মৌসুমী মানবাধিকারবারী (মৌমা)

আনু-আল হক এর ছবি
লিখেছেন আনু-আল হক [অতিথি] (তারিখ: মঙ্গল, ২২/০৭/২০১৪ - ১২:৪২অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

সাম্প্রতিককালে সুশীল সমাজের পাশাপাশি মানবাধিকার বস্তুটি যথেষ্ট জনপ্রিয় ওঠার উপ্রক্রম হলে বঙ্গদেশের আনাচে কানাচে মানবাধিকার সংগঠন এবং মানবাধিকারবারী গজিয়ে উঠছিল বেশ। মানবাধিকারবারীকে অনলাইন প্লাটফর্মে বাংলায় আক্তিভিস্ত বলা হয়। ইহা ছাড়াও ভলান্তিয়ার, কিংবা সোস্যাল ওয়ার্কার ইত্যাদি অধুনা খুব সেক্সি। ষাট-সত্তরের দশকে যেমন ছিল বাম রাজনীতি। তখন নাকি প্রেমের দুনিয়ায় বামদের ব্যাপক দৌরাত্ম! বাম রাজনীতিবিদদের সঙ্গে বাম রাজনীতির সম্পর্ক দু:সম্পর্কের প্রেমিকার মত ছিল বলে একদা-বাম পরে হেলতে হেলতে ডাইনে যাওয়ার আর অবকাশ রাখেন নাই!

রাজনীতির সুবিধা মেলা। বহুদিন যাবত ছাইঞ্ছে পড়লেও ছায়েন্টিস্ট হওয়ার গ্যারান্টি নাই, দর্শনে পড়ার পর দার্শনিক হওয়ার সম্ভাবনা কইমা যাইতে দেখা যাইতেসে, অথচ রাজনীতিবিদ হইতে গেলে রাজনীতি পড়ার কোনো প্রশ্নই আসে না। একইভাবে মানবাধকারবারী, ভলান্তিয়ার বা সমাজসেবক ওরফে সোস্যাল ওয়ার্কার হইতে চাওয়ার মাজেজা অনেক। শুধু নিজে নিজে ভাববেন, মনে মনে বলবেন "ধুন খায়া ফুন"; ব্যাস আফনে হইয়া গেলেন "যা-হইতে-চাইসেন-তাই"... বলেন সুভানাল্লাহ!

এইসব গুরুত্বপূর্ণ টাইটেল ঠিক মৌলানা, আল্লামা, মুফতি, যুক্তিবাদী, তর্কবাগীশ, ডা. ইত্যাদির মত। এগুলো বেশ সফলভাবেই অনিয়ন্ত্রিত বাংলাদেশে। এগুলো অনেকটা 'যেমন খুশি সাজো' টাইপের। আল্লামা তথা জ্ঞানীর কথায় জ্ঞানের সামান্যতম প্রকাশ অযাচিত; যুক্তিবাদী যুক্তির আশপাশ দিয়েও যান না; ইস্লামিক আইনকানুনের বিশেষজ্ঞ না হয়ে মুফতি হন গ্রেনেড হামলার চৌকস পরামর্শক; নামের আগে ডা. লাগায়া মানুষ মারার বৈধতা পাওয়া যায়।

মূল আলাপে আসি। সোস্যাল ওয়ার্কার হওয়ার শ্রেষ্ঠ সময় যখন আপনি ফুলটাইম বেকার। ওই সময় যা করবেন বা করার নিয়ত করবেন, সেইটা না-করাটাই যে সমাজের জন্য কতটা উপকারী সেইটা আপনি ছাড়া বাকি সবাই জানে। অতএব নি:সংকোচে নিজেরে সমাজসেবক দাবি কইরা বস্পেন।

ভলান্তিয়ার তো সম্প্রতি মুড়ি-মুড়কির মত পয়দা হইতেসে। বৈদেশে পড়তে যাওয়ার নিয়ত করামাত্রই টের পায় যে ভলান্তিয়ার হইলে দরখাস্ত বেশ মজবুত হয়। ব্যাস, বঙ্গদেশের যে-কোনো একটি "ভলান্তিয়ার উৎপাদন ও বাজারজাতকরণ" সংস্থার সদস্য হন, দুর্দান্ত একটা টি-শার্ট (হইলদা এবং লোগো-আলার ডিমান্ড বেশি) গায়ে চড়ান, প্রেমিক (বা প্রেমিকা) এবং বন্ধুদের নিয়ে বনভোজনে যান, আর ধুমায়া ছবি তোলেন। কয়েকটা আবার পথশিশুদের সঙ্গে তুইলেন। কিন্তু সাবধান, বেশি উত্তেজিত হইয়া নিজেই নিজেরে ভলান্তিয়ার বৈলা বস্পেন না। আপনে না 'শাই' (লাজুক বলবেন না); আপনে না আর্থিং করেন (ডাউন-টু-আর্থ)!

পথশিশুদের সঙ্গে তোলা ছবিগুলান পোস্টান; ক্যাপশন দিতে পারেন: "ফিলিং বেলেস্ড উইদ পথশিশুজ"... কথা বেশি বৈলেন না-- শুধু পিক দেন; আ পিকচার সেইজ মোর দ্যান আ থাউসেন্ড ওয়ার্ডস!! এখন আপনের যেই কয় হাজার ওয়ার্ড লাগে সেই অনুযায়ী পিক দেন। আপনি অলরেডি ভলান্তিয়ার; এখন শুধু সামাজিক স্বীকৃতি। সেইটাও নিজে নিজে করতে যাইয়েন না। আরে মিয়া আপনে এখনো শাই তো!

তার চাইতে আপনে আপনার বন্ধুদের ভলান্তিয়ার্গিরির প্রশংসা করেন, বন্ধুরা আপনার করুক। এইভাবে পারস্পরিক পিঠ-ঘষাঘষির মধ্য দিয়ে আপনারা সকলেই ভলান্তিয়ার হইয়া উঠলেন। আমিন।

পথশিশুদের পথশিশুত্ব জাদুঘরে পাঠানোর পিছনে (জ্বী, পেছনেই) আপনার ঐতিহাসিক অবদানের পরেও তো আপনে যে 'শাই', এবং আপনে যে আর্থিং করেন সেইটা তো সবাই জাইনা গেল। এইদিকে আপনার মা এবং আপনার উম্মত তথা অনুসারীরা প্রায়শই আপনার ওয়াল-এ আপনাকে স্মরণ করিয়ে দেন যে গোটা দুনিয়ার মানুষের জন্য নিজের জীবন এইভাবে আজকাল আর কেউ উৎসর্গ করে না; নিজের জন্য সামান্য কিছু হইলেও আপনার করা উচিত। আর তাছাড়া আপনে তো দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়ার সময় বিস্কুট দৌড়ে তৃতীয় হইসিলেন; মেধার এই অপব্যবহার কেন!

আপনার আর আক্তিভিস্ত হওয়া ঠেকায় কে! আপনার বেল্টের নিচে (আরো কিছু অত্যাবশ্যকীয় যন্ত্রপাতিসহ) যথারীতি ভলান্তিয়ারগিরী এবং সমাজসেবার প্রত্যয়নপত্র আছে। কিন্তু খুব সাবধানে, খুব খিয়াল কৈরা!

আক্তিভিস্ত হইতে আইসা দেখলেন মেলা ঝামেলা; খেলার সঙ্গে রাজনীতি খালি মিশ খায়া যাইতে চায়। ছোট ওড়না দিয়া বড় ঘোমটা দিতে গেলে যেমন আরো বড় কিছু অবারিত হয়, তেমনি প্রিয় খাবারের তালিকা থেকে কাঁঠাল পাতা লুকাইতে গিয়া দেখলেন ল্যাঞ্জা বাইরায়া যাওয়ার দশা। আপনি দীর্ঘ অপেক্ষার পর রানা পেলাজা পাইলেন। ধর তক্তা মার পেরেক। ধুমায়া পোস্টান। 'লাইক' বাড়ানোর এই তো সুমায়। কিন্তুক আবার যে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রসঙ্গ আসে! আপনে এখন বিচারক হইয়া গেলেন, মানে আপনেও 'বিচলিত' হন! এইটা নিয়া কথা বললে অনেকেই নাখোশ হবেন, অনেকেই আপনারে আর স্যালমন (ল বাদ দিবেন কেন! ল্যাঞ্জা কি দোষ করসে!) ফিশ দিবে না উয়িন্টারে, গাড়িতে কইরা সুপারমার্কেটে বাজার করতে লিবে না, পট-লাকের মতন ’মাসিক’ অনুষ্ঠানগুলো থেকে আপনে বাদ পড়বেন (অথচ চিকিত্সাশাস্ত্রে মাসিকের আশেপাশের সময়টাই 'নিরাপদ' বলা হইসে!).. অনিবার্যভাবেই আপনার পোস্টে লাইকের পরিমাণ কইমা যাবে! কিন্তু আপনে আবার নিরপেক্ষও থাকতে চাইতেসেন; কোন সুমায় আবার তত্বাবধায়ক সরকার থেকে আপনার ডাক আসে! তাই, আপনে গুপনে শাহ্বাগিদের মেসেজ দিয়ে জানান যে আপনে আছেন 'মেন্টালি এন্ড ইন স্পিরিট', কারণ শারীরিকভাবে তখন আপনি অন্যত্র বিরাজ করবেন। "দেহ পাবি তো মন পাবি না"র কাউন্টার-ন্যারেটিভ আর কি!

কিন্তুক আবার হ্যাপা-জোট প্রসঙ্গ আসে। আপনে তখন দেখলেন আর উপায় নাই। এইবার ফেইসবুক সাময়িকভাবে ডিএক্টিভেট করে রাখেন; তার আগে একটা পোস্ট দেন যে আপনের অতিজরুরি পরীক্ষা আছে। অন্য নিকের একাউন্ট থেকে খিয়াল রাখেন পরিস্থিতি। আইসা পড়ল সংখ্যালঘু হামলা। আপনে তো দেখলেন মহা ফাঁপর। হঠাৎ দেখলেন কে একজন লেখসে এইটা হিন্দুদের সাজানো নাটক, আর র-এর তত্বাবধানে সরকার এই নাটকের প্রযোজক। লাইনে আসেন। পোস্ট করতে শুরু করেন বেদম। আবার বোকো হারাম নাইজেরিয়ার স্কুলছাত্রীদের অপহরণ করলে বন্ধ করে দেন একাউন্ট। উগান্ডার সমকামীদের অধিকার নিয়ে প্রবন্ধ লেখেন, কিন্তুক গাজায় মানুষ মারলে তখন মিয়ানমারকে সার্কে আনার বিষয়টা অনিবার্য হয়ে পড়ে। সাকিবকে কিভাবে ষড়যন্ত্র করে বেপরোয়া কথা বলতে উদ্বুদ্ধ করা হইসে সেইটা নিয়া আপনে রীতিমত কান্দাকাটি করলেন। আইএসআইএস-এর কর্মকান্ডের সময় আবার "এন ইন্টারন্যাশনাল পিল্ম পেস্টিবাল অন লোকাল সেল্ফ-আক্লেম্ড পিল্ম-মেকার্স" উত্সবের খবর দিয়া ওয়াল ভরাইয়া রাখেন, বা শীতের কাপড়ে প্যাঁচানো একটা বাচ্চার ছবি অখ্যাত কোনো সাইট থেকে নিয়ে পোস্ট দেন: "পর্দানশীন এই কিউট বাচ্চাটার জন্য কয়টা লাইক?" গাজায় গণহত্যার কথা আপনে বলেন কারণ মুসলমান মারা হইতেসে বৈলা, খোদ নিজের দেশে গণহত্যার বিষয় আসলেই খেলার সঙ্গে রাজনীতি মিশ খায়। গাজায় গণহত্যা দেইখা হিটলার আপনার নেতা হইয়া যান।! কনগ্রাচুলেশনস! আপনাকেই খুঁজছে বাংলাদেশ। আপনিই মৌসুমী মানবাধিকারবারী সংক্ষেপে মৌমা।

আফনে গাজায় হামলা নিয়া মানববন্ধন করলেও লুকজন যাইতে চায় না কারণ আফনার ল্যাঞ্জার জেনমিক্স পর্যন্ত প্রকাশিত হইয়া গেসে। আফনে কিছু ভালো কাজের সঙ্গে থাকেন অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে (মানে সময়মতো) পল্টি মারার জন্য। প্রথমটা করেন মাইনষের আস্থা অর্জন করে পরে টিস্যু পেপার সাপ্লাই দেবেন বলে: আপনার সঙ্গে পীরিতের পর সেই টিস্যু চোখ কিংবা পশ্চাদ্দেশ কিংবা উভয়টিই শুকানো/পরিষ্কার করার কাজে ব্যবহৃত হতে পারে।


মন্তব্য

মেঘলা মানুষ এর ছবি

চলুক

আনু-আল হক এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

----------------------------
নয় মাসে হলো তিরিশ লক্ষ খুন
এরপরও তুমি বোঝাও কি ধুন-ফুন

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

চলুক

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

আনু-আল হক এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

----------------------------
নয় মাসে হলো তিরিশ লক্ষ খুন
এরপরও তুমি বোঝাও কি ধুন-ফুন

রাজিব মোস্তাফিজ এর ছবি

হুলে ভরা হলাহল দেখি পুরা!
ভাল্লাগসে!
আক্তিভিস্ত, ভলান্তিয়ার, হ্যাপা-জোট প্রমুখ শব্দচয়নও খুউব ভাল্লাগসে!

----------------------------------------------------------------------------
একশজন খাঁটি মানুষ দিয়ে একটা দেশ পাল্টে দেয়া যায়।তাই কখনো বিখ্যাত হওয়ার চেষ্টা করতে হয় না--চেষ্টা করতে হয় খাঁটি হওয়ার!!

আনু-আল হক এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা- রাজীব

----------------------------
নয় মাসে হলো তিরিশ লক্ষ খুন
এরপরও তুমি বোঝাও কি ধুন-ফুন

এক লহমা এর ছবি

চলুক

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

আনু-আল হক এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

----------------------------
নয় মাসে হলো তিরিশ লক্ষ খুন
এরপরও তুমি বোঝাও কি ধুন-ফুন

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।