ফেসবুকে মজার ভিডিও বা ছবি: উদ্দেশ্য এবং বিধেয়

আনু-আল হক এর ছবি
লিখেছেন আনু-আল হক [অতিথি] (তারিখ: বুধ, ১০/০৬/২০১৫ - ৪:৪৮অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

ফেসবুক বহুবিধ কারণে ব্যবহৃত হয়: সেলফি থেকে শুরু করে সামাজিক আন্দোলন, রক্তদান কর্মসূচী থেকে শুরু করে বোলগার খুন, সবই। অতএব, ফেসবুক খারাপ কি ভালো, সেটা নির্ভর করে কে কী উদ্দেশে কীভাবে ব্যবহার করছে সেটার উপর। এই আজাইরা কথাটা না-পাড়লেও চলেতো। আজকের আলোচ্য বিষয় নিয়ে যা বলতে চাই, সেটা শুরু হওয়ার কথা ছিলো দ্বিতীয় প্যারা থেকে। অতএব, প্রথম প্যারার এখানেই সমাপ্তি।

পৃথিবীতে সম্ভবত সবচেয়ে জরুরী, ফলত সবচাইতে কঠিন, বিষয় হাস্যরস। হাস্যরস কোনো এক অদ্ভুৎ কারণে আমাদের সুখ-শান্তির প্রায়-একমাত্র প্রকাশমাধ্যম হয়ে দাঁড়িয়েছে, এবং আমরা সহাস্যচিত্তে সেটা মেনেও নিয়েছি। সে-কারণেই হয়তো, এই হাসিই এক ভয়ানক হাতিয়ার হিসাবে সুখ্যাতি লাভ করেছে। সবাই জানেন, লাস্যময়ী রমণীর ভূবনমোহিনী হাসির পেছনে সর্বদা প্রেম থাকে না, থাকে সর্বস্ব হরণ করার বাসনাও; মিষ্টিকথা বলেই কিন্তু পকেট পগারপার করে দেয় মাহামান্য পকেটমার কিংবা ক্যানভাসার; চিকন হাসি দিয়েই অধ্যাপক ধরিয়ে দেন ভিটামিন সি (গ্রেড); রম্যরচনার আপাত-মজার পেছনে থাকে অপরিশোধিত প্রাকৃতিক বাঁশ। অতএব, হাসি দেখলেই সব ভুলে সেদিকে এগিয়ে যাওয়া খুব সুখকর না-ও হতে পারে।

মানে দাঁড়াচ্ছে, ক্ষেত্রবিশেষে হাসির উদ্দেশ্য হচ্ছে উদ্দেশ্য হাসিল করা। কিন্তু হাসিই একমাত্র হাতিয়ার নয়: এর মূলমন্ত্র হচ্ছে আপনার পছন্দের বিষয় কিংবা দুর্বল জায়গায় আঘাত করা। যেমন, আপনার দুঃসম্পর্কের প্রেমিকাকে অপহরণ করে আপনার কাছ থেকে নিশ্চয়ই ক্ষতিপুরণ নেয়ার জন্য ফোন করবে না, করবে আপনার নিকটতম আত্মীয়কে অপহরণ করেই। সেই মূলমন্ত্র ধারণ করে, ছাগল মোটাতাজাকরণ প্রকল্পের আওতায় বাংলাদেশে মোটা দাগে দুটো বিষয়কে হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করা হয়: (১) ধর্ম, (২) মজার/বিস্ময়কর ভিডিও।

দুটোই কিন্তু আপাতদৃষ্টিতে খুবই নির্জঞ্ঝাট বিষয়। কিন্তু একটু তলিয়ে দেখলেও তলাটা পরিষ্কার বোঝা যায়:

১। প্রথমে ফেসবুক পেইজের নাম দিতে হবে ধর্মভিত্তিক (বাংলাদেশে সেটা ইসলামভিত্তিক), এবং অথবা বিস্ময়কর/মজার ভিডিও/ছবি ইত্যাদি।

২। এরপর ওই পেইজে ধর্মভিত্তিক/হাসির/মজার/বিস্ময়কর ছবি/ভিডিও আপলোড দেয়া হয়।

৩। সবাই এসব বিষয় পছন্দ করেন, এবং তুমুল শেয়ার/লাইক দিতে থাকেন। তাদের পেইজের ফলোয়ার বাড়তে থাকে। প্রচারেই প্রসার।

৪। এরপর ল্যাঞ্জাটি সুড়ুৎ করে বেরিয়ে পড়ে, ঠিক এইভাবে--
[*] রাজাকার কাদের মোল্লাকে শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লা হিসাবে প্রচার করেন কেউ কেউ, বাকিরা দেশের সার্বিক অরাজক পরিস্থিতির মাধ্যমে মূলতঃ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধের ইঙ্গিত দেন। বার্গুদা কিংবা টবিজীর বোলোগ/ভিড্যু শেয়ার দেন।

[*] বোরখা/হিজাবের গুরুত্ব বোঝানোর আড়ালে প্রকারান্তরে যাঁরা বোরখা/হিজাব পরেন না, তাঁদেরকে অভিশাপ দেয়া হয়। এমনকি, এসব অনৈসলামিক পোষাক (এবং পোষাক পরিধানকারীরাই) যে ধর্ষণের প্রধান কারণ, সেটা ইনিয়ে-বিনিয়ে প্রচার করেন।

[*] অমুসলিমপ্রধান দেশে মুসলিমদের হিজাব/বোরখা পরার স্বাধীনতার কথা উচ্চস্বরে বলা হয়, কিন্তু মুসলিমপ্রধান দেশে অমুসলিমদের স্বাধীনতা (তথা তাঁদের পছন্দ অনুযায়ী পোষাক পরা, খাওয়া ইত্যাদি) অস্বীকার করা হয়।

[*] গাজার বোমা হামলার ছবি/ভিডিও শেয়ার করা যায়, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে গণহত্যার কথা ভুলক্রমেও প্রাসঙ্গিক মনে হয় না তাদের। মিয়ানমারে মুসলিমদের মানবাধিকার নিয়ে সোচ্চার, কিন্তু আইসিস যে বিশ্বব্যাপী মানুষ (মুসলিমসহ) হত্যা করছে, সেটা নিয়ে কী সুনসান নীরবতা!

এইরকম তালিকা দিতে থাকলে দুনিয়া তালিকাময় হয়ে যাবে, কিন্তু তাহাদের কথা শেষ হইবে না। তারা কিন্তু এসব হুট করে দেবে না; আগে মানুষের আস্থা অর্জন করবে, তারপর তাদের উদ্দেশ্য হাসিলের লক্ষ্যে এগিয়ে যাবে। লক্ষ্য অর্জনে তারা এতোটাই বুঁদ হয়ে থাকে যে, অহরহ মিথ্যার আশ্রয় নিতেও তারা এতটুকু পিছপা হয় না। কোথায় কোন গাছ কালেমার আকার ধারণ করেছে সেটার মিথ্যা ছবি, কোন কোন বিখ্যাত ব্যক্তি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছেন ইত্যাদি মিথ্যা প্রচারণা। যারা শেয়ার করেন, তারা নিজেরাও যে জেনে করেন সবসময়, সেটা সঠিক নাও হতে পারে। কারণ, ধারণা করা অসঙ্গত নয় যে, এসব কাজ করে প্রায়-মূর্খ ধর্মান্ধ মানুষ। এরা নিজেরাই বলে ছবি তোলা/প্রচার করা হারাম, অথচ নবীর পাদুকার মিথ্যা ছবি, কবরের মিথ্যা ছবি দিয়ে সয়লাব করে ফেলে। এসবের মধ্য দিয়ে ধর্মের উপকারের পরিবর্তে অপকারই বেশি হয় (আল্লাহ’র ঠেকা পড়ে নাই, গাছকে কালেমার আকার ধারণ করিয়ে অাল্লাহ’র অস্তিত্ব জানান দিতে হবে)। কিন্তু এসব প্রচারের মাধ্যমে ধর্মভিত্তিক ঘৃণা-বিদ্বেষ-হানাহানির পথ সুগম হয় বলেই এতো কথা।

যারা এসব কায়দায় সিদ্ধহস্ত, সেটার একটা তালিকা করতে পারলে সবারই সুবিধে হয়। সবার সহযোগিতায় তালিকাটা সম্পূর্ণ (হালনাগাদ) করতে পারলে ভালো হতো। এখানে একটা তালিকা আছে। কিন্তু রেডিওমুন্না সহ আরো আরো রেডিওর নাম নাই। ছাগু এবং ছাগুবান্ধব ফেসবুক পেজগুলোর একটা হালনাগাদ তালিকা থাকলে খুবই ভালো হতো। কেউ কি উদ্যোগ নেবেন?

মূলে ফেরত আসি। তো, যারা শেয়ার দেয়, তারা না-হয় অনেক সময় না-জেনে দেয়। যদিও বেশিরভাগ সময় জেনে দেয় বলেই ধারণা করা দস্তুর। হেফাজতের সমাবেশ থেকে শুরু করে সুন্দরবন হয়ে মিয়ানমারের ঘটনার অধিকাংশ প্রচারণাই মিথ্যা ছবি দিয়ে ভরপুর:

মিয়ানমার লিংক ১:

মিয়ানমার লিংক ২:

মিয়ানমার লিংক ৩:

বাংলাদেশ লিংক (এটি বেশ তথ্যবহুল)।

(বি.দ্র.: এই লিংকগুলো দেয়ার উদ্দেশ্য এই নয় যে, মিয়ানমারে, বা সুন্দরবনে কিছুই হয়নি। কিংবা হেফাজতের সমাবেশে একজনও মারা যায়নি। আমরা কেবল মিথ্যা দিয়ে সত্য প্রমাণ করার নোংরা প্রক্রিয়ার সমালোচনা করছি। সত্যের প্রমাণ কেবল সত্য দিয়েই হোক।)

কিন্তু বাকিরা কি না-জেনেই, না-বুঝেই সেগুলো শেয়ার দেন? সেটাও তো ক্ষতিকর। বুঝি, মাঝে মাঝে মজার/বিস্ময়কর ছবি/ভিডিও খুবই লোভনীয়, লাইক/শেয়ার দিতে ইচ্ছে করে। কিন্তু, সেসব শেয়ার করলে তাদের পেইজের প্রসার হয়, এবং প্রচার হয় তাদের দুর্গন্ধযুক্ত মানসিকতারও। কিন্তু সেইসব ছবি/ভিডিও শেয়ার যদি করতেই হয়, তাহলে ডাউনলোড করে নিজে আবার পোস্ট দেন। ছবি ডাউনলোড করা সহজ, ভিডিও কঠিন (মনে হয়)। নিচে ফেইসবুক থেকে ভিডিও ডাউনলোড করার কায়দা বাংলায় দেয়া হলো। মূল সূত্র:

১। প্রথমে খেয়াল করুন: জনাব ওমুক shared this VIDEO.

২। shared this VIDEO-র VIDEO-তে ক্লিক করুন।

৩। এবার ইমেজ লিংক (টাইটেল বার)-এর www-এর স্থলে m টাইপ করুন।

৪। এরপর ভিডিও প্লে করুন।

৫। ভিডিও চলা অবস্থায় ডান ক্লিক করে Save video as-এ ক্লিক করুন, এবং ভিডিও সেভ করুন আপনার পছন্দসই ফোল্ডারে।

সাবধানতা: ছবি বা ভিডিওতে জলছাপ দিয়ে কোনো ওয়েবসাইট ইত্যাদি দেয়া থাকলে অভিজ্ঞদের পরামর্শ নিন। একেবারেই সম্ভব না হলে নিজে দেখুন, কিন্তু লাইক/শেয়ার দিয়ে সেটার প্রচারে ঝাঁপিয়ে পড়বেন না। একটা (বা কয়েকটা) ছবি/ভিডিও অন্যরা না-দেখলে এ-জীবন তেমন অর্থহীন হবে না। সুন্দরের শেষ নেই। কিন্তু লেখা শুরু করলে শেষ করতে হয়। তাই করলাম।

ছবি: 
01/06/2007 - 1:46পূর্বাহ্ন

মন্তব্য

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

বিশ্বাসে মিলায় ফেসবুক, তর্কে বহুদূর... চোখ টিপি

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

আনু-আল হক এর ছবি

বিশ্বাসে মিলায় ফেসবুক, আর তর্কে মিলিয়ে যায় বিশ্বাস? চোখ টিপি

----------------------------
নয় মাসে হলো তিরিশ লক্ষ খুন
এরপরও তুমি বোঝাও কি ধুন-ফুন

সুবোধ অবোধ এর ছবি
আনু-আল হক এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

----------------------------
নয় মাসে হলো তিরিশ লক্ষ খুন
এরপরও তুমি বোঝাও কি ধুন-ফুন

অতিথি লেখক এর ছবি

চলুক

দেবদ্যুতি

আনু-আল হক এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

----------------------------
নয় মাসে হলো তিরিশ লক্ষ খুন
এরপরও তুমি বোঝাও কি ধুন-ফুন

অতিথি লেখক এর ছবি

মুশকিল হলো ফেসবুক ব্যবহারের জন্য কাউকে কোন পরীক্ষা দেয়ার দরকার হয় না যেমন মোবাইল ফোন ব্যবহারেও । সার্বজনীনতার এইটা প্রধান নেতিবাচক দিক হচ্ছে সার্বজনীন গুজবে সার্বজনীন অংশগ্রহন । একজন মানুষ !!! সেইটাই শেয়ার দিবে যা সে বিশ্বাস করে আর সে তাই বিশ্বাস করে যা সে বিশ্বাস করতে চায় । এর সাথে ক্রস রেফারেন্স এর কোন সম্পর্ক নাই । লাভের মধ্যে রেডিও কলিমুদ্দি বা কঞ্চির কেল্লারা টু পাইস কামিয়ে নিচ্ছে এই যা আর ধর্মভীতু !!! মানুষগুলোর মানষিক শান্তি এই ভেবে যে উহ একটা বিরাট ধার্মিক কাম করে ফালাইসি ।

একটা পেজের কাজ শুরু করেছি গুজব নিয়েই সেইটা প্রাথমিক গাথুনির মধ্যেই আছে । ভীত মজবুত হলেই দেশীয় ও ধার্মিক গুজবগুলোর বিষয়ে কাজ শুরু হবে । এইরকম জিনিসগুলো করা দরকার যাতে অন্ত:ত অর্ধেক ভাসমান বিশ্বাসীদের বিশ্বাস অন্ধত্বে পরযবাসিত না হয় ।

মোস্তফা কামাল

আনু-আল হক এর ছবি

সহমত।

গুজব বিষয়ক পেজের জন্য শুভকামনা। কাজ হলে জানায়েন।

----------------------------
নয় মাসে হলো তিরিশ লক্ষ খুন
এরপরও তুমি বোঝাও কি ধুন-ফুন

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।