ক্যান্সারের জার্নাল (পর্ব -৫)

জোহরা ফেরদৌসী এর ছবি
লিখেছেন জোহরা ফেরদৌসী (তারিখ: বুধ, ২৮/০৪/২০১০ - ১০:১৫পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

প্রবাসে এক বাঙ্গালী নারীর ক্যান্সারের সাথে যাপিত জীবনের এই গল্পটি শুরু করেছিলাম বেশ কিছুদিন আগে, অন্য একটি ব্লগে । মাঝে নানা কারনে লেখা হয়ে উঠেনি । অথচ, এটি শেষ করা আমার জন্য খুব জরুরী । লিখতে শুরু করে সচলায়তনেই দিচ্ছি নতুন পর্বটি । আগের পর্বগুলোর লিঙ্ক দিচ্ছি এখানে,
পর্ব -১ , পর্ব - ২ , পর্ব - ৩ , পর্ব -৪
++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++

৬.

রাফাতের ফোন পেয়ে মিতি নীচে নেমে আসে । রাফাত এরমধ্যে অয়নকে স্কুলের ডে কেয়ার থেকে তুলে এনেছে । গাড়ীর কাছে আসতেই অন্যদিনের মত অয়ন ডেকে উঠে, “মা, তুমি আমার সঙ্গে বসবে ।” প্রতিদিন রাফাত আর অয়নের এই আরেক যুদ্ধ । অয়ন চায় মা পেছনের সিটে তার পাশে বসবে, তাহলে সে যেতে যেতে মার হাত ধরে সারাদিনের গল্প বলবে । রাফাত ইচ্ছে করে অয়নকে রাগানোর জন্য বলবে, “না মিতি, তুমি সামনে আমার পাশে বসবে ।” আজ কিন্তু রাফাত অয়নের কথার কোন জবাব দিল না, কেমন চুপচাপ সামনের দিকে তাকিয়ে রইলো । মিতি পেছনের সিটে গিয়ে বসতেই অয়নের অভিযোগ শুরু হল, “মা, বাবা আমাকে টিম হর্টনস থেকে টিম বিটস কিনে দেয় নাই ।” রোজ অয়নের বায়না তাকে ডে কেয়ার থেকে নেয়ার সময় কিছু কিনে দিতে হবে । টিম হর্টনসের টিম বিটস তার সবচেয়ে বেশী পছন্দের । মিতি খেয়াল করে দেখলো রাফাত অন্যদিনের মত অয়নের সঙ্গে ছেলেমানুষী ঝগড়ায় মেতে উঠছে না । চুপচাপ খুব মনোযোগের সাথে সামনের দিকে তাকিয়ে গাড়ী চালাচ্ছে । মিতি অয়নের দিকে তাকিয়ে বলল, “ঠিক আছে, অয়ন । বাবা তোমাকে অন্য আরেকদিন টিম বিটস কিনে দেবে । এখন বল সারাদিন কি কি করলে স্কুলে আর ডে কেয়ারে ।”

অয়ন এক এক করে বলে যেতে লাগলো মিসেস ক্যাম্পবেলের ক্লাসে আজ কি হয়েছে । বন্ধুরা সবাই মিলে কেমন করে একটা বড় কাগজে হাতে রং মেখে ছাপ দিয়েছে । হাতের ছাপের নীচে সবাই নিজের নামও লিখেছে । মিসেস ক্যাম্পবেল সেই হাতের ছাপের পোস্টারটা শুকিয়ে দেয়ালে টানিয়ে রেখেছেন, মা গেলেই দেখতে পাবে । পুরোটা পথ মা আর ছেলে নানান গল্পে এমন মেতে রইল যে বুঝতেই পারল না, রাফাত একটি কথাও বলেনি এর মধ্যে ।

ঘরে ঢুকে মিতি অভ্যাসমত সবার আগে টেলিফোনের দিকে এগিয়ে গেল । দিনের বেলায় কেউ ফোন করে ওদেরকে না পেয়ে মেসেজ রেখেছে কিনা সেটা সবার আগে দেখে নেয় ও ঘরে ঢুকেই । বিশেষ করে দেশ থেকে কোন ফোন এসেছিল কিনা তা দেখার জন্যই ও সবচেয়ে আগে ফোনের মেসেজ চেক করে । আজকাল দেশে মা প্রায়শই অসূস্থ থাকে । তাই, ওর মনে সবসময় একটা কাঁটা বিধে থাকে । আজ ফোনে একটাই মেসেজ ছিল । ডাঃ হাবীবের ক্লিনিক থেকে মেসেজ রেখেছে, “This message is for Momota. Dr. Habib wants to discuss the recent test reports with you. Please give us a call to set up an appointment with him as soon as possible.”

মিতি বেশ একটু অবাক হল, গত বুধবারে ওর টেস্টগুলো করা হয়েছে আর আজ শুক্রবার । মাত্র দূ’দিনের মধ্যে রিপোর্ট চলে গিয়েছে ডাক্তারের কাছে ? রিসেপশনের মেয়েটাতো বলেছিল আগামী সপ্তাহের আগে কিছু জানা যাবে না । প্রথম বিস্ময়ের ধাক্কাটা কাটিয়ে ওর মনে হল, কি আছে রিপোর্টে ? এই দেশে পাবলিক হেলথ সিস্টেমের কারনে রিপোর্ট সরাসরি রোগীকে কখনো দেয়া হয় না । রিপোর্ট চলে যায় ডাক্তারের কাছে, ডাক্তার তার রোগীকে জানায় । রিপোর্ট ভাল থাকলে সাধারনতঃ রোগীর কাছে কোন ফোন আসে না । আর যদি খারাপ কিছু থাকে তাহলেই শুধু ডাক্তারের ফোন আসে । তাহলে কি ওর টেস্টের রিপোর্ট ভাল নয় ? খারাপ হলে কতটা খারাপ ? কেমন যেন একটা ভয়ের অনুভূতি ওকে ঘিরে ধরল । ওর ভেতরটা কেমন অবশ হয়ে আসছে । মিতি ঘুরে রাফাতের দিকে তাকায়, “তুমি কি কিছু জানো ? হাসপাতাল থেকে কি কোন ফোন এসেছিল তোমার কাছে ? ”

রাফাত নির্বাক তাকিয়ে আছে মিতির দিকে, ঘরের মধ্যে এক নিথর নীরবতা নেমে এল । শীতের পুরো সময় জুড়ে দরজা, জানালা বন্ধ থাকে । বাইরে ভীষন জোরে হিম শীতল বাতাস বইছে । ঘরের ভেতরের নীরবতার মধ্যে বাইরের বাতাসের শো শো শব্দ খুব বেশী জোরালো শোনাচ্ছে । তুষার ঝড়ের এক একটা ঝাপটা প্রচন্ড জোরে আছড়ে পড়ছে বাইরের দেয়ালে, রান্নাঘর থেকে ব্যাক ইয়ার্ডে যাওয়ার বড় কাচের দরজায়, আর লিভিংরুমের জানালায় । সেই শব্দ ছাড়া আর কোন শব্দ নেই চারিদিকে । স্বছ কাঁচের জানালায় তুষারকনা জমে জমে কুয়াশার মত আবছা হয়ে গিয়েছে । জানালায় জমে ওঠা অস্বচ্ছ কুয়াশা আর ওদের দু’জনের মধ্যে জমে ওঠা নিথর মুহুর্তগুলো যেন ওদেরকে এই পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্য করে দিল । রাফাত জানে না কেন ওর সেই দুপুরের মত বিরান চরের অনুভূতিটা ফিরে এল । ওর কেন মনে হচ্ছে ক্রমাগত ঢেউয়ের আঘাতে পারের মাটিতে বোধহয় বড় ধরনের ভাঙ্গন ধরেছে । এক্ষুনি ধ্বস নামবে নদীর পারের মাটিতে । ও কি করে ঠেকাবে সেই ভাঙ্গন ? কেমন করে ও বলবে, “মিতি, আমি জানি তোমার রিপোর্ট । তোমার দেহে মরনব্যাধী ক্যান্সার বাসা বেঁধেছে । তোমার স্বপ্ন বোনার দিন শেষ । অয়নকে নিয়ে, আমাকে নিয়ে, এই পৃথিবীকে নিয়ে তোমার যে প্রতিদিন অসংখ্য স্বপ্ন দেখা, সেগুলো কখনই সত্যি হবে না ।”

মিতি আর রাফাত দূ’জন দূ’জনের দিকে তাকিয়ে আছে । রাফাতের মনে হচ্ছিল এই দীর্ঘ, শীতল মুহুর্তগুলোর মত অসহায় সময় আর কখনও আসেনি ওর জীবনে । রাফাতকে কিছু বলতে হল না, মিতিই বলে উঠল, “থাক, তুমি জানলেও কিছু বলো না । হয়তোবা এটাই আমার জীবনের শেষ স্বাভাবিক উইক এন্ড । জীবনটা একেবারে বদলে যাওয়ার আগে চল আমরা এই উইক এন্ডটা ভাল করে উদযাপন করি ।” বলেই মিতি ব্যস্ত হয়ে গেল নিত্যদিনকার ঘরের কাজে ।

চলবে….

পূনশ্চঃ অনুগ্রহ করে আমার লেখায় বানান ও যতি চিহ্নের ভুলগুলো দেখিয়ে দিন । ধন্যবাদ ।


মন্তব্য

ধুসর গোধূলি এর ছবি
জোহরা ফেরদৌসী এর ছবি

না, সচলে আমি লিখেছি খুব কম । দেখুন না, এখনো স্ট্যাটাস “অতিথি” । সচলে প্রথম লিখি আমার মাকে নিয়ে । তারপর ক্যান্সার নিয়ে আরো একটি সিরিজ লিখেছিলাম “ভালবাসার ক্যান্সার” । এছাড়া একটি সাড়ে সাত বছরের শিশুর চোখ দিয়ে মায়ের দেশ বাংলাদেশ ও দেশের মানুষের কথা লিখেছিলাম “সৃজন ও নির্ঝরের একদিন” । এই তো । তবে, আশা করছি ইনশাল্লাহ এই সিরিজটা লিখে শেষ করতে পারব, ভীষন অলস আমি ।

ও হ্যা, সময় করে দীর্ঘ লেখা পড়া ও মন্তব্যের জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ ।

.......................................
তোমারই ইচ্ছা কর হে পূর্ণ ....

__________________________________________
জয় হোক মানবতার ।। জয় হোক জাগ্রত জনতার

হরফ এর ছবি

জোহরা ভালো লাগছে আপনার লেখা। সবগুলো পর্ব পড়লাম, খুব-ই ব্যক্তি্গত ও আন্তরিক লেখাটি মন ছুঁয়ে গেল।
------------------------------------
"ছুটলে কথা থামায় কে/আজকে ঠেকায় আমায় কে"

ছুটলে কথা থামায় কে/আজকে ঠেকায় আমায় কে

জোহরা ফেরদৌসী এর ছবি

ধন্যবাদ হরফ সময় করে পড়ার জন্য । এ এক দীর্ঘ পথ চলা…… জানি না কতটুকু তুলে আনতে পারব ।
.......................................
তোমারই ইচ্ছা কর হে পূর্ণ ....

__________________________________________
জয় হোক মানবতার ।। জয় হোক জাগ্রত জনতার

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

ভালো লাগলো। আগের পর্বগুলো পড়বো
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

জোহরা ফেরদৌসী এর ছবি

ধন্যবাদ নজরুল পড়ার জন্য । প্রতিক্রিয়া জানানোর জন্যও অবশ্যই ।
.......................................
তোমারই ইচ্ছা কর হে পূর্ণ ....

__________________________________________
জয় হোক মানবতার ।। জয় হোক জাগ্রত জনতার

অতিথি লেখক এর ছবি

আবহটা মন ছুঁয়ে যায়। তবে শেষের দিকটা একটু বেশি নাটকীয় মনে হল যেন। চলুক।

কৌস্তুভ

জোহরা ফেরদৌসী এর ছবি

কৌস্ত্তভ, অনেক ধন্যবাদ পড়ার জন্য । এই পর্বের শেষের দিকটা নাটকীয় মনে হতে পারে বিচ্ছিন্যভাবে শুধু এই পর্বটি পড়লে । আগের পর্বগুলো পড়লে মিতি চরিত্রটি বুঝতে হয়তোবা সহজ হোত ।

.......................................
তোমারই ইচ্ছা কর হে পূর্ণ ....

__________________________________________
জয় হোক মানবতার ।। জয় হোক জাগ্রত জনতার

জোহরা ফেরদৌসী এর ছবি

এই যাহ! কৌস্ত্তভের মন্তব্যের জবাবতো আমি একবারই দিতে চেয়েছি, তিনবার দেখাচ্ছে কেন? মডুরা কেউ কি মুছে দেবেন?
.......................................
তোমারই ইচ্ছা কর হে পূর্ণ ....

__________________________________________
জয় হোক মানবতার ।। জয় হোক জাগ্রত জনতার

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।