ঢাকামেট্রো ১৬-০৮১২

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি
লিখেছেন আনোয়ার সাদাত শিমুল (তারিখ: বিষ্যুদ, ১৬/০৮/২০১২ - ৩:৫৯অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

মানুষের মৃত্যু কতোবার হয়? কেউ কেউ বলেন, সাধারণ মানুষ একবার মরে, আর অসাধারণ মানুষ অমর হয়। অমরত্ব মানে কি বেঁচে থাকা মানুষের স্মৃতিতে লেপ্টে থাকা? নাকি বেঁচে থাকা মানুষের মনে কখনো কখনো জেগে ওঠা? সংবাদ শিরোনাম, টেলিভিশন কিংবা ছাপা কাগজে, নতুন হয় প্রতিদিন। থাকে কিছু চর্বিত চর্বন। সংবাদও কি মরে যায়? শেয়ার বাজারের পতন, রেলমন্ত্রীর কালো বিড়াল কেলেঙ্কারি, ইলিয়াস আলীর গুম, তত্ত্বাবধায়ক সরাকারের দাবীতে বিএনপির আল্টিমেটাম, ইউনূস ইস্যূতে সরকার বনাম পশ্চিমাবিশ্ব, হুমায়ূনের মৃত্যু-দাফন জটিলতা, শাওন-গসিপ, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর তালাতত্ত্ব, নতুন যোগাযোগ মন্ত্রীর ঝটিকা সফর, মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি পরীক্ষা হবে কি হবে না - কতো কতো খবর। বলা হয়, 'একটা ফুলের তোড়া এবং একটা সংবাদপত্র একই রকম, মিলটা এখানে যে - পরদিন সকালে দুটোই বাসি হয়ে যায়।' ইদানিং সংবাদ শিরোনামেও একঘেঁয়েমি; ঘরমুখো মানুষের ভীড়, টিকিট নেই, সময় মত বাস ট্রেন ছাড়ছে না, মানুষের ভোগান্তি, শত কিলোমিটার যানজট।

মানুষ শহর ছাড়ছে, ফিরছে গ্রামে পরিবার প্রিয়জনের সঙ্গে ঈদ আনন্দ ভাগাভাগিতে।
আজ সকাল থেকে ঢাকায় যানজট একটু কম।
মিরপুর থেকে নিউমার্কেট যেতে গাড়িতে ২০ মিনিটের মতো লাগলো। মনে হচ্ছিলো - ঢাকা শহর যদি এমন থাকতো সারা বছর!
ক্রেতার ভীড় নেই, ফুটপাথের বইয়ের দোকানগুলোয় হাল্কা ক্রেতা সমাগম। বাতাসে তেহারীর ঘ্রাণ। লক্ষ্য করলাম - ইংরেজী বইয়ের পসরা বেড়েছে। ছোটোভাই বলেছিল তিন গোয়েন্দা ভলিউম-১০ কিনতে। ভলিউম-১০ দূরে থাক, তিন গোয়েন্দার বইয়েরই সংকট। অবশেষে মার্কেটের ভেতরে পুরনো এক দোকানে এক কপি পাওয়া গেল, অনেক পুরনো। দামও রাখলো তিরিশ টাকা। এর আগে বাইরের দোকান থেকে কিনেছি ভলিউম ১০৬/২।

হুমায়ূন আহমেদের বইয়ের কাটতি সম্ভবত বেড়েছে। আফটার-ডেথ-ইফেক্ট। টিভিতে প্রতিবেদন দেখছিলাম, 'আজ রবিবার', 'শ্যামল ছায়া'- এসব নাটক সিনেমার ডিভিডির ব্যাপক চাহিদা। হুমায়ূনের কিছু বই পড়ে আক্রান্ত হয়েছিলাম অনেক আগে, ইচ্ছে ছিল - ওগুলো সংগ্রহে রাখব। পেয়েও গেলাম কয়েকটা। আশ্চর্য্যজনকভাবে খেয়াল করলাম, বইয়ের দাম অনেক বেড়ে গেছে। ৮০ পৃষ্ঠার "শংখনীল কারাগার"এর দাম ২০০ টাকা, আর ৭৮ পৃষ্ঠার "নন্দিত নরক"এর দাম ১৫০ টাকা। শুনেছিলাম, একটা হিসাব আছে এরকম - প্রতি ফর্মা বইয়ের দাম সর্বোচ্চ এখন ২৫ টাকা। দু বছর আগে ছিল ২০ টাকা। সে হিসেবে পাঁচ ফর্মার বইয়ের দাম ১২৫ টাকা হতে পারে এখন। তাহলে, নরক-কারাগারের দাম এত বেশি কেন? পাশাপাশি "কোথাও কেউ নেই" "এলেবেলে" "প্রেমের গল্প"র দামও দেখলাম। পরেরগুলোর দাম ঠিক আছে, ক্ষেত্রবিশেষে কমও। ২৫৪ পৃষ্ঠার "কোথাও কেউ নেই"এর লিখিত মূল্য ২৫০ টাকা।
পরে বুঝলাম, কাহিনী অন্যখানে - নরক আর কারাগারের প্রকাশক "অন্যপ্রকাশ"। হুমায়ূনের বইয়ের প্রায় মনোপলি পাওয়া এ প্রকাশনী ইচ্ছামত দাম বাড়িয়েছে। দোকানী জানালো, গত দু'সপ্তায় নতুন যা ছাপা হয়েছে তাতে দাম বেড়েছে, সামনে আরো বাড়তে পারে। জানালো, আগের সংস্করণে নন্দিত নরকের দাম ছিল ১২০ টাকা, এবার সেটা ১৫০ হয়ে গেছে।
হুমায়ূন মরে গেছেন।
সবাই বলছে তিনি অমর থাকবেন- পাঠকের মনে।
অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে - হুমায়ূনকে আবার মারবে "অন্যপ্রকাশ"। এভাবে দাম বাড়িয়ে হুমায়ূন সাধারণ পাঠকের আয়ত্বের বাইরে চলে যাবে...।

এ প্রসঙ্গে আরেকটি বইয়ের কথা উল্লেখ করি - "বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী"।
বইটির প্রকাশ করেছে ইউপিএল। ৩২৮ পৃষ্ঠার বইটির লিখিত মূল্য ৬৫০ টাকা। গতকাল ছিল পনেরো আগস্ট, জাতীয় শোক দিবস। বিভিন্ন মিডিয়ায়- বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আলাপ হয়েছে অনেক। শোক-স্মৃতি-স্তুতি ছিল। আমার প্রবল বিশ্বাস অনেক পাঠক পড়তে চায় - বঙ্গবন্ধু নিজের জীবন নিয়ে কী বলেছেন, জানতে চায়। কিন্তু, দামের দিকে তাকালে হতাশ হতে হয়। সরকার কতো দিকে কতো টাকা খরচ করে, এই বইটির ব্যাপারে আওয়ামী লীগ সরকার কি একটু ছাড় দিতে পারতো না? পারতো না কি প্রকাশক ইউ পি এল? শুধু শহর হয়, মফস্বলের কতো নতুন প্রজন্ম আগ্রহ নিয়ে কিনতো এই বই। হতে পারতো - স্কুলের বার্ষিক অনুষ্ঠানের পুরস্কার এই বই! বাড়তি দামের কারণে তা সম্ভবত হবে না। ইউপিএল আগামীতে কোনো সুলভ সংস্করণ বাজারে ছাড়ে কিনা তার অপেক্ষায় রইলাম---।

বলছিলাম, ঈদে ঘরমুখো মানুষের কথা।
আমাদের নগর জীবন কষ্টের জীবন। কাজের সন্ধানে মানুষ শহুরে হয়ে ওঠে। সারাবছর বিদ্যুৎ-পানি-গ্যাস-যানজট-নিরাপত্তার সংকটে কষ্টে পার করে। উৎসব আনন্দের উপলক্ষ খুব কম। ঈদে তাই মানুষ ঘরে ফেরার অপেক্ষায় উদ্গ্রীব হয়ে থাকে। এবারের ঈদে অর্ণবেরও এভাবে ঘরে ফেরার কথা ছিল। অর্ণব আমার দেখা তুখোড় ছাত্রদের একজন। পাস করার আগেই এক বিজনেস কেইস কম্পিটিশন জিতে চাকরী পেয়েছিল নামকরা বহুজাতিক কোম্পানীতে, পোস্টিং ছিল ঢাকার বাইরে। যাওয়ার আগে একদিন দেখা করে গেছে। পরশু আবার এলো, চেহারা বিমর্ষ। জিজ্ঞেস করলাম, কী খবর। বললো, খুব ঝড় ঝাপ্টার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি।
বসতে বললাম।
অর্ণব জানালো, গত ৪ তারিখে তার বাবা মারা গেছেন। শুনে চমকে উঠলাম। বছর দেড়েক আগে আমার এক বন্ধুর বিয়েতে অর্ণবের বাবা মা দুজনের সাথেই হঠাৎ দেখা হয়েছিল।
আমি সমবেদনা প্রকাশের আগেই অর্ণব জানায় তার আম্মার ক্যান্সার ধরা পড়েছে, ইন্ডিয়ায়ও গিয়েছে - ডাক্তার তেমন আশার বাণী দেয়নি।
আমি চোখ বড়বড় করে অর্ণবের দিকে তাকিয়ে থাকি।
এবার সে আমাকে বলে, "আমি নিজেও স্ট্রোক করেছিলাম, মুখের একপাশ অবশ হয়ে গিয়েছিল।"
অর্ণব ফিজিওথেরাপী নিচ্ছে। মুখ স্বাভাবিক হয়ে এসেছে, এক চোখ একটু বড় এখনো, ডাক্তার বলেছে ঠিক হয়ে যাবে।
আমি কথা বলার ভাষা খুঁজে পাইনা। এমন বিপদাপন্ন একজন মানুষকে কী বলতে হয় আমার জানা নেই। অর্ণবের কষ্ট এখানেই - চাকরী পাওয়ার পরে ইচ্ছে ছিল প্রথম ঈদটা বাবা মার কাছাকাছি খুব আনন্দ করবে, সেটা আর হলো না! বাইশ বছর বয়েসি অর্ণবের দিকে আমি নিশ্চুপ তাকিয়ে থাকি। দেখে মনে হয়, শোকে কষ্টে তার বয়স অনেক বেড়ে গেছে। এরপরও কিছু টুকটাক আলাপ হয়। যাওয়ার সময় হাত মিলিয়ে বলি, "তোমার এই ব্যক্তিগত কষ্টের সময়ে সান্ত্বনা দেয়ার ভাষা আমার নেই, শুধু এটুকু বলি, ভেঙে পড়ো না- বেঁচে থেকো।"


মন্তব্য

সাত্যকি এর ছবি

শেষটা পড়ে আমিও বোবা হয়ে রইলাম।
জীবন এত কঠিন কেন ?

মোখলেছুর রহমান সজল  এর ছবি

কিছু কিছু ঝড় সবকিছু বড় এলোমেলো করে দেয়। কেন দেয় বলুনতো ?

সুমন চৌধুরী এর ছবি

কয়েকদিনের জন‌্য শহরের বাতাসে বিষ কমে যাওয়া ‌ছাড়া কোন সুখবর নাই।

তারেক অণু এর ছবি

আপনার এই সিরিজটা খুব অন্যরকম। ছুঁয়ে যায়---

স্যাম এর ছবি

শিরোনাম টা ইন্টারেস্টিং!
"বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী" - নিয়ে লেখাতে পূর্ণ সমর্থন।
অর্ণবের বিপদকাল কেটে যাক।এমন অবস্থায় আসলেই অসহায় হয়ে তাকিয়ে থাকা ছাড়া বা হাত টা একটু ধরে থাকা ছাড়া কিছুই বলার থাকেনা মন খারাপ ঘনিষ্ট এক বন্ধুকে দুই বছরের মধ্যে পরিবারের একমাত্র জীবিত পুরুষ সদস্য হয়ে উঠতে দেখেছিলাম - বাবা, ছোট ভাই, মামা এবং চাচা একের পর এক চলে গিয়েছিল বন্ধুটিকে ছেড়ে মন খারাপ ও অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল শেষ দিকে হস্পিটাল, দাফন, কুলখানি ইত্যাদি নিয়ে।

মৃত্যুময় ঈষৎ এর ছবি

সপ্তাহান্তে যে অনুভূতিগুলো ভিতরে জমা হয় তার সার্থক ও সুলিখিত সন্নিবেশ পাই আপনার লেখায়, ঢাকাকে আপনার চোখ দিয়ে দেখতে ভালো লাগে।

অচেনা অর্ণবের জন্য কেন যেন মনটা হুহু করে উঠলো, সে ভালো থাকুক, জীবিত থাকুক....... মন খারাপ


_____________________
Give Her Freedom!

প্রৌঢ় ভাবনা এর ছবি

ঢাকামেট্রো, দারুণ গতিতে চলুক।

ওডিন এর ছবি

কালকে রাতে ছোটবেলার বন্ধুর বাবা মারা গেলেন। অনেকটা হঠাৎই। ওর মা প্রায় এক বছর ধরে নিয়মিত ডায়ালাইসিস করে কোনভাবে টিকে আছেন। আমরা সবাই তাকে নিয়েই চিন্তায় ছিলাম। মাঝখান থেকে আঙ্কেলই চলে গেলেন।

কেউ মারা গেলে আমার সেইখানে যেতে ইচ্ছে করে না। আসলে আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারি না কি বলতে হয়। কি করতে হয়। সকালবেলা তারপরেও গেলাম। ভেতরে ঢোকার সাহস করতে পারলাম না। বাড়ির বাইরে কতক্ষন পায়চারি করলাম। বঙ্গবন্ধুর বাড়ির পাশেই ওদের বাড়ি। কতক্ষন ঘুরেফিরে পনেরই অগাস্টের প্যান্ডেল ফুল এইসব দেখলাম। বন্ধুর বোন আর দুলাভাই এর সাথে তারপরেও দেখা হয়ে গেলো। কিচ্ছু না বলে ফিরে এলাম।

অতিথি লেখক এর ছবি

আমি এই সিরিজের একেবারেই নতুন পাঠক।তবে অনুভুতিগুলো একই রকম। (কমেন্টগুলো পড়ে মনে হলো সিরিজ, ভুল বুঝে থাকলে মাফ চাই)। সবশেষে এসে অর্ণবের জন্য মনের ভেতরটা ভিজে গেলো। ভালো থাকুন অর্ণব।

-অয়ন

লুৎফর রহমান রিটন এর ছবি

দেখো আগামী বইমেলায় হুমায়ূনকে তাঁর প্রীতিভাজন প্রকাশকরা কীভাবে বিক্রি করে!

হাবু বেশ বড়সড়,গাবুটা তো পিচ্চি
হেরে গিয়ে হাবু বলে--উৎসাহ দিচ্ছি!

অনিন্দ্য রহমান এর ছবি

মৃত্যুর প্রসঙ্গ এড়িয়ে যাই। চোখ বুলিয়ে এড়িয়ে গেলাম।


রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক

অতন্দ্র প্রহরী এর ছবি

দুনিয়া জুড়েই হয়ত এরকম, কিন্তু সব তো আর জানি না, বিশেষ করে বাংলাদেশের মিডিয়া আমার কাছে খুবই হাস্যকর লাগে। একই সাথে প্রচণ্ড বিরক্তিকরও বটে। সংবাদ প্রকাশে কোনো আন্তরিকতা নাই।

সামনের বইমেলায় হুমায়ূন আহমেদের অনেক অনেক "অপ্রকাশিত" বই বের হবে, আমার জোরালো ধারণা। দামের ব্যাপারে যেটা বললেন, সেটা তো আছেই, সে তুলনায় বইয়ের মান অতটা বাড়ে নি... ভুল বানান থাকে অনেক। সব মিলায়ে আমার কাছে আগের ছাপা আর কাগজই ভালো লাগত নতুন বইগুলার চেয়ে।

শেষে এসে খারাপ লাগল। অর্ণবের জন্য শুভকামনা। এই শোক ও বিপদ সামলানোর শক্তি যেন থাকে ওর।

তিথীডোর এর ছবি

শেষটায় এসে চুপ করে গেলাম...

________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।