ক্ষুধার্ত সমাজের সংযম উৎসবের পর - - -

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি
লিখেছেন আনোয়ার সাদাত শিমুল (তারিখ: বুধ, ২৬/০৯/২০০৭ - ১১:৫০পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

আধুনিক জীবনধারার সঙ্গে তাল মিলিয়ে বিত্তবান রোজাদারদের চাহিদা পূরণে তারকা হোটেল আর অভিজাত রেস্তঁরাগুলো এ বছরও সাজিয়েছে বনেদী আর দামি ইফতারির পসরা। তারকা হোটেলগুলোতে ইফতার করতে সব মিলিয়ে জনপ্রতি খরচ হয় ১ হাজার থেকে ১ হাজার ৫শ’ টাকা। প্রতি কেজি জিলাপি এখানে ৪শ’ টাকা। খাসির হালিম প্রতি বাটি ৫শ’ টাকা। প্রতি বাক্স ইফতারির দাম ৯শ’ টাকা। ১৪ রকমের খাবার থাকে প্রতিটি বাক্সে। এগুলোর মধ্যে চিকেন হালিম, মাটন হালিম, চিকেন বিরিয়ানি, সেকান্দরী রান, মাহি কাস্’রি টিক্কা, সুপার রুস্তম, লাহরি কাবাব, করমি কাবাব, রেশমি পরোটা, ভেজিটেবল রোল, ফ্রানকি রোল, চিলি চিকেন, দই বড়া, চিকেন সাসলিক, পেপরিকন সালাদ, জাফরানি জিলাপি, গাজর কা হালুয়া, গোলাব জামন, পাকুরা জিলাপি, মটকা লাচ্ছি ইত্যাদি রয়েছে। ৬শ’ গ্রাম ওজনের সমুদ্রের সবচেয়ে বড় চিংড়ির দাম ১২শ’ থেকে ১৫শ’ টাকা। এছাড়া জাফরান জিলাপি প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকা। চিকেন হালিম ও মাটন হালিম কেজিপ্রতি ১৭৫ থেকে ৩৫০ টাকা। ৮ থেকে ১০ প্রকারের ডাল, ১৫০ প্রকারের মশলা ব্যবহার করা হয়। সেকান্দরী রানের দাম ৭৫০ থেকে ৮৫০ টাকা। একটি খাসির পুরো রান ভারতীয় স্পাইসিস দিয়ে তন্দুরিতে গ্রিল করে এই সেকান্দরি রান তৈরি করা হয়। একটি রান তৈরি করতে সময় লাগে ১২ থেকে ১৪ ঘণ্টা। সমুদ্রের মাছ দিয়ে তৈরি মাহি কাস্’রি টিক্কা কাবাব প্রতি পিস দাম ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকা। সুপার রুস্তমে রয়েছে মুরগি, খাসি আর ভেজিটেবলের তিনটি স্তর। প্রতি ৮ পিসের দাম ৪০০ টাকা। (যুগান্তর)

দেয়ালের ওপাশে:
ঢাকার আজিমপুরের স্যার সলিমুল্লাহ মুসলিম এতিমখানায় আশ্রিত চার শতাধিক শিশু, কিশোর-কিশোরী ও তরুণ-তরুণীর চরম নিরানন্দে কাটছে রোজার দিনগুলো। দয়াপরবশ হয়ে একদিন বিরিয়ানি দিয়েছিলেন কেউ একজন। তারপর গত ১১টি রোজায় আর কোনো ভালো খাবার জোটেনি কপালে। ছোলা-পেঁয়াজু-বেগুনির মিশ্রণে তৈরি নামমাত্র ইফতারিতে পেটও ভরে না অনেকের। - - - গতকাল বিকেলে এতিমখানায় ঢুকতেই কড়াই হাতে দেখা গেল আশ্রিত সুজন ও রাব্বিকে। শরীর ভালো না থাকায় রোজা নেই ওরা। কড়াইয়ে দু’টুকরো গরুর মাংস গরম করে এনেছে রান্নাঘর থেকে। সেহরি খাওয়ার পর অবশিষ্ট কিছু ভাতে পানি দিয়ে রেখেছিল ওরা। দুপুরে তা দিয়েই সারবে আহার। বিকেল থেকেই অসহায় চোখগুলো তাকিয়ে থাকে মূল ফটকের দিকে। হয়তো বাহারি ইফতারি নিয়ে চলে আসবেন কোনো দানশীল ব্যক্তি। অন্তত: এক সন্ধ্যায় ভালো-মন্দ দুটি খাবার জুটবে কপালে। (সমকাল)

অন্য এক ভোরে:
এইসব আধুনিক আলোকোজ্জ্বল ক্ষুধার্ত দানবের সবুজ নেপিয়ারময় লন, ইরানী কিংবা আফগানী কার্পেটের মেঝে, পাশমিনা ঢাকা সোফা, অথবা থাই অর্কিড শোভিত ঝুল বারান্দা - কোথাও একটু বসবার জায়গা নেই। সেকান্দরী রান, লাহরি কাবাব, করমি কাবাব, কিংবা রেশমী পরোটার মৌতাত ঘ্রাণ নয়, চরম দুর্গন্ধময় বমিতে ভরে গেছে ঝকঝকে সাদা আর রুপোলি বেসিন। টয়লেটের সিংক ফ্লাস কাজ করছে না, আঁটকে গেছে সুয়ারেজ পাইপ। পাঁচ তারকা নার্সিং হোমগুলোয়ও জায়গা খালি নেই। পাকস্থলি পঁচে গলে ভুরভুর গন্ধ বেরুচ্ছে নাক মুখ দিয়ে। সিংগাপুর এয়ালাইন্স আর থাই এয়ারওয়েজ দরজা থেকে ফিরিয়ে দিয়েছে ঘাঁড় ধাক্কা দিয়ে। পরকালের মেশকে আম্বরের সুরভিত লোভের এখানেই ট্র্যাজিক সমাপ্তি। লাইপোসাকশন আর ফেস লিফটের পর বিগতাযৌবনা হয়েও কিশোরী সাজা ওদের রমণীগুলো রক্তশুন্যতায় ধুসর। সনি পিএস টু হাতে অসহায় থলথলে বাচ্চা। বাবা-মা'র চোখে বাচ্চার মোটা গদগদে পা গুলো তখন ১৫০ কিসিমের মসলা মিশিয়ে ১২-১৪ ঘন্টার এন্তেজামের; সেকান্দারি রান। ঐতিহ্য আর আধুনিকতার মিশ্রণের ইফতারী কাবাবগুলো লেমিন্যাটেড মেনুর পুরনো চ্যাপ্টার। উত্তরাধুনিক খাদ্য তালিকায় জায়গা করে নেবে বাচ্চার ঐ থলথলে রান। ক্ষুধার্ত দানবের হিংস্ত্র চানহীয় হাতের আঙুলগুলো হয়ে উঠবে চিকেন ললিপপ আর সোনার কাঠি রোল। অন্য উৎসবে মেতে উঠবে বাহারী জগত।

তখন তীব্র গন্ধময় অ্যাফ্লুয়েন্ট অ্যাপার্টমেন্ট কিংবা ডুপ্লেক্স হোমের সিঁড়ি বেয়ে গুটিগুটি পা'য়ে উঠে যাবে ৪২৫টি শিশু। হাতের গামলা-মগ শরবত মুড়ি ভিক্ষার জন্য নয়, খালিও নয় ওগুলো। বরং প্রচন্ড ঘৃণা আর অভিশাপের থুতু ঢেলে দিবে তারা এই ক্ষুধার্ত রাক্ষস সমাজের মুখে।


মন্তব্য

জ্বিনের বাদশা এর ছবি

চমৎকার টার্ম দিয়েছেন -- সংযমের উৎসব ...আসলেই

একটা প্রশ্ন, এতিমখানার বাচ্চাগুলোর উপর কি রোজা ফরজ? নাকি খাবার নাই দেখে রোজা রাখায়?

========================
যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে,ঘড়ির ভিতর লুকাইছে

========================
যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে,ঘড়ির ভিতর লুকাইছে

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

এতিমখানা তো; হয়তো এতিম আছে খানা নাই।

বিপ্রতীপ এর ছবি

হুম...এরই নাম পৃথিবী...

এস এম মাহবুব মুর্শেদ এর ছবি

অদ্ভুত লাগল! থাম্বস আপ ফর ইউর রাইটিং।

====
চিত্ত থাকুক সমুন্নত, উচ্চ থাকুক শির

দুর্বাশা তাপস এর ছবি

'সংযম উৎসব'। ঠিকই বলেছেন। উৎসবই বটে।

==============================
আমিও যদি মরে যেতে পারতাম
তাহলে আমাকে প্রতি মুহূর্তে মরে যেতে হত না।

বিপ্লব রহমান এর ছবি

অর্থের কি মারাত্নক অপচয়! ধর্মের কি আচরণবাদী প্রকাশ!


একটা ঘাড় ভাঙা ঘোড়া, উঠে দাঁড়ালো
একটা পাখ ভাঙা পাখি, উড়াল দিলো...

সংসারে এক সন্ন্যাসী এর ছবি

'সংযম উৎসব' - দারুণ বলেছেন।

রমজান মাসে বাঙালিদের ইফতার-বাহুল্য আর আসন্ন ঈদ উপলক্ষে কেনাকাটার ব্যাপকতার সঙ্গে সংযমের সম্পর্কটা কোথায়, ভেবে পাই না।

আরেকটা কথা মনে পড়লো, আমার প্রয়াত পিতা কোরবানি ঈদকে বলতেন 'পশুবধযজ্ঞ'।

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
টাকা দিয়ে যা কেনা যায় না, তার পেছনেই সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয় কেনু, কেনু, কেনু? চিন্তিত

সৌরভ এর ছবি

আধিপত্য বিস্তারের জন্যে ধর্মের যে ব্যবহার, তা অনেক প্রাচীন।
আজ তার সাথে যোগ হয়েছে, ফ্যাশন আর অনর্থক লৌকিকতা।



আমি ও আমার স্বপ্নেরা লুকোচুরি খেলি


আবার লিখবো হয়তো কোন দিন

হিমু এর ছবি
অমিত এর ছবি

থাম্বস আপ
______ ____________________
suspended animation...

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

পড়ার জন্য সবাইকে ধন্যবাদ।

নিঘাত তিথি এর ছবি

চলুক

--তিথি

----------------------------------------------------
আমার এই পথ চাওয়াতেই আনন্দ

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

সকল বৃদ্ধাঙুলি মাথাপেতে নেয়া হলো।

আদনান-বিন-তাজ এর ছবি

কঠিন দিছ।

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

আরে বস! তুমি কোত্থেকে? বাংলা ক্যামনে লিখলা? তোমার জন্য জাঝা। বলতো জা-ঝা মানে কি?

আরশাদ রহমান এর ছবি

ভাল লাগল। রোজা মাসে সবচেয়ে বেশি অপচয় হয়। এ অপচয়তো খোদার জন্য করা!

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

ধন্যবাদ, আরশাদ রহমান। হুমম, পরকালের জন্য রোজা রেখে ইহকালের ইফতার।

তারেক এর ছবি

পড়ছিলাম আগেই। আলসেমি করে লগইন করি নাই, সংযম আরকি খাইছে

শিমুল ভাই, বালা নি?
_________________________________
ভরসা থাকুক টেলিগ্রাফের তারে বসা ফিঙের ল্যাজে

_________________________________
ভরসা থাকুক টেলিগ্রাফের তারে বসা ফিঙের ল্যাজে

আরশাদ রহমান এর ছবি

ঠিক তাই। রোজা রাখার লোকের অভাব নাই। কেউ কেউ আবার ইফতারও খায় আবার ঘুসও খায়। কোনটাই ছাড়তে রাজি না।

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

তারেক বাই, হ বালা আচি।
ঠিক@ আরশাদ রহমান।

সুমন চৌধুরী এর ছবি

উত্তম!
তুমি এত কম লেখ ক্যান ইদানিং?



ঋণম্ কৃত্বাহ ঘৃতম্ পীবেৎ যাবৎ জীবেৎ সুখম্ জীবেৎ

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

শুক্রিয়া বদ্দা।
কামলাগিরিতে সময় দেয়া লাগতেছে বেশী।
সময় পাইলেই ব্লগে ঢুকি।
হাসি

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।