লোকগানের কাস্টমাইজেশন (এক): হাসানের উত্তরে

??? এর ছবি
লিখেছেন ??? (তারিখ: শনি, ২৩/০৬/২০০৭ - ১১:১৫অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

হাসান মোরশেদ-এর লেখাটি চিন্তার উদ্রেক করে। এর কিছু কিছু বিষয়ে আমি একমত, আবার কোন কোন বিষয়ে আমার ভিন্নমত আছে। তিনি ঠিক বলছেন যে, ফরিদা, আনুশেহ, সেলিম-হুমায়ুন বা হাবিব-এর "কল্যাণে" নাগরিক মধ্যবিত্ত বাংলার লোকশিল্পীদের চিনতে পেরেছে। কিন্তু, আমি মনে করি, এই প্রমোশন স্বতোৎসারিত নয়, বরং বাজারের ধর্ম অনুযায়ী সাধিত হয়েছে। অর্থাৎ একটা ডিমান্ড-সাপ্লাই পেজগি আছে সেখানে। এনারা যে লোকগান "উদ্ধার" করলেন, সেইটা এই কারণে যে, লোকগানের বাজার তৈরি হয়ে গেছে ইতোপূর্বে। এরই ফলে জেমসের কান্ধে গামছা ওঠে, বিপ্লব আলখাল্লা পৈরা সঙ সাজেন। মহত্তের কিংবা আধ্যাত্মিকতার কোন মামলা নাই এইখানে।

বাজার তৈরি না হৈলে কী হৈত? একটা দৃষ্টান্ত দেই: সত্তর দশকের শেষাশেষি আবদুর রহমান বয়াতি বা কাঙালিনী সুফিয়াকে আমাদের আগ্রাসী মিডিয়ায় প্রমোট করা হৈছিল। কিন্তু সেই প্রমোশন বাজারে টিকে নাই। পরের দশকে মমতাজ এসেই টিকে গেছেন। আপনি নিশ্চয় জানেন, লোকগানের ভূবনে কিংবদন্তীসম রহমান বয়াতি বা সুফিয়ার কাছে লোকগায়ক মমতাজ অনেকটাই ম্লান। কিন্তু মিডিয়ার মমতাজ তাদের ছাপায়া অনেক অনেক উপরে।

এর কার্যকারণ খুঁজলে আমাদের দেখতে হবে বাংলাদেশের রুরাল-আরবান অভিবাসনের ইতিহাস। সত্য বটে, সত্তরের দশকেই এই ট্রেন্ড জোরেশোরে শুরু হৈছিল, কিন্তু আশিতে সেইটা আরো ব্যাপক আকার নেয়। গ্রামের গরিব অভিবাসী বেসিক্যালি আশিতে আইসা শহরকে মাইনা নিতে আরম্ভ করে। শহরের চুপকথাগুলোকে সে তার নিজের ফেলে আসা রূপকথার সাথে মেলাতে শুরু করে। ফলাফল? আরবান ফোক-ফিউশন।

মধ্যবিত্ত কোন আক্কেলে লোকসংস্কৃতির সংরক্ষণ করতে গিয়া তার নিজের রূচির বাইরে যাবে? আর যাওয়া কি সম্ভব আদৌ? হাসান যে দাবি করতেছেন সেইটা স্বার্থহীনের দাবি। আগ্রাসী মিডিয়া এই ধরনের বেনোভেলেন্স দিয়া চলে না। তবে সরকার সেইটা করতে পারে। করেও। বাংলা একাডেমীর লোকসংকলন গুলা ঘাইটা দেখেন, কী নাই সেখানে। শাহ আবদুল করিম থিকা শুরু কৈরা উকিল মুন্সী সবই আছে। কিন্তু সবই ট্যাক্সিডর্মি।

আমার কাছে লোকসংস্কৃতির সংরক্ষণকে একটা অবাস্তব স্বপ্ন বৈলা মনে হয়। সংস্কৃতির সংরক্ষণ একট কন্ট্রাডিকটরি ধারণা। বাউন্ডারি ক্রস করাই সংস্কৃতির ধর্ম। এইটাকে হোমিভবা ভাল ব্যাখ্যা করছেন তার "হাইব্রিডিটি" তত্ত্বে।

যে "কাস্টমাইজেশন" ঘটে লোকসংস্কৃতির ক্ষেত্রে, এইটাকে অনিবার্য মনে করি আমি। লোকসংস্কৃতি নিজেও কাস্টমাইজেশনের উর্ধ্বে না। বরং কাস্টমাইজেশনের মাধ্যমেই সে এক রিভারবেসিন থিকা অন্য রিভার বেসিনে প্রবাহিত হয়। উকিল মুন্সী যে গান লেখছেন, তার প্রায় কাছাকাছি ম্যাসেজ পাইবেন জালাল-গীতিকায়। একই গান একটু সামান্য অদলবদলে নানান অঞ্চলে নানান জনের নামে প্রচলিত আছে। যারা আবহমানকাল ধৈরা এসবের চর্চা করতেছেন, এসব নিয়া তাদের কোন কপিরাইট সমস্যা নাই। কপিরাইট সমস্যাটিও মধ্যবিত্ত মননের।

ফলে, নগর গরিবের গানের লোকসুরে যখন গাড়িয়াল ভাইকে রিকশাঅলা রিপ্লেস কৈরা ফেলে, বা নায়র-প্রত্যাশী বৌ-এর জায়গা দখল করে গার্মেন্টসের মাইয়া, সেইটা মিডিয়া কনস্ট্রাকশন হৈলেও একটা বাস্তবতাকে রিপ্রেজেন্ট করে। আরবানাইজেশন একটা ক্রমবর্ধমান বাস্তবতা, ফলে আরবান ফোক-ফিউশনও তাই। জেমস কিংবা আনুশেহ এর সামান্য কিছু ফায়দা নিতেছেন মাত্র, কিন্তু সেই প্রক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা তাদের হাতে নাই।


মন্তব্য

??? এর ছবি

হা হা হা... নিজের পোস্ট নিজেই পড়লাম! শ্রেক-২ মনে পড়ল... লেস হিট, মোর ফোম!!

এস এম মাহবুব মুর্শেদ এর ছবি

আররে কঠিন বিশ্লেষণ। বাজারের ব্যাপারে আমি আপনার সাথে একমত।

====
মানুষ চেনা দায়!

কনফুসিয়াস এর ছবি

এই লেখাটাও সমর্থন করি।
এই ইস্যুগুলা নিয়া নিজের মধ্যেই একধরণের কনফিউশান কাজ করে। কোনটারে যে ভালা পাই, নিজেও জানি না।
-যা দেখি তা-ই বলি...

-----------------------------------
বই,আর্ট, নানা কিছু এবং বইদ্বীপ

আরিফ জেবতিক এর ছবি

তর্কের আরেকটা দিক তুলে নিয়ে আসায় আপনাকে ধন্যবাদ।সুন্দর বিশ্লেষন।
কাষ্টমাইজেশন লোকসম্পদেও প্রযোজ্য,এই কথাটি মেনে নিচ্ছি।

কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে কাস্টমাইজেশনটা কতোটুকু হচ্ছে,কার স্বার্থে হচ্ছে?

আজকে সুনামগঞ্জের ভাটিগান যদি ময়মনসিংহের ভাটিতে কাস্টমাইজ হয়ে গাওয়া হয়,সেটাকে আমি দেখব ভাষা ও সংস্ক্রৃতির বিবর্তন হিসেবে।বাউল ঘরানার উর্দ্ধপুরুষরা সেটিকে চর্চা করেছেন।তাই জালাল গীতি,রাধারমন আর উকিলমুন্সীর ভাব একই ভাব,একই দর্শন,একই জীবন বোধ,হয়তো প্রকাশ রীতিতে একটু অদলবদল মাত্র্র।

কিন্তু নাগরিক কাস্টমাইজেশনের ব্যাপারে আমার আপত্তি আছে।আজকে রিমিক্স নামে যে গানগুলো হচ্ছে,রবীন্দ্রনাথের গানকে ফিউশন করে মাকসুদ যে কাজ করেছেন,সেটি বাজারের চাহিদা থাকলেই করতে দেয়া বোধহয় ঠিক না।একই কথা খাটে আমাদের লোকসঙগীতের ব্যাপারে।

যেহেতু আমরা খুব সম্ভবত:সেকেন্ড জেনারেশন শহুরে,আমাদের পায়ের জুতো খুললে এখনও পায়ে হালের কাদা দেখা যাবে,তাই আমাদের রক্তে
যে সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার বাহিত হয় সেখানে লোকসঙ্গীত এমনিতেই এসে দোলা দেয়।সেই সুর আর ভাবকে আশ্রয় করে নগর বাউল আর নাগরিক কবিয়ালরা গান বাধুন,মার্কেটে আমার মতো কৃষকপুত্ররা সেটা কিনে নেবে;কিন্তু আমার আদি ও অকৃত্রিম লিরিক আর সুরকে বিকৃত করার অধিকার আমি দিতে রাজী নই।

??? এর ছবি

ধন্যবাদ মুর্শেদ,কনফুসিয়াস ও আরিফ। আসলে সংস্কৃতির "কাস্টমাইজেশন" না বৈলা "হাইব্রিডাইজেশন" বলতে আমি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি। তাতে অনেক কিছুই পরিষ্কার হয়। আরিফ জরুরি প্রশ্ন তুলেছেন, কাস্টমাইজেশন কার স্বার্থে? উদ্ধৃত করি:


আজকে সুনামগঞ্জের ভাটিগান যদি ময়মনসিংহের ভাটিতে কাস্টমাইজ হয়ে গাওয়া হয়,সেটাকে আমি দেখব ভাষা ও সংস্ক্রৃতির বিবর্তন হিসেবে।

এইখানে, যিনি দেখছেন, তিনি কোথায় বসে দেখছেন তার উপরও নির্ভর করে অনেক কিছু। ঢাকাবাসী নাগরিক মধ্যবিত্তের কাছে সুনামগঞ্জ আর ময়মনসিংহের লোকরীতির/সংস্কৃতির আদান প্রদানকে "ভাষা ও সংস্কৃতির বিবর্তন"রূপে দেখা সম্ভব, এবং স্বাভাবিক। কিন্তু নানান লোক ঐতিহ্যের মাঝেও যে তুলনামূলক আগ্রাসনের ব্যাপার আছে! যেমন: ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় মলয়া সঙ্গীতের একটা দাপট আছে। এই দাপটের সুবাদে, ভৈরবের জব্বার মৌলভীর বহুগান দেখেছি মলয়া হিসেবে গীত হয় নানান জায়গায়। এতে জব্বার মৌলভীর যারা অনুসারী তারা বিপন্ন বোধ করেন, কারণ তাদের মতে, মনমোহন-আফতাবের জীবন দর্শনের সাথে জব্বার মৌলভীর জীবন দর্শনের বহুৎ ফারাক।

কিন্তু নাগরিক কাস্টমাইজেশন ঠেকাইবে কে? মাকসুদ রবীন্দ্রসঙ্গীতের রিমিক্স বানাইছে, পাবলিক খায় নাই। খাইলে তারে ঠেকানোর রাস্তা ছিল না, যেহেতু বিশ্বভারতীর কপিরাইট উইঠা গেছে। কিন্তু মমতাজের রিমিক্স বা কাস্টমাইজেশন পাবলিকের মনঃপুত হৈছে। খেয়াল কৈরা দেখেন, গুটিকয় মধ্যবিত্ত রূচিশীলতার কাছে মমতাজরে অশ্লীল মনে হৈছে। মনে হৈছে, তিনি লোকগানের বারটা বাজাইতেছেন। এই ধুয়া কারা তুলতেছেন? যারা ভিন্ন একটি সাংস্কৃতিক চর্চার মধ্যে নিজেদের বড় কৈরা তুলছেন, এবং সেইটা যে ডমিন্যান্ট সংস্কৃতি এই গর্ববোধও তাদের আছে। কিন্তু শ্রেণীগত অবস্থানের কারণেই লোকগানের যারা শ্রোতা, তাদের কাছে এসব বাড়াবাড়ি লাগে নাই। বরং তারা এইসব কাস্টমাইজেশন পছন্দই করছে, আমার গবেষণা অভিজ্ঞতায় এমনি দেখেছি। আমি নগর গরিবের কথা বলতেছি, নানান কারণে সংরক্ষণের নামে "আদি ও আসল ছহি" সন্ধান এবং এর পৃষ্ঠপোষণ তাদের অগ্রাধিকারের মধ্যে নাই। এইসব আমাদের অর্থাৎ নাগরিক মধ্যবিত্তের কাজ।
আবারো বলি, এই আগ্রাসী নাগরিকায়নের উত্তাপ থিকা লোক ঐতিহ্যকে দূরে রাখার ব্যবস্থা নাই। কারণ, তার যারা গায়ক, তার যারা শ্রোতা, তাদের অনেকেই আজ শহরবাসী। লোকসঙ্গীত ব্যক্তি বা সমাজের অভিজ্ঞতা দিয়েই রচিত হয়, ফলে নাগরিক অভিজ্ঞতাকেও লোকসঙ্গীত আয়ত্ব করতে চাইবে, এতে সন্দেহ নাই।

আরিফ জেবতিক এর ছবি

আপনার পর্যবেক্ষন ঠিক আছে@সুমন রহমান।

সময়ের স্রোতে বিবর্তন হবেই আর এটা ভিন্ন ভিন্ন শ্রেনীতে ভিন্ন ভিন্ন ভাবে দেখা হবে।মমতাজের গানগুলোর মাঝে যে হাইব্রিডাইজেশন আছে সেটাকে একটু ভিন্ন মাত্রায় দেখার অবকাশ আছে।

লোকগান আসলে মধ্যবিত্তের সম্পদ যতো না,তার থেকে তথাকথিত আম জনতা,বিশেষ করে বিশাল নিম্নবিত্ত শ্রেনীর বিনোদন উপাদান।
গ্রামের নিম্নবিত্তের বিনোদনের জন্য "খেউড়" নামের একটা কালচার ছিল,সেখানে আমাদের তথাকথিত অশ্লীলতা বোধ আহত হতে পারে কিন্তু সাধারন মানুষের কাছে মঞ্চের সেই গালাগালিটাই বিনোদন ছিল।

এখন মমতাজের গানগুলো কিন্তু তার শ্রেনীবোধটুকুকে অক্ষুন্ন রেখেই করা হচ্ছে।মমতাজের গান আমি শুনছি না,শুনছে আমার গার্মেন্টসের বস্ত্রবালিকা।
তার শ্রেনীগত কারনেই সে এটা পছন্দ করছে।

সেই মেয়েটির কাছে এখন তার প্রেমিক আর গাড়োয়ান হয়ে আসছে না,আসছে টেম্পু ড্রাইভার হিসেবে।সুতরাং মমতাজের গানে গাড়িয়াল ভাইয়ের জায়গাটি পুনস্থাপিত হচ্ছে টেম্পু অথবা রিক্সাড্রাইভার দিয়ে।লোকগানের সুরকে অক্ষুন্ন রাখতে হয় কারন অবচেতনে এই বস্ত্রবালিকার ধমনীতে গ্রামের সেই পরিচিত সুরটি আছে।সেই সুরকে এখন নতুন জীবন যুদ্ধের সাথে তার লিরিককে প্রতিষ্ঠিত করতে হচ্ছে,তার সদ্য বস্তিজীবনের নতুন অনুষঙ্গগুলোর সাথে তাকে খাপ খাওয়াতে হচ্ছে,সেটাকে অস্বীকার করার উপায় নেই।

এখন কথা হচ্ছে এটাও ঠিক যে ইতিহাস শেষ পর্যন্ত রচিত হবে মধ্যবিত্তের কলমে।পরিচয় সংকট কাটাতে মধ্যবিত্তকেও একসময় তার শেকড়ের কাছে ছুটে যেতে হবে।সেই যাত্রা শেষে যদি সে দেখে তার আবহমান কলা পরিবর্তিত হয়ে গেছে তার অজান্তে তখন সে বিপন্ন বোধ করবেই ,সেটাকে রক্ষার জন্য সে শোরগোল তুলবেই।

আপনার কথাটি সঠিক যে এই পর্যবেক্ষন কোনটাই নিজ নিজ শ্রেনীর বাইরে গিয়ে করা সম্ভব না।কিন্তু যার যার অবস্থান থেকে কারো অবস্থানকেই খাটো করে দেখারও বোধহয় অবকাশ নেই এখানে।

??? এর ছবি

একজাক্টলি, আরিফ জেবতিক। খুব ভাল লাগল আপনার অবধারণ। ধন্যবাদ, সময় দেবার জন্য।

আরিফ জেবতিক এর ছবি

আপনাগো লগে কথা কইলে দুই চাইর আনা শিখতে পাই,এই আর কি!

??? এর ছবি

সেইটাও একতরফা ভাবার কারণ নাই। শেখাশেখি উভয় তরফেই চলে।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।