প্রিয় বন্ধু রতিকান্ত,
আমাদের অভিযান আপাততঃ সফল। কোনো সমস্যা ছাড়াই গন্তব্যস্থল অবধি পৌঁছাতে পেরেছি। সময়যানটি চলার কয়েক মিনিটের মাঝেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। জেগে ওঠে মাথায় সামান্য যন্ত্রণা অনুভব করলেও তা সহ্যের ভেতরেই আছে। কোথাও বসে বড়ো চিঠি লেখার সুযোগ নেই, তাই সামনের চিঠিতে বিস্তারিত জানাতে পারব বলে আশা রাখি।
ইতি
তোমার বন্ধু রামকুমার
------------------------
প্রিয় বন্ধু রতিকান্ত,
গত চিঠিতে তোমাকে শুধুমাত্র কুশল বার্তা জানিয়েছিলাম। কিন্তু এবারের চিঠিতে এই দুদিনের অভিজ্ঞতায় সৃষ্ট নানা ধরণের সংশয় ছাড়া আর কিছুই জানাতে পারছি না। বারবারই ভেবেছি, তুমি কি ভুল করে অন্য কোনো গ্রহে পাঠিয়েছ আমাকে? আমার নিজের কাছে শুরুতে তাই মনে হয়েছিল। তারপর কোনোভাবে নিজের বুদ্ধির উপর আস্থা ফিরে পেয়ে পাথরটির কাছে যাই। সেখানে তোমার জন্যে গতকাল যে চিঠিটি রেখেছিলাম, সেটি না থাকায় মনে শান্তি পেলাম। তার অর্থ হচ্ছে, পৃথিবীর যাই হোক না কেন, তোমার সাথে আমার যোগাযোগ ঠিকই ঘটছে। আপাততঃ এই নিয়েই আশ্বস্ত থাকতে হবে আমাকে।
এটা কি সেই পৃথিবী, যে পৃথিবী থেকে ছয়শ বছর ভবিষ্যতে পাড়ি দিলাম? সময়ের সাথে সাথে কি স্থানও পাল্টালো? না হলে এত বিরাট পরিবর্তন কি করে ঘটতে পারে? সে পরিবর্তন যদি ঘটেই থাকে, আগের পৃথিবীর কী রইল আর! কোথায় গেল সেই দিগন্ত বিস্তৃত প্রান্তর? তার বদলে চারপাশে উঁচু উঁচু বিকট চেহারার দালানকোঠা। অদ্ভুত পোশাকের কারণেই হতে পারে হয়তো, মানুষগুলোও অন্যরকম। তাদের পাশাপাশি আরও কিছু ছোটোবড়ো জন্তু, যা আগে কখনও দেখিনি। একেকজনের একেক রকম চেহারা। এদের গলার আওয়াজে ভয়ে রক্ত হিম হয়ে যায়। তবে এখনকার মানুষ যে ভাবে ওদের সাথে পাশাপাশি চলতে পারছে, সেটি দেখে নিজের ভয় কিছুটা হলেও দূর করতে সক্ষম হয়েছি। আপাততঃ সবকিছুই কিছুটা দূর থেকেই দেখব বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি। বড়ো সমস্যা এই যে মানুষের সংখ্যা এতোই বেশী যে, এদেরকে এড়ানোই প্রায় অসম্ভব।
আমরা কি ধ্বংসের মুখোমুখি? পৃথিবীর ধ্বংস একসময় যে অনিবার্য, সেটি আমাদের সবারই জানা। কিন্তু পেছনের এই পেরিয়ে যাওয়া সময়ে পরিবর্তনের যে গতি দেখতে পাচ্ছি, তাতে মনে হয়, ধ্বংসের খুবই কাছাকাছি চলে এসেছি আমরা।
এই মুহূর্তে একমাত্র পাথরটি, আর তোমার সাথে যোগাযোগই আমার একমাত্র সম্বল।
এসব নিয়ে পরে আর বিস্তারিত লিখব। চারপাশ আরও ভাল করো দেখতে হবে। তার আগে বেশি বলে তোমাকে ভুল ধারনা দিতে চাইনা।
যে সব স্বর্ণমুদ্রা নিয়ে এসেছিলাম, সবই কোমরে বাঁধা। এসবের ব্যবহার এই পৃথিবীতে কি করে করতে পারব, এখনও জানি না। খাবার জন্যে থলেতে যতোটা ছাতু আছে, তাতে আরও কয়েকদিন চলবে। থলেতে একটা দুটো পোশাকও আছে। এখানে তেমন শীত নেই। এই পোষাকেই চলে যাবে কয়েকটি দিন। তারপর দেখা যাক, কি হয়!
তোমার কুশল কামনা করছি।
ইতি
তোমার বন্ধু রামকুমার
------------------------
প্রিয় বন্ধু রতিকান্ত,
আজ যে ঘটনা ঘটল, মনে করে বারবারই চিমটি কাটি শরীরে। বেঁচে আছি, না মরে গেছি, তাও বুঝতে পারি না। সময়যানে উঠার পরও একবার এই একই অনুভূতি হয়েছিল।
তোমাকে লেখা গত চিঠিটি পাথরের নীচে লুকিয়ে রাত কাটানোর একটি জায়গা খুঁজছিলাম। একটি উঁচু পথে উঠে লোকের চোখ এড়িয়ে অন্যপাশে যাবার সময় ঘটনাটি ঘটে। আগের চিঠিতে তোমাকে যে সব অপরিচিত, অদ্ভুত জন্তুর কথা বলেছিলাম, তারই বড়ো আকারের একটি বুনো শুয়োরের মতো হঠাৎ ছুটে আসে আমার দিকে। হয়তো আমার উপর দয়ায় বা অপরিচিত পোশাক দেখে ভয় পেয়ে জন্তুটির গতি কিছুটা কমে যায়। সে সুযোগে এক চুলের জন্যে লাফিয়ে পথটি পেরিয়ে একটি গাছের আড়ালে পালাতে সক্ষম হই। জন্তুটির ভেতর থেকে একটি মানুষ গলা বাড়িয়ে উত্তেজিত কর্কশ আওয়াজে কী সব বলল, তা বুঝতে পারলাম না।
গাছের আড়ালে থেকে যা দেখলাম, সেটি তুমি বিশ্বাস করবে বলে মনে হয়না। কিন্তু তারপরও বলছি।
সামান্য এগিয়েই ঘড় ঘড় আওয়াজ করে থেমে যায় জন্তুটি। পেটের ভেতর থেকে উগড়ে ফেলে কিছু মানুষ। আরও অবাক লাগল, যখন দেখলাম মানুষগুলো পেট থেকে বেরিয়ে নিজেদের মাঝে আলাপ করতে করতে এমনভাবে বেরিয়ে গেলো, যেন কিছুই ঘটেনি। এদের কি ভয়ডর, জীবনের প্রতি কোনো মায়া নেই? পথের পাশেই দাঁড়ানো ছিল কিছু মানুষ। আরও বেশী অবাক হলাম, যখন দেখলাম নিজেদের মাঝে ধাক্কাধাক্কি করে স্বেচ্ছায় জন্তুটির পেটে ঢুকল তারা। সবাই ঢুকতেই আবার বিকট আওয়াজ করে দৌড়াতে থাকে জন্তুটি। তার পেছন থেকে বেরিয়ে আসা দুর্গন্ধময় কালো ধোওয়ায় কালো হয়ে যায় চারপাশ।
এটা কী দেখলাম? আমরা ভবিষ্যত নিয়ে যে পড়াশোনা করেছি, বইপত্র ঘেটেছি, সেসময় এ ধরণের কোনো জন্তুর কথা কখনোই পড়িনি। এটা কি কোনো জৈবিক বিবর্তনের ফলাফল?
এখনকার জীবনে জন্তু আর মানুষের মাঝে এধরণের কোনো চুক্তিবদ্ধতা আছে কি? এ সব অদ্ভুত বিশাল জন্তু কোত্থেকে এলো? ছয়শ বছর আগে যে পরিবর্তনের চক্র আমরা চোখের সামনে সাজিয়েছিলাম, আজ সেটি এতোটা আলাদা হবার কারণ কী? এসব অনেক প্রশ্নের মুখোমুখি আমি। ভয় পেয়েছি, এ কথা যেমন সত্য, তার চাইতে বড়ো সত্য আমার নিজের ভেতরে এসব প্রশ্নের উত্তর জানার অদম্য ইচ্ছা।
এই পরিবর্তিত পৃথিবীর পরিবর্তিত অবয়বেই পথ খুঁজে নিতে হবে আমাকে। একটি কথা অনেক পুরনো হলেও ভেবে খুব সাহস পাই। মায়ের পেটের অন্ধকার আরাম থেকে যখন পৃথিবীর আলোকিত যন্ত্রণায় প্রবেশ করি, চীৎকার করে কেঁদেছি তখন। তারপরও অসহায় শৈশব আর টগবগে যৌবনের হাত ধরে ধরে এরই মাঝে নিজের পথও করে নিতে পেরেছি। এভাবেই সময়, পৃথিবী আর মানুষকেও চিনতে পেরেছি। তখন যা পেরেছি, এখনও আমাকে সেটিই পারতে হবে। আমাকে নিয়ে ভয় পেওনা তুমি। আমার নিজের ভেতরের স্বতঃস্ফূর্ততা আমাকে আগে সঠিক পথ দেখিয়েছে অনেকবারই। এবারও দেখাবে।
তোমার কুশল কামনা করছি।
ইতি
তোমার বন্ধু রামকুমার
------------------------
চলবে ....
লেখকের কথাঃ জার্মান লেখক হেরবার্ট রোজেনডরফার একটি বই পড়ে এই লেখাতে অনুপ্রাণিত হয়েছি। আমার লেখার গতিপথ রামকুমারের গতিপথের মতোই অজানা। তবে সে যেখানে, আমিও সেখানেই।
মন্তব্য
গাড়ি?
...........................
একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা
গাড়ি তো বটেই, তবে বাস। আপনার একমাত্র মন্তব্যের জন্যে অশেষ ধন্যবাদ!
**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব
নতুন মন্তব্য করুন