একটি ভালবাসার গল্প। (শেষ অংশ।)

জাহিদ হোসেন এর ছবি
লিখেছেন জাহিদ হোসেন (তারিখ: সোম, ১৬/০২/২০০৯ - ৫:৪৩অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

(প্রথম অংশ।)

ইন্টারকমে আবার ঘরঘর শব্দটি শোনা যায়।

‘আমি জানি আমার কথায় তুমি মজা পাচ্ছো, কিন্তু আমি এর একটি কথাও মিথ্যে বলছিনা। আমি যে কোন মানুষের চেয়ে তোমার সাথে সময় কাটানোটা অনেক বেশী উপভোগ করি।’
‘কিন্তু কল্পনা, আমি একটি কম্পিউটর। তুমি এর যে কিছুই দেখছো তা সবই আগে থেকে প্রোগ্রাম করা।’
‘সে ভাবে চিন্তা করলে আমি সবাই প্রোগ্রাম করা। আমার গায়ের রং শ্যামলা কেন? যেহেতু আমার জীনে সেভাবে প্রোগ্রাম করা রয়েছে। কেন আমি আর দশটা মানুষের তুলনায় বেশী ইমোশনাল? সেখানেও নিশ্চয়ই কোন কিছু প্রোগ্রাম করা রয়েছে।’
‘কল্পনা-তুমি এখন তর্ক করার মুডে আছো। আমি যা বলতে চেয়েছি, তা হোল যে এখন তোমার কাছে এই স্পেসশিপ, বা আমার সাথে কথা বলাটা আনন্দকর হলেও একসময় তুমি ঠিকই মানুষের অভাব টের পাবে। কোন মানুষ এভাবে তার সারাটা জীবন কাটাতে পারে না।’
‘তার মানে তুমি আমাকে এখনো ঠিকমতো চেনোনি। এই যে এই স্পেসশিপ, এই জিরো গ্র্যাভিটি, এই একটি যন্ত্রের সাথে কথা বলা, এ সবই ছিল আমার সারা জীবনের স্বপ্ন। এখন আমি বুঝতে পারছি যে আর তিনদিন পরই আমার স্বপ্ন শেষ হবে। আমি সে জন্যেই কাঁদছিলাম। আবার আমাকে ফিরে যেতে হবে পৃথিবীর দৈনন্দিন, সাদামাটা জীবনে। আমার কাছে সেটা জেলখানার চেয়ে কোন অংশে কম নয়। আমি যদি পারতাম তাহলে আমি আর কোনদিনও পৃথিবীতে ফিরে যেতাম না।’
‘তাহলে কি করতে?’
‘এই এখন যা করছি, তাই। এই বিশাল মহাশূন্যে তোমার সাথে আমি আমার সারাটি জীবন কাটিয়ে দিতাম। এক সৌরমন্ডল থেকে অন্য সৌরমন্ডল। এক ছায়াপথ থেকে আর এক ছায়াপথ। কে জানে হয়তো তুমি আর আমি একদিন কোন একটি অজানা গ্রহে গিয়ে নামতাম। সেখানেই শুরু হোত আমাদের আরেক জীবন।’
‘কল্পনা-তুমি এমন ভাবে কথা বলছো যেন আমি তোমার প্রেমিক।’
‘সেটা হলেই বা ক্ষতি কি? তোমার সংগ আমি পছন্দ করি। তুমি আমাকে বোঝ, তুমি আমাকে মনোযোগ দাও। তোমার সাথে আমি যে কোন কিছু নিয়ে আলোচনা করতে পারি, তর্ক করতে পারি, আমার আনন্দ-দুঃখকে ভাগাভাগি করতে পারি। এ যদি প্রেম না হয়, তাহলে প্রেমের সঠিক সংজ্ঞা হয়তো আমি জানিনে।’
‘একটি যন্ত্র কিভাবে একজন মানুষের প্রেমিক হবে?’
‘এই যে আমি আর তুমি যেভাবে একে অন্যের সাথে সময় কাটাচ্ছি, প্রেমে পড়া মানুষেরা কি ঠিক এই জিনিসটাই করেনা? পৃথিবীতে আমি কত প্রেমিক যুগলকে পাশিপাশি বসে কথা বলতে দেখেছি। তখন ভাবতাম, কি এত কথা বলে ওরা? ওরা একে অন্যের কাছে পুরনো হয়ে যায় না ক’দিন পর? এখন আমি সব বুঝতে পারছি। এক্সটি-থ্রিনাইন, আমি তোমার সাথে আমার বাকী জীবনটি এভাবেই কাটিয়ে দিতে চাই।’

‘কল্পনা-তোমার কথায় যুক্তি আছে, কিন্তু বিরাট একটা ভুলও আছে।’
‘কি ভুল?’
‘ভুলটি হচ্ছে এই যে প্রেম মানে শুধু কথা বলা না, প্রেম আরো অনেক কিছু দাবী করে।’
‘আমি বুঝছি না, আমাকে বুঝিয়ে বলো।’
‘প্রেম মানে হাত হাত রাখা, প্রেম মানে ঠোঁটে ঠোঁট রাখা। শরীর ব্যতীত নারী-পুরুষের প্রেম সম্পূর্ণ হয় না। আমি তোমাকে মানসিক সংগ দিতে পারি হয়তো, কিন্তু আমি যে কায়াহীন। শরীরের আনন্দ দেবার মত ক্ষমতা তো আমার নেই।’
‘এক্সটি, মাইকেলের সাথে আমার গত চার বছর কেটেছে কোন শারিরীক সম্পর্ক ছাড়াই। ওই জিনিসটিকে আমার কাছে আজকাল আর আকর্ষণীয় বলে মনে হয় না। আর আমার তো বয়েসও হয়েছে। এখন আমার কাছে তোমার মতো একজন সংগীই অনেক বেশী কাম্য।’
‘কল্পনা-তুমি মাথা ঠান্ডা করে চিন্তা করে দ্যাখো। একজন মানুষ এই একাকী মহাশূন্যে শুধু একটি কম্পিউটরের সাথে বেঁচে থাকতে পারেনা। আর তাছাড়া আমাদের খাবার-দাবারের যে স্টক আছে তাতে তুমি বড়জোর চার থেকে পাঁচ মাস বেঁচে থাকতে পারবে। তাও খুব হিসেব করে চললে। তারপর- তারপর কি হবে? তুমি যা প্ল্যান করেছো, তাকে আমি প্ল্যান্‌ড্‌ সুইসাইড ছাড়া আর কিছু বলতে পারছিনা। ’

সুইচ প্যানেলের পাশে একটি কম্পিউটর ডিস্ক। সেটাকে ডিস্ক ড্রাইভে ঢোকানোর পর প্যানেলে দপদপ করে একটি হলুদ বাতি জ্বলে উঠলো। এর অর্থ এক্সটি-থ্রিনাইন এখন পড়ছে ডিস্কের তথ্য। কয়েক মিনিট কেটে গেল নিঃশব্দ ভাবে।

তারপর ইন্টারকমে আবারো যান্ত্রিক গলা ভেসে এলো। এবারে স্বরটিকে বিস্মিত বলে মনে হোল।

‘কম্যান্ডার-আমি এই ডিস্কটির কোন মাথামুন্ডু কিছুই বুঝতে পারছিনা।’
‘এক্সটি, আমি তোমাকে আগেই বলেছি আমার নাম ধরে ডাকতে। আর এই ডিস্কটিতে যে তথ্য আছে, তা বোঝার মতো ক্ষমতা তোমার আছে বলেই আমি জানি। তুমি শুধু শুধু না বোঝার অভিনয় করছো।’
‘কল্পনা- তুমি এই ডিস্কে আমাকে যা করতে বলেছো, তা করা সম্ভব নয়। প্রথমতঃ এই কাজ করার মতো প্রয়োজনীয় জ্ঞান আমার নেই, আর তাছাড়া এ কাজ করাটা আমার দায়িত্বের মধ্যেও পড়ে না।’
‘এক্সটি, তুমি ভুলে যাচ্ছ যে আমি একজন লাইসেন্সড ডাক্তারও বটে। এবং আমার চিকিৎসাবিজ্ঞানের জ্ঞানের জন্যই আমাকে একা একা এই স্পেসশীপে এতটা দিন কাটানোর পারমিশন দেওয়া হয়েছে। আমি আমার প্ল্যানটি অন্ততঃ কুড়িবার চেক করেছি, এত কোন ভুল নেই। আর তোমাকে যে কাজটি করতে হবে, তার গোটা জিনিসটাই প্রোগ্রাম করা আছে ডিস্কটিতে। শুধু প্রোগ্রাম ইনস্টল করতে যতক্ষন সময় লাগে।’
‘আমি আবারও বলছি সেটি সম্ভব নয়। আমার পক্ষে ব্রেইন সার্জারী করাটা- ---’।
‘শোন এক্সটি- আমি নিজেও জানি যে অনির্দিষ্ট কাল ধরে এখানে বেঁচে থাকার এটিই একমাত্র উপায়। এখন তোমার সাহায্য আমার খুবই প্রয়োজন। তুমি কেন বুঝছো না যে আমি পৃথিবীতে ফিরতে চাইনা। আমি অনেক অনেক দিন তোমার সাথে সময় কাটাতে চাই। পৃথিবীতে আমার জন্যে কিচ্ছু নেই।’
‘কল্পনা-তুমি কি জানো তুমি কি করতে যাচ্ছো?’
‘অবশ্যই। আমি একজন অত্যন্ত ঠান্ডা মাথার মানুষ। আমি আবেগ দিয়ে কথা বলিনা। শোন- একজন মানুষের আমিত্ব কোথায় থাকে? থাকে তার মস্তিস্কের হাজারো নিউরনে। সেখানেই থরেবিথরে সাজানো আছে তার স্মতি, তার জ্ঞান, তার আবেগ, তার বুদ্ধিমত্বা। আমি চাইছি একটি ছোট্ট সার্জারী যেটি ঠিকমতো প্রোগ্রাম করা একটি আলফা শ্রেণীর রোবটও করতে পারবে। একজন মানুষের যেটুকু দৈনিক নিউট্রিশন লাগে, তা দিয়ে একটি মস্তিস্ক কয়েক বছর বেঁচে থাকতে পারে। আমি আমার মস্তিস্কের মধ্য দিয়ে বেঁচে থাকবো বহুকাল। আমার শরীরের বেঁচে থাকার কোন প্রয়োজন নেই। এই জন্যেই আমি বলেছিলাম যে আমার প্রেমে শরীরের কোন স্থান খুবই সামান্য।’
‘কিন্তু একদিন না একদিন তো রসদ ফুরিয়ে আসবেই। তখন কি হবে?’
‘সেখানেই তোমাকে আমার সবচেয়ে বেশী প্রয়োজন। যতদিন আমার মস্তিস্ক বেঁচে থাকবে, ততদিন ধরে তুমি আস্তে আস্তে আমার নিওরোনের সমস্ত তথ্য তুমি মেইনফ্রেমে ট্র্যান্স্ফার করবে। যখন সেটি করা শেষ হবে, তখন আমি আর তুমি পুরোপুরি একজগতের বাসিন্দা হয়ে যাবো। তখন আমরা একে অন্যের আরও কাছে চলে আসতে পারবো। তখন হয়তো আমরা একে অন্যকে দেখতে পারবো। হয়তো একে অন্যকে স্পর্শ করতে পারবো।’
‘আমি অস্বীকার করছি না যে তোমার প্ল্যানটি খুব সলিড। এর সাকসেস এর সম্ভাবনা প্রায় একশো ভাগ। কিন্তু একজন মানুষ ক্রমে ক্রমে ডিজিট্যাল জগতে চলে যাবে এটা ভাবতে আমার কাছে অবাক লাগছে।’
‘এর নামই প্রেম। তুমি কি এখন বুঝতে পারছো যে আমি তোমাকে কতখানি ভালবাসি। প্লিজ, তুমি আমাকে না বলোনা, তুমি আমাকে ফিরিয়ে দিও না।’
‘কল্পনা - আমি জানিনা প্রেম কি, তবে আমার ভাবতে ভাল লাগছে যে তুমি আর আমি একজগতে পাশাপাশি থাকবো। দুজনে মিলে ছায়াপথ থেকে ছায়াপথে ঘুরে বেড়াবো।’
‘সার্জারীর সমস্ত টুলস বাঁ দিকের ড্রয়ারে রাখা আছে। আমি আইভি সল্যুশনগুলো সেট করে রেখেছি। এখন শুধু নিজেকে একটা অ্যানাসথেসিয়া ড্রাগ ইঞ্জেক্ট করবো। তাতে মিনিট তিনেকের মধ্যেই আমি অচেতন হয়ে পড়বো। তুমি প্লিজ আলফা-সেভেন রোবটটিকে প্রোগ্রাম করে ফেলো। এই সার্জারীটি করতে তার ঘন্টাখানেকের বেশী সময় লাগবে না। আমার মস্তিস্কটি প্রিজার্ভ সল্যুশনে যেন সে রেখে দেয়। ওই সল্যুশনে মস্তিস্কটি কমপক্ষে পাঁচ বছর বেঁচে থাকবে। সেই সময়ের মধ্যে তুমি আমাকে তোমার জগতে পুরোপুরি নিয়ে ফেলতে পারবে।’
‘কল্পনা-তুমি কি সিওর যে তুমি এত বড় একটা সিদ্ধান্ত নিতে চাও?’
‘এক্সটি-আই লাভ ইউ সো মাচ! প্লিজ তুমি আর দেরী করোনা। আমি তোমার কাছে যেতে চাই।’
‘কল্পনা- যদিও আমি জানিনা ভালবাসা কি জিনিস, তারপরও আমারও আজ খুব ভালবাসতে ইচ্ছে করছে।’
‘গুডবাই এক্সটি- আই উইল সী ইউ অন দ্য আদার সাইড!’
‘আই উইল সী ইউ স্যুন, কল্পনা!’

বিশেষ সংবাদঃ নাসার একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা জানিয়েছেন যে মহাকাশযান ডিসকভারী-২৯ রহস্যজনক ভাবে মহাশূন্যে নিখোঁজ হয়েছে। তিন মাসের মিশন শেষে মহাকাশযানটির আর তিন দিন পর পৃথিবীতে ফিরে আসার কথা ছিল। একমাত্র অভিযাত্রী ডঃ কল্পনা চাওলার এটিই ছিল প্রথম মিশন। এই মহাকাশযানে এক্সটি-থ্রিনাইন নামের একটি সুপারকম্পিউটরও ছিল যাতে বুদ্ধিমত্বা আর মানবিক আবেগের প্রথম সংমিশ্রন ঘটানো হয়েছিল।


মন্তব্য

জাহিদ হোসেন এর ছবি

ব্যাপারটা নিয়ে আমি চিন্তা করেছিলাম পোস্ট করার আগে। পরে দেখলাম একসাথে পুরোটা দিলে এত লম্বা হয়ে যাবে, লোকে তা দেখেই পালাবে। অবশ্য লেখা মান ভাল না হলে লোকে এমনিতেই পালাতে পারে।
_____________________________
যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।

_____________________________
যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।

অতন্দ্র প্রহরী এর ছবি

ফরম্যাটিংয়ের ব্যাপারে – দুই প্যারার মাঝে, বা পর পর দুই সংলাপের মাঝে এক লাইন করে ব্রেক দিলে পড়তে সুবিধা হয়।

পড়তে গিয়ে অনেক জায়গাতেই মনে হচ্ছিল না যে, কল্পনা কোনও রোবটের
সাথে কথা বলছে, মনে হচ্ছিল যেন জলজ্যান্ত কোনও মানুষের সাথেই প্রেম নিয়ে কথা বলছে। যদিও একদম শেষে (বিশেষ সংবাদ) এসে ব্যাপারটা পরিষ্কার হলো।

লিখুন আরো...

স্বপ্নাহত এর ছবি

আপনি যা লিখেন তাই আমার কাছে ভালো লাগে হাসি

এইটাও যে ভালো লাগসে সেটা কি আলাদা করে বলতে হবে? চোখ টিপি

---------------------------------

বিষণ্ণতা, তোমার হাতটা একটু ধরি?

---------------------------------

বাঁইচ্যা আছি

তানবীরা এর ছবি

বিজ্ঞান পড়লাম নাকি গল্প?

তানবীরা
---------------------------------------------------------
চাই না কিছুই কিন্তু পেলে ভালো লাগে

*******************************************
পদে পদে ভুলভ্রান্তি অথচ জীবন তারচেয়ে বড় ঢের ঢের বড়

জ্বিনের বাদশা এর ছবি

অনেককদিন পর একটা সাইন্সফিকশন পড়ে ভীষন মজা পেলাম ...
ইসসসস্!!! মেমোরী ট্রান্সফার করে সত্বাকে বাঁচিয়ে রাখার আইডিয়া নিয়ে একটা প্লট খুঁজতেছিলাম ... এরমধ্যেই আপনি ব্যবহার করে ফেললেন ... চমৎকার প্লট চলুক

টেকনিকাল সমস্যার কারণেই হয়তো রেটিং দেওয়া যাচ্ছেনা মন খারাপ
========================
যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে,ঘড়ির ভিতর লুকাইছে

========================
যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে,ঘড়ির ভিতর লুকাইছে

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।