ওরা

আনন্দী কল্যাণ এর ছবি
লিখেছেন আনন্দী কল্যাণ (তারিখ: বুধ, ১৭/০৪/২০১৩ - ১:৫৫অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

কখন, কীভাবে বিস্ফোরণ ঘটবে এবং তা কে ঘটাবে সে সম্বন্ধে জানতে রাষ্ট্রযন্ত্রের এখনো বাকি……হারবার্ট, নবারুণ ভট্টাচার্য

চরিত্র এক। অনার্স থার্ড ইয়ারে পড়ে। থাকে সিলেটে। আড্ডাবাজি, ফেসবুকিং, প্রেম করার টুকটাক চেষ্টা, পাশ করে কি করবে এইসব করে তার দিন কাটে। সবকিছুই ঠিক আছে, শুধু মাঝে মাঝে আমার বন্ধু রাশেদের রাশেদের কথা তার মনে হয়। মনে হওয়ার তেমন কোন কারণ না থাকলেও আপাত নিরীহ দেখতে ছেলেটার মাঝে মাঝে রাশেদ হতে ইচ্ছা করে। কিশোর বয়সের আবেগে জীবন কাটানো কোন কাজের কথা না, সে জানে। তারপরও।

চরিত্র দুই। গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে দেশের বাইরে পিএইচডি করছে। অ্যাডভাইজারের ঝাড়ি, গ্রোসারি করা, রান্না, কোর্সওয়ার্ক ইত্যাদি করে তার দিন কাটে। পড়া শেষ করে দেশে ফিরবে কি ফিরবে না এই দোলাচলে থাকে। দেশকে নিয়ে স্বপ্ন দেখে, কিন্তু ভয়ে ভয়ে। দেশে ফেলে আসা বাবা-মা-ভাই-বোনের জন্য মন তো খারাপ হয়ই। আর মনখারাপ হয় ফেলে আসা পড়ার টেবিলের ড্রয়ারের জন্য। আপাত দৃষ্টিতে অর্থহীন টুকিটাকি জিনিস, কার্ড, ডায়রি এসবে ঠাসা ড্রয়ার। তাতে বন্দী হয়ে পড়ে আছে ছেলেমানুষী সেই কার্ড। জননী জাহানারা ইমাম কে একবার সামনাসামনি দেখার খুব ইচ্ছা ছিল মেয়েটির, ইচ্ছা ছিল পা ছুঁয়ে সালাম করার। উনি তখন চিকিৎসার জন্য আমেরিকায়, মেয়েটি একটা কার্ড বানিয়ে অপেক্ষায় থাকে, তিনি চিকিৎসা শেষে সুস্থ হয়ে ফিরলে দেখা করে কার্ডটি দিবে। স্কুল ড্রেস পড়া মেয়েটি হাত বাড়িয়ে স্পর্শ করতে চাইছে জননী সাহসিকাকে, আর তিনি হাসিমুখে মেয়েটির মাথায় হাত রাখছেন, এই ছিল বিষয় আঁকার। আর ফেরেননি তিনি।

চরিত্র তিন। এক বছর আগে এস এস সি পাস করে এখন কলেজে পড়ছে। কলেজের বাইরে ফুটবল-ক্রিকেট, ফাস্টফুড, বোনের সাথে মারপিট ইত্যাদি করে তার দিন কাটে। দেশ নিয়ে যে সে খুব ভাবে তা না। মাঝে মাঝে ভাবে। প্রতিবছর বাবা-মা-ভাই-বোন সবাই খালি পায়ে শহীদ মিনারে ভোরবেলায় ফুল দিতে যায়। সেদিন থাকে সরকারি ছুটি। বেশিরভাগ বাড়িতেই মানুষজন বেলা করে ঘুমায়। কিন্তু, তাদের বাড়ির নিয়ম আলাদা, এই দিনটার জন্য। প্রভাতফেরি, প্রভাতফেরি আমায় নেবে কি? রাস্তায় নেমে আসা আরো হাজার মানুষের সাথে গলা মিলে যায়, আমি কি ভুলিতে পারি।

চরিত্র চার। বাবা ছোটখাট ব্যবসা করেন, মা চালান একটা বুটিক। মেয়েটা পড়াশোনার পাশাপাশি মাকে সাহায্য করে ব্যবসায়। গানের গলাটা ভারি মিষ্টি। তার খুব ইচ্ছা ক্লোজ আপ ওয়ানে অডিশন দেয়ার। বাসায় এখনো কিছু বলেনি। লুকিয়ে লুকিয়ে প্র্যাক্টিস করছে। বান্ধবীর কাছ থেকে একটা গান তুলে নিয়েছে অডিশনের জন্য। কি কারণে জানে না। গানটা গাইলেই একটু পর চোখে পানি চলে আসে। গলা ভেঙে যায়। আমায় গেঁথে দাও না মাগো, একটা পলাশ ফুলের মালা, আমি জনম জনম রাখবো ধরে ভাই হারানোর জ্বালা। আসি বলে আমায় ফেলে কই যে গেল ভাই, ত্রিভুবনে কোথায় গেলে ভাইয়ের দেখা পাই।

চরিত্র পাঁচ। পড়ার বইয়ের বাইরের বই পড়ার নেশা। শহরের পুরান বই বিক্রির আস্তানায় প্রায়ই ঢুঁ মারে। স্কুলে পড়ার সময় বছরের শুরুতে নতুন বই হাতে পেলে সবার আগে বাংলা বই আর র‍্যাপিড রিডারের গল্প-কবিতা পড়ে শেষ করত। যেসব বঙ্গে জন্মে হিংসে বঙ্গবাণী, সেসব কাহার জন্ম নির্ণয় না জানি। সমাজ বইয়ে বছর বছর ইতিহাস বদল নিয়ে নানা প্রশ্ন ছিল তার। একটু বড় হবার পর নিজে খুঁজে খুঁজে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পড়ে জেনেছে অনেককিছু। একসময় ব্লগের সাথে পরিচয় হয়। অনলাইনে স্বাধীনতা-বিরোধী চক্রের সদর্প ঘোরাফেরা দেখে ক্ষুব্ধ হয়। ক্ষুব্ধ হয় মূল মিডিয়ার নিরপেক্ষতা আর মানবতার দোহাই দেয়া বিক্রি হয়ে যাওয়া বুদ্ধিজীবিদের লেখায়। একসময় লিখতে শুরু করে। আর দাবায় রাখতে পারবা না।

চরিত্র ছয়। ছোটবেলা থেকেই দেখে আসছে বাড়িতে রাজনৈতিক আলোচনা। নানারকম বিশ্লেষণ, তর্ক-বিতর্ক। স্বপ্ন দেখে সমতার, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের। বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢোকার পর জড়িয়ে পড়ে সক্রিয় রাজনীতিতে। মুক্তিযুদ্ধের যেই চেতনা নিয়ে যোদ্ধারা দেশ স্বাধীন করেছিলেন, সেটা আজ কোথায় তা নিয়ে ভাবে, কষ্ট পায়। দৈনন্দিন নানা ব্যস্ততা, রঙ-বেরঙ, বাস্তবতা, কর্কশতা সবকিছুর মাঝে কর্কশতর হয়ে যন্ত্রণা দেয়, রাজাকারের গাড়িতে একদিন দেশের পতাকা উড়েছিল।

তারপর? জানা এসব গল্পের পরিচিত আশেপাশের চরিত্রগুলো একদিন চেনা সব ছক ভেঙে, সব হিসাব গোলমাল করে দিয়ে রাস্তায় নেমে আসে। শ্লোগান ওঠে, কোন আঁতাতে এমন রায়, দেশের মানুষ জানতে চায়। শ্লোগান ওঠে, ন তে নিজামী, তুই রাজাকার, তুই রাজাকার। শ্লোগান ওঠে, জামাতে ইসলাম, মেইড ইন পাকিস্তান। শ্লোগান ওঠে, একটাই দাবি, ফাঁসি ফাঁসি। প্রশ্ন ওঠে, বেয়াল্লিশ বছর কেটে গেল, ইতিহাসের জঘন্যতম গণহত্যার বিচার কই? জননী সাহসিকা কি দেখছেন কোথাও থেকে? বছর বছর সমাজ বইয়ের বদলানো ইতিহাস পড়ে, পরীক্ষা দিয়ে, ভুল ইতিহাস লিখে ভাল নাম্বার পেয়ে এরা কোথা থেকে ঠিক চিনে নিল তাঁকে? নাহ, তাঁর কথা কোন পাঠ্যপুস্তকে নাই। হরেকরকম রাজনীতিবিদদের মুখে নাই। রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা করা হয়েছিল তাঁর নামে। তারপরেও ওরা ঠিকঠাক জেনে যায় কাকে আশ্রয় করে দাঁড়াতে হবে। কার ফেলে যাওয়া কাজ শেষ করতে হবে। আম্মা কে কেউ ভোলে নাকি? দল করা মানুষ, লীগ করা মানুষ, বাম করা মানুষ, কিছুই না করা মানুষ আসতে থাকেন। আস্তিক, নাস্তিক আসতে থাকেন। এই দেশের কিছুই হবে না ভাবতে থাকা বাবারা, সন্তানের হাত ধরে কোচিং ফেরত মায়েরা আসতে থাকেন। এত লোক কি করে যাই দেখে আসি গিয়ে টাইপ মানুষ আসতে থাকেন, এবং তারপর বারবার ফিরে ফিরে আসতে থাকেন। পৃথিবীর প্রান্তে প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা ওরা দাঁড়িয়ে পড়ে একই দাবীতে। প্রাণের দাবীতে শহরে শহরে ছড়িয়ে পড়ে জাগরণ।

আর অন্যদিকে চলতে থাকে ছক না মানা, কাঠামো না মানা এই আন্দোলন কে লাইনে আনার হিসাব-নিকাশ। ভোটের হিসাব কষতে থাকা রাজনৈতিক দলগুলির ফুটবল খেলা। সাথে চলে অশুভ শক্তির অপতৎপরতা। ছলে, বলে, কৌশলে। রাজনৈতিক দল, রাষ্ট্র, আইন, মিডিয়া, ধর্ম, বুদ্ধিজীবি, লেখক কাউকেই ব্যবহার করতে তারা ছাড়ে না। স্বচ্ছতা, নিরপেক্ষতা, আন্তর্জাতিক মান, ফ্যাসিবাদ এবং মানবতাবাদ এই শব্দগুলি পরিস্থিতি ঘোরাতে বেশ উপকারে লাগে অনেকের। বেহিসাবী কোনো কিছু হাজির হলে সেটা সামলানোর মতো শব্দও যথারীতি এসে হাজির হয়। নাস্তিক। বেশ্যা।

এই গল্পের শেষটুকু অজানা এখনো। কিন্তু, এটুকু জানা যে পরিচিত আশেপাশের এসব চরিত্র সংখ্যায় বাড়ছে, প্রতিজ্ঞায় বাড়ছে। কলেজে পড়া যেই ছেলেটির দেশপ্রেম প্রভাতফেরিতে যাওয়ার মাঝে সীমাবদ্ধ ছিল একসময়, সে এখন ভাবছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে উঠে বন্ধুদের নিয়ে ছোট ছোট দল করে গ্রামে গ্রামে গিয়ে মানুষকে বোঝাবে। মৌলবাদ, কুশিক্ষা যে আমাদের অনেক পিছিয়ে দিচ্ছে তা জানাবে। সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই, এই কথা সে আর শুধু পরীক্ষায় ভাল নাম্বার পাওয়ার জন্য লিখবে না, অন্য ধর্মের বন্ধুটির ক্ষতগুলি বোঝার চেষ্টা করবে। সিলেটের ছেলেটি ভাবছে কেন তার বয়সী একটা ছেলে স্বাধীনতাবিরোধী চক্রের সাথে হাত মেলায়, একই দেশে কেন আমরা একই স্বপ্ন দেখি না? দেশে ফিরবে কি ফিরবে না এই দোলাচলে থাকা মেয়েটি ভাবে সে দেশে ফিরে যাবে, একবার শেষ চেষ্টা করে দেখবে। ওরা বলছে, যতবার একজনের লেখার স্বাধীনতায় আঘাত আসবে, আরো একশজন নতুন লেখক তৈরি হবে। যতবার কোনো মেয়েকে অপমান করে গল্প লেখা হবে, তার প্রতিবাদে আরো একশটি গল্প লেখা হবে। আমার প্রতিবাদের ভাষা,আমার প্রতিরোধের আগুন, দ্বিগুণ জ্বলে যেন, দ্বিগুন দারুণ প্রতিশোধে।

ওরা পড়ছে সেই চিঠিটা। মরণব্যাধি ক্যান্সার আমাকে শেষ মরণ কামড় দিয়েছে। আমি আমার অঙ্গীকার রেখেছি। রাজপথ ছেড়ে যাই নি। মৃত্যুর পথে বাধা দেবার ক্ষমতা কারো নেই। তাই আপনাদের কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছি এবং অঙ্গীকার পালনের কথা আরেকবার আপনাদের মনে করিয়ে দিতে চাই। আপনারা আপনাদের অঙ্গীকার ও ওয়াদা পূরণ করবেন। আন্দোলনের শেষ পর্যায় পর্যন্ত ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ে থাকবেন। আমি না থাকলেও আপনারা আমার সন্তান-সন্ততিরা - আপনাদের উত্তরসূরিরা সোনার বাংলায় থাকবেন।

ওরা বলছে, আমরা সকল যুদ্ধাপরাধীর সর্বোচ্চ শাস্তি চাই। আমরা রাজাকারের ফাঁসি চাই। আমরা গণহত্যা, ধর্ষণের বিচার চাই। যতদিন না পর্যন্ত এর মীমাংসা হবে, আমরা বিচার চাইব। আরো দশ বছর, বিশ বছর, ত্রিশ বছর...দেশ থেকে, দেশছাড়া করলে দেশের বাইরে থেকে, পৃথিবীর কোন এক প্রান্ত থেকে, পৃথিবী ছাড়া করলে পরবর্তী প্রজন্ম কে বলে যাব, শিখিয়ে যাব বিচার চাইতে। যেন ভুলে না যাই। বেদনা পাই, শয়নে স্বপনে।


মন্তব্য

লাবণ্যপ্রভা  এর ছবি

জানিনা এ গল্পটা কবে কিভাবে শেষ হবে, তবে সত্য সূর্যের মত - প্রকাশ পাবেই যত বিপত্তিই আসুক না কেন।

কড়িকাঠুরে এর ছবি

আমরা সকল যুদ্ধাপরাধীর সর্বোচ্চ শাস্তি চাই। আমরা রাজাকারের ফাঁসি চাই। আমরা গণহত্যা, ধর্ষণের বিচার চাই। যতদিন না পর্যন্ত এর মীমাংসা হবে, আমরা বিচার চাইব। আরো দশ বছর, বিশ বছর, ত্রিশ বছর...দেশ থেকে, দেশছাড়া করলে দেশের বাইরে থেকে, পৃথিবীর কোন এক প্রান্ত থেকে, পৃথিবী ছাড়া করলে পরবর্তী প্রজন্ম কে বলে যাব, শিখিয়ে যাব বিচার চাইতে। যেন ভুলে না যাই। বেদনা পাই, শয়নে স্বপনে।

চলুক

সুহান রিজওয়ান এর ছবি

আপনার লেখা আমার খুব পছন্দের।

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

দারুণ...

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

চলুক

স্যাম এর ছবি

চলুক

শিশিরকণা এর ছবি

চলুক

~!~ আমি তাকদুম তাকদুম বাজাই বাংলাদেশের ঢোল ~!~

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

গল্পে ইতিহাস, বিশেষত উপেক্ষিত ইতিহাসের বর্ণনা থাকার এই স্টাইলটা আমি পছন্দ করি। খোদ নবারুণ ভট্টাচার্য এই কাজটা বহু বার করেছেন। সুন্দর, গোল গোল কাল্পনিক কাহিনী না বানিয়ে সাধারণ মানুষের পর্যবেক্ষণ, উপলদ্ধি আর আশার কথাগুলো ফুটিয়ে তুললেও ভালো গল্প হয়।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

মর্ম এর ছবি

গতকালকেই আপনার গান শুনতে শুনতে মনে হচ্ছিল- ইশ একটা নতুন গল্প যদি লিখতেন!

~~~~~~~~~~~~~~~~
আমার লেখা কইবে কথা যখন আমি থাকবোনা...

তানিম এহসান এর ছবি

প্রভাতফেরি, প্রভাতফেরি আমায় নেবে কি!

পোস্ট দারুণ অনুপ্রাণিত করলো, মনে হচ্ছে যে চরিত্রগুলোকে প্রতিদিন শাহবাগে দেখেছি তাদের নিয়ে এভাবে লিখি।

বহুদিন পর লিখলেন। চলুক

তমসা এর ছবি

"ওরা"ই একদিন সবাইকে বলতে বাধ্য করবে "আমরা" .................. করবেই করবে............ এ শুধু স্বপ্নময় আশা নয়.................. দৃপ্ত অঙ্গীকারে ভরা বিশ্বাস।

তারেক অণু এর ছবি
আনন্দী কল্যাণ এর ছবি

সবাইকে অনেক অনেক ধন্যবাদ পড়বার জন্য হাসি

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।