আরেকটু অপেক্ষা করো প্রিয়াংকা- বঙ্গবন্ধু আসছেন।

কর্ণজয় এর ছবি
লিখেছেন কর্ণজয় (তারিখ: বিষ্যুদ, ১২/০১/২০১৭ - ৩:৩০পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

১০ জানুয়ারি, ১৯৭২। প্রিয়ংকা গান্ধি অপেক্ষা করছে। তখনও তার নাম প্রিয়ংকা হয় নি। সে যে কে, তা তখনও কেউ জানে না। এমনকী তার মা সোনিয়া গান্ধিও। তিনি শুধু অস্তিত্বের মধ্যে টের পাচ্ছেন কেউ আছে। বড় হচ্ছে। আর এখন তার সময় হয়েছে।
নিজের মাতৃত্বটা সোনিয়া গান্ধি প্রাণভরে অনুভব করলেন। এই মুহূর্তটার জন্য তিনি সারাজীবন অপেক্ষা করেছেন। কিন্তু এখন যখন মুহূর্তটা এসেছে সোনিয়া গান্ধির মনে হলো, ও যদি আর একটু পরে জন্মাতো। তাহলে তাকে দেখতে পারতাম।
নিজেকে শক্ত করে শাশুড়ি ইন্দিরা গান্ধির কাছে যাওয়ার জন্য বিছানা থেকে উঠলেন। এক মুহূর্ত তিনি থমকে গিয়ে অনুভব করলেন- ও নড়াচড়া করতে শুরু করেছে। যেন মাতৃগর্ভের গভীর অতল থেকে ঘোড়া ছুটিয়ে আসছে পৃথিবীর আলো দেখবে বলে। সোনিয়া তাকে থামতে বললেন।
‘এতদিন আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করেছি। তুমি আমার জন্য শুধু এতটুকু অপেক্ষা করো।’
সোনিয়া না জন্মানো প্রিয়ংকাকে আদেশ দিয়ে ইন্দিরা গান্ধির খোঁজে বের হলেন। ‘বেশি সময় না। অল্প একটু। এটুকু অপেক্ষা না করলেতো মানুষটাকে এরকম একটা মুজূর্তে আর দেখতে পাবো না।’ বিড়বিড় করতে করতে সোনিয়া ইন্দিরার কাছে আসলেন। ইন্দিরা তখন ভীষণ ব্যস্ত। ইন্দিরা সোনিয়াকে দেখেই আরও ব্যস্ত হয়ে উঠে এলেন। সোনিয়ার হাসপাতালে যাওয়ার সময় হয়েছে।
‘ও’র আসতে একটু দেরি আছে। আমি হাসপাতালে একটু পরে যাবো।’
‘কেন?’
‘আমি বিমানবন্দরে যেতে চাই।’
ইন্দিরা গান্ধি অবাক হলেন। কী বলছে এসব! মা হওয়ার আনন্দে সোনিয়া কি বাচ্চা মেয়ে হয়ে গেছে!
‘না মা, আমি এই মুহূর্তটা হারাতে চাই না। আমার ওর সাথে কথা হয়েছে- কোন সমস্যা হবে না। এই টুকু সময়, আমরা সহ্য করতে পারবো।’
ইন্দিরা কিছুতেই মানবেন না। তার বড় ছেলের বড় সন্তান আসছে। এসময় কোন ঝুঁকি নেয়া যাবে না। কিন্তু সোনিয়া ছাড়বেনই না।
বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে লন্ডন হয়ে তার স্বাধীন দেশে ফিরছেন। মাঝখানে দিল্লিতে কিছুক্ষনের জন্য নামবেন। একটা দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের নায়ককে যুদ্ধ শেষে বিজয়ীর বেশে দেশে ফিরে যাওয়ার মুহূর্তেটা তিনি বঙ্গবন্ধুর এই বিজয়ীর বেশে ফেরার মুহূর্তটা তিনি হারাতে চান না। ‘পারবে না। এতটুকু অপেক্ষা করতে?’ প্রিয়ংকা নড়ে ওঠে। হ্যা।
না আমি যাবোই।
ইন্দিরা মুহূর্তের জন্য থমকে গেলেন।
‘আপনি চিন্তা করুন- মা। আজকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখি মানুষকে আমি দেখতে পাবো। গোটা দেশ যে মানুষটা হয়ে গিয়েছিল আর যে মানুষটা দেশ হয়েহিয়ে গিয়েছিল- সেই মানুষটা জীবনে প্রথমবারের মতো স্বাধীন দেশে ফিরছেন। এই মুহূর্তটা আমি দেখতে চাই মা।’
ইন্দিরা গান্ধি একটু চিন্তা করলেন। বঙ্গবন্ধুর আসতে দেরি নেই। আর তিনি এখানে থাকবেনও খুব কম সময়ের জন্য। তিনি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দেশে ফিরতে চান। ছোট সময়। কিন্তু সোনিয়ার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ঠিক এ সময়ই তার সন্তানের জন্ম হচ্ছে। ইন্দিরা একটা সমাধান দেখতে পেলেন।
‘ঠিক আছে, দুটো শর্তে তুমি বিমানবন্দরে যেতে পারো। প্রখম শর্ত, ও যখন আসতে চাইবে, তখন তুমি সাথে সাথে বলবে। তুমি সহ্য করার চেষ্টা করবে না। আর দ্বিতীয় শর্ত, রাজীব সবসময় তোমার সঙ্গে থাকবে।’
সোনিয়া খুশি হয়ে উঠলো।
বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বৃটিশ এয়ারওয়েজের বিমানটা চোখে ধরা দিতেই সবাই আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকলো। একদৃষ্টিতে সবাই তাকিয়ে আছে। যেন কোন বিমান কখনও এভাবে নামেনি। পাশে একটা এ্যাম্বুলেন্স অপেক্ষা করেছে। ওটা প্রিয়ংকা যখন জন্মাবার জন্য অস্থির হয়ে যাবে, তখন সোনিয়াকে নিয়ে যাওয়ার জন্য দাঁড়িয়ে আছে। এমন ভঙ্গিতে, যেন এখনই দৌড় দেবে।
অবশেষে বঙ্গবন্ধূকে নিয়ে বিশেষ বিমান নেমে আসলো। সোনিয়া গান্ধি তাকিয়ে থাকেন। সাড়ে সাত কোটি মানুষ তার হয়ে তারই জন্য যুদ্ধ করেছে। দেশকে স্বাধীন করেছেন। তিনি আসছেন।
অবশেষে বঙ্গবন্ধু নামলেন। ইন্দিরা গান্ধি এগিয়ে গিয়ে তাকে স্বাগত জানালেন। খুবই অল্পসময়। আলাপ করেই বঙ্গবন্ধু দেশে চলে যাবেন। যারা এসেছিল, সবাই চেষ্টা করছেন মানুষটির কাছে থাকার। এমন সময় বৃটিশ এয়ারওয়েজের বৈমানিকরা বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে বিদায় নিতে আসলেন। বঙ্গবন্ধু বললেন, এখনই বিদায় কেন? ঢাকায় গিয়ে বিদায় হবে। বৈমানিকরা জানালেন, তাদের এ পরযন্তই আসবার কথা। তারা এখান থেকেই লন্ডন ফিরে যাবেন। আর এখান থেকে ভারতীয় একটা বিমান তাকে দেশে নিয়ে যাবে।
সবঙ্গবন্ধু এটা মানলেন না। তিনি যে বিমানে এসেছেন- সে বিমানেই যাবেন। বৈমানিকরা জানালেন, তাদের অনুমতি এখান পরযন্ত। ঢাকা যাওয়ার জন্য অনুমতি নেই। বঙ্গবন্ধু বললেন, আমি লন্ডন ফিরে যাবো।’ সবাই সচকিত হয়ে উঠলো। কয়েক ঘন্টার মধ্যেই লন্ডন থেকে বিমানটির ঢাকা যাওয়ার জন্য অনুমতি চলে এলো । এই পুরোটা সময় সোনিয়া গান্ধি নিজেকে সামাল দিয়েছেন, আরেকটু প্রিয়াংকা। আরেকটু অপেক্ষা করো। অবশেষে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বিমান উড়ে গেল তার দেশের পথে। আকাশে দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে যাওয়ার পর সোনিয়া টের পেলেন, সেই ঘোড়ার শব্দ। উঠে আসছে ও।
কিন্তু না ঘোড়ার শব্দটা একটু দূরে চলে গেল। সোনিয়া গান্ধি আকুল হয়ে প্রিয়াংকাকে ডাকেন। কোথায় গেলে? যদিও সে তখনও প্রিয়াংকা হয় নি। বঙ্গবন্ধু’র জন্য অপেক্ষা না করলে- হয়তো সে ততক্ষনে প্রিয়াংকাই হয়ে যেতো। কিন্তু এখন যখন মা তাকে ডাকছেন সে লুকিয়ে পড়েছে। সে আর আসলো না। আসলে প্রিয়াংকার তখন একটু অভিমান হয়েছে।
এমনিতে শিশুর অভিমান বেশিক্ষন থাকে না। কিন্তু যে শিশুর এখনও জন্ম হয়নি তার অভিমান যে কতক্ষনের হবে কেউ জানে না।
অভিমানটা যখন কাটলো। আরো ২ দিন পেরিয়ে গেছে।

• সোনিয়া গান্ধি এক নদী সংক্রান্ত বৈঠকে বাংলাদেশের তৎকালীন পররাষ্ট্র মন্ত্রী আবদুস সামাদ আজাদকে এই স্মৃতিচারণ করেন। তখন তার পাশে উপস্থিত ছিলেন ড. আইনুন নিশাত। তার মুখে শোনা ঘটণায় ভাষার রঙটুকুই শুধু যোগ করা।


মন্তব্য

এক লহমা এর ছবি

ভাল লেগেছে।

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

অতিথি লেখক এর ছবি

একেবারে ব্যক্তিগত অভিমত, এর সাথে কারো একমত হবার দায় নেই। এইরকম গল্পগুলো ক্লিশে লাগে। এতে না গল্পের মজা আছে না ইতিহাস আছে। ফুটনোটের বয়ানকে সত্য ধরলে উল্লেখিত বৈঠকের বয়স এক যুগেরও বেশি। গল্পটা গুটির খোলস ছাড়াতে বেশ লম্বা সময় নিল মনে হচ্ছে। সোনিয়া গান্ধীর সাথে কোন পরিচয় নেই (মানে উনি আমাকে চেনেন না) কিন্তু বাকি দুই জনের সাথে পরিচয় ছিল। তাতে গল্পটার সত্যতা সম্পর্কে আরও সন্দেহ ঘনীভূত হলো। বয়ানের ওপর গল্পকার কতোটা রঙ চড়িয়েছেন জানি না তবে ১২ই জানুয়ারি জন্মানো প্রিয়াঙ্কা গান্ধীর (বাংলায় লিখছি তো তাই হিন্দীর মতো করে আ-কার বাদ দিয়ে প্রিয়ংকা লিখলাম না) মা ১০ই জানুয়ারি'র কঠিন সময়ে বঙ্গবন্ধুকে দেখতে সফদারজঙ্গ রোডের বাড়ী থেকে পালামের এয়ারপোর্টে যেতে চাইছেন এটাকে কী বলবো? হরমোনাল আপহিভাল?

অতিথি লেখক এর ছবি

অতিথি লেখকের মন্তব্যটি উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয় কর্ণজয়!

--মোখলেস হোসেন

কর্ণজয় এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ। আপনার বক্তব্য যুক্তিপূর্ণ এবং এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই। আপনার মন্তব্য আমাকে ভাবালো- দেখালো, এর ত্রুটি এবং সীমাবদ্ধতা এটিই এই লেখার প্রাপ্তি, আমার জন্য। আমি মেনে নিচ্ছি, সামগ্রিক বিবেচনায় এই লেখাকে ক্লিশে- বলে মনে হতে পারে। আর হওয়তোবা অনেক বিবেচনায় তাইই। তবে এটা জানা আমার জন্য আনন্দদায়ক- স তথ্যগত বিভ্রাট শংশোধনীয়- ঘটণার কালপঞ্জীর সাথে কিছূটা সমন্বয় করে দেয়া হলো। তাতে অবশ্য আপনার সকল জিজ্ঞাসার উত্তর দেয়া হলো না। অপরাগতা স্বীকার করে নিলাম। আর তথ্যদাতার ওপর আপনার আস্থার বিষয়ে আমার কোন মন্তব্য নেই। কিন্তু তারিখেবিভ্রাটের দায় আমার ওপরই, কেননা তিনি শুধু ঘটণায় সোনিয়ার উপস্থিতি নিয়ে ইন্দিরার আলাপের সূত্রটি বলেছিলেন। প্রিয়াংকা আর মায়ের সম্পর্কের বর্ণনার কল্পনা- এটার উল্লেখ লেখার ধরণের মধ্যেই আছে ধরে নিয়েছিলাম। এটা প্রথম পাতা থেকে সরিয়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েই আপনাকে লিখতে লিখতে মনে হলো, থাক না একটা ক্লিশে লেখা। আমার অক্ষমতার চিহ্ন হয়ে যার সাথে আমি জড়িয়েই গেয়েছি। তবে আগামীতে আপনার থেকে যা শিখলাম, তার চিহ্ন থাকবে- এটার সৎ প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি।।।।

ঈয়াসীন এর ছবি

চলুক

------------------------------------------------------------------
মাভৈ, রাতের আঁধার গভীর যত ভোর ততই সন্নিকটে জেনো।

আব্দুল্লাহ এ.এম. এর ছবি

অসাধারণ একটি ঘটনার অসাধারণ উপস্থাপন। ভাষা নেই!

অতিথি লেখক এর ছবি

কী অসাধারণ একটি ঘটনা, অপূর্ব! আপনি লিখেছনও কী মমতা নিয়ে! ধন্যবাদ কর্ণজয়।

--মোখলেস হোসেন

মুস্তাফিজ এর ছবি

ঘটনাটা জানা ছিলোনা। ভালো লেগেছে।

...........................
Every Picture Tells a Story

দেবদ্যুতি এর ছবি

সুন্দর লেখা।

...............................................................
“আকাশে তো আমি রাখি নাই মোর উড়িবার ইতিহাস”

অতিথি লেখক এর ছবি

খুবই সুন্দর লেখা । ঘটনাটার একটা রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিও আছে । বঙ্গবন্ধু জানতেন , দেশে ভারতীয় বিমানে গেলে এইটা নিয়ে পরে অনেক কাদা ছোড়াছুড়ি হত। তাই তিনি জোর করে হলেও ব্রিটিশ এয়ারয়েজেই দেশে গেলেন ।

--- বোকা তেলাপোকা

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।