শওকত ওসমানের ‘ছোটদের কথা রচনার কথা’: বাবা, মা ও শিক্ষকদের জন্য খুব জরুরি একটি বই

কর্ণজয় এর ছবি
লিখেছেন কর্ণজয় (তারিখ: বুধ, ০২/০৮/২০১৭ - ৩:০৯অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

একজন বালক আর তার শিক্ষক বন্ধু হলে সেই বন্ধুত্বটা কেমন হবে? সুসাহিত্যিক শওকত ওসমানের ‘ছোটদের কথা রচনার কথা’ বইটি পড়লে, তার সহজ একটা ছবি আমরা দেখতে পাই। এক কিশোর বালকের সাথে শিক্ষকের বন্ধুত্বের গল্প নিয়ে এই বইটি। বইটি আসলে লেখা শেখার ওপর একটি বই। গল্পের মতন বইটি পড়তে পড়তে ‘কীভাবে লিখতে হয়’ সেটা খুব পরিষ্কার হয়ে যায়। বইটি ছোটদের জন্য খুব ভাল। সে যে কোন বিষয়ে সহজে দুকথা লিখতে শিখবে। কিন্তু আমাদের বড়দের জন্য এই বইটি পড়া শুধু ভাল নয়, এটা জরুরি। বড় মানে শিক্ষক, বাবা-মা-বড় ভাইবোন- যারা ছোটদের বড় করেন। কোন বাবা এবং মা এই বইটি পড়লে- তাদের সন্তানদের লেখার ক্ষমতা, জানার দক্ষতা একটু হলেও বাড়বে।
বইটি শুরু হয়েছে একটা ভ্রমণ গল্প দিয়ে। গল্পের বালক বড় ভাইয়ের হাত ধরে সুদূর চাঁটগা থেকে জীবনে প্রথমবারের মত রাজধানী শহর ঢাকা শহরে এসেছে। এই শহরের আশ্চর্য অভিজ্ঞতা নিয়ে সে মাকে একটা চিঠি লেখে। বালকটির বাবা ছেলের ইশকুলের সেকেন্ড মাস্টারকে এই চিঠিটি দেখিয়েছিলেন। ইশকুলের পরীক্ষারে সময় ছেলেটি দেখলো সে যেই রচনাগুলো পড়ে গিয়েছিল, তার কোনটা আসেনি। রচনা এসেছে এমন সব বিষয় নিয়ে যা সে কখনও পড়েনি। যে বিষয় নিয়ে রচনা লিখতে বলা হয়েছে, তার মধ্যে দুটো বিষয়, ‘বিদেশ হতে মার নিকট চিঠি’ আরেকটি ‘‘তোমার দাদা (বড়ভাই)’। ছেলেটি রচনার উত্তর দেয় নি শুনে শিক্ষক অবাক। তিনি বললেন, সে যে মায়ের কাছে চিঠি পাঠিয়েছিল- সেটিই ছিল প্রথম রচনার বিষয়। আর বড়ভাইযে তাকে নিয়ে নতুন নতুন জায়গা চেনায়, নিয়ে যায়- এই গল্পটাই দ্বিতীয় বিষয়ের উত্তর। ছেলেটি সেটি বুঝতে পারে নি। এই বুঝতে না পারা বুঝতে গিয়ে এই গল্পের শুরু।
ছেলেটি একটু একটু বড় হয়। শিক্ষকের সাথে বন্ধুত্বও জমে। বইটি পড়লে আমরাও ওভাবে ছোটদের সহজে লিখতে পারার ক্ষমতাটা দিয়ে দিতে পারবো।
বইটি একটু উল্টালেই বুঝতে পারবো, কেন বইটি জরুরি। কেমন জরুরি, তা বোঝার জন্য পৃষ্ঠা উলিয়ে ঝটপট কয়েকটি নমুনা দেখে নেয়া যেতে পারে।
আমরা দেখি, শিক্ষক আর বালক ছাত্রবন্ধু দুজন মিষ্টি শীতের সকালে মাদুরে বসে রোদ পোহাতে পোহাতে মুড়ি চিবোচ্ছেন আর গল্প করছেন। শিক্ষক তাকে রচনা কাকে বলে বলছেন,
‘একটা বিষয়ে তুমি কি জানো, কি ভাবো- তা অপরকে জানানোই রচনা। কিন্তু এই লেখাটা শিখতে হয়।’
মুড়ি চিবোতে চিবোতে বালক বলে, ‘স্যার কি করে শিখতে হয়? ‘আগে নামো জলে।’
‘মানে?’
‘সাতার কাটা শিখতে গেলে যেমন জলে নামতে হয় আগে, লেখা শেখার উপায়ও তাই। লেখা। বারবার লেখা।’
‘কিন্তু স্যার, কোন একটা বিষয়ের ওপর লিখতে বসলে কী দিয়ে শুরু করবো? সেটাইতো ধরতে পারি না।’
‘প্রথমে সেই বিষয়ে তুমি কি কি জানো, সব মনে করো। তারপর লেখো।’
বালক বিষয়টা ধরতে পারে কিন্তু কোন কূল পায় না।
‘কিন্তু কিভাবে আরম্ভ করবো, স্যার?’ আবার বলে ওঠে ছেলেটি।
‘সেটা তোমার জানার ওপর নির্ভর করে। যদি তোমার বিষয়টা জানা থাকে তাহলে দেখবে মন থেকে হড়বড় করে সব কথা আসছে।’
‘কিন্তু স্যার কোন কথাটা আগে লিখবো, কোন কথাটা পরে?’
‘এটার কোন বাঁধাধরা নিয়ম নেই। কিন্তু শুরুতে সহজভাবে শুরু করা ভাল। তুমি শুরতেই পরিচয় দাও। পরে ঐ বিষয়ে কি কি বলা যায় তা লেখ। ধরো তুমি একজনের জীবনি লিখতে শুরু করেছো- তখন তার বাল্যকাল, কিশোরবেলা, যৌবনের কীর্তি, তার স্বভাব, মৃত্যু। তারপর ঐ লোক সম্পর্কে দুই একটি মতামত দিয়ে শেষ করতে পারো। সিহংহের জীবনি নিশ্চয় এমন হবে না?’
এরপর এই বইতে এরকম বেশ কয়েকটি রচনার নমুনা দেয়া আছে। নানা রকম রচনা। রচনাগুলো পরীক্ষার গাইড বইগুলোর মত নয়। মুক্ত ধরণের। কাক, গ্রামের নদী, কুকুর, সিংহ, সাপ, শীতকাল, কাগজ, হাজী মোহাম্মদ মহসীন, রাখাল রাজা দিলাল, লবণ, ছাপাখানা, উড়োজাহাজ, ফুটবল, বন্যা এসব শিরোনামের রচনাগুলো পড়া ও পড়ার অভ্যাস থেকে লেখার অভ্যাসে নিয়ে আসার খুব কাজের। এখন শিক্ষায় যে সৃজনশীল পদ্ধতি- তার সাথে খাঁপ খাইয়ে নেয়ার জন্য এগুলো খুব সহায়ক।
শওকত ওসমানের বইয়ের ভাষায়,
‘আসল কথা জানা আর লেখা। লিখতে লিখতে সব ঠিক হয়ে যায়’
তবু বালকের ভয় যে আর যায় না। শিক্ষক তখন ভয় কাটানোর ওষুধ বাৎলে দিলেন।
‘খুব কষে কবিতা পড়ো প্রথমে। প্রথমে ছোটদের কবিতা। তারপর বড়দের কবিতা।’
‘স্যার রচনা লিখবো গদ্যে অথচ পড়বো কবিতা?’ বালক অবাক।
‘ঐখানেইতো মজা। যা-ই লিখি না কেন, তা শুনতে ভাল লাগা উচিত। গদ্যও সে নিয়ম মেনে চলে। এখন শুনতে ভাল লাগার জন্য কান দরকার। কবিতায় ভাল লাগা সহজে ধরা যায়। তাড়াতাড়ি ভাল শোনার কান তৈরি হয়। তাই গদ্য লেখার জন্য কবিতা পড়া উচিত।’
এই বইতে এরপর কিছু কবিতা দেয়া আছে। শওকত ওসমান বলছেন, কবিতার টুকরা।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নজরুল ইসলাম, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, সুনির্মল বসু, বিমল ঘোষ, সুকান্ত ভট্টাচার্য, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, গোবিন্দচন্দ্র দাস, জসিম উদ্দীন প্রমুখ কবির রচনা সম্ভার থেকে তুলে আনা কবিতার টুকরাগুলো আমাদের ভাষার যে একটা সৌন্দর্য আছে তার মধ্যে নিয়ে যায়। ভাষার সৌন্দর্যকে নিজের মধ্যে নিয়ে আসে।

বইটার মধ্যে মানুষের নানা রকম সঙ্গীর কথা আছে। বই মানুষের ভাল সঙ্গী্। কেন ভাল সঙ্গী সেটা এই বই থেকে আমরা খুব ভাল বুঝতে পারি। লেখার সাথে পড়া মিলে কেন লেখাপড়া সেটি পরিষ্কার হয়।
‘বই পড়লে লেখা শেখা যায়?’
বালকের উত্তরে শিক্ষকবন্ধু বললেন, ‘অপরে কি লিখেছেন তা থেকে কি লিখেছেন তা শুধু নয়, কীভাবে লিখেছেন তাও শেখা যায়। তখন লেখার কায়দা কৌশল নিজের মধ্যে চলে আসে। তবে লক্ষ কথার এক সেই পুরনো কথা- লেখা শেখার শ্রেষ্ঠ উপায় লেখা, লেখা আর লেখা।’
এর তিনি তাকে টুকরো টুকরো করে কয়েকজন লেখকের লেখা থেকে নমুনা তুলে দিলেন। মীর মোশাররফ হোসেন, কাজী ইমদাদুল হক, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, মনোজ বসুর লেখা থেকে মণি মাণিক্যের মত নানা ঢঙের লেখা জড়ো করে তুলে দিয়েছেন। কতভাবেই না লিখে কথা বলা যায়, এগুলো পড়লে আমাদের সবারই মনে হবে। মনে হবে আমরাও নানাভাবে আমাদের কথা লিখতে পারি।
বাগধারা, নীতিকথা, প্রবাদ এগুলো কী- গল্পগুলোর ভেতরে লুকিয়ে থাকা অর্থ খুঁজে বের করে তা আবার নিজের মতো করে উপস্থাপন করার কলাকৌশলও বইটা পড়লে সহজ হয়ে আসে। খেলার মতো। একই শব্দ, ব্যবহারের অবস্থা ভেদে নানা অর্থ নিয়ে হাজির হয়, সেটা বুঝতে পারলে ভারি মজা লাগে। এগুলো ভাষাজ্ঞানের পাশাপাশি বুদ্ধির চর্চাও বাড়ায় নিশ্চয়ই।
ব্যকরনে আমাদের ভারি ভয়। এই ভয়টা আসে আসলে না বোঝা থেকে। ব্যকরনের সাধারন বিষয়গুলো এই বইতে খুবই মজার করে গল্পের মত করে উঠে আসে। যেমন বাক্যে যতিচিহ্ন বোঝানোর জন্য তিনি ট্রাফিক পুলিশের গল্প বলেছেন। ট্রাফিক পুলেশের নির্দেশে যেমন রাস্তার গাড়িগুলো চলতে শুরু করে, যতিচিহ্নগুলোও যেন তাই। এক একটা গাড়ি হচ্ছে এক একটা শব্দ। ট্রাফিক নিয়ম না মানলে যেন গাড়িতে গাড়িতে ধাক্কা লাগে, এখানেই তেমনি শব্দে শব্দে ধাক্কা লেগে বিদিকিচ্ছিরি দূর্ঘটনার মত কাহিনী হয়। কিচ্ছু বোঝা যায় না তখন আর।
চিঠি আমরা এখন আর লিখি না, কথাটা ঠিক নয়। চিঠি হয়তো আর ডাকবাক্সে ফেলি না, কিন্তু নানাভাবেই আমাদের খবর পাঠাতে হয়। আপিস আদালতে ইশকুলে আর্জি জানাতে হয়। এগুলোও খুব মজার করে আছে।
বইটি থেকে একটা মজার চিঠির খানিকটা আমরা পড়তে পারি। এক পিতা পুত্রকে একটি চিঠি লিখতে বলেছিলেন। কথামতো পুত্র পিতাকে চিঠি লিখেছেন। সেই চিঠি পড়ে পিতা এবার পুত্রকে লিখলেন-
‘আমার কথামতো তুমি আমাকে এইকটি পত্র লিখিয়াছো। কিন্তু পত্রটি তুমি আর পড়িয়া দেখ নাই। আর একবার পড়িয়া দেখার ইচ্ছা থাকিলে, তুমি এমন পত্র কখনই লিখিতে না। কারণ, পড়িতে না পারিয়া তুমি নিজেই ভুলগুলি সংশোধন করিতে।..’
কে এই পুত্র?
কে এই পিতা?
উভয়েই ভারতবর্ষের সম্রাট ছিলেন। দিল্লীর সম্রাট বাবর তাঁর পুত্র হুমায়ূনের লেখা চিঠি পড়ে তাঁকে এই চিঠিটি লিখেছিলেন। লেখার জন্য জানাটা সবচেয়ে বেশি জরুরি। এই জানাটা কীভাবে গড়ে ওঠে তার নানা সূত্র পাওয়া যায়। দেশকে চেনা, প্রকৃতিকে চেনা, মানুষকে চেনার মধ্য দিয়ে এই জানা তৈরি হয়। আমরা কোন বিষয়কে যত জানি তত সেটাকে ভালবাসতে পারি। এই জানার গল্প জানতে গিয়ে আমরা অনেক মজার কিছু জেনে যাই। যেমন বাবার সবচেয়ে বেশি ভালবাসতেন বালাদেশের জুঁইফুল। বাবর গভীর ভালবাসা দিয়ে দেশকে দেখতে পেরেছিলেন বলেই বাবার নামা’ বইতে তিনি বাতাসে দোলানো কলাপাতার কথা লিখতে পেরেছিলেন। শওকত ওসমান লিখছেন, ভালো রচনার জন্য সহজ সরল মন দরকার। সহজ সরল মন দ্বারাই সহজ সহজ লেখা যায়। একটা বাংলা প্রবাদ বাক্যও শওকত ওসমান আমাদের জন্য তুলে ধরেছেন।

‘কালি, কলম, মন
লেখে তিনজন।’

“রচনা শিক্ষার জন্য মনও তৈরি করতে হয়। তার কোন উপায় আছে?” এর উত্তর মাস্টার মশাইয়ের জবানিতে শওকত ওসমান লিখছেন-
‘আছে। তাহা এক কথায় বলা যায়; নিজের দেশকে ভালবাসো। দেশের মানুষ, ফলফুল, গাছপালা, পশুপাখি, নদনদী- সবকিছু যেন তোমার প্রিয় হয়। নচেৎ কোনোদিন ভাল রচনা তোমার দ্বারা সম্ভব হবে না। কারণ, দেশপ্রেম ছাড়া তুমি ভাল মানুষ হতে পারবে না। সৎ মানুষ না হলে সৎ রচনা অসম্ভব। দেশকে ভালবাসো...”
আমরা কোথায় লেখার বিষয় পাবো? বইয়ের একেবারে শেষ পৃষ্ঠায় শওকত ওসমান বলছেন-
লেখার সন্ধানে নিত্য ছুটে যেতে হয়
পথ-ঘাট, বিল-খাল, গিরিদরীময়,
ঝোপে-ঝাড়ে গ্রামে শহরে শহরে
আমার দেশের লোক যেথা বাস করে;
দ্রুত তাঁত বোনে, হাল ধরে, দাঁড় টানে,
দরিয়ায় পাড়ি দেয় দুরন্ত উজানে
সারা রাত্রিদিন চাকা কলের ঘোরায়...
হাজার রচনা সেখানে পড়ে আছে ভাই।

এরপর কিছু বলার থাকে না, বইটি হাতে তুলে নিয়ে নেয়া ছাড়া।

ছবি: 
04/06/2007 - 1:18অপরাহ্ন

মন্তব্য

হিমু এর ছবি

পরিস্থিতি শিকার যেভাবে পরিস্থিতির "স্বীকার" হয়ে যাচ্ছে, ব্যাকরণও সে পথে ক্রমশ "ব্যকরন" বা "ব্যকরণ" হয়ে যাচ্ছে। মানববন্ধন না করলে মনে হয় এসব সারবে না।

সাইদ এর ছবি

@হিমু চলুক
আসলেই মনে হচ্ছে মানববন্ধন করা লাগবে।

তাহসিন রেজা এর ছবি

বইটি পড়ার ইচ্ছে রইল হাসি

------------------------------------------------------------------------------------------------------------
“We sit in the mud, my friend, and reach for the stars.”

অলীক জানালা _________

সোহেল ইমাম এর ছবি

বইটা পড়তে ইচ্ছে হচ্ছে কিন্তু বইটার প্রচ্ছদ দেখেই মনে হচ্ছে এ বই বাজারে পাওয়া কঠিন হবে।

---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।