বাক্স

আনন্দী কল্যাণ এর ছবি
লিখেছেন আনন্দী কল্যাণ (তারিখ: শুক্র, ২০/০৫/২০১১ - ১২:৫৭পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

(১)

কোন এক বছর বন্যার সময় আমাদের বাসার সামনে পানি উঠলো। বাসা হল রামপুরায়। ব্যস, ভাইয়া আর টিকলির ভার্সিটি আর স্কুল যাওয়া বন্ধ। সারাদিন ওরা বাসায় থাকে আর হৈ-চৈ, মারামারি, এইসব করে। একদিন বিকালে বিস্কুটের বয়াম থেকে বিস্কুট ফেলে-টেলে দিয়ে রাস্তা থেকে তিনটা খলসে মাছ নিয়ে আসল। কি যে একটা অবস্থা তখন, পাশের বাসা থেকে পানি ভেঙে, প্যান্ট গুটিয়ে শাহেদ ভাইও সেই মাছ দেখতে চলে আসে। পারলে প্রায় সারাদিন আমাদের বাসায়ই থাকে, মাছ কে খাওয়া দেয়, গান শোনায়, আটটার খবর দেখায়। শাহেদ ভাই ভাইয়া আর টিকলির সাথে ক্যারাম খেলে, আম্মাকে তরকারি কুটে দেয়, আব্বার সাথে হাসিনা-খালেদা নিয়ে আলাপ করে, আর তারপর যেই সময়টুকু থাকে, সেটা মাছদের। আমি অনেক ভেবেচিন্তে একেকটা বাক্য ঠিক করি, শাহেদ ভাইয়ের সাথে কথা বলার জন্য, যেমন, পানি কবে নামবে? খালাম্মার ডায়েবেটিস কেমন এখন? ফ্যান বাড়াব, গরম লাগছে? কিন্তু, শাহেদ ভাই আমাকে দেখতে পায় না, শুনতেও পায় না। স্টার মুভিজে ওই সিনেমাটা প্রায়ই দেখায়, ওই যে একটা মানুষ, ল্যাবরেটরি তে একটা এক্সপেরিমেন্ট করতে গিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল, তারপর তাকে আর কেউ দেখতে পায় না। আমাকে বাকি সবাই দেখতে পায়, কিন্তু শাহেদ ভাই পায় না। একটা খলসে মাছও আমার চেয়ে বেশি মনোযোগ পায় শাহেদ ভাইয়ের কাছে।

অবশ্য এই বাসার অন্য মানুষগুলাও মাঝে মাঝে আমাকে দেখতে পায় না, শুনতে পায় না। কিন্তু আমি কিন্তু এই বাসার সবকিছু মনে রাখি। নতুন মাস আসলে ক্যালেণ্ডারের পাতা উল্টাতে হবে, তিন তারিখে ডিশের বিল নিতে আসবে, রাতে খাবার পর আব্বার প্রেসারের ওষুধ খেতে হবে, সন্ধ্যায় বুয়া তার বাসায় যাবার আগে ময়লা ফেলে দিয়ে যাবে, ভাইয়া ভার্সিটি থেকে এসে পেন ড্রাইভ কোথায় ছুঁড়ে ফেলল, টিকলির প্র্যাক্টিকাল খাতা জমা দেবার তারিখ, সব, সব মনে রাখি আমি। আসলে আমি তো একটা অর্ধেক মানুষ, তাই আমাকে ওদের মনে থাকে না। আমি হাঁটতে পারিনা, কোমর থেকে পায়ের পাতা পর্যন্ত প্যারালাইসিস আমার, ডাক্তার বলেছে আর কখনো ভাল হব না, আমার একটা হুইলচেয়ার আছে, সেটাতে করে চলাফেরা করি। আর যারা আস্ত মানুষ, দুটো পা আছে, সকাল হলেই তারা বেরিয়ে পড়ে, ওদের অনেক কাজ। ওরাই তো পৃথিবীটা চালায়। কত কত চাকা বানায়, সেইসব চাকা ছুটছে, ঘুরছে, চলছে। আর কিছু বড় বড় বাক্স বানায়, আকাশ ছুঁই ছুঁই, সন্ধ্যা হলে আবার সেইসব বাক্সে ফেরে। ওদের পা আছে, ওরা চলতে জানে, হাঁটতে জানে, দৌঁড়াতে জানে। আর ভাইয়া বলে, একা একা দৌঁড়ে কোন মজা নেই, আশেপাশে আরো কিছু মানুষ লাগে, যারা দৌঁড়াতে জানে, ল্যাঙ মারতে জানে, তাকে নাকি বলে র‍্যাট রেস। আমি হাঁ করে ভাইয়ার কথা শুনি। ভাইয়াটা একটা জিনিয়াস। মাঝে মাঝে ভুলভাল হাবিজাবি প্রশ্ন করি, এই যেমন সেদিন জানতে চাইলাম, ভাইয়া কাকে কাকে ল্যাঙ মেরেছে। প্রশ্নটা করেই বুঝেছি করা ঠিক হয় নি, ভাইয়াও ভুরু কুঁচকে উঠে চলে গেল।

সবাই সকালে বেরিয়ে গেলেও আম্মা কোথাও যায় না। আমার এই অসুখের জন্য আম্মা বাসা ছেড়ে আমাকে রেখে কোথাও যায় না। আম্মা আমাকে সবসময় দেখতে পায়, শুনতে পায়। মাঝে মাঝে বুকে জড়িয়ে ধরে বলে, ছোট্ট পাখি চন্দনা। আমি মনে মনে বলি, না, মা, আমি পাখি না, আমার আকাশ দেখার মাঝখানে গ্রিল থাকে সবসময়। আমার আকাশ খোপ খোপ, বাক্স বাক্স। ওইসব মানুষেরা যারা ছুটে, চলে বেড়াচ্ছে, তারাও আবার শখ করে কিছু বাক্স বানায়। সারাদিন ছোটাছুটি করে যখন পা ব্যথা করে, তখন রাতে বাড়ি ফিরে ওই বাক্সের সামনে বসে অন্যদের ছোটাছুটি দেখে, বোতাম চিপে চিপে কাউকে থামিয়ে দেয়, কাউকে জোরে দৌঁড় করায়। আমার সারাদিনের বেশিরভাগ সময় কাটে ওই বাক্সটার সাথে। ওদের লাফ-ঝাঁফ, সাঁতার, নাচ বোতাম চিপে চিপে থামিয়ে দিতে বেশ লাগে আমার। বলি, কেমন লাগছে তোমাদের? কেমন লাগে থেমে যেতে? তুমি এখন চাকা বানানোর দলে নেই, চাকা বিক্রিরও দলে নেই, চাকায় চড়ার দলে কেবল, কেমন লাগছে তোমাদের?

ওই বাক্সটায় আমি নানাকিছু দেখি। দেখি চলতে ফিরতে পারা মানুষেরা দুনিয়া জুড়ে কেমন দাপিয়ে ফিরছে। অর্থ-অনর্থ করছে। নিজেদের বানানো বড় বড় আকাশ-ছোঁয়া বাক্স আর চাকা থেকে তৈরি করছে ধোঁয়া, ধোঁয়া। আর পুরো পৃথিবীটাকেই নাকি একটা বাক্স বানিয়ে দিচ্ছে, সূর্যের আলোগুলি আটকে পড়ছে ওই বাক্সে, আর বের হতে পারছে না। আর পালটে দিচ্ছে হাওয়া-জল-মেঘের কলকব্জা, বিগড়ে দিচ্ছে সব। হাওয়া-জল-মেঘ ফুঁসে উঠে দুমড়ে-মুচড়ে দিচ্ছে মাটি, মানচিত্র, আর তোমরা, আস্ত মানুষেরা, দুটো পা আছে যাদের, হাজার দৌঁড়েও বাঁচছো না প্রাণে।

(২)

ফিরে ফিরে আমার শুধু মনে পড়ে ওই বাক্সটাতেই দেখা সেই ভয়ংকর দৃশ্যটার কথা। আমার থেমে থাকা বেঁচে থাকায় কী প্রবল আলোড়ন। ওই যে প্লেন উড়ে এসে ভেঙে দিল আকাশ ছুঁই ছুঁই দুইটা বাক্স। ঝুপঝুপ করে ভেঙে পড়ল সাথে গরিমা, পরষ্পরের জন্য রাখা বিশ্বাস। সারা পৃথিবী জুড়ে দাপিয়ে বেড়াল তল্লাশি, ইঁদুর আর বিড়াল, বিড়াল আর ইঁদুর। আরো কত মানুষকে আমার মত করে দিলে তোমরা, চলে-ফিরে বেড়ানো মানুষেরা, থামিয়ে দিলে। ভাইয়া তখন বলেছিল, এই যে দেখছিস, প্লেন ছুঁড়ে মারা, এর আগের গল্প হল, প্লেন থেকে ছুঁড়ে মারা। আমি তো অতশত বুঝি না, মেনে নিয়েছি বুদ্ধিশুদ্ধি আমার মাছের চেয়েও কম। তাই ভাইয়ার বলা যেকোন কথা আমি হাঁ করে শুনি। ভাইয়া বলে, শোন মিতুন, যারা এই প্লেন ছুঁড়ে মারল, যাদের কে মারল, তারাই শিখিয়েছে ওদের কিকরে মারতে হয়।

- এটা কি সেই র‍্যাট রেস? তুমি যে বলেছিলে আশেপাশে লোকজন না থাকলে দৌঁড়ে মজা নেই?
- ঠিক ধরেছিস। আশেপাশে দৌঁড়াবার মানুষজন না থাকলে, তৈরি করতে হবে, শেখাতে হবে দৌঁড়।
- তারপর কখন ছোঁবে ফিনিশিং লাইন? কখন পরবে মেডেল গলায়?
- আরে মেডেল পরলে তো হয়েই গেল, দৌঁড় শেষ।
- ওদের পা ব্যথা করে না?
- নারে, ওদের না দৌঁড়ালে পা ব্যথা করে।

আমি ভাবি, আর খুব ভাবি। কে মারল অমন প্লেন ছুঁড়ে? টিকলিরা স্কুলে ক্লাসে টিচার পিছন ফিরলেই প্লেন ছুঁড়ে মারে। কে মারে সেটা টিচার দেখতে পায় না, তাই যেদিন যার উপর মেজাজ খারাপ থাকে, তাকে দাঁড় করিয়ে রাখেন টিচার। টিকলিরাও আসলে জানে না কে মারে প্লেন ছুঁড়ে, একেক দিন একেকজন, কো-এড স্কুল দেখে মাঝে মাঝে ছেলেরা নাকি না মারলেও ভাব নেবার জন্য বলে, টিচার আমি মেরেছি। আমি ভাবি, আর খুব ভাবি।

এবার আমি ভাইয়াকে বলি, প্লেন থেকে ছুঁড়ে মারার গল্পটা বলতে। ভাইয়া বলে, ওরা প্লেন থেকে ছুঁড়ে মারত আগুন, অনেক দেশে দেশে চলে-ফিরে বেড়ানো মানুষকে সারাজীবনের জন্য থামিয়ে দিয়েছে, মাটির নিচে বাক্সে ভরে দিয়েছে, কফিনে। আর অনেক দেশে দেশে মাটির নিচে আছে সম্পদ। সেই মাটির নিচের জিনিস পাবার জন্য মাটির উপরের না সরতে রাজি হওয়া, মাটি খুঁড়তে না দেওয়া মানুষগুলিকে সরিয়ে দেয়া দরকার। আর মাটি খুঁড়ে গুপ্তধন বের করার জন্য এমন মানুষ দরকার, যারা ওদের কথা শুনে ঠিকঠাক কোদাল চালাবে, ওদের বাক্স-প্যাটরা ঠিকঠাক গুছিয়ে দেবে। ভাইয়া আরো অনেককিছু বলে, আমি কিছু শুনি, কিছু শুনি না। আমি চোখ বন্ধ করলেই শুধু দেখতে পাই, ওই বিরাট দুই বাক্সবাড়ি ঝুপঝুপ করে ভেঙে পড়ছে। যেমন আম্মা ঝুপঝুপ করে ধ্বসে গেছিল আব্বার ওই কথাটা শুনে, খানকি মাগি কোনখানকার। সেদিন বুঝেছিলাম প্লেন ছোঁড়া অনেকরকমের হয়। আমার তখন জানতে ইচ্ছা করেছিল, আব্বার এই প্লেন ছোঁড়ার কারণ কি। কারণ ভাইয়া বলেছিল, তার আগেও অনেক গল্প ছিল, মাটির নিচে বা মাটির উপরে। কিন্তু, ভাইয়া সাত সমুদ্র তের নদীর ওপারের গল্পগুলিই ভাল জানে, আমাদের এই বাক্সবাড়ির গল্প বলতে বললে বলে, যা ভাগ, বিরক্ত করিস না। আমি তখন রুবিক কিউবের রঙ মেলাবার চেষ্টা করি নিজে নিজেই। মনে পড়ে, অনেক অনেক দিন আগে এক দুপুরবেলা, আধো ঘুমে ছিলাম, দাদীর পাশে শুয়ে, আমাদের দুজন কে দেখিয়ে আম্মা ঠাণ্ডা গলায় আব্বাকে বলেছিল, দুজনের গু-মুত পরিস্কার করতে পারব না, তোমার মাকে ছোটনের বাড়িতে রেখে আস। আব্বা দাদীকে ছোটচাচার বাসায় রেখে এসেছিল।

(৩)

যাই হোক, আমার বুদ্ধিশুদ্ধি মাছেদের থেকে কম হলেও, আমি বুঝতে পারি ওই প্লেন ছুঁড়ে বাক্স ভেঙে দেবার পর থেকে কেমন যেন সব পালটে যাচ্ছে। আমি তো বাসার বাইরে যাই না, তাও বুঝতে পারি। টিকলি এখন প্রত্যেকটা রোজা রাখে, আম্মা হিজাব পরা শুরু করেছে, আব্বা প্রায়ই খুব চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে তর্ক করে বন্ধুদের সাথে। ভাইয়া একেকটা ফর্ম পূরণ করে, আর বলে ফর্মের বাক্স বাক্স ঘরে নাম লেখার জায়গাটায় এম.ডি দেখলেই সেই ফর্মগুলি নাকি একটা নির্দিষ্ট বাক্সে গিয়ে পড়ে, তার গায়ে লেখা থাকে সন্ত্রাসবাদ। আমাদের এই বাক্সবাড়ি ছেড়ে খুব দূরে কোথাও চলে যেতে চায় ভাইয়া। কেন? ও তো বলে পড়াশোনা করবে আরো তাই। সেই জায়গাটায় নাকি অনেক ঠাণ্ডা। আমাদের এই বাড়িটার চেয়েও বেশি ঠাণ্ডা? সেজন্য নানারকম প্রস্তুতি নেয় ও, নাম কি সেই জায়গার জানতে চাইলে বলে, America-the distant hated paradise.

একদিন শাহেদ ভাই আসলো আমাদের বাসায়, সে তো প্রায়ই আসে, কিন্তু সেদিনের আসাটা একদম অন্যরকম ছিল। সাথে আরেকজন ছিল। কাজরীদিদি। আব্বা ওর নাম শুনে ভুরু কুঁচকে ফেলল, আম্মা তো জিজ্ঞেসই করে ফেলল, তুমি কি মুসলমান? কাজরীদিদি বলল, আমার বাবা-মা মুসলমান। আব্বা বলল, কেন যে বাবা-মারা বাচ্চাদের এমন কনফিউজিং নাম রাখে, বলে চলে গেল। বাসায় প্রথম একজন মানুষ এসেছে, কি একটা বিব্রতকর অবস্থা। কিন্তু, ওই যে বললাম, দিনটা একদম অন্যরকম ছিল, যাকে নিয়ে এত আলোচনা, তার এসব নিয়ে কোন মাথাব্যথাই নেই। আমি ঠিক জানি না, কেন, কিন্তু আমার কাজরীদি কে দেখে মনে হচ্ছিল, এই মানুষটা প্লেন ছোঁড়া আর প্লেন থেকে ছুঁড়ে মারা কোন দলেই নেই। রূপকথার বইগুলো থেকে উঠে আসা মানুষ যেন, উহু, না। রূপকথার রাজকন্যাগুলোর মত ফ্যাঁচফ্যাঁচ করে কেঁদে, রাজপুত্র এসে উদ্ধার করবে সেই আশায় উদাস চোখে বসে থাকার মত মানুষ না কাজরীদি। অথবা কে কবে এসে ঘুম ভাঙাবে, সোনার কাঠি, রুপার কাঠি ইত্যাদি দিয়ে, ওসবের ধার ধারে না কাজরীদি। আর সেই কাজরীদির সাথে বিয়ে হল শাহেদ ভাইয়ের। আর শাহেদ ভাইকে তো আমি অনেক ছোটবেলা থেকেই চিনি, বড় সুন্দর দেখতে মানুষটা। আমি শাহেদ ভাই কে খুব ভালবাসতাম, উহু, পছন্দ করতাম। পরে অনেক ভেবে বুঝেছি, ঠিক পুরো মানুষটা কে না, ওর লম্বা লম্বা আঙুল, ঝকঝকে দাঁত, একমাথা কোঁকড়া চুল, পরিষ্কার নখ, মেদহীন তলপেট, এইসব আমার খুব ভাল লাগত। আমি ভালবাসতাম ওই সুস্থ্-সবল-গটগট করে হাঁটতে পারা উপস্থিতিটাকে। একটা আস্ত মানুষ, একটা আস্ত শরীর। আমার মত অর্ধেক নয়, বিকলাঙ্গ নয়। আমি চাইতাম, ওই তকতকে সুস্বাস্থ্য শরীর, আমাকে তার শরীরের সাথে মিশিয়ে নিক। সুন্দর এসে বসুক অসুন্দরের কাছে, হাঁটু গেড়ে। কিন্তু শাহেদ ভাই তো আমাকে কখনো দেখতেই পেত না। ও ওর অজান্তেই দৃষ্টিসীমা থেকে যাবতীয় অসুন্দর, বিকলাঙ্গতাকে সরিয়ে দিত। অসম্পূর্ণ কিছু দেখলে ওর ভুরু কুঁচকে উঠত, আমি জানতাম, আমাকে ভয় পেত ও।

তারপর কাজরীদির সাথে বিয়ে হবার পর থেকে শাহেদ ভাই শুধু আমাকে না, অন্য আর কিছুই দেখতে পায় না, শুনতে পায় না। একে অপরের বাক্সে ঢুকে পড়েছিল ওরা, পৃথিবী থেকে আলাদা হয়ে। তাই আমি যখন শুনলাম, ওরা আলাদা হয়ে যাচ্ছে, খুব অবাক হয়েছিলাম। একদিন দুপুরবেলা কাজরীদি আমাদের বাসায় আসল। বলল, সব গোছগাছ হয়ে গেছে, কাল চলে যাচ্ছে ও। আমি অবাক হয়ে অনেকগুলো প্রশ্ন করতে চাচ্ছিলাম, জানতে চাচ্ছিলাম, তোমাদের তো সব আছে, তোমাদের কিসের কষ্ট? তোমরা কেন একে অন্যের বাক্সে উঁইয়ের বাসা বানাও? ইচ্ছা করে? খেলা?

- মিতুন, আমাদের সব নেই। কে বলল আমাদের সব আছে? আমরা ভাবতেই শিখিনি আমাদের সব আছে। সব থাকা কাকে বলে আমরা জানি না। তুই ভাবছিস, তোর কিছু নেই? কি নেই তোর? হাঁটতে পারিস না, এই তো? হাত-পা ওয়ালা মানুষেরা পৃথিবীর কি অবস্থা করেছে দেখ। হাঁটতে যারা পারে, তারা একসময় কুচকাওয়াজ করে। মার্চ না করলে ওদের তখন পা ব্যথা করে। সবাইকে ওদের দলে টানতে চায়। সবার একসাথে ডান পা ফেলতে হয়, বাঁ পা ফেলতে হয়। সবার সাথে পা না মিললে তুই আউট, তুই ডিটেনশন পাবি। তুই বেঁচে গেছিস মিতুন, তুই হাঁটতে পারিস না।

-আর দুজন মানুষ একসাথে হাঁটা? দুজনের পা মেলানো? সেটাও কি খুব কঠিন?

আমার এই প্রশ্নের কোন উত্তর দেয় না কাজরীদি, চুপ করে বাইরে তাকিয়ে থাকে, কিছু একটা দেখে বা দেখে না। আমি বুঝি, আবার ভুল প্রশ্ন করে ফেলেছি।

হঠাৎ ভাইয়া ঘরে ঢোকে। জানায়, আবারো ওর ভিসা রিজেক্ট করেছে। আর পাশের ঘরের বাক্স থেকে অনেক মানুষের গলার আওয়াজ শুনি, আনন্দমিছিল। সেই প্লেন ছুঁড়ে মারার ঘটনায় যেই লোকটা হাত তুলেছিল, বলেছিল, আমি মেরেছি টিচার, সেই লোকটা, যে অন্য সব পরিবারের রাতের খাবারের টেবিল থেকে একের পর এক প্রিয়জন কমিয়ে দেয়, বুকে বোমা বেঁধে দেয়, আর নিজের রাতের খাবার টেবিলের একজন সদস্যকেও হারাতে চায় না, সেই লোকটাকে নাকি প্লেন থেকে ছুঁড়ে মারার দল মেরে ফেলেছে। এসব খবরে ভাইয়ার সবসময় অনেক আগ্রহ দেখি, আজকে দেখি চুপ করে বসে আছে। ভাইয়া এবার মনে মনে ভেবেছিল, ভিসা হয়ে যাবে, চুপিচুপি কি কি বই নেবে গোছাচ্ছিল, আমি জানি। একটু পরে উঠে কোথায় যেন চলে যায়। আমি ভাবলাম, জানতে চাইব, এবার কি? ভিক্টরি স্ট্যাণ্ডে দাঁড়াবে, মেডেল পরবে? আরেকটা বোকা বোকা প্রশ্ন মাথায় এসেছিল, হেরে যাওয়া আর জিতে যাওয়া মানুষেরা কি কখনো একসাথে ভিক্টরি স্ট্যাণ্ডে দাঁড়ায়? কোন প্রশ্নই করা হয় না।

কাজরীদিও চুপ করে বসে থাকে। এই একটা মানুষ আমাকে দেখতে পারে, শুনতেও পারে, আর কি আশ্চর্য, বুঝতেও পারে। আমি আগে কখনো জানিনি, মানুষ মানুষ কে বুঝতে পারলে কেমন লাগে, একটা ম্যাজিক হয়, ম্যাজিক। আমার ইচ্ছা হয়, কাজরীদি কোথাও না যাক, আমার কাছে থেকে যাক, আমার কাছে থেকে যাক। শেষ না হওয়া কথাটুকু এবার শেষ করে কাজরীদি,

- তুই বেঁচে গেছিস, মিতুন। তোকে হত্যা করতে হয় না, হত্যাকাণ্ডের আনন্দমিছিলে তোকে কেউ ডাকে না। তোকে কেউ দলে নেয় না, তোর গলায় কোন আইডি ট্যাগ ঝোলে না, তুই কোন বাক্সে নেই। তোর শরীর ওরা থামিয়ে দিতে পারে। মন কি করে পারবে? তোর ভাবনা কোথাও আটকাবে না, কারণ তুই কোন বাক্সে নেই। সেই ভাবনা ওরা প্লেন ছুঁড়ে বা প্লেন থেকে আগুন ছুঁড়ে পুড়িয়ে দিতে পারে, থামাবে কি করে?

আমার এই মাছের মত বুদ্ধিশুদ্ধির মাথা দিয়ে আমি হঠাৎ অনেককিছু বুঝতে পেরে যাই। বুঝতে পারি, কাজরী নামের মানুষ আমাকে বলছে, আমরা সবাই অসম্পূর্ন, মিতুন, তোরটা চোখে দেখা যায়, আমাদেরটা যায় না, এই। আর সেই দেখা না যাওয়া অসম্পূর্ণতা ঘুণপোকা হয়ে ঝুপঝুপ করে ধ্বসিয়ে দিচ্ছে সব, অনেক অনেক আগে বাক্সে দেখা চুরচুর করে ভেঙে পড়া বাড়িগুলোর মত?


মন্তব্য

রু (অতিথি) এর ছবি

ভালো, কিন্তু মনে হয়েছে অনেকগুলো বিষয় একসাথে এসে গল্পটাকে খুব ব্যস্ত করে ফেলেছে।

আনন্দী কল্যাণ এর ছবি

@ রু, আমাদের কাটানো যে কোন একটা দিন ভাবুন, এই গল্পে আসা বিষয়গুলি কিন্তু বারবার মোকাবেলা করি, একটা দিনে যদি এতগুলি বিষয় নিয়ে খেলতে হয়, গল্পে কেন পারব না? সেরকমই একটা চেষ্টা নিয়েছিলাম। ধন্যবাদ আপনাকে।

আনন্দী কল্যাণ এর ছবি

@মানিক চন্দ্র দাস, সবুজ পাহাড়ের রাজা, ফাহিম হাসান, কাঠপুতুল, ঘুম কুমার, ধৈবত, সুহান রিজওয়ান, অনার্য সঙ্গীত, দ্রোহীদা, নৈষাদদা

অসংখ্য ধন্যবাদ পাঠ ও মন্তব্যর জন্য।

মানিক চন্দ্র দাস এর ছবি

দেখা না যাওয়া অসম্পূর্ণতা ঘুণপোকা হয়ে ঝুপঝুপ করে ধ্বসিয়ে দিচ্ছে সব

চলুক

সবুজ পাহাড়ের রাজা এর ছবি

চলুক

ফাহিম হাসান এর ছবি

সমাপ্তিটা দারুণ!!

অনিন্দ্য রহমান এর ছবি

গ্রেট!


রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক

কাঠপুতুল এর ছবি

চমৎকার!

ঘুম কুমার এর ছবি

সুন্দর লেখা চলুক

- ঘুমকুমার

ঘুম কুমার এর ছবি

সুন্দর লেখা। চলুক

- ঘুমকুমার

ধৈবত(অতিথি) এর ছবি

চলুক মুগ্ধ

সুহান রিজওয়ান এর ছবি

অনেক অনেকবার এসে ফিরে ফিরে পড়ে যেতে হবে এই গল্পটাকে।

প্রিয়তে নিলাম।

আসমা খান, অটোয়া। এর ছবি

চলার পথে কোন দলের আইডি থাকলে ল্যাং মারতে হয় ঠিকই, কোন দলের আইডি না থাকলে কি হয়??? আসলেই মানুষ ঘুনে ধরা অসম্পুর্ন, কিন্ত তারপরেও মানুষ যখন একজন আরেকজনকে শোনে, চেনে, জানে, তখন সত্যি সত্যি ম্যাজিক হয়, ম্যাজিক!!!
আপনার গল্পটি আমাকে ছুয়ে গেছে আনন্দী কল্যান! অনেক অনেক ধন্যবাদ!!!

আনন্দী কল্যাণ এর ছবি

মানুষ মানুষ কে বুঝুক, অবিশ্বাস কমুক, ব্যস, খুব বেশি কিছু আর চাওয়ার নেই।
আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ পড়বার জন্য।

অনার্য সঙ্গীত এর ছবি

দারুণ, অসাধারণ...

______________________
নিজের ভেতর কোথায় সে তীব্র মানুষ!
অক্ষর যাপন

দ্রোহী এর ছবি

পড়ে মুগ্ধ হলাম!

গুরু গুরু গুরু গুরু গুরু গুরু গুরু গুরু গুরু গুরু

নৈষাদ এর ছবি

চমৎকার।

guest_writerকৃত্যদাস এর ছবি

গল্পের প্লট টা অতি চমৎকার লেগেছে। কলেবর টা আরেকটু বড় হলে ভালো লাগতো। ধন্যবাদ অনেক।

আনন্দী কল্যাণ এর ছবি

@ কৃত্যদাস, অনেক ধন্যবাদ। হ্যাঁ, একমত।

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

অন্যেরা কী ভাবছেন জানি না, আমার কাছে গল্পটার পরিসর ছোট বলে মনে হয়েছে। মিতুনের মনে যে প্রশ্নগুলো জাগে তার যতগুলো এখানে এসেছে তার প্রত্যেকটাই আরেকটু বেশি করে পরিসর দাবী করে। ব্লগে গল্প লেখার একটা সমস্যা হচ্ছে "গল্পের দৈর্ঘ্য খুব বড় হয়ে গেলো না তো!" এমন ভাবনা মাথায় চলে আসে বলে গল্পের গায়ে ছুরি-কাঁচি চলতে থাকে। "ফাদার সার্গেই", "ক্রয়ৎজার সোনাটা" বা "ইভান ইলিচের মৃত্যু" এখনকার বহু বহু উপন্যাসের চেয়ে আকারে বড় লেখা। অথচ সেগুলোকে বড় গল্পই বলা হয় - উপন্যাস নয়। ব্লগে এই আকারের লেখা দেয়া সম্ভব হয় না। কিন্তু তাতে মূল গল্পটাকে ছেঁটে ফেলার দরকার নেই। ছাপার অক্ষরে গল্প যখন প্রকাশিত হবে তখন তা ডানাওয়ালা পাখির মতো, বনের পাখির মতো মুক্ত-স্বাধীন হোক।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

আনন্দী কল্যাণ এর ছবি

@পাণ্ডবদা, গল্পটা বড় করে লিখলে অবশ্যই ভাল হত, মিতুনের আরো অনেক প্রশ্ন ছিল, সেগুলো লেখা হয় নি, আর যা লিখেছি তার জন্যও অবশ্যই আরো বড় করে লিখতে হত। কিন্তু, গল্পটা ছাটাই হয়নি। যেমন লিখেছিলাম, তেমনটাই পোস্ট করেছি। বুঝতে পারছিলাম আরো বড় পরিসরে লিখলে ভাল হত, কিন্তু আর লিখতে পারছিলাম না, আর কেন জানি আর বেশি সময় দিতে ইচ্ছা করছিল না, চরিত্রগুলি মাথা থেকে বের করে দিতে চাচ্ছিলাম।

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

গুরু গুরু

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

আনন্দী কল্যাণ এর ছবি

ইয়ে, মানে...

নীড় সন্ধানী এর ছবি

ভাবছি এরকম গল্প লিখতে গেলে মাথার ভেতর কতগুলো জিলিপির প্যাঁচ একসাথে গিট্টু খেতে থাকে। আপনার মাথার সাথে কীবোর্ডের দারুণ সমঝোতা আছে নিঃসন্দেহে চলুক

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

আনন্দী কল্যাণ এর ছবি

মাথায় গিট্টু লেগে ছিল, সেটা ছাড়াতেই গল্পটা লিখে ফেললাম হাসি

যাযাবর ব্যাকপ্যাকার এর ছবি

সময়ের পরিসরটা নিয়ে একটু দোটানায় পড়লাম, মনে হচ্ছিলো ঘটনাপ্রবাহ বছর পাঁচেকের থেকে যেন একলাফে দ্বিগুণ হয়ে গেল... কিন্তু কী জানি...
তবে লেখায় - চলুক

___________________
ঘুমের মাঝে স্বপ্ন দেখি না,
স্বপ্নরাই সব জাগিয়ে রাখে।

আনন্দী কল্যাণ এর ছবি

হুম, অনেকগুলো বিষয় তো। অনেকগুলো বছর ধরে গল্পের সময়কাল, কিন্তু বিষয়গুলি ঘুরেফিরে একই, সমস্যাগুলিও একই, বছর কেটে যায়, মূল সমস্যাগুলি থেকেই যায়, ভিন্ন ভিন্ন ফর্মে হাজির হয় শুধু, এইসব নানা হাবিজাবি বোঝাতে চেয়েছিলাম। যাই হোক, পরে অন্য গল্প লেখার সময় খেয়াল রাখবো। অনেক ধন্যবাদ আপু পড়বার জন্য হাসি

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।