশু” গানটির। তার পরিবর্তে কবি মিনিমাস আরেকটি গান লিখে সবার জন্যে। গানটির কথা,

পশুখামার, তোমার কাছেই এই আমার অঙ্গীকার,
আমার যতই চাওয়া থাকুক, তোমার না হয় ভার!

প্রতি রোববার সকালে পতাকা তোলার সময় এই গানটিই গাওয়া হয়। কিন্তু কোনো না কোনো ভাবে পশুদের এই অনুভব যে, “ইংল্যান্ডের পশু”র তুলনায় এই গান না কথায়, না সুরে, কোনোভাবেই দাঁড়ানোর যোগ্য নয়।

চলবে………

পশুখামার (এক)
পশুখামার (দুই)
পশুখামার (তিন)
পশুখামার (চার)
পশুখামার (পাঁচ)
পশুখামার (ছয়)
পশুখামার (সাত)
পশুখামার (আট)


মন্তব্য

দীপ্ত এর ছবি

আপনার অনুবাদ প্রথম থেকেই পড়ছি। নীড়পাতায় আসলেই পড়ে ফেলি। প্রিয় বইয়ের একটা, বাংলায় অনুবাদ করছেন বলে আপনাকে ধন্যবাদ। আর থামবেন না দয়া করে, আগ্রহ নিয়ে বসে থাকি।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।