গল্প: যদি...

অমিত আহমেদ এর ছবি
লিখেছেন অমিত আহমেদ (তারিখ: শনি, ৩০/০৬/২০০৭ - ১২:০০অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

autoঘুম থেকে উঠেই একটা সিগারেট ধরায় কামাল। আজকাল সিগারেট খেলে বুকে ব্যাথা করে। দম নেয়ার সাথে সাথে বুঝতে পারে গলায় কোথাও ধোঁয়া আটকে যাচ্ছে। প্রশ্বাসের সাথে জমে থাকা শ্লেমার খড়খড়ানিটা স্পষ্ট অনুভব করা যায়। সস্তা সিগারেটে টানের সাথে সাথে মনে হয়, যদি কেউ থাকতো কাছে এখন! অভিমান নিয়ে কেউ যদি বলতো, "আর না, অনেক হয়েছে। আর একটা সিগারেটও ধরাতে পারবে না!" ঘড়ি দেখে কামাল, ভোর সাড়ে চারটা। সাড়ে পাঁচটার সময় বিস্কুটের কারখানায় কামলা খাটতে যেতে হয়। মাকে একটা গ্রামীনের ফোন কিনে দিয়েছে বড় খালুর মাধ্যমে। সেই মোবাইলের নাম্বার টিপে নিজের ক্ষয়ে আসা কিপ্যাড থেকে। মা বুড়ো হয়ে গেছেন। এখন বাবার কাছে পৌঁছুনোর অপেক্ষা। "মা, আমি ভালো আছি। বউ ভাল আছে। নাতির মুখ দেখবে মা। আমার প্রমোশনটা হোক। হবে মা। এই বছরের শেষেই হবে। টাকা পাঠাতে হবে মামাকে? বোনকে? পাঠাবো!" ফোন রেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। বিয়ে করেছিল পাসপোর্ট পারার আশায়। মা সেটা জানেন না, ভেবে বসেছেন এখানে সুখের সংসার সাজিয়ে বসেছে সে। বোনটা বিয়ে করে সেই পার্বত্য চট্রগ্রাম। যোগাযোগ বলতে কেবল টাকা পাঠানোর ফর্ম। বাংলাদেশের একটা ডিগ্রী ছিল ওর। নাকি ছিল না? এখন ঠিক মনেও পড়ে না। আহারে, কি কষ্টের জীবন। ভোর থেকে রাত দশটা পর্যন্ত হাড় ভাঙা খাটুনি। একটু কষ্ট করে একটা ডিপ্লোমা করে ফেললে ভাল একটা চাকরি পাওয়া যেত না? কেন যাবে না? কিন্তু কার জন্য? যদি কেউ থাকত, যদি কেউ বলতো ঠোঁট ফুলিয়ে, "তোমার কষ্ট ভাল্লাগে না আমার। কান্না পায়। ভাল একটা চাকরী খুঁজে নাও লক্ষিটি!"

সময় বাঁধা বাসটি বাসস্টপে সময় ধরেই চলে আসে।

কাজে কথা কমই বলে ও। ট্রাক থেকে মাল নামতে ওঠাতে কথা বলার সুযোগটাই বা কোথায়। তাই এতদিন বিদেশে থেকেও ইংরেজীটা ওর রপ্ত হলো না। কাজ শেষে পাঞ্চ মেশীনে নিজের কার্ড পাঞ্চ করে বেরিয়ে আসে ও।

নির্ভরযোগ্য বাস সময় ধরেই ওকে তুলে নেয়।

আসার পথে ভিক্টোরিয়া পার্কে নামে। কিছু বাজার করা দরকার। বাজার শেষে মক্কা রেস্টুরেন্টে ঢুকে খিচুরি মাংসে হাত মাখায় কামাল। ভাল কিছু রান্না করার ইচ্ছা জাগে না ওর। একার জন্য রান্না করার কোন মানে নেই। স্বপ্নে একটা মেয়েকে দেখে ও। ওর আসার সময় দাঁড়িয়ে আছে গেটের সামনে। সারাটা দিন ওর পছন্দের পদ রান্না করছে লক্ষী মেয়েটা। আহা যদি সেই মমতার ছিটেমাত্র থাকত মক্কার এই খিচুড়িতে। "মানুষ এখানে স্টুডেন্ট ভিসায় আসে সিটিজেনশিপের ধান্দায়, সব আবাল। পড়তে আসছিস, আগে পড়া শেষ কর। তার আগেই ফ্যাক্টরিতে কাজ!" কথাটি কে বলছে মুখ ফিরিয়ে দেখে কামাল। ছেলেটিকে চেনে ও, অমিত আহমেদ। কষ্টের হাসি হাসে কামাল। হায়রে অমিত, সারাটা জীবন প্রাচুর্যে থেকে তুই কি বুঝবি মানুষের বাধ্যকতা। এক হাতে বাজারের ব্যাগ ধরে পা টেনে টেনে বাসার দিকে হাঁটে কামাল। বাঙালি এলাকার বাঙালি কথা। ধার্মিক মানুষটি রাস্তার পাশের উদ্দামতা দেখে সন্তানের হাত আরও শক্ত করে ধরে বলেন, "আসতাগফিরুল্লাহ! ওদিকে দেখতে হয় না বাবা!" হায়রে একটা হাত ধরার ক্ষমতাও তোমার খোদা আমাকে দেয়নি। যদি দিত!

চাবি ঘুরিয়ে নিজের অন্ধকার বেসমেন্টে ঢুকে পড়ে ও। মুখে পানি দিয়ে বিছানায় উঠে পড়ে। একটা বেজে গেছে। কাল আবার সকালে কাজ। বালিশে মাথা রাখতেই ঘুমে জড়িয়ে আসে চোখ। মাগো, ছোট্ট বোনটা আমার... চোখ ভেঙে আসে ক্লান্তি, আসে নিঃসঙ্গতা, আর স্বপ্ন, যদি...

© অমিত আহমেদ

প্রথম প্রকাশ: সামহোয়্যার ইন ব্লগ, ৩০ মে ২০০৭
পরিমার্জিত দ্বিতীয় প্রকাশ: গল্পগ্রন্থ, "ফেলে আসা গল্প যতো", সীমাহীন সংলাপ, ২০০৯


মন্তব্য

কেমিকেল আলী এর ছবি

প্রথম প্যারা তো তোর গল্প, মানে বিড়ি খাইতে খাইতে ঝামা হইয়া গেলি!!

বুঝতে সময় লাগতাছে- গল্পের মানে!!

অমিত আহমেদ এর ছবি

ওরে সর্বনাশ, প্রথম পাতায় না দিয়েও কমেন্ট পেয়ে গেলাম হাসি

হাসান ভাই, সামহোয়্যারে দেয়া আপনার কমেন্ট আমার মনে আছে। বহুৎ ধন্যবাদ!

সেলিম ভাই, গল্পের মানে বেশী খুঁজতে না যাওয়াই ভালো। যা লিখেছি তাই, কোন ঘোরপ্যাঁচ নাইরে ভাই। কষ্ট করে পড়ার জন্য আপনাকেও ধন্যবাদ!


আমার বেলা যে যায় সাঁঝ-বেলাতে
তোমার সুরে সুরে সুর মেলাতে

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

অমিতের গল্প মিস করি...

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।