গল্প: বিবর্তনের শহরে অবিবর্তিত দু'জনা

অমিত আহমেদ এর ছবি
লিখেছেন অমিত আহমেদ (তারিখ: রবি, ২৯/০৭/২০০৭ - ১২:১৩অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

autoএক

মাথার চারপাশে উড়তে থাকা ঢাউস আকারের মশাটির দিকে তাকিয়ে থাকল কামাল। খুবই নির্বোধ ধরণের মশা। মহান মানব সম্প্রদায়ের দেহ ফুঁড়ে রক্ত চুষে নেয়া ঠিক হবে কি-না তাই নিয়ে চিন্তায় পড়ে গেছে। মাতালের মত উড়ছে এদিকে-ওদিকে। বাঙালি মশা হলে রক্ত নিয়ে এতক্ষণে উধাও হয়ে যেত নিশ্চই। পশ্চিমা বলেই মানুষ নিয়ে এত অনিশ্চয়তা। কামাল এখনই এক তালিতে ব্যাটাকে ভর্তা বানিয়ে ফেলতে পারে। নির্বোধটা যেভাবে বিরক্ত করছে ঠিক সে কাজটাই করা উচিৎ। কিন্তু হাত ওঠাতে ইচ্ছে করছে না। ইচ্ছে হচ্ছে সোফার আরও ভেতরে ঢুকে যেতে। একটি কাঁথা হলে ভালো হতো। সারা দেহ কাঁথায় মুড়িয়ে সোফাতেই ঘুম দিয়ে দেয়া যেত। কাঁথার চিন্তাটিই এতো আরামদায়ক যে কামাল এক লাফে সোফা থেকে উঠে দাঁড়ালো। পার্টির জমজমাট অবস্থা। এখন ইউসুফ ভাইয়ের কাছে কাঁথা-বালিশ চাওয়া ঠিক হবে না। নিজেই কাবার্ড-টাবার্ড খুলে দেখতে হবে। ভিড় ঠেলে কাঁথার খোঁজে পা চালালো কামাল।

দুই

ইউসুফ সাহেব জানেন তিনি অনেক জোরে কথা বলছেন। হাসছেনও বেশি। কিন্তু কিছুতেই নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারছেন না। এত বেশি আনন্দ হচ্ছে যে কি করতে কি করবেন সব তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে! মাঝে মাঝেই মনে হচ্ছে যা দেখছেন-শুনছেন তার সবই স্বপ্ন। এ দিগন্ত সমান অ্যাপার্টমেন্ট তার নয়। এই পার্টি, পার্টির এতো মানুষ, খাবার, পানীয় সবই বুঝি কল্পনা। ঠিক তখন নিজের গলার স্বর, হাসির শব্দ প্রমান দিচ্ছে তিনি জেগে আছেন - আশে-পাশের সবাই তারই নিমন্ত্রিত অতিথি। এ অবস্থায় কিভাবে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করবেন তিনি!

কেউ কিছু একটি বলেছে। মজার কথা নিশ্চই - সবাই খুব হাসছে। হাতের সিভাস রিগ্যলের গ্লাস এক চুমেকে খালি করে না বুঝেই গলা খুলে হাসতে থাকলেন ইউসুফ সাহেব। তিনি নিঃসন্দেহে আজ রাতে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ!

তিন

পাশের কামরায় মহিলাদের মধ্যে দু'টো ভাগ হয়ে গেছে। এক ভাগে মডার্ন ভাবিরা, আর আরেক ভাগে গৃহিণী ভাবিরা। গৃহকত্রী হিসেবে মিসেস ইউসুফকে দুই ভাগের সাথেই একটু একটু করে থাকতে হচ্ছে। এই কিছু দিন আগেও প্রথম ভাগের ভাবিরা তাকে সিকিটিও পাত্তা দিতেন না। তবু আজ কেনো যেনো মডার্ন ভাবিদেরকেই বেশি ভালো লাগছে। প্রথমদিকে তার ধারণা ছিলো শিক্ষিত-মডার্ন হিসেবে পরিচিত ভাবিরা সবাই বুঝি খুব উচ্চশিক্ষিত। কিন্তু ওদের অনেকে তার মতোই ইন্টারপাশ শুনে মনটি ভারী ভালো হয়ে যায়!

মডার্ন ভাবিদেরকে ভালো লাগার অন্য কারণও আছে। তাদের অর্থনৈতিক অবস্থার রাতারাতি স্থানান্তরের পরে এতো দিন যেই ভাবিদের সাথে-সাথে ছিলেন - তাদের ব্যবহারে পরিবর্তন দেখতে পেয়েছেন তিনি। হঠাৎ করেই তাদের দৃষ্টিতে ঈর্ষা-লোভ-ঘৃণা আর অবিশ্বাসের এক মিশ্র আবির্ভূত হয়েছে। তার দিকে এমন ভাবে তাকাচ্ছে সবাই ঠিক যেমন ভাবে তিনি তাকাতেন, এই কিছু দিন আগেও, মডার্ন ভাবিদের দিকে। তিনি আরও খেয়াল করেছেন মর্ডান ভাবিদের আড্ডায় আসলেই ওদিকে কানাকানি শুরু হয়ে যাচ্ছে। অভিমানে বুক ভিজে আসে তার... কি দোষ করেছেন তিনি...? ঠিক করে ফেলেন ওই দিকেই আর যাবেন না।

স্মার্ট ভাবিদের সাথে বসে জীবনে প্রথম চুমুক দিয়ে ফেলেন মদ্য-জাতীয় কোন পানীয়ে। বিস্বাদ পানীয়টুকু গলা শুকনো করে দিয়ে নিচে নেমে যায়। তিনি মনোযোগ দিয়ে সুমনা ভাবীর নতুন কেনা স্কার্টটির কথা শুনতে থাকেন। রঙধনু রংয়ের স্কার্টটি নাকি ডিজাইনার্স কালেকশন! বয়স্ক মহিলাদের জিন্স-স্কার্ট-টপস পরা নিয়ে সব সময় নাক সিঁটকিয়েছেন তিনি। আজ তার মনে হয় বড্ড বড় ভুল হয়েছে... এখন সময় এসেছে সেই ভুলগুলো একে একে শোধরাবার!

চার

মাঠ সমান ব্যালকনির দখল নিয়েছে ভাই-ভাবিদের ইংলিশভাষী পুত্র-কন্যারা। এখন গ্রীষ্মকাল বলে বাইরের আবহাওয়া খুব সুন্দর। এছাড়া ব্যালকনিতে সবার চোখ এড়িয়ে সিগারেট খাবার সুবিধাও আছে। এখানে যারা আছে তারা প্রায় সবাই কৈশোরে। সবচেয়ে কমবয়সী রানা - ১৬ বছর। সবচেয়ে বেশিবয়সী নীপা - ২১ বছর। একটু বড়রা অলরাউন্ডার আজকে। লিভিংরুমে প্রাপ্তবয়স্ক আর ব্যালকনিতে অপ্রাপ্তবয়স্ক দুই দলেই ঘুরে ফিরে আড্ডা চালিয়ে যাচ্ছে।

ব্যালকনিতে মানিয়ে নিতে সবচেয়ে কষ্ট হচ্ছে ফারজানার। তামান্না ফারজানাকে আগে থেকেই চেনে। ফারজানার বাবা-মা প্রচন্ড কড়া। বাংলাদেশের বাবা-মাও মনে হয় না মেয়েকে এতটা শাসনে রাখেন। বেচারা এখানে এক দঙ্গল "বেশি কানাডিয়ান-কম বাংলাদেশী" ছেলে-মেয়েদের মধ্যে পড়ে দিশেহারা বোধ করছে।

তামান্নাকেও ওর বাবা ইউসুফ সাহেব কিছুটা চোখে চোখে রাখার চেষ্টা করেন। কিন্তু তামান্না মোটেই ফারজানার মতো সুবোধ মেয়ে নয়। ওর যা করতে ইচ্ছা করে তা সে সামনে-গোপনে ঠিকই করে ফেলে। আসলে এখানে যারা আছে সবাই কম-বেশী এমনই। বাবা-মা চাইলেই এখানে জন্মানো সন্তানেরা সব অযৌক্তিক শাসন মেনে নেবে কেনো?

তামান্না বিব্রতবোধ করছে কারণ ব্যালকনিতে এক বোতল ভদকা চলে এসেছে! নিয়ে এসেছে সাদিক ভাই। প্রচন্ড ধনীর ছেলে। কানাডাতে লেখাপড়া করতে এসেছে। তামান্না দেখেছে বাংলাদেশ থেকে যারা কানাডাতে আসে তাদের মধ্যে দু'টো ভাগ আছে - "ওভারস্মার্ট-টাইপ" আর "লেবেনডিশ-টাইপ"। দুটিই অসহ্য! তাই ওদের কাছে বাঙালি ছেলে-মেয়েরা তেমন পাত্তা পায় না। কিন্তু সাদিক ভাই এখানে মেয়েদের মধ্যে যে পরিমান জনপ্রিয় তা অবিশ্বাস্য। ছেলেদের মনও তিনি আজ জয় করে নিলেন জ্যাকেটের ভেতরে লুকিয়ে আনা তিন প্যাকেট সিগারেট আর ফ্লেভারড-ভদকার বোতলে। তিনি অবশ্য কড়া ভাবে মানা করে দিয়েছেন ঊনিশের নিচে কাউকে সিগারেট-ভদকা ছুঁতে। সাদিক ভাইয়ের দেখাদেখি আরও কিছু বাঙালি ছেলে ব্যালকনিতে এসে তাদের কষ্ট করে বলা ইংরেজিতে আড্ডা জমানোর চেষ্টা করেছে - কাজ হয় নি।

তামান্না আগে সিগারেট টেনে দেখেছে - ভালো লাগেনি। তবে অ্যালকোহল মুখে দেবার সাহস তার আগে হয়নি। আজ সবাই এক চুমুক-এক চুমুক বলে যেভাবে চাপাচাপি করছে ভয় হচ্ছে পাছে নিজ-কতৃত্ত্বের বাঁধন না আলগা হয়ে পড়ে!

পাঁচ

কামাল একটি কাবার্ডে ঠিক যেমন কাঁথা কল্পনায় দেখেছিলো তেমনটি পেয়ে গেলো। মুগ্ধ ভাবে স্নেহের আঙ্গুল বোলায় কামাল রঙিন সুতোর বুনোনে। বাংলাদেশ থেকে এসেছে কোনো সন্দেহ নেই। কাঁথা দেখেই কি-না কে জানে, থেমে থেমে শরীরে কাঁপুনি দিয়ে উঠে কামালের। মোহগ্রস্থ ভাবে কাঁথা হাতে সোফার দিকে হেঁটে চলে ও। অবাক কান্ড! প্রতিটি পদক্ষেপের সাথে সাথে ব্যাথা ছড়িয়ে পড়ছে সারা দেহে। ফিরে গিয়ে সোফার কোনায় কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়ে কামাল। আহ! ঘুম!

ছয়

লিভিংরুমের এক কোনে বসে কৌতুক নিয়ে চারদিক তাকিয়ে দেখে সাদিক। পার্টির কান্ড দেখে তার খুবই মজা লাগছে। সবাই কি পাগল হয়ে গেল না-কি!

"এই ছেলে এখানে কি? চলো চলো ব্যালকনিতে চলো।" ওর হাত ধরে টানে দিপা।

মেয়েটির বয়স সবে সতেরো। এই বয়সেই সাদিকের সাথে পাগলামি শুরু করেছে! মনে মনে হিসেব কষলো সাদিক - দিপার সাথে ওর বয়সের ব্যবধান প্রায় সাত বছর - সাড়ে সর্বনাশ! সবার সামনে এসে হাত ধরে টানাটানি করা মোটেই পছন্দ হলো না সাদিকের। সবাই কেমন জুলজুল চোখে তাকিয়ে আছে। সন্দেহ নেই এই নিয়ে এখন রসালো গল্প তৈরি হয়ে যাবে।

"তুমি যাও, আমি আসছি!"

"দশ মিনিট ঠিক আছে? এর মাঝে না এলে আমি এসে ধরে নিয়ে যাব কিন্তু!"

দিপা চলে গেলে সদ্যপরিচিত বন্ধুদের দিকে তাকায় সাদিক। যা ভেবেছিল তাই! শুরু হয়ে গেল রসালো আলাপ আর নোংরা ঠাট্টা। এসব থোড়াই পাত্তা দেয় সাদিক।

"সাদিক তুই ইংলিশ মিডিয়ামে ছিলি?" কেউ একজন প্রশ্ন করে।

"না। আমি গভ: ল্যাবের ছাত্র।" আনমনে জবার দেয় সাদিক।

সাত

তামান্না কামালকে কোথাও দেখতে না পেয়ে একটু অবাক হয়। কামাল বাংলাদেশ থেকে স্টুডেন্ট ভিসায় এসেছিলো। কিন্তু পড়াশোনা তো দূরের কথা, কামাল এসেই পুরোদমে বেগল কারখানায় কাজ করা শুরু করে দেয়। গতর খাটানোর কাজ। প্রচন্ড কষ্টের। তার উপরে থাকে ধরা পড়ার ভয়। স্টুডেন্ট ভিসায় এসে লেখাপড়া না করাটা অবৈধ এখানে।

তামান্নার বাবাও একই কারখানায় কাজ করতেন। সেই থেকে দু'জনের পরিচয়। কোন কারণে কামালকে খুবই মনে ধরেছিলো ইউসুফ সাহেবের। ঠিক করে ফেলেছিলেন দু'বছরের মাঝে তামান্নার সাথে বিয়ে দেবেন। তামান্নারা অনেকদিন থেকেই কানাডার নাগরিক। তাই তামান্নাকে বিয়ে করে কামালও বৈধ কাগজ পেয়ে যাবে। কামালের বাবা-মার সাথেও কথা বলে রেখেছিলেন ইউসুফ সাহেব।

তামান্নার এতে কোনো কালেই মত ছিলো না। প্রথমত দুই বছর পরে ওর বয়স হবে তেইশ। তেইশে কেউ বিয়ে করে না। আর তাও কামালকে, যে কিনা নিঃসন্দেহে "লেবেনডিশ-টাইপ"। প্রশ্নই আসে না! তবে বাবা লটারিতে সাত মিলিয়ন ডলার জিতে যাবার পর সব কেমন যেনো বদলে গেলো। তিনি ভেবে দেখলেন কারখানায় কামলা খাটে এমন কেউ তার জামাই হতে পারে না। তার নজর তখন সাদিকের দিকে।

আজ পার্টিতে বাবা সাদিক-কামাল দুই জনকেই একসাথে দাওয়াত দিয়ে দেবেন তা ভাবেনি তামান্না। দাওয়াত দিলেও যে কামাল আসবে তা-ও তামান্না কল্পনা করেনি। লটারি জেতার পর বাবা একদম অন্যমানুষ! যেই অবমাননা-অবহেলা-অসম্মান তিনি কামালকে পদে পদে করেছেন তা-তো প্রকট ভাবেই দৃশ্যত ছিলো। কামালকে এখন যেহেতু চোখে পড়ছেনা - সে সম্ভবত খাবার শেষেই চলে গেছে। ওর জন্য কষ্টই লাগে তামান্নার। আহারে বেচারা!

"ন্যাট, একটা বিড়ি দাও তো... কুইক!"

সাদিকের গলায় ঘোর ভাঙে তামান্নার। ওর ছোট ভাই নান্টুকে সাদিক কেনো যেনো ন্যাট ডাকে। গদগদ ভঙ্গিতে ওকে একটি সিগারেট বাড়িয়ে দেয় নান্টু।

সাদিক যেনো আগাগোড়া মোড়া আভিজাত্য। ক্যাজুয়াল গেস সামার শার্ট, লো-রাইস-বুট-কাট ডেনিম, গুচির হাই-বুট। ধবধবে ফর্সা হাতে ক্রোনোমিটার। তামান্নার হঠাৎ করেই মনে হয় এখন বিয়ে হলেই বা সমস্যা কি?

আট

মিসেস ইউসুফের সাথে গৃহিণী ভাবিদের ছোট-খাট ঝগড়া হয়ে যায়। তিনি দিয়েছেন ভালো মতো দু'কথা শুনিয়ে! ভয় হচ্ছিলো পার্টিই না ভেঙে যায়। কিন্তু সামাল দিয়েছেন নজরুল ভাবি! উনি এখানে স্কুলে পড়ান। বাচ্চাদের ঝগড়া থামিয়ে অভিজ্ঞতা আছে।

আড্ডার জন্য কিচেন থেকে আরও ভাজা বাদাম আনতে গিয়ে দেখা হয়ে যায় সাদিকের সাথে। দেখেই মিষ্টি করে হাসে ছেলেটি। এত সুন্দর করে হাসে, মায়া পড়ে যায়! স্বামী যখন তামান্না-সাদিকের ব্যাপারটি বলেছিলো, তার মন সায় দেয়নি। সাদিক বনেদি ঘরের ছেলে। ও কি আর হঠাৎ পয়সা দেখা তামান্নার বাবা-মাকে পাত্তা দেবে? তাও তিনি লোকমুখে শুনেছেন সাদিক নাকি কাউকে পাত্তা দেয় না। যেখানে সেখানে টাকার গরম দেখায়।

তবে পার্টিতে এতো সাবলিল কেনো সাদিক? নাকি লটারি পাবার পর সাদিকও অন্য সবার মতো বদলে গেলো?

নয়

বিশাল লিভিংরুমটিও সবার ভিড়ে খুব ছোট বলে মনে হয় ইউসুফ সাহেবের। এ তো বিশাল সমস্যায় পড়া গেলো! কামাল গাধাটিকে সোফায় অচেতন অবস্থায় আবিষ্কার করা হয়েছে। গায়ে হাত দেয়া যায় না এতো গরম!

জরুরি নাম্বারে ডায়াল করা হয়েছে। অ্যাম্বুলেন্স আসছে। গাধাকে সেটাতে উঠিয়ে বিদেয় করা হবে। ওদেরকে বললেই হবে ওকে এখানে কেউ ওকে চেনে না - ঝামেলা শেষ। কেবল নজরুল ভাবি একবার বললেন, "এতো অসুস্থ ছেলেটিকে আমরা একা একা অ্যাম্বুলেন্সে তুলে দেবো? কেউ সাথে গেলে হতো না?" কেউ সেই প্রশ্নটির উত্তর দেবারও প্রয়োজন মনে করে না। ঠিক দশ মিনিট পর অচেতন কামালকে নিয়ে ছুট লাগায় অ্যাম্বুলেন্স।

আবার জমে ওঠে পার্টি।
ভাবিতে-ভাবিতে আবার ঝগড়া লাগে।
অপভ্রংশ প্রজন্মের চোখে ব্যবচ্ছেদ হয় মূলহীণ আবার মূলহীণ প্রজন্মের চোখে অপভ্রংশ।
আর বিনা কারনেই গলা ফাটিয়ে হাসতে থাকেন আজ রাতের সবচেয়ে সুখী মানুষটি!

পরিশিষ্ট

চোখ খুলে সব কিছু সাদা দেখে কামাল।

বিছানার চাদর সাদা। জানালার পর্দা সাদা। দেয়ালের রঙ সাদা। এমনকি কামরার মেশিনগুলোও সাদা রঙের। কামাল বুঝে যায় ও হাসপাতালে। গতরাতে কি হয়েছিলো? ও কি ইউসুফ সাহেবের বাসায় অচেতন হয়ে গিয়েছিলো?

ছিঃ ছিঃ! কি লজ্জা... কি লজ্জা!

"অতিরিক্ত পরিশ্রমে এই অবস্থা হয়েছে তোমার। সময় মতো খাওনা বুঝি?" বিছানার পেছনে যে নার্স দাঁড়িয়ে আছে তা লক্ষ্যই করেনি কামাল।

"আমাকে ডিসচার্জ করবে কবে?"

"আজই। তেমন কিছুই হয়নি। তবে কিছু দিন তোমাকে মুঠো মুঠো ভিটামিন গিলতে হবে।"

নার্স এমন ভাবে কথাটি বলে - হেসে ফেলে কামাল।

"মুখে হাসি যখন ফুটেছে তখন তোমার বন্ধুকে ভেতরে আসতে বলি... নাকি?"

অবাক হয়ে যায় কামাল, বন্ধু আবার কে? ইউসুফ ভাই জমজমাট পার্টি ছেড়ে কিছুতেই ওর সঙ্গে আসবে না। বাকি সবারও অ্যাম্বুলেন্স ডেকেই ভারমুক্ত হয়ে যাবার কথা।

"আমার বন্ধু তুমি নিশ্চিত?"

"বলো কি!" চোখ কপালে তোলে নার্স, "গতকাল তোমার মেডিকেল ফর্ম পূরণ করার পর থেকে ঠায় বসে আছে বাইরে। তুমি নাশতা করা শুরু করো। আমি ওকে জানাচ্ছি তোমার ঘুম ভেঙেছে!"

কে হতে পারে? কানাডাতে আসার পর তেমন বন্ধু তো হয়নি ওর। সেই সাত সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত কাজ, মানুষের সাথে মেশার সময় কোথায়! স্কারব্রোর যে দম বন্ধ হওয়া বেসমেন্টে ও থাকে তার আশে-পাশের কামরা গুলোতে শ্রীলংকান তামিলদের বাস। ওদের সাথে সামান্যই কথা হয়। মনে পড়ে আসার পরপরই একবার জ্বরে পড়েছিলো কামাল। তিন দিন টানা পড়ে ছিল বিছানায়। কেউ একবার এসে কপালে হাতও রাখেনি।

দরজা খোলার শব্দে ফিরে তাকায় কামাল। সাবলিল ভাবে হেঁটে ওর নাশতার ট্রে থেকে একটা আপেল তুলে নিয়ে কামড় বসায় সাদিক। ওর দিকে তাকিয়ে চোখ মটকে বলে, "একটা সিন্‌ও দেখাইলিরে ভাই!"

© অমিত আহমেদ

প্রথম প্রকাশ: সামহোয়্যার ইন, ১১ মার্চ ২০০৭
পরিমার্জিত তৃতীয় প্রকাশ: গল্পগ্রন্থ, "বৃষ্টিদিন রৌদ্রসময়", শস্যপর্ব ও শুদ্ধস্বর প্রকাশন, বইমেলা ২০০৯

ব্যবহৃত ছবি © "Scars of Love" by Suzanne Parker


মন্তব্য

নৈয়ায়িক. এর ছবি

শুরুটা খুব চমৎকার লাগলেও, শেষটা ভাল লাগলনা তেমন।

হাসান মোরশেদ এর ছবি

যাক, এই প্রথম সুযোগ পেলাম অমিত আহমেদের গল্পে প্রথম মন্তব্য করার ।
সুযোগ পেলাম যখন কাজে লাগাই ।

ভালো লাগলো, বেশ ভালো । পুরোটা পড়ার পর মনে হলো এর আগে ও পড়েছিলাম ওখানে । ভালো লেগেছিলো তখনো ।
-----------------------------------
'পড়ে রইলাম বিধির বামে,ভুল হলো মোর মুল সাধনে'

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

অমিত আহমেদ এর ছবি

নৈয়ায়িক: হুট করে কেমন ভাবে যেন শেষ হয়ে গেল, তাই তো? গল্পটা নিয়ে সে আফসোস আমারো আছে।

হাসান মোরশেদ: এটা ছিল ছ'বছর পরে আমার লেখা প্রথম গল্প। মননশীলতার সিন্যাপসে মরচে ধরেছিল, তা ছাড়াবার জন্যই পণ ধরে লেখা।

ধন্যবাদ আপনাদের মন্তব্যের জন্য।


আমার বেলা যে যায় সাঁঝ-বেলাতে
তোমার সুরে সুরে সুর মেলাতে

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

অমিত, আপনার লেখা দেখে প্রায়ই ভাবি, এখন না - পরে মন দিয়ে পড়বো। নানা ঝামেলায় আর পড়া হয় না। 'গন্দম'ও ঝুলে আছে এখনো। সেজন্য স্যরি বলে নিই।

"বিবর্তনের শহরে অবিবর্তিত দু'জনা" পড়লাম। মনে হলো - গল্প নয়, চোখে দেখা কোনো ঘটনা তুলে এনেছেন শব্দের কব্জায়। কারণ, পরবাসী শেঁকড় বিচ্যুত এ কনফিউজড মানুষগুলো একেবারে অচেনা কিংবা অবাস্তব নয়। এরা বিদেশ কিংবা দেশ কোনো জায়গাতেই ঠিক নেই। অস্থির।

মন্তব্যে স্বীকার করেছেন,গল্পটা হুট করে শেষ হওয়া নিয়ে আফসোস আছে আপনার। আমার মনে হয় খানিকটা কাটছাট করলে আপনার এ আপসোস কমতে পারে :)।

আরো গল্প পড়ার অপেক্ষায় রইলাম।

অমিত আহমেদ এর ছবি

শিমুল ভাই, আপনার মতামতের জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ। যখন মনে চাইবে তখনই পড়বেন, আমার রদ্দি লেখা পড়তেই হবে এমন তো নয় হাসি

একবার লেখা হয়ে গেলে কেন জানি আর সে লেখা পরিবর্তন করতে ইচ্ছা করে না। এটা আমার অলসতাই হবে হয়তো! দেখি হয়তো করবো কোন দিন।

আপনাকে আবারো ধন্যবাদ!


একটা ঝলসে যাওয়া বিকেল বেলা, একটা লালচে সাগরের জলে
যায় ভেসে যায় স্বপ্ন বোঝাই, নৌকা আমার কাগজের...

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

অমিত ভাই, ঠিক আছে। হাসি

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।