গল্প: স্বপ্নভঙ্গ

অমিত আহমেদ এর ছবি
লিখেছেন অমিত আহমেদ (তারিখ: শুক্র, ১৪/০৯/২০০৭ - ৩:৪৬অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

autoএক

আলতাফ সাহেবের সকাল সকাল অফিস আসা অভ্যাস। বাসা অফিসের কাছে, তাই তিনি হেঁটেই আসেন। সকালের তাজা আবহাওয়াটিও বেশ লাগে। এখন অবশ্য আগের মতো সেই নির্মল ভাবটি আর নেই। সব কেমন বদলে গেছে। যুবা কালে মনে আছে ঢাকায় সকাল সাড়ে সাতটা মানে ছিলো রাত্রি। সামান্য কিছু খেটে খাওয়া মানুষ ছাড়া রাস্তা প্রায় ফাঁকাই থাকতো বলা যায়। এখন এই সাত সকালেও রাস্তায় হাঁটার সময় সতর্ক থাকতে হয়। কখন গায়ের উপড় রিক্সা-সিএনজি উঠে পড়ে। এছাড়া সারাটা হাঁটাপথ দখল করে রাখে কর্মগামী গার্মেন্টেসের মেয়েরা। মেয়েগুলো দুই পয়সা কামাই করতে শিখে লজ্জা-শরম সব খেয়ে বসেছে। পারলে আলতাফ সাহেবকে ধাক্কিয়ে নিয়ে যায়। উনি কুঁকড়ে গা বাঁচিয়ে কালো ধোঁয়া খেতে খেতে পথ চলেন।

অফিসে এতো সকালে আর কেউ আসে না বলে আনকোড়া সংবাদপত্রটি হাতে পাওয়া যায়। আরামবাগের একটি মার্কেটের দোতলায় আলতাফ সাহেবের ইসলামী ব্যাঙ্কের ছোট্ট শাখাটি। পিওন মোস্তাকিম সাতটার সময়ই অফিস খুলে বড় সাহেবের টেবিলে ত্যানা ঘষাঘষি শুরু করে।

তিনি কাঁচের সারি বাঁধা কাউন্টার গুলোর একটায় ঢুকে পড়ে মোস্তাকিমকে ডাকেন, "মোস্তাকিম? ও মোস্তাকিম...!"

"জ্বী ছার?" হাতের ত্যানা কাঁধে ঝুলিয়ে নবাবী চালে কাছে আসে মোস্তাকিম।

"আজকের পেপার আসছে?"

"আসছে তো ছার!"

"কই?"

"বড় ছারের টেবিলে রাখছি!"

"তোরে না কইছি স্যারের টেবিলে রাখার আগে আমাকে দ্যাখায়া যাবি? ক? কই নাই?"

"বড় ছার কইছেন উনার পড়া না হইলে এই দিকে পেপার না আনতে!"

"ওই ব্যাটা তুই তো বেশি বোঝা শুরু করছস? সকাল দশটার আগে স্যার অফিসে আসে? যা পেপারটা নিয়া আয়!"

গজ-গজ করে পেপার আনতে যায় মোস্তাকিম, "ছার চিল্লাইলে কিন্তু আমি কইয়া দিমু আপনি জোর করছেন... আপনের কারণে ছার আমার উপর চিল্লাইবো... এইটা কি ধরনের বিবেচুনা?"

আলতাফ সাহেব খুব যত্ন ভরে পাট না ভাঙা সংবাদপত্রটি হাতে নেন। তরল গলায় বলেন, "যা তো বাবা, এক কাপ চা নিয়া আয়!"

বাসায় তিনি সংবাদপত্র রাখেন না। এটা তার কাছে অহেতুক পয়সা খরচ মনে হয়। বাবলুর মা'র লেখাপড়ার অভ্যাস নেই। তিনি সারাদিন সাংসারিক কাজেই ব্যস্ত থাকেন। আর বাবলুর সংবাদপত্র পড়ার কোন কারন তিনি দেখেন না। সে ক্লাস নাইনে পড়ছে। সংবাদপত্র-গল্পের বই পড়া মানে লেখাপড়া গোল্লায় যাওয়া। কোনো মানে হয় না। এমনিতেই ছেলে বেশ লায়েক হয়েছে। এই কিছু দিন আগে দেখেন পড়ার বইয়ের ফাঁকে লুকিয়ে "মাসুদ রানা" পড়ছে। দু'পাতা পড়ে দেখেছেন তিনি। বইয়ের নাম যেমন গল্পও তেমন। আসতাগফিরুল্লাহ! নষ্টামি ছাড়া কিচ্ছু থাকে না আজকালকার বইগুলোতে। তিনি রাগ সামলাতে না পেরে দিয়েছিলেন গালে দু'টো থাপ্পড় বসিয়ে!

গতকাল এসএসসি-র ফলাফল দিয়েছে। আজ সারা সংবাদপত্র জুড়ে কেবল তারই সংবাদ। কোন স্কুলে কতজন প্রথম বিশে এলো। জেলা ভেদে উত্তীর্ণের হার কেমন হলো। গতবারের চেয়ে এবারের ফলাফল ভালো না খারাপ হলো। কৃতি ছাত্র-ছাত্রী, তাদের শিক্ষক আর বাবা-মা কি বললেন। ইত্যাদি, ইত্যাদি। তিনি সব লেখাই আদ্যোপান্ত পড়েন।

এবারে একটি মেয়ে প্রথমস্থান অধিকার করেছে। একদম প্রথমপাতার প্রথমভাগে বাবা-মা'র সাথে তিন কলাম জুড়ে মেয়েটির রঙিন ছবি এসেছ। মুগ্ধ চোখে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সেই ছবি দেখেন আলতাফ সাহেব। ছবির সাথে লেখায় মেয়ে আর মেয়ের বাবা-মা'র সাক্ষাতকার নেয়া হয়েছে। মেয়ে নাকি কোথাও প্রাইভেটে পড়েনি। মিটি-মিটি অবিশ্বাসের হাসি হাসেন আলতাফ সাহেব। বললেই হলো!

আগামীবার বাবলু পরীক্ষা দেবে। আলতাফ সাহেব যেনো স্পষ্ট দেখতে পান ফলাফল বেরুবার পর বাবলু আর তার ছবি নেবার জন্যও সংবাদপত্রে হুড়োহুড়ি লেগে গেছে। ছোট্ট বাসাটি ভরে গেছে সাংবাদিক আর টিভি ক্যামেরায়। সাংবাদিকেরা জানতে চাইছে বাবলুর সাফল্যের পেছনে কার অবদান বেশি।

এসব ব্যাপারগুলো ছেলেকে আগে থেকেই শিখিয়ে-পড়িয়ে নিতে হবে। চারজন শিক্ষকের কাছে যে প্রাইভেট পড়েছে এসব গোপন করে যেতে হবে। অবদানের কথা হলে বলতে হবে, "আমার বাবার কারনেই আমার এই সাফল্য!" কথাটি মোটেই মিথ্যে হবে না। কোন বিষয়ে কোন শিক্ষক ভালো, কার নোট পড়ে কবে কে মেধা তালিকায় স্থান পেয়েছে, কোন শিক্ষকের দেয়া "সাজেশন" ভালো - এসব কিছুর খোঁজ তো তিনিই রাখেন। তবে ছেলে ছাত্র ভালো হলেও জাগতিক বিষয়ে একটু গর্ধভ আছে। দেখা যাবে হুট করে সে স্কুলের প্রধানশিক্ষকের নাম বলে ফেলেছে।

তিনিই ছেলের সাফল্যের নেপথ্যে সেটি জেনে সাংবাদিকরা নিশ্চই তাকে ঘিরে ধরবে। কি ধরণের প্রশ্ন আসতে পারে আর সেগুলোর জবাব কি হতে পারে তা কল্পনায় বেশ দেখতে পান আলতাফ সাহেব। তিনি যে গ্রামে ধানী জমিতে কাজ করে, গরু চরিয়ে, দুই বেলা খেয়ে-না খেয়ে কষ্ট করে লেখাপড়া করেছেন তা হাইলাইট করতে হবে। "আমি জীবনে কষ্ট করে লেখাপড়ার মূল্য বুঝেছি, আর তাই আমার ছেলেকে..."

"আলতাফ ভাই! নেন মিষ্টি নেন..." সহকর্মী দুলালের গলায় ঘোর ভাঙে আলতাফ সাহেবের।

"কি দুলাল খবর কি? কেমন করছে তোমার ছেলে?"

গর্বের হাসি হাসে দুলাল, "আলহামদুলিল্লাহ আলতাফ ভাই। স্টার মার্কস। পাঁচটা লেটার পাইছে!"

প্যাকেট থেকে একটি কালোজাম তুলে নেন আলতাফ সাহেব, " বাহ! বেশ ভাল রেজাল্ট করছে তো। তা কোন কলেজে পড়াবা ঠিক করছো?"

"ওই সব চিন্তা পরে করুম আলতাফ ভাই! পোলাডা আমার মুখ উজ্জ্বল কইরা দিলো। কাইলকা রেজাল্ট পাইয়া কি-যে আনন্দ হইছে ভাই। আপনারে আর কি কমু! পোলাডা অনেকদিন থেইকা সাইকেল-সাইকেল করতেছিলো। কাইলকা রেজাল্ট শুইনা সেই রাত্তিরেই সায়েন্স ল্যাবরেটরি থেইকা একটা সাইকেল কিইনা আনছি। নে বাবা! যদি শুধু ক্ষমতা থাকতো আলতাফ ভাই... আমি যে কি করতাম!" চোখের কোনের চিকচিকে জল মোছে দুলাল।

মনে মনে হাসেন আলতাফ সাহেব - এ রেজাল্টেই এই! সামনের বছরটা খালি আসুক।

"আরে আলতাফ ভাই! কি হইলো? নেন নেন... আরেকটা কালোজাম নেন।"

হাত বাড়িয়ে আরেকটি কালোজাম তুলে নেন আলতাফ সাহেব।

দুই

রাস্তার ধারের দোকান দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চায়ে চুমুক দেন আলতাফ সাহেব। ছেলের কোচিং শেষ হবে আর কিছুক্ষণের মধ্যেই। এই কোচিং এর মডেল-টেস্টগুলো বেশ ভালো হয় শুনেছেন। মডেল-টেস্টে যেসব প্রশ্ন আসে তার বেশির ভাগই আসল পরীক্ষায় কমন পড়ে যায়। এখানে পর পর দু'টো মডেল-টেস্ট হবার কথা। প্রথম টেস্টের ফলাফল বেশ ভালোই হয়েছিল। সাড়ে তিনশো ছাত্র-ছাত্রীর মধ্যে বাবলু সহ মোট তিনজন এ-প্লাস পেয়েছিল। ছেলের দ্বিতীয় পরীক্ষা নাকি প্রথমটির চেয়েও ভালো হয়েছে। আজ ক্লাস শেষে তারই ফলাফল দেবার কথা।

চা শেষ হবার আগেই বাবলুকে দেখা যায়। সাথে দু'টো মেয়ে। তিনজনেরই মুখ হাসি-হাসি। ছেলের এদিকে আসার কোন লক্ষণ দেখা যায় না। সে খাতা খুলে কি যেনো দেখাচ্ছে দু'জনকে। এসব মেয়েদের ভালো চেনা আছে আলতাফ সাহেবের। বাবা-মা এদের লেলিয়ে দেন ভালো ছাত্রদের পেছনে। হাহা-হিহি করে ছেলেদের মাথা খাবে আর সুযোগ বুঝে নোট-সাজেশন বাগিয়ে নেবে। বাবলু যেমন গর্ধভ... দেখা যাবে বাকবাকুম করে সব বিলিয়ে দিচ্ছে। ছেলের জন্য অপেক্ষা না করে এবার তিনিই হাঁটা দেন। ছেলে আলোচনায় এতো মগ্ন এদিকে ফিরেও তাকাচ্ছে না।

কাছে গিয়ে গম্ভীর গলায় ডাক দেন তিনি, "বাবলু!"

ছেলে চমকে ওঠে। চোখে-মুখে ধরা পড়ে যাবার ভয়। মেয়েগুলোর কাছ থেকে বিদায় না নিয়েই কেমন ভয়ার্ত ভাবে সরে আসে।

"কি? মেয়েগুলা নোট চাইতেছিলো নাকি?"

"জ্বী-না আব্বা!"

"তাইলে? মেয়েমানুষের সাথে এত কি কথাবার্তা?"

জবাব দিতে পারে না বাবলু। কি কথা হচ্ছিল তা তো আর বাবাকে বলা যায় না। চটজলদি কোনো অজুহাতও মাথায় আসে না।

আলতাফ সাহেব অবশ্য জবাবের অপেক্ষাও করেন না। বলেন, "কেউ নোট-সাজেসন চাইলে দিবি না। বলবি "আমার কাছে নাই। আমি নোট-সাজেশন ধইরা পড়ি না।" ঠিকাছে?"

"জ্বী আব্বা!"

"রেজাল্ট দিছে?"

মুখটা উজ্জ্বল হয়ে ওঠে বাবলুর, "জ্বী আব্বা দিছে। এইবারও এ-প্লাস পাইছি। প্রতিটা সাবজেক্টেই এ-প্লাস!”

কঠোর মুখ একটু পেলব হয় আলতাফ সাহেবের। জিজ্ঞেস করেন, "আর কেউ এ-প্লাস পাইছে?"

"পাইছে আব্বা। পঞ্চান্নোজনের মতো!"

নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারেন না আলতাফ সাহেব।

"পাঁচ-পঞ্চাশজন? পাঁচ-পঞ্চাশজন এ-প্লাস পাইছে?" কঠোর গলায় জেরা করেন তিনি।

"জ্বী!" কি ভুল করেছে তা বুঝতে না পেরে ভয়ে-ভয়ে বাবার দিকে তাকায় বাবলু।

"পাঁচ-পঞ্চাশজন ক্যামনে এ-প্লাস পাইবো? গর্ধভ কোথাকার! কে কইছে এইটা?"

"ক্লাসে স্যার কইলো...” আত্মবিশ্বাসহীণ গলায় বলে বাবলু।

"গর্দভ জানি কোনখানকার। মায়ের মতো গাধা হইছোস! এত্তো বয়স হইলো বুদ্ধি হইলো না। চল দেখি তোর স্যারের লগে কথা কই। বলে কি-না পাঁচ-পঞ্চাশ জন এ-প্লাস পাইছে।"

বাবলুকে হাতে ধরে হিঁচড়ে কোচিং-সেন্টারে নিয়ে যান আলতাফ সাহেব।

***

"আপনি রাগ করছেন কেনো? আপনার ছেলে তো খুবই ভাল করেছে।" ভদ্রলোকের রাগের কারণ বুঝতে না পেরে কেমন বিভ্রান্ত হয়ে যান কোচিং-ব্যবস্থাপক, মধ্য-ত্রিশের রব স্যার।

"সাড়ে তিনশত ছাত্র-ছাত্রীর মইধ্যে ক্যামনে পাঁচ-পঞ্চাশজন এ-প্লাস পায় সেইটা আপনে আমারে বুঝান। এইটা কি সম্ভব? এ-প্লাস কি গাছে ধরে?"

"চাচা সিস্টেম তো পরিবর্তন হয়ে গেছে। এখন লেটারগ্রেডে সবকিছু। আশির উপর নাম্বার পেলেও সেটা এ-প্লাস। আবার নব্বুইয়ের উপরে পেলেও তাই। আর দুই-তিনটা সাবজেক্টে খারাপ করলেও এখন এভারেজে এ-প্লাস চলে আসে। ধরেন আপনি বাংলায় সত্তর পেলেন আবার ম্যাথে পেলেন নব্বুই, তাহলে দুই সাবজেক্টের এভারেজে আপনার গ্রেড হয়ে যাচ্ছে এ-প্লাস!"

"সব বিষয়ে ভালো করলে আলাদা কোনো গ্রেড নাই?"

"সরকারী ভাবে নাই। তবে বেসরকারী ভাবে সব বিষয়ে এ-প্লাস পেলে আমরা সেই রেজাল্টকে বলছি "গোল্ডেন এ-প্লাস"।"

এবারে একটু শান্ত হন আলতাফ সাহেব।

"আরে সেইটাই তো কইতেছি। কিছু একটা তো থাকবো ভালো ছাত্র বুঝানের লাইগা। পোলাপাইন কষ্ট কইরা কেন পড়বো যদি এইসব না থাকে।"

"জ্বী!" সায় দেন রব স্যার।

"এইবার কন গোল্ডেন এ-প্লাস কয়জন পাইছে?"

"জ্বী সাঁইত্রিশ জন।"

হা হয়ে তাকিয়ে থাকেন আলতাফ সাহেব।

"আপনি আমারে কন সাত-তিরিশ জন গোল্ডেনপ্লাস পাইছে?" গলায় উষ্মা নিয়ে জিজ্ঞেস করেন আলতাফ সাহেব।

"জ্বী!" অসহায় ভাবে মাথা নাড়েন রব স্যার।

রাগ সামলাতে পারেন না আলতাফ সাহেব।

টেনে টেনে বলেন "আ-ই-চ্ছা! আ-ই-চ্ছা! বুঝছি ব্যাপারটা। ব্যবসা না? ব্যবসা? বেশি এ-প্লাস দিলে ব্যবসা ভাল হয় না?"

"দেখুন আপনি ব্যাপার বুঝতে পারছেন না। পুরো সিস্টেম চেঞ্জ হয়ে গেছে। এখন একটু ভালো করলেই সবাই এ-প্লাস, গোল্ডেন এ-প্লাস পাচ্ছে।"

"আমারে আপনে হাইকোর্ট দেখান? প্রতি জিলায় বিশজন স্ট্যান্ড করতো এর এখন শ'য়ে শ'য়ে গোল্ডেন পাইবো? এইসব ব্যবসা আমরা বুঝি না ভাবছেন?"

এবারে আর রাগ সামলাতে পারেন না রব স্যার।

কড়া গলায় বলেন, "চাচা আপনি কিন্তু নিয়ম না বুঝে বাড়াবাড়ি..."

"হেই বেয়াদ্দপ!" দড়াম করে ধমক দেন আলতাফ সাহেব, "দুই দিনের পোলা তুমি আমারে নিয়ম শিখাও? আশিতে এ-প্লাস হইলে নিশ্চই সরকার সবাইরে লাইন ধইরা এ-প্লাস দিবো না। কম-কম কইরা নাম্বার দিবো য্যান সবাই এ-প্লাস না পায়। এইটা কি আমরা বুঝি না?"

শিক্ষিত একজন বয়স্ক লোকের মুখে এমন কথা শুনে হতভম্ব হয়ে যান রব স্যার। কি বলবেন বুঝে পান না। এদিকে উঁচু গলা শুনে মজা দেখতে দাঁড়িয়ে গেছে আরও কয়েকজন।

"আপনার বালের কোচিং-এ পড়াইলাম না আমার ছেলেকে। ওই আয়! চল আমার সাথে!"

পাশে দাঁড়ানো বিব্রত ছেলের হাত ধরে টান মারেন তিনি।

তিন

আজ বিকেলে পরীক্ষার ফল দেবে বলে দুপুরেই বাসায় চলে আসেন আলতাফ সাহেব। তিনি বাসায় থাকলে স্ত্রী-ছেলে দু'জনেই ভয়ে কাঠ হয়ে থাকে। পান থেকে চুন খসলেই তিনি ভয়াবহ হয়ে ওঠেন।

আজ বাসায় এসেই তিনি ছেলেকে নিয়ে বসেছেন। ছেলের পরীক্ষা খুব ভাল হয়েছে। গোল্ডেন জিপিএ যে পাবে সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। সে হিসেবে আজ রাতে বাসায় ফটো-সাংবাদিক, সাংবাদিক, টিভি-রিপোর্টারদের ভিড় লেগে যাবার কথা।

কি কি প্রশ্ন আসতে পারে আর তার কি জবাব হবে তা বার বার করে শিখিয়ে দিয়েছেন তিনি বাবলুকে। বাবলুর মা'কেও তামিল দেয়া হয়েছে। এখন কেবল সাংবাদিকদের আসার অপেক্ষা। তিনি উত্তেজনায় বারান্দায় গিয়ে বসেন। এমনও তো হতে পারে সাংবাদিকরা বাসা খুঁজে পাচ্ছে না। বারান্দা থেকে রাস্তার দিকে ভালো নজর রাখা যায়।

চায়ের কাপ হাতে ভয়ে ভয়ে বারান্দায় আসেন বাবলুর মা সিতার বেগম। স্বামীর উত্তেজনা দেখে ভয়ে বুক কাঁপে তার। ছেলে বলেছে এবারে অনেক গোল্ডেন জিপিএ হবে। আগের মতো প্রতি জেলায় বিশজন করে মেধা তালিকায় থাকবে না। কিন্তু সেই কথা বাবাকে কে বলবে? আর ছেলে যদি গোল্ডেন জিপিএ না পায়? সেই অলুক্ষুণে চিন্তায় শরীর ঠান্ডা হয়ে আসে তার। আল্লা না করুক। বাসায় কেয়ামত হয়ে যাবে না হলে! তিনি ভয়ে ভয়ে চায়ের কাপ এগিয়ে দেন।

চায়ের দিকে একবার তাকিয়ে খেঁকিয়ে ওঠেন আলতাফ সাহেব, "তোমাকে না বলছি বেশি জর্দা দিয়ে পান আনো? পান আনার আগে চা আনছো ক্যানো?"

"বাসায় জর্দা নাই। বাবলুকে জর্দা আনতে পাঠাইছি।"

রাগে ব্রক্ষ্মতালু জ্বলে ওঠে আলতাফ সাহেবের, "মাথায় কি বুদ্ধি-শুদ্ধি কিছু দেয় নাই আল্লাতালা তোমাকে? না-কি? এখন কি বিবেচনায় তুমি ওকে বাইরে পাঠাইলা? যে কোনো সময় সাংবাদিক আসতে পারে।"

চা হাতে মুর্তির মত দাঁড়িয়ে থাকেন সিতার বেগম।

"এখনো দেখি চা নিয়ে দাঁড়ায় আছে!"

চা নিয়ে রান্নাঘরে ফিরে যেতে যেতে সূরা ইয়াসিন পড়েন সিতারা বেগম। আল্লা তুমি ছেলেটাকে গোল্ডেন জিপিএ পাওয়ায় দাও। আলতাফ সাহেবের সাথে প্রায় পঁচিশ বছরের সংসার তার। এরপরেও তার সাথে তিনি সেভাবে মানিয়ে নিতে পারেননি। আত্মমুখী আলতাফ সাহেবকে তিনি চিনতে পারেননি। লোকটা কখন কি বুঝে কি করে আর কি ভাবে - তা তার আজও অজানাই থেকে গেছে।

সন্ধ্যা নামার সাথে সাথে অস্থিরতা বাড়তে থাকে আলতাফ সাহেবের। বিকেলেই ফলাফল চলে আসার কথা। এখনো একবারও বাসার ফোন বাজলো না। সাংবাদিকের দেখা মিললো না। অফিস থেকে দেশের পাঁচটি জাতীয় সংবাদপত্রের ফোন নাম্বার টুকে এনেছিলেন তিনি। ধৈর্য্য রাখতে না পেরে সেই ধরে প্রথম নাম্বারে ডায়াল করেন তিনি।

"জ্বী হ্যালো... আপনারা কি ম্যাট্রিকের রেজাল্ট পাইছেন?"

"এসএসসি? জ্বী পেয়েছি। আপনি কে বলছেন?"

"আমি ছাত্রের অভিবাবক। আপনারা রেজাল্ট নিয়া নিউজ করতেছেন না এইবার?"

"জ্বী করছি তো। আপনি আপনার ছেলের রেজাল্ট পাননি?"

"জ্বী না।"

"আপনার ছেলে কোন স্কুলে পড়ে?"

"গভঃ ল্যাবরেটরি।"

"খুব ভালো রেজাল্ট হয়েছে তো এবার গভঃ ল্যবের। আপনার ছেলে কি বাসায়? ওকে এক্ষুণি স্কুলে পাঠিয়ে দিন। স্কুলে সবাই আনন্দমিছিল করছে খবর পেলাম। আমাদের ফটোসাংবাদিক ইতিমধ্যে ওখানে চলে গেছে।"

"না... মানে... যারা স্ট্যান্ড করছে?"

"আঙ্কেল এখন তো আর স্ট্যান্ড নাই! এক ঢাকাতেই হাজার হাজার এ-প্লাস জিপিএ। এর মধ্যে কয়েকশো গোল্ডেন জিপিএ।"

গলাটা কেমন শুকিয়ে আসে আলতাফ সাহেবের।

"কয়েক শো?"

"জ্বী আঙ্কেল। আপনি ছেলেকে এক্ষুনি স্কুলে পাঠিয়ে দিন। আগামীকাল নিউজপেপারে গ্রুপ ছবি চলে আসতে পারে..."

আস্তে করে ফোন নামিয়ে রাখেন আলতাফ সাহেব।

চার

ভয়ে ভয়ে বারান্দায় আসেন সিতারা বেগম। অনেক রাত হয়ে গেছে। ঠান্ডা বাতাস দিচ্ছে। আলতাফ সাহেব এখনও ঠায় কাঠের চেয়ারে বসে আছেন। এভাবে বসে থাকলে বুকে কফ জমে যাবে। তবে সে কথা তুলতে ভয় পান তিনি।

"বাবলু গোল্ডেন এ-প্লাস পাইছে! হের বন্ধুরা কল দিছিলো।"

কোনো উৎসাহ দেখান না আলতাফ সাহেব।

বলেন, "আমি কখনো ভাল ছাত্র ছিলাম না সিতারা!"

অনেকদিন পর স্বামীর মুখে নিজের সিতারা নাম শোনেন বাবলুর মা।

"লেখাপড়া বলো, খেলাধুলা বলো, কোনোটাতেই আমি ভালো আছিলাম না। অনেকে গান গায়, কবিতা ল্যাখে, বিতর্ক করে... আমি ওইসবও কখনো করতে পারি নাই।"

সিতারা বেগম কাছে গেলে তার হাত ধরে ফেলেন আলতা সাহেব, "সারা জীবন ফেলনা একটা মানুষ থাইকা গেছি। আমারে নিয়া কেউ কথা কয় না। রাস্তা দিয়ে হাঁইটা গেলে কেউ আঙ্গুল তুইলা কয় না - ওই যে, ওই আলতাফ সাহেব যায়।"

ঘড়ঘড়ে গলায় স্বাস নেন তিনি, "সাধারণ চাকরি করি। অন্য সবার মতো ঘুষ খাই। সনাতন পথের বাইরে যেই পথ সেই পথে কখনো যাইতে পারি নাই। সাহসে কুলায় নাই। সবাই যা কইছে করছি। যা বুঝাইছে বুঝছি।"

"কিন্তু... কিন্তু পোলাটা যখন ক্লাস ফাইভ বৃত্তি পাইলো... জীবনে প্রত্থম লোকে আমারে দেখায় কইলো - ওই যে ওই আলতাফ সাহেব। উনার ছেলে বৃত্তি পাইছে। সেই থেইকা শুরু। পোলা আমার কি চায়, কি ওর জন্য ভালো, সেইটা তো আমি কক্ষনো ভাবি নাই! কেবল চাইছি সে এইটেও বৃত্তি পাক। ম্যাট্রিকে স্ট্যান্ড করুক। পেপারে আমাগো ছবি আসুক। সব্বাই সেই ছবি দেখায়া বলুক - আরে আমাগো আমাদের আলতাফ সাহেব না? কিন্তু এইটা কি হইলো সিতারা? এই করতে গিয়া তো আমি তো আমি ছেলের কাছে ছোট হইয়া গেলাম! আমি তো হের কাছে মাথা উঁচু কইরা দাঁড়াইবার অধিকার হারাইলাম সিতারা!"

আস্তে আস্তে ডুকরে ডুকরে কাঁদা বয়োবৃদ্ধ মানুষটির মাথায় হাত বুলিয়ে দেন সিতারা বেগম।

পঁচিশ বছরের সংসার-জীবনে প্রথমবার। এই প্রথমবার তার মানুষটিকে রক্তমাংসের মানুষ বলে মনে হয়।

উৎসর্গ: শ্রদ্ধেয় আরিফ জেবতিক ভাই। একটি মন্তব্যের মাধ্যমে তিনি আমাকে গল্পটির প্লট দিয়েছিলেন।

© অমিত আহমেদ

পরিমার্জিত দ্বিতীয় প্রকাশ: গল্পগ্রন্থ, "বৃষ্টিদিন রৌদ্রসময়", শস্যপর্ব ও শুদ্ধস্বর প্রকাশন, বইমেলা ২০০৯

ব্যবহৃত ছবি: The Sorrows of the King (1952) By Henri Matisse


মন্তব্য

মাহবুব সুমন এর ছবি

গুরুর প্লৎা মারাত্মক ছিলো, গল্পটাও ভালো হয়েছে , তবে যতটুকু আবেগ আসা দরকার ছিলো আলতাফ সাহেবের সেটা গল্পকার ফুটিয়ে তুলতে পারেন নাই যুত মতো । তবে ভালো লেগেছে এটা ঠিক।

অমিত আহমেদ এর ছবি

...অথবা যতটা আবেগী আলতাফ সাহেবকে ভাবছেন ততটা হয়তো তিনি নন।

ঝামেলা সহ্য করে মতামত দিয়েছেন সেজন্য আমার কৃতজ্ঞতা জানবেন।


একটা ঝলসে যাওয়া বিকেল বেলা, একটা লালচে সাগরের জলে
যায় ভেসে যায় স্বপ্ন বোঝাই, নৌকা আমার কাগজের...

আরিফ জেবতিক এর ছবি

ভালো হইছে! নিচে আসার আগে জানতাম না এই প্লটটা আমি দিয়েছিলাম।
মজা লেগেছে।

তুমি তো ক্রমেই সত্যিকারের কথা শিল্পী হয়ে উঠছো দেখছি।
-------
এখন পাঠক হিসেবে কিছু মূল্যায়ন:

১. কোচিং সেন্টারের অংশটুকুর দরকার নেই।।অধিকাংশ চাকরিজীবি বাবা কিন্তু ছেলের কোচিং সেন্টার পর্যন্ত খবর পান না।

তাছাড়া,জিনিষটার শেষ পর্যায়ে একটা শক দরকার।
কোচিং সেন্টারের কারনে বুঝা যাচ্ছে যে আলতাফ সাহেবের কাছে কিছু তথ্য আগে থেকেই ছিল যে অনেকেই জিপিএ ৫ পায়।এটার কি দরকার আছে?
রেজাল্টের দিন খবরটা জানলে বেশী ভালো হয় না?

অমিত আহমেদ এর ছবি

ধন্যবাদ আরিফ ভাই!
আপনার সাজেশন গুলো নিয়ে ভাবছি।


একটা ঝলসে যাওয়া বিকেল বেলা, একটা লালচে সাগরের জলে
যায় ভেসে যায় স্বপ্ন বোঝাই, নৌকা আমার কাগজের...

দৃশা এর ছবি

আমার কইলাম অলথ্রু ভালাই লাগলো...
আমার এক ফ্রেন্ড আছিল...তার বাপে এই আলতাফ সাহেব থেইকাও কঠিন জিনিস আছিল। স্কুলতো স্কুল উনি উনার পোলারে কলেজেও পর্যন্ত দিয়া আসত আবার সময় হইলে নিয়া যাইত। এখন পোলা মেডিকেল কলেজে পড়ে অথচ এখন পোলার প্রতিটা আইটেম কার্ড সব কিছুর স্কোরের পুংখানুপুংখ হিসাব রাখে...ডেইলি টিচারগো লগে পোলার বিষয়ে আলাপ করে। যারে বলে পরম ভালবাসার চরম পেইন।

দৃশা

এস এম মাহবুব মুর্শেদ এর ছবি

একজন আলতাফ সাহেব ছাড়াও আশেপাশে আরেকটু তাকাইলে হইত। তবে বেশ ভাল হইছে। থাম্বস আপ।

====
চিত্ত থাকুক সমুন্নত, উচ্চ থাকুক শির

নিঘাত তিথি এর ছবি

আমার ভালো লাগলো। এরকম ক্যারেকটার আসলেই আছে, অতিরিক্ত লেগে থাকা ছেলেমেয়ের সাথে। তবে স্ট্যান্ড করা আর জিপিএ সিস্টেমের দ্বন্দের আইডিয়াটা দারুণ। থিমকারক (এটা কি রকম বাংলা হলো?) এবং লেখক দুজনকেই অভিনন্দন।

--তিথি

----------------------------------------------------
আমার এই পথ চাওয়াতেই আনন্দ

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

বরাবরের মতোই অমিত আহমেদ।
একটা ব্যাপার আমার খুব কনফিজড মনে হয়, এই যে সবাই বলে এ প্লাস পেলো, এ পেলো, বি প্লাস পেলো। এটা কি রেজাল্ট? নাকি গ্রেড?
জিপিএ সিস্টেমে পয়েন্টটাই তো রেজাল্ট হওয়ার কথা, যেমন ফাইভ আউট অব ফাইভ অথবা ফোর পয়েন্ট এইট, নাইন! নাকি!

অমিত আহমেদ এর ছবি

হুমম! ব্যাপারটা সেরকমই কিনা আমি ঠিক নিশ্চিত নই। আমার লজিক বলে লেটার গ্রেড আর জিপিএ দুটোই ফলাফল। একটা লেটার দিয়ে রিপ্রেজ়েন্ট করা হয়েছে আরেকটা নাম্বার দিয়ে।

এখানে অবশ্য কেউ জিপিএ মনে রাখে না। "What's your average?" প্রশ্নের উত্তরও আমরা দেই "A"


ব্লগস্পট | অর্কুট | ফেসবুক | ইমেইল

অমিত আহমেদ এর ছবি

দৃশানিঘাত তিথি: কি আর বলবো দুঃখের কথা, আমার মাও কিঞ্চিত সেইরকম ছিলেন ম্যাট্রিকের সময়। তাঁকে হয়তো কেউ বলল, "ওই স্যার তো তুখোড় পড়ায়"। ব্যাস, আমার কানের কাছে "রেডিও আম্মাজান" চালু হয়ে যাবে।

এস এম মাহবুব মুর্শেদ: ছোট গল্প তো, তাই আর আশে-পাশে তাকাইলাম না হাসি

আনোয়ার সাদাত শিমুল
: থ্যাংকস ব্রাদার!


ব্লগস্পট | অর্কুট | ফেসবুক | ইমেইল

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।