গন্দম: নিষিদ্ধ মোহের অনিশ্চিত হাতছানি

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি
লিখেছেন আনোয়ার সাদাত শিমুল (তারিখ: শনি, ২৩/০২/২০০৮ - ১১:০৬পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

দমদম এয়ারপোর্টে ঋতু এবং রাজীব যখন অনেকগুলো অনিশ্চিত প্রশ্নের মুখোমুখি, আশাবাদী ভাবনায় সান্ত্বনা খোঁজার ব্যর্থ চেষ্টায় দু'জনই জানে - আর দেখা হবে না, তখন নিষ্ঠুর ভগবানের অবিচারের পৃথিবী এবং সামাজিক কাঠামোয় দায়বদ্ধতা চাপিয়ে গন্দম কাহিনীর ইতি ঘটে। তবে এই সমাপ্তি কেবল মলাট বন্দী ছাপার অক্ষরেই সীমিত, কারণ ততক্ষণে পাঠকের মনে অনেকগুলো প্রশ্নের দগদগে ক্ষত তৈরি হয়ে গেছে। পাঠকের চিন্তায় কড়া নাড়ার এ কৌশলী দক্ষতা উপন্যাস 'গন্দম' কিংবা লেখক অমিত আহমেদের মূল কারিশমা।

'গন্দম' প্রচলিত কাঠামোয় বিন্যস্ত নয়। সব চরিত্রের সম্মিলিত অংশগ্রহণে সময়-তারিখ ধরে কাহিনী সামনে এগোয়। কোলকাতার ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে দীপনের জন্য ঋতুর অপেক্ষা এবং রাজীবের সাথে দেখা নিয়ে প্রথম এবং দ্বিতীয় অধ্যায়ে যে গল্পের সূচনা, পরের অধ্যায়ে গিয়ে সে গল্প চলে আসে ঢাকায় - সময়ের হিসাবে পিঁছিয়ে যায় আরও এক বছর। কুর্মিটোলা গলফ ক্লাব, মহাখালীর তিস্তা গ্রুপ, বনানীর নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়, এবং গুলশানের সিমেন্স অফিসের ঘটনা পরম্পরায় রাজীব ফিরে আসে কাহিনীতে, সাথে উঠে আসে একদল তরুণপ্রাণ। সবাই কোনো না কোনোভাবে রাজীবের সহযাত্রী। এ চরিত্রগুলোর জীবন কিংবা জীবনের আকাঙ্খা বর্ণন সুদূর অতীত কিংবা ফ্যান্টাসীর আগামী নয়, চলতি সময় এবং স্বপ্ন নিয়েই তাদের জীবনাচরণ। গ্র্যাজুয়েশন শেষে সবাই ক্যারিয়ারিস্ট হয় পারিবারিক ব্যবসায়, কর্পোরেট অফিসে, এনজিও কিংবা অন্য কোথাও তখন সম্পর্কের সংকট প্রবল হয়ে ওঠে। কর্পোরেট কিক-আউটের ঝাপসা কাঁচের ওপাশে শিশুতোষ ভালোবাসার প্রকাশ বড়জোর বয়:সন্ধির অস্থিরতা। চরিত্রগুলো এ সংকট অতিক্রম করতে পারে না। এরা এক নতুন প্রজন্মের প্রতিনিধি, প্রেম-ভালোবাসা সংজ্ঞায় এরা অস্থির। ক্রমান্বয়ে রাজীব এবং তৃণার সম্পর্ক যখন একই পথে গতি পায়, তখন কাহিনী আবার কোলকাতায় ফিরে যায়। চিত্তরঞ্জন এভিনিউ, পার্ক স্ট্রীট, রাফি আহমদ রোডে ঋতু-রাজীবের বিচরণ পাঠককে বর্তমানে নিয়ে আসে। দুটি ভিন্ন সময়কে দুই-স্তরে বয়ান পাঠককে ধরে রাখে। ঢাকার রাজীব কিভাবে কোলকাতায় গেলো, তৃণার সাথে তার সম্পর্কের পরিণতি কী হয়েছিল এসব জানতে উল্টাতে হয় পাতার পর পাতা।

ঢাকা-কোলকাতার ভিন্ন প্রেক্ষাপট অথবা সময় ব্যবধান পাঠককে বিরক্ত করে না মোটেও। বরং ঘড়ির কাঁটা ধরে ধরে গল্প বলায় পাঠক হয়ে ওঠে গল্পেরই একজন। ঢাকা কাহিনীর তুলনামূলক দ্রুততা পাঠককে ইংগিত দেয় - এ দুটো ধারা কোনো এক মোহনায় মিলবেই মিলবে। কিন্তু, সেই কাঙ্খিত মোহনার স্রোতে ভাসবে কে! রাজীব-তৃণা, রাজীব-ঋতু, নাকি ঋতু-দীপক? রাজীবের বড় ভাই সজীব এবং ইশিতার ঘর বাধার পরিকল্পনা কতটুকু বাস্তব হবে? এসব প্রশ্নের উত্তর লেখক দিতে একটু সময় নেন বটে, তবে সেটা যতটা না গল্পচ্ছলে তার চেয়ে বেশী গতকাল-আজ-এবং পরশুর সময় প্রবাহে। সৌরভের বিশ্বকাপ দলভুক্তি, উত্তপ্ত নন্দীগ্রাম, ইউনূসের নোবেল, বাংলাদেশে ওয়ান-ইলেভেন, ইয়াবা কালচার এবং বাংলাদেশ ক্রিকেটের ব্যর্থতার মতো সমকালীন ঘটনার ছাপ থাকে পরতে পরতে। খুব শংকা থাকে এসব রিপোর্টিং মূল কাহিনীতে জড়তা নিয়ে আসবে, মনে হবে স্পুনফিডিং অথবা আরোপিত চেষ্টা। কিন্তু গন্দম কাহিনীর দ্বি-স্তর যখন একই সরল রেখায় মিলতে শুরু করে, ঢাকা-কোলকাতা নিকটবর্তী হয়, তখন স্পষ্ট হয়ে ওঠে - যে সময়কে এবং সময়ের মানুষগুলোকে অমিত আহমেদ ধরতে চেয়েছেন সে চেষ্টা এইসব সামষ্টিক ঘটনাপঞ্জী ছাড়া নিতান্তই সাদামাটা থাকতো।

বাক্য গঠন বা শব্দ বিন্যাসে 'জিজ্ঞাস'/'আর্ধেক' এর মতো কথ্যরূপ, 'টা/টি' প্রত্যয়ের অতি ব্যবহার চোখে পড়লেও ঢাকা/কোলকাতা ভেদে লেখকের ভাষা নির্বাচন পাঠককে মুগ্ধ করে। যেমন - ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে - "---আকাশের দিকে তাকায় ঋতু। আকাশে শাদা-কালো মেঘের ঘনঘটা, বাতাসটাও ভারি - জল করবে নাকি!"
এই "জল করবে নাকি" ঢাকায় ইশিতা, নওরীণ কিংবা তৃণার ভাবনায় হয়তো হয়ে যেতো - "বৃষ্টি হবে নাকি?"
আবার কোলকাতায় রতনদের বাসায় রতন বলে - "আরে যাহ শ্লা"। কোলকাতার সহজাত সংলাপ, একই প্রেক্ষিতে ঢাকায় নিপুনদের বাসায় রাজীবের সংলাপ - "আরে নাহ মানে কি? যাস নাই?" আবশ্যিকভাবে ঢাকার বর্ণিত প্রজন্মের নতুন বচন।

চরিত্র সৃষ্টি নিয়ে লেখকের সাহসী প্রয়াসকে সাধুবাদ না জানালেই নয়। দারিদ্র্য-প্রপীড়িত ক্ষয়িষ্ণু সমাজ অথবা মধ্যবিত্তের নিত্য জীবন যখন সাহিত্যের জনপ্রিয় ধারা রূপ পায়, তখন অ্যাফ্লুয়েন্ট সোসাইটির টাইলস মোড়ানো বাসা এবং ভাষা নিয়ে লেখা চোখে পড়ে কম। কিংবা যারা লিখেছেন, তাঁদের বেশিরভাগই বাইরের চাকচিক্যের আলোকছটার বিবরণে ক্ষান্ত। ঠিক এ জায়গাটিতেই অমিত আহমেদ দু:সাহসী। রঙ-মেশাল ধনীক মানুষগুলোর ড্রয়িং-ডায়নিং, গেদারিং আর রেস্টুরেন্টে তার বিচরণ। কামাল আতাতুর্ক এভিনিউ বা বারিধারা হাউজিংয়ের ধুলো পড়া পথে লেখক দ্রুত হেঁটে যাননি, বরং নিজ হাতে ধুলো ওলোট-পালোট করে পৌঁছে গেছেন স্বপ্ন ও সংঘাতের অলিগলিতে। অনভ্যস্ত পাঠক অভিযোগ করতেই পারেন - এসব আমরা নই, আমাদের চেনাজানা মানুষ নয়। লেখকের নিজস্ব ব্যাখ্যার অপেক্ষায় না থেকেও আমরা সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারি - ২০০০ সাল পরবর্তী সময়ের বিভ্রম প্রজন্ম প্রলয় বন্ধ থাকবে না মোটেও, অন্ধ থাকার ভান যতো কম করা যায় তত বেশিই বোধের জয়।

উপন্যাসের সমাপ্তিটিও যথার্থ ম্যাচিওর্ড। শুধু একদিন আগে সজীবের হঠাৎ কোলকাতা পৌঁছানো, কয়েক সংলাপে ফেলুদার মতো সব সমস্যার গটাগট সমাপ্তি টানাকে তাড়াহুড়া মনে হয়েছে। মনে হয়েছে - একটি সৌম্য গতির গল্পে অহেতূক নাটকীয়তা। ঋতু-রাজীবের ঘরবন্দী ঘনিষ্টতা নিয়ে সজীবের প্রতিক্রিয়া খাপছাড়া মনে হয়। একই পরিণতির জন্য সজীব কোলকাতায় না গিয়ে ই-মেইলও করতে পারতো। কাহিনীর সময় পরিধি ঢাকা থেকে শেষ দৃশ্যে পৌঁছতে লেগেছে প্রায় এগারো মাস। বিপরীতে কোলকাতার ঘটনা মাত্র পাঁচ দিনের। পাঁচ দিনে পরিচয়, ভালো লাগা, জানা শোনা শেষে পার্ক হোটেলে ঘনিষ্টতাকে দ্রুত পরিণতি মনে হয়েছে। রাজীবের কোলকাতা থাকাকে, পাঁচ দিনের বদলে অন্তত: একমাস, প্রলম্বিত করা যেতো নির্ভাবনায়। গল্পের ধারাপাতে পরিবর্তন হতো না মোটেও। আরেকটি প্রশ্ন থেকে যায় - যে পরিস্থিতিতে রাজীব ঢাকা ছেড়ে কোলকাতা এসেছিলো, সেখানে মানসিক চাপ থাকাটা স্বাভাবিক। ঋতুর সাথে রাজীবের দেখা কিংবা স্বগত: সংলাপে সেরকম ইংগিত অনুহ্য।

অমিত আহমেদের গদ্যরীতি ইতোমধ্যে পাঠকের (বিশেষ করে ব্লগে) প্রশংসা কুড়িয়েছে। 'গন্দম' রচনায় মানসিক প্রস্তুতি এবং পাঠকের ধৈর্য্য নিয়ে লেখক যথেষ্ট সচেতন ছিলেন। কোন জায়গায় থামাতে হবে, কোথায় পাঠককে অপেক্ষা করাতে হবে, কখন কারণ দর্শাতে হবে; এসবে মুন্সিয়ানা ছিল ব্যাপক। সময়কে ধরার কাজটি অমিত করে গেছেন সুচারুভাবে। আমাদের শহরের রাজীব শেষ পর্যন্ত কোলকাতায় আবার যাবে কিনা, তৃণার মানসিক পরিবর্তন স্থায়ী কিনা এসব প্রশ্নের উত্তর হয়তো আমাদের চেনাজানা জগতেই পেয়ে যাবো। তবে গন্দম পাঠক হিসেবে কখনো কোলকাতায় গেলে ঋতু সেনকে খুঁজে বেড়াবো অচেনা রাস্তায়, মানুষের ভীড়ে। কারণ, পাঠের পর মনে হয় - এখানে সেখানে আমিও ছিলাম, আছি, অথবা থাকার কথা ছিল। কীভাবে কীভাবে যেনো অমিত আহমেদ সেটা জেনে গেছেন!


মন্তব্য

মাহবুব লীলেন এর ছবি

পাঠকের চিন্তায় কড়া নাড়ার এ কৌশলী দক্ষতা উপন্যাস 'গন্দম' কিংবা লেখক অমিত আহমেদের মূল কারিশমা।

সমর্থন
সমর্থন
সমর্থন করা হইল

০২

অমিত অবহেলা করে যে নওরীনকে সৃষ্টি করেছেন সেই নওরীন এখন আমার কাছে
অপরা কাহিনীতে যে এগুচ্ছে

ধুসর গোধূলি এর ছবি

- হুম।
গন্দম এখনো পড়িনি। বই হাতে নিয়েই পড়ার ইচ্ছা এবং এই ইচ্ছেটা অমিতকে জানানোর ইচ্ছে ছিলোনা মোটেও, কিন্তু আপনার লেখাটা আমাকে সেখানে দাঁড় করিয়ে দিলো। হাসি

_________________________________
<সযতনে বেখেয়াল>

অতিথি লেখক এর ছবি

আমি নিয়েছি কিন্তু এখনও পড়তে পারিনি
সবার কথা শুনে মনে হচ্ছে দ্রুত পড়ে ফেলা দরকার
(ক্যামেলিয়া আলম)

হাসিব এর ছবি

ধন্যবাদ রিভিউয়ের জন্য । বাকি বইগুলোর রিভিউ কবে দিচ্ছেন ?

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

খুব শীঘ্রই।

বিবাগিনী এর ছবি

আমার কাছে এখনও ঋতুকে ছাড়ায়নি কিছুই।এ হয়ত একান্তই আমার ব্যক্তিসত্বার অনুভব।‌‌অমিত তোমাকে অনেক ধন্যবাদ।

::একাকিত্বের বিলাস আমার অনেকদিনের সাধ::

‌‌::একাকিত্বের বিলাস আমার অনেকদিনের সাধ::

কেমিকেল আলী এর ছবি

দারুন রিভিউ লিখেছেন!!!!!!!

কনফুসিয়াস এর ছবি

গন্দম এর এগারো পর্ব পর্যন্ত পড়ে বসে আছি। বাকিটুকু পড়ার উপায় নেই, কারনে সচলে ঐটুকু পর্যন্তই পোস্ট করা হয়েছে।
*
গন্দম নিয়ে লিখবো ভেবেছিলাম, কিন্তু তা আর হচ্ছে না।
ভাবছি গন্দম পড়া হলে শিমুলের রিভিউ নিয়েই লিখবো না হয়! হাসি
-----------------------------------
... করি বাংলায় চিৎকার ...

-----------------------------------
বই,আর্ট, নানা কিছু এবং বইদ্বীপ

অমিত আহমেদ এর ছবি

শিমুল এর রিভিয় পড়ে খানিকক্ষণ গুম হয়ে বসে ছিলাম। একটু সন্দেহও হচ্ছিলো, এই গন্দম এর লেখক কি আমি নিজে?

ধন্যবাদ হে সুহৃদ।

(পরামর্শ গুলোও তুলে রেখেছি পরের উপন্যাসের জন্য)

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।