আমাদের দেশে কি আর কোনওদিন বিপ্লব হতে পারে? যে জাতির একটা স্লোগান থাকে না, তারা কি কোনওদিন বিপ্লব করতে পারে? আমাদের আজকে কোন একক স্লোগান নাই। “রাজাকারের ফাঁসি চাই” এই স্লোগানের নিচেও আমরা বিভক্ত। এই স্লোগানটাও আমাদের জাতীয় স্লোগান হতে পারল না। ‘জয়বাংলা’র পরিণতি বরণ করতে হল একেও। আমার মনে হয়, ৭১ পর্যন্ত যা হবার হয়ে গেছে, এই বাংলাদেশে আর কোনওদিন কোনও বিপ্লব হওয়া সম্ভব নয়। হবেও না।
আজকের বাংলাদেশে আমি কোনও মুসলমান দেখি না। হিন্দু দেখি না। এখানে বৌদ্ধও নাই। খৃষ্টানও নেই। এই দেশে আজ আর কোন সাহসী নাই। ভীতু নাই। সেক্যুলার নাই। মৌলবাদি নাই। বাম ডান কিছুই নাই। গোঁড়া নাই, মুক্তমনা নাই। আমি আজকের বাংলাদেশে শুধু দুইটা ধর্ম দেখি; দুইটা দল দেখি; মাত্র দুইটা ইজম - বিএনপি আর আওয়ামীলীগ। গোটা বাংলাদেশ আজকে শুধু এই দুইটা ধর্মের চর্চা হচ্ছে। এই বিচিত্র দেশের আইনজীবি বলেন, দার্শনিক বলেন, ডাক্তার বলেন, আলেম-ওলামা বলেন, মুক্তিযোদ্ধা বলেন আর নিরপেক্ষ তত্বাবধায়ক সরকার-প্রধান’ই বলেন সবাই মূলতঃ এই দুই ধর্মের চর্চা করেন। আর এই চর্চা শুধু তাদের ব্যক্তিগত জীবনে না, তাদের কর্মজীবন, মতামত, মানবিক চেতনা সব কিছুকে গ্রাস করেছে। আমার আজকে ভয় হয়, জাতীয় পতাকার নিচেও এরা আর এক দল হয়ে দাঁড়াত পারবে কি না। এদের তো পতাকাও আলাদা!
দুইটা লোকের শুধু ব্যক্তি বা বাঙালি হওয়াই যথেষ্ট না; উনি কি আওয়ামী না কি বিএনপি সেইটা মূখ্য। এই দু’য়ের বাইরে আর কোনও পরিচয়ে মানুষ তার বক্তব্য দিতে পারছে না এখানে। যদি কেউ দিয়ে ফেলেন, তাহলে এই দুই দলের কিছু সুশীল বুদ্ধিজীবী সেটাকে টেনে হিঁচড়ে কোনও একটা দলে ফেলে দিবেন।
বিচিত্র আমাদের দেশের মানুষ। এরা বিদেশে পা রেখেই লাজুক হাসি হেসে বলবেন, বিদেশে আসছি এক-আধ’টু মদ্যপান না করলে হয়?! আপনি তাদের মদ্যপান করাবেন। এরা শর্মিন্দা হয়ে হেসে ‘ধন্যবাদ’ জানাবেন। অতপরঃ যখন দাওয়াত দিয়ে বাড়িতে ডাল ভাত খেতে ডাকবেন, আপনার চৌকাঠে পা দেওয়া মাত্র অসভ্য একটা প্রশ্ন করবেন, মাংস-টাংস যা রান্না করেছের সেগুলা হালাল তো?! এনারা কোরবানীর মাংসের সাথে কনুই ডুবিয়ে হুইস্কি খেতে পছন্দ করেন, কিন্তু ম্যাকডোনাল্ডসে গেলে হালাল বিফ নাই বলে সালাদের অর্ডার করেন! এত ধর্মপ্রান জাতি’কে ধর্ম ছাড়া আর কোন অস্ত্র দিয়ে বধ করবেন?!
এই চমৎকার বিবেচনা শক্তির কারণেই দিনে দিনে এদের মস্তিষ্কে ‘গণতন্ত্র’ শব্দটা ঢুকেছে ‘বিএনপি’ আর ‘আওয়ামী’র প্রতিশব্দ হিসেবে। আমরা তাই যুগে যুগে আমাদের রাজনীতিতে বিসমিল্লাহ, জিন্দাবাদ, কাবা-ঘর, আলহাজ্জ্ব, তসবীহ, হিজাব, দাঁড়ি, টুপী ইত্যাদি বিষয়গুলোকে ঢুকে যেতে দেখেছি। মেক-আপ হিসেবে এর প্রত্যেকটি উপাদান কতটা কার্যকর সেটা জেনেছি খালেদা, হাসিনা, বাচ্চু আর দেলু’দের ‘মেক-আপ’ দেখে। এরা সবাই বিভিন্ন সময়ে এই মেকআপের দারস্ত হয়েছে। বাংলাদেশের অর্ধেক লোক আজকে ‘দেশ খুব ভাল চলছে’ ভেবে আশ্বস্ত একটা জীবন যাপন করছে। আর বাকি অর্ধেক ‘একদিন আমাদের রাজপুত্র কষ্ট(!)র জীবন শেষে ঘরে ফিরবে, তখন দেশ ধর্ম সব বাঁচবে’ এই আশায় বুক বেঁধে নির্বাচনের অপেক্ষা করছে।
২০০৫ এ চ্যানেল আইতে একবার এক প্রত্যন্ত গ্রামের প্রায় জনা দশেক লোকের সাক্ষাতকার দেখেছিলাম। অনুষ্ঠানের সঞ্চালক একটা প্রশ্নই বারে বারে করলেন প্রত্যেককে,
“এই দেশের প্রধান মন্ত্রীর নাম জানেন?”
“উমমম ... পরধান মন্ত্রী মানে পেরসিডেন?... .উহু কইতে পারি না বাবা”
“ভোট দিবেন এবার?”
“হে তো দেয়ন-ই লাগবো। ভোট না দিল অইবো?! পরতেক বারেই দেই”
আমি ঐ চাচামিয়াদের সাথে ‘অধ্যাপক অমূক’ আর ‘ডক্টর অমূক’র কোন পার্থক্য দেখি নাই। তার অনেক কারণের একটা কারণ, এনাদের কেউই বিগতবারের ‘না-ভোট’এর সুযোগ টা গ্রহন করেননি; অথচ জিজ্ঞেস করলে সবাই বলবেন, ‘এই দুই দলের অত্যাচারে এনারা অতীষ্ঠ’! ধন্যি আমাদের গ-ণ-ত-ন্ত্র! ধন্যি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ।
কথাটা তাই অন্যভাবেও বলা যায়, আমরা আদতে বিপ্লব চাই কি না। আমাদের বিপ্লবের আদৌ দরকার আছে কি না। তবে দরকার থাকুক বা না থাকুক, বিপ্লব আর না হলেও অবশ্য তেমন অসুবিধা নাই। ৮০ বা ৯০ এর দশকে গান শুনতে হত শুধু ক্যাসেটের মাধ্যমে। সিডি টিডি ছিল না। সেই সময় আমার এক কাজিন ছিল, কোনও গান ভালো লাগলে একটা ক্যাসেটে সেই গানটা বারবার রেকর্ড করে নিতো। ‘এ’ পিঠ আর ‘বি’ পিঠে মোটমাট ১২-১৩ বার একই গান রেকর্ড করে ও আয়েশ করে শুনত। আমরা আমাদের সন্তানদের সাথেও এই কাজ করব। বাংলাদেশের সামনের দিনগুলাতে আমরা আমাদের সন্তানদের শুধু ‘ভাষা আন্দোলন’ আর ‘মুক্তিযুদ্ধ’র গল্প শুনিয়ে সুখের ঢেকুর তুলবো। এটা নির্বিঘ্নে করে যাবার জন্য আমাদের ছোটখাটো প্রস্তুতি লাগবে; যেমন, ভাষা আন্দোলন আর মুক্তিযুদ্ধে যারা আমাদের শহীদদের হত্যা করেছিল আর যারা হত্যাকারীদের সহায়তা করেছিল তাদের পরিচয়ের অংশটুকু ইতিহাস থেকে কৌশলে বদলে বা ঢেকে দিতে হবে। কারণ নতুন এই ফেসবুক-প্রজন্ম বড়ই ধুরন্দর। এরা খালি প্রশ্ন করে। এরা যদি দেখে সেই রাজাকারের দল স্বাধীনতার পাঁচ দশক পরেও বহাল তবিয়তে টিকে আছে, তাহলে আবার বেয়াড়া সব প্রশ্ন করবে। আমাদের সততা, সাহস এসব নিয়ে প্রশ্ন তুলবে। আমাদের তাই গাইতে হবে “এক সাগরও অশ্রুর বিনিময়ে ... বাংলার স্বাধীণতা আনলে যারা....” কিংবা “আমার ভাইয়ের স্লোগানে কাঁপানো একুশে ফেব্রুয়ারী ... ” কারণ ‘অশ্রু’ বা ‘স্লোগান’র সাথে হত্যাকারী ততোটা জড়িত নয় যতটা রক্তের সাথে জড়িত। হোক না তাতে আমাদের শহীদদের খানিকটা অপমান। তাদের রক্তের সাথে খানিকটা বেইমানী। তারা তো যুগে যুগে অপমানিত হতেই ৫২ আর ৭১ এ বোকামীগুলা করেছিলেন! আমরা তো অন্ততঃ পোলাপানের কাছে মান বাঁচাতে পারব!
মন্তব্য
অনেক প্রিয় লেখকের কাছ থেকে অনেক দিন পর অনেক ভাল এবং প্রোয়জনীয় লেখা।
আমার মনে হয়-পরিবর্তন আসবে।শাহাবাগ তার সূচনা মাত্র।
এতোদিন পর লিখলেন! ভাবলাম চারিদিকের দুঃখের খবর মাঝে একটু মন-টন ভালো হবে আপনার লেখা পড়ে, হইলো উল্টাটা!
"মান্ধাতারই আমল থেকে চলে আসছে এমনি রকম-
তোমারি কি এমন ভাগ্য বাঁচিয়ে যাবে সকল জখম!
মনেরে আজ কহ যে,
ভালো মন্দ যাহাই আসুক-
সত্যেরে লও সহজে।"
তিন বছর পরে হলেও লিখলেন। মনের ক্ষোভ ঝাড়ার জন্যই হয়তো অবশেষে লিখলেন ।
অসাধারণ। এত্ত সুন্দর করে লিখলেন কি করে ভাই। মুগ্ধ হয়ে গেলাম পুরা। এই দেশে বিপ্লব আর কখনোই হবে না। যেই দেশে বিপ্লব শুরু হতে না হতেই কুকুরের দল হাড্ডির খোঁজে এসে কামড়া কামড়ি শুরু করে দেয় সেই দেশে আবার বিপ্লব। হাহ। হতাশার মাঝে আপাতত ডুব দিয়ে থাকি আর পুরানো সেই কথা জপে যাই,
সুতরাং সুদিন আসবে এই প্রত্যাশায় রই।
সামি
এই ক্ষোভ, এই আক্ষেপ, এই দুঃখ শুধু আপনার একার না চৌদ্দ কোটি বাঙালির ও।
সাম্পানওয়ালা
লেখাতে প্রথম মন্তব্যকারী হিসাবে যখন লিখলাম এবং সংরক্ষনের জন্য দিলাম তখন দেখালো এরর ৫৩৩। বুঝলাম না কিছুই। লেখাটা খুব চমৎকার হয়েছে। মনের কথাগুলো খুব সহজে এখানে তার ঠিকানা খুঁজে পেয়েছে।
অনেক অনেক অনেক ধন্যবাদ এত সুন্দর লেখার জন্য। নিয়মিত লিখবনে আশা করি।
আলোকিত-মন
"বাঙালি, পৃথিবীর সবচেয়ে অহমিকাপরায়ণ জাতিগুলোর একটি, বাস করে পৃথিবীর এককোণে; ছোটো, জুতোর গুহার মতো, ভূভাগে;- খুবই দরিদ্র, এখন পৃথিবীর দরিদ্রতম। তার দেশ ছোটো;- ছোটো ভূভাগে বাস করার একটি ফল মানসিকভাবে ছোটো, সংকীর্ণ হওয়া; কুপমন্ডুকতায় ভোগা, যাতে ভুগছে বাঙালি অনেক শতাব্দী ধ'রে।
রুগ্ন রাজনীতি বিনাশ ঘটায় সবকিছুর; এখন বিনাশ ঘটছে বাঙালির সবকিছু। বাঙালি হয়ে উঠেছে আরো প্রতারক; হয়ে উঠেছে আরো অসৎ, নীতিশূণ্য, আদর্শহীন; বাঙালি হয়ে ঊঠেছে আরো খল, সুবিধাবাদী, সুযোগসন্ধানী। নিয়ন্ত্রণের ফলে
বিকৃত হচ্ছে বাঙালির শরীর, ও কামনাবাসনা।
বাঙালি হয়ে উঠেছে একটি বিকৃত জনগোষ্ঠি।
বাঙালির রুগ্নতা আর লুকিয়ে রাখা চলে না, ক্ষতস্থলকে ময়লা কাপড়ে মুড়ে রাখলে ক্ষত শুকোয় না, তাতে পচন ধরে। পচন ধরেছে এর মাঝেই। বাঙালির চিকিৎসার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না;- একটি জনগোষ্ঠি কি রুগ্ন থেকে রুগ্নতর হ'তে হ'তে লুপ্ত হয়ে যাবে?"
হ্যাঁ, ডঃ হুমায়ুন আজাদ, লুপ্ত হয়ে যাবে, হয়ে যাওয়া উচিত।
আমাদের এই দেশে আবারো বিপ্লব সংঘটিত হবে, ইতিহাসের সামান্যতম বিকৃতিও ঘটবে না এই আশাই মনে জিঁইয়ে রাখতে চাই।
============================
কত আর রবে দেশ রাহু গ্রাস কবলে?
সমূলে উপড়ে ফেলি দূর্নীতি সবলে।
মন ভাল থাকলে লেখাও ভাল হয়, খারাপ থাকলে খারাপ। এইটা খারাপ মনের লেখা। ভাল না লাগারই কথা
বৃত্তাবদ্ধতা ভাঙছে...
উত্তরবঙ্গের যেখানে অনেক হিংস্রতা দেখা গেল সেখানে ৮৬টি এমপিও ভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৭৬টিই ভবিষ্যতের আল্লামা প্রস্তুতকারী - মন বা মেজাজ খারাপ করা লেখার প্রয়োজন সহসাই ফুরাবেনা
অনেক, অনেক দিন পরে দেখা দিলেন!
কত কত কত কত কত কত দিন পর লিখলেন!
প্লীজ, নিয়মিত থাকুন! আপনাদের লেখা পড়তে খুব খুব ইচ্ছা করে।
~~~~~~~~~~~~~~~~
আমার লেখা কইবে কথা যখন আমি থাকবোনা...
মন খারাপ করা লেখা
নতুন মন্তব্য করুন