গন্দম | পাঁচ

অমিত আহমেদ এর ছবি
লিখেছেন অমিত আহমেদ (তারিখ: শনি, ১৪/০৭/২০০৭ - ৮:৩০অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

৬ ফেব্রুয়ারী, ২০০৭
সময়: রাত ৮:০০-৮:৩০
স্থান: চিত্তরঞ্জন এভিনিউ, কোলকাতা

চিত্তরঞ্জন এভিনিউয়ের জমাট বাঁধা ছোট্ট এক অ্যাপার্টমেন্টে ঋতুদের বাস। জমজমাট এলাকা বলে এই ছোট্ট অ্যাপার্টমেন্টের জন্যও বাবা-মাকে বেশ বড় অঙ্কের টাকাই গুনতে হয়। তবু এখানে দাঁত কামড়ে পড়ে থাকার একমাত্র কারন হচ্ছে বাবার অফিস, মা'র স্কুল আর ওর কলেজ - এই তিনটিই বাসা থেকে একদম কাছে।

বাবার এলাহবাদ ব্যাঙ্ক আর মা'র এসএসবি স্কুল - দু'টোই চিত্তরঞ্জন এভিনিউতে। বাসা থেকে বেরিয়ে মা হাঁটা দেন ডানে আর বাবা বামে। ওর প্রেসিডেন্সী কলেজটাও বাম দিকেই পড়ে, কিন্তু হেঁটে যাবার মত এতটা কাছে নয়। ঋতু বেরিয়ে বাস নেয় - বাসা থেকে কলেজ মোটে পঞ্চাশ পয়সা ভাড়া। এ ভাড়াটা অবিশ্যি ওর বাবা-মাকে দিতে হয় না। ওদের অ্যাপার্টমেন্টেরই এক মাড়োয়াড়ি পরিবারের ক্লাস ফাইভের মেয়েকে পড়ায় ও। সেই সাথে কলেজেও একটা বৃত্তি আছে। সেই থেকে টিউশন আর টুকটাক হাতখরচের টাকা দিব্যি উঠে আসে।

ঋতুর কামরাটা একদম রাস্তা ঘেঁষে বলে পড়ার টেবিলে থেকে জানালা দিয়ে দিব্যি রাস্তার ট্রাম-বাস দেখা যায়। রাস্তার ওপাড় থেকে লাল-নীল নিওন আলো জানালা বেয়ে টেবিলের সামনের দেয়ালে পড়ে একটা বিমূর্ত ছায়া তৈরী করে। খোলা বই সামনে রেখে সেই ছায়ার দিকেই ঠায় তাকিয়ে আছে ঋতু।

রাজীবের কথা ভাবলেই রোম খাড়া হয়ে আসছে ওর। হাত ধরার স্মৃতি মনে পড়লেই পেটের মাঝে শিরশিরে ঠান্ডা স্রোত বয়ে যাওয়ার মত এক অদ্ভুত অনুভুতি হচ্ছে। অনুভূতিটা এরকম যেন কেউ একমুঠো বরফকুচি ওর পাকস্থলী-ফুসফুস-শিরায়-উপশিরায় ছড়িয়ে দিয়েছে। এমন অনুভূতি আগে কক্ষনও হয়নি ওর। অসহ্য ঋতুর মনে হয় এখন ময়দানে গিয়ে খোলা আকশের নিচে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে কাঁদলে ভালো লাগতো ওর। এমন হলো কেন? কেন হলো এমন? এমনতো হবার কথা ছিল না। ও তো কখনও চায়নি এমন কিছু হোক। এ কোন পরীক্ষা নিচ্ছেন ভগবান ওর!

আজ দীপক কি বুঝেছে কে জানে ট্যাক্সিতে সারাটা পথ ও কোন কথা বলেনি। ঋতুও সারাটাক্ষণ অন্যপাশে সিঁটিয়ে বসে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ছিল। দীপকের চোখে চোখ রাখার সাহস ওর ছিলো না।
বাসার সামনে নামিয়ে দিয়ে দীপক শুধু বলেছে, "কাল কলেজে আসবো?"
ঋতু 'এসো' বলে পালিয়ে বেঁচেছে।
কাল যখন দীপক আসবে তখন কি বলবে ওকে?

ঋতু দু'হাতে শক্ত করে মাথা চেপে বসে থাকে। ও বুঝে উঠতে পারে না কেন ওর নির্বোধের মত কান্না পাচ্ছে! কান্নাটা কি দীপককে ও ভালবাসেনা সেটা বুঝতে পেরে? নাকি যে ভালবাসা কেবল ওর কল্পনায় ছিল সেটা হঠাৎ এভাবে নিরাভরণ হয়ে সামনে এসে দাঁড়িয়েছে বলে?

মা স্নানে ছিলেন, কখন পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন ঋতু খেয়ালও করে না। ঋতুর মা প্রতিমা সেন অবাক হয়ে দেখেন মেয়ে তার দুহাতে মাথা চেপে ধরে ব্যাকুল ভাবে কাঁদছে!

সময়: রাত ৮:৩০-১০:৩০
স্থান: পার্ক হোটেল, পার্ক স্ট্রিট, কোলকাতা

পার্ক হোটেলের ডিলাক্স রুমে উল্টেপাল্টে টিভির চ্যানেল ঘুরায় রাজীব। কিছু একটা করার কথা ছিল ওর, হোটেলে এসে সেটা এখন কিছুতেই মনে পড়ছে না! পার্ক হোটেলের ভারতীয় গরম্যে 'স্যাফরনে'র অনেক নাম শুনেছে, সেখান থেকে অর্ডার করা ডিনার - 'পালাং পনির', 'চিকেন টিক্কা', 'চাটনী' আর 'বাটার তান্দুরি' অবহেলায় পাশে পড়ে থাকে। মুখে এক বিন্দু রুচি নেই।

ঋতুর নাম্বার কি হতে পারে তার একটা লিস্ট করে এক টুকরো কাগজে টুকে রেখেছে ও। মোটে সাতটা নাম্বার আছে সেখানে। একটা না একটা ঋতুর নাম্বার হবেই।

না হলেও ঋতুকে বের করার অন্য উপায় আছে। মেয়েটার পুরো নাম মনে আছে ওর 'ঋতু সেন'। প্রেসিডেন্সী কলেজে পদার্থ বিজ্ঞানে দ্বিতীয় বর্ষে পড়ে। কলেজের রেজিস্ট্রি চেক করে ওকে ঠিকই বের করা যাবে। রেজিস্ট্রি দেখতে না দিলেও উপায় আছে, পদার্থ বিজ্ঞানের দ্বিতীয় বর্ষের ক্লাস কোথায় হয় সেটা বের করে ক্লাসের সামনে দাঁড়িয়ে থাকলেই হয়। ঋতু যেরকম ভালো ছাত্রি, মনে হয়না কোন ক্লাস ফাঁকি দেয়।

ঋতুকে খোঁজার পদ্ধতি গুলো অবচেতন মনেই যাচাই করছিল রাজীব, হঠাৎ সম্বিত ফিরতেই শিউরে ওঠে ও। একটা মেয়ে, যাকে একবার মাত্র দেখেছে, তাকে খুঁজে বের করার জন্য ক্লাসের সামনে দাঁড়িয়ে থাকার মত নিচ চিন্তাও ও করছে। ভেবে ঘেন্না আসে ওর, ছিঃ! হাতের লিস্টটা মুচড়ে দলা পাকিয়ে দেয়ালে ছুঁড়ে দেয় ও।

মাথাটা নষ্ট হবার জোগাড় হয়েছে। আর নষ্ট মাথা ঠিক করার মাত্র একটা উপায়ই ওর জানা আছে। রুমের ছোট্ট ফ্রিজারটা খুলে বিতৃষ্ণা নিয়ে লিকারের মাইক্রোস্কোপিক বোতল গুলো দেখে রাজীব। হোটেলওয়ালারা কেন যে এই বোতল গুলো ফ্রিজে রাখে মাবুদই জানেন! লিলিপুটদেরও তো মন ভরবেনা ওগুলোতে!

রাজীব গতকালই দেখে রেখেছে হোটেলে পান করার মত জায়গা আছে দু'টো। শুধু তৃষ্ণা নিবারণের জন্য বার 'রক্সি'। আর নাচ-গানের সাথে পানের জন্য ক্লাব 'তান্ত্রা'। 'তান্ত্রা'তে সম্ভবত টাকা দিয়ে ঢুকতে হয়। কিন্তু যেহেতু ও পার্ক হোটেলেই থাকছে, চাবি হিসেবে ব্যবহৃত মাগনেটিক কার্ডটা দেখালেই ওকে ঢুকতে দেবার কথা। কিন্তু এখন নাচ-গানের চেয়ে গলা ভেজানোটাই বেশী গুরুত্বপূর্ণ।

কার্ড আর ওয়ালেটটা তুলে নিয়ে 'রক্সি'র উদ্দেশ্যে পা বাড়াতেই ওকে চমকে দিয়ে ফোন বেজে ওঠে। হতবিহ্বল রাজীব তাকিয়ে থাকে হোটেলের ফোনের দিকে। কে জানে ওর এই নাম্বার? রিসেপশন থেকে কল দিয়েছে?

ফোন উঠিয়ে 'হ্যালো' বলতেই ভাইয়ার গলা শোনে ও। ভাইয়া ঠান্ডা গলায় বলেন, "হোটেলে সাত দিনের ভাড়া একসাথে চুকাতে বলেছিলাম, সেটা করেছিস?"

"করেছি!"

"এসেই মোবাইল নিতে বলেছিলাম। সে নাম্বার তোর ইমেইল করার কথা আমাকে। তার কি হলো!"

গলা শুকিয়ে গেল রাজীবের। এটাই করার কথা ছিল হোটেলে এসে, একদমই মনে ছিল না "মোবাইলের জন্য হোটেলে বলেছি। কালই পাবার কথা।" বেমালুম মিথ্যা বলল রাজীব।

"ঠিক আছে। সে নাম্বার আমাকে ইমেইল করবি। আমি সে নাম্বার না পাওয়া পর্যন্ত রোজ ফোন-ফ্যাক্সের দোকান থেকে হোটেলেই কল দেবো, নয়টা থেকে দশটার মধ্যে।"

"আচ্ছা!"

"তোকে কি কি বলেছিলাম মনে আছে?"

"আছে!"

"তবু একে একে আবার বলছি শোন। এক. বাংলাদেশের কোথাও তুই কল করবি না, প্রয়োজনে আমাকে ইমেইল করবি।"

"আচ্ছা!"

"দুই. মোবাইলটা নিবি যে নামে হোটেলে উঠেছিস সে নামে। ভালো কথা পাসপোর্টটা কোথায়?"

"হোটেল জমা রেখেছে। ওটা নাকি সিকিউরিটির জন্য জমা রাখা নিয়ম।"

হুট করে রেগে গেলেন ভাইয়া, "তোকে না বলেছি পাসপোর্ট সব সময় সাথে রাখতে? বলেছি? না বলিনি?"

"বলেছো, কিন্তু..."

দড়াম করে ধমক দিলেন ভাইয়া, "আবার মুখের ওপর কথা বলে!" আতঙ্কে বুকটা কেঁপে গেল রাজীবের। ভাইয়া সাধারণত রাগেন না কিন্তু রাগলে... ভাইয়ার রাগকে তাই যমের মত ভয় পায় সবাই, "রিসেপশনে গিয়ে বলবি পাসপোর্ট ফেরত দিতে। এক হপ্তার ভাড়া জমা আছে, স্টুপিডরা আবার কিসের সিকিউরিটি চায়? নিয়ম দেখালে বলবি প্লেনের টিকেট কাটতে পাসপোর্ট লাগবে। ঠিক আছে?"

"আচ্ছা!"

"তিন. মোবাইল থেকেও বাংলাদেশে কোন কল না। নেটওয়ার্ক ভালো এমন প্রোভাইডারের কাছ থেকে কানেকশন নিবি, একবার কল করেই যেন পাই।"

"ঠিক আছে!"

"আর চার. ক্রেডিটকার্ড ব্যবহার করবি না। একদম না। ডলার যা দিয়েছি, সেগুলো দুই ভাগে ভাগ করে এক ভাগ নিজের কাছে রাখবি আরেক ভাগ হোটেলে। কলকাতার রাস্তার অবস্থা ঢাকার মতই, ছিনতাই হলে হোটেলের টাকাটা রিজার্ভে থাকবে।"

"আচ্ছা!"

"যতটা টাকা তোর সাথে আছে তা দিয়ে হপ্তা দুই আরামেই কাটার কথা। এরপরে লাগলে যে ঠিকানাটা দিয়েছি সেখানে যাবি। খুব প্রয়োজন ছাড়া ওদিকে পা মাড়াবি না।"

"আচ্ছা!"

এতক্ষণে গলাটা নরম হয়ে আসে ভাইয়ার, "কেমন আছিস তুই?"

গলা আটকে আসে ওর, "ভালো!"

"আমি তোকে ঢাকার আপডেট জানাবো। দুঃশ্চিন্তা করিস না। ঠিক মত খাওয়া দাওয়া করিস। সকাল সকাল ঘুমিয়ে পড়িস। মা খুব চিন্তায় আছেন তোকে নিয়ে, সারাটা দিন জায়নামাজে ছিলেন!"

উঠে আসা কান্না চাপে রাজীব, "আর বাবা?"

"বাবাকে তো চিনিস। উনি এমন ভাব করছেন যেন কিছুই হয়নি। কিন্তু মনে মনে অনেকটাই ভেঙে পড়েছেন। বোঝা যায়।"

"আর... ওদিকে..." প্রশ্নটা শেষ করতে পারে না রাজীব।

খানিকক্ষণ চুপ থাকেন ভাইয়া। এরপর আস্তে করে বলেন, "আগের মতই...!"

কিছুক্ষণ কথা হয় না কোন প্রান্তে, "ভাল থাকিস!" বলে ফোনটা রেখে দেয়ন ভাইয়া। ভাইয়ার শেষ কথাটার মধ্যে এত নিবিড় একটা মমতা ঝরে পড়ে যে দুম করেই চোখে পানি চলে আসে রাজীবের।



পার্ক হোটেলের 'রক্সি বারে'র ডেকোরেশনটা দেখার মত। পুরো রুমটাই কারুকাজ করা কাঠ দিয়ে ঢাকা। রুমে হলুদাভ আলোয় একটু দূরে দূরে সাজানো মোমবাতি জ্বালানো গোল টেবিল। রুমের একদম সোজাসুজি বাঁকা ভাবে উঠে আসা লম্বা টানা শক্ত প্লাস্টিকের বেগুনি আলোয় মোড়া পার্লার।

রাজীব বারের ডেকোরেশন দেখার কোন উৎসাহ বোধ করে না। সটান পার্লারের উঁচু চেয়ারে বসে একের পর এক রাম-কোকের অর্ডার করতে থাকে। কলকাতায় পানীয়ের দাম অবিশ্বাস্য সস্তা! আমেরিকাতেও এত সস্তায় ককটেল বিক্রি হয়না, বাংলাদেশ তো দূরের কথা।

মোবাইল ফোন আর পাসপোর্ট দুই সমস্যারই সমাধান হয়েছে। রিসিপশনে যে ছেলেটা ছিল সে বেশ করিৎকর্মা। পাসপোর্ট চাইতেই কোন কথা না বলে বের করে দিয়ে দিয়েছে। মোবাইল কিভাবে পাওয়া যাবে জিজ্ঞেস করাতে গলা নামিয়ে বলেছে ও নিজেই নাকি মোবাইল ব্যবসা করে। হোটেলে উঠে অনেকেই নাকি মোবাইলের খোঁজ করেন তাই কতৃপক্ষের চোখ এড়িয়ে তার এই গোপন ধান্দা।

রাজীবের কাছে ঢাকার খালি সেটটা ছিল। ছেলেটা তক্ষুনি ব্যাগ থেকে একটা সিম বের করে সেটায় লাগিয়ে দিল। হাচ এর কানেকশন। কলকাতায় নাকি ওরাই সেরা সার্ভিস দেয়। রেজিস্ট্রেশনের ঝামেলাটা এড়ানো যাচ্ছে বলে রাজীব কোন দরদাম করেনি। তক্ষুনি ওকে দুই হাজার রুপি ধরিয়ে দিয়েছে।

রাম-কোকে চুমুক দিতে দিতে সেটের দিকে তাকিয়ে থাকে রাজীব। যে কোন দেশে নিমিষে কথা বলার অদ্ভুত এই যন্ত্র! কিন্তু কোথাও কল দেবার অনুমতি ওর নেই। হঠাৎ করেই এই তিনশো বছরের শহরে নিজেকে বড্ড একা মনে হয় রাজীবের।

সময়: রাত ৯:৩০-১২:০০
স্থান: চিত্তরঞ্জন এভিনিউ, কোলকাতা

মা কখন পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল মোটেই টের পয়নি ঋতু। ও যে কাঁদছিল সেটাও মা জড়িয়ে ধরার আগে বোঝেনি ও। মা ব্যাকুল ভাবে জিজ্ঞাস করছিলেন, "ঋতু, কি হয়েছে মা? কেউ কিছু বলেছে?"
কোন জবাব দিতে পারেনি ঋতু। মা'রা হয়তো জানেন মাঝে মাঝে মেয়েদের এমনি কান্না পায়। তবু জবাব না পেয়ে আরও জড়িয়ে ধরেছেন প্রতিমা, আওড়ে গেছেন একই প্রশ্ন গুলো।

খাবার টেবিলে জোর করেই খেতে হয়েছে ঋতুর। মা সারাক্ষণ তাকিয়ে ছিলেন ওর দিকে। বাবারা মনে হয় এত খেয়াল করে কিছু দেখেননা। তিনি আপন মনেই গল্প করে গেছেন ক্রিকেটের, রাজনীতির। ঋতু শোনার ভান করেছে।

মা জেদ ধরেছিলেন আজ ঋতুর সাথে শোবেন। সেটা এটা-ওটা বলে পাশ কাটাতে হয়েছে ঋতুর। মা'র সাথে শুতে পারবেনা আজ ও। মা আদর-সোহাগ দিয়ে সত্যি কথা ঠিকই বের করে ফেলবেন। মা'দের এই ক্ষমতাটাও বোধহয় থাকে।

এছাড়া ঋতুর মন বলছিল আজ রাজীবের ফোন আসবে। কেন তা জানে না, কিন্তু খুব মনে হচ্ছিল। মোবাইলটা সে সাইলেন্ট করে রাখে রাত্রে, যেন দীপক কল করলে সেটা বাবা-মা'র কানে না যায়। দীপক সাধারণত রাত সাড়ে দশটা থেকে এগারোটার দিকে ফোন করে। আজ দীপকের ফোন সে ধরবে না। দীপকের সাথে কথা বলার সময় রাজীব যদি কল করে না পায়!

একটু আগে পর্যন্ত রাজীবকে নিয়ে ওর ভাবনায় একটা অপরাধবোধ ছিল। ভাবনার ফাঁকে ফাঁকে দীপক উঁকি দিয়ে ও যে কতটা নির্লজ্ব সেটা আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু মা'র কাছে ধরা পড়ার পর দীপকের সব চিন্তা কর্পূরের মত উড়ে গেছে। মনে হচ্ছে এই বিদেশী ছেলেটার জন্য সব করতে পারে ও। সব!

সাড়ে এগারোটা পর্যন্ত অপেক্ষা করে ঘরের বাতি নিভিয়ে দিল ঋতু। বাতি নেভালেও রাস্তার নিওনের জন্য সম্পূর্ণ অন্ধকার হয়না ঘর। একটা আলোছায়ার লুকোচুরি থাকে। সেই আলোর দিকে তাকিয়ে আবার কান্না পেল ওর। এবারের কান্না অপমানের। ও বুঝতে পারে রাজীবের কল আসবে না।

যে ছেলেটার একটা কলের জন্য ও নির্বোধের মত এতক্ষণ অপেক্ষা করেছে সেই ছেলেটার করা অপমান আজ মেমোরিয়ালের অপমানের চেয়েও তীব্রতর মনে হয় ওর। সেই চারটে ছেলের অপমান ছিল কেবল খোলশে, কিন্তু এ ছেলেটার অপমান খোলশ ভেদ করে দেহের প্রতিটা অনুরণনে ছড়িয়ে পড়েছে বিষের মত।

হঠাৎ মোবাইলের কাঁপনে চমকে ওঠে ঋতু। দীপকের কল ভেবে ফোন তুলে একটা অচেনা নাম্বার দেখে ও।
"হ্যালো" বলতেই একটু পরে একটা চেনা কন্ঠ শোনে ঋতু।
রাজীব বলে, "ঋতু, তুমি কাঁদছিলে?"

আজ সারা রাত ঋতু চিন্তা করেছে রাজীবের ফোন আসলে কি কি বলবে। কিন্তু এখন, এ মুহূর্তে রাজীবের কন্ঠ শুনে ভুলে গুলে খেয়ে বসে ও!

[চলবে...] © অমিত আহমেদ


মন্তব্য

অমিত আহমেদ এর ছবি

পরের পর্বে আর দেরি হবে না, দু'তিন দিনের মধ্যেই পাবেন হাসি


অলৌকিক ভাই দুটো ইমেইল করেছি আপনাকে একটু আগে। একটু চেক করেন প্লিজ।

আমার বেলা যে যায় সাঁঝ-বেলাতে
তোমার সুরে সুরে সুর মেলাতে

নজমুল আলবাব এর ছবি

দুই আর তিন মিলে যেন পাচ না হয় হে ভ্রাতা।

-----------------------------------
পড়িয়া আরাম পাইয়াছি। তবে আতঙ্কিত। নায়ক বেটায় খুনি টুনি নাকি?

অমিত আহমেদ এর ছবি

আরে না।
অনেক ঝুলাইছি, আর না।
এখন থেকে নিয়মিত!
কেমন লাগলো সে মতামত তো পাইলাম না!


আমার বেলা যে যায় সাঁঝ-বেলাতে
তোমার সুরে সুরে সুর মেলাতে

শোহেইল মতাহির চৌধুরী এর ছবি

খুব গতিশীল।
অমিত আহমেদের লেখা মেদহীন। মনে হয় পাশে বসে সত্য একটা ঘটনা নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বলছেন লেখক। তবে যা বলছেন তাই সব না। আরো আছে। অনেক ছোট ছোট রহস্য। আরো শুনতে হবে। পাঠক আটকে থাকে। আর এই পর্ব শেষ হলেই তার মনে হয় এ্যাতো তাড়াতাড়ি শেষ হলো। যেমন মনে হয়েছে অলৌকিকের।

ভাষাটা ঝরঝরে। তাই বলে নবিশের কলম চালানো নয় এটা। লেখকের বিশেষ ভঙ্গি ধরা যায় সতর্ক হয়ে পড়লে। পাঠকের সেই ভঙ্গি আবিষ্কারের কোনো দরকার নেই। কোনো অতিরিক্ত কেরদানি না থাকায় গল্পটা, কাহিনীটাই মুখ্য। তথাকথিত সাহিত্য করেননি লেখক। যেধরনের লেখায় ভাষা থাকে, ভাব থাকে, অথচ গল্পটাই থাকে না। উপমা, বিশেষণ আর বর্ণনার ভার গল্পের গতিকে থামায় না। পাঠককে হোঁচট খেতে হয় না। হয়তো বা বর্ণনার বাইরে ভিন্ন কিছু ভাবার সুযোগও পাঠক পায় না।

আজ এই পর্যন্তই। লেখক তার ছকে যেভাবে কাহিনী উন্মোচন করবেন বলে দাগ কেটে রেখেছেন তা শেষ হোক, তারপর প্রাণখুলে আমরা প্রশংসা করতে বসি।
শুভেচ্ছা।
-----------------------------------------------
সচল থাকুন ---- সচল রাখুন

-----------------------------------------------
মানুষ যদি উভলিঙ্গ প্রাণী হতো, তবে তার কবিতা লেখবার দরকার হতো না

অমিত আহমেদ এর ছবি

মতাহির দা, আপনার কমেন্টে আমি আপ্লুত - এমন কন্সট্রাকটিভ মন্তব্য খুব কমই পাওয়া যায় কোন লেখায়।

কোথাও কোন ভুল হলে দয়া-মায়া না করে বলে দেবেন, এই একটা অনুরোধ আমার রইলো।

অনেক ধন্যবাদ আপনাকে!


আমার বেলা যে যায় সাঁঝ-বেলাতে
তোমার সুরে সুরে সুর মেলাতে

দিগন্ত এর ছবি

হঠাৎ করেই এই সাড়ে চারশো বছরের শহরে নিজেকে বড্ড একা মনে হয় রাজীবের।
- সাড়ে চারশো বছর কোন শহরের বয়স? কোলকাতা তো ১৬৯০ সালে শুরু বলে জানি ...


পথের দেবতা প্রসন্ন হাসিয়া বলেন, মূর্খ বালক, পথ তো আমার শেষ হয়নি তোমাদের গ্রামের বাঁশের বনে । পথ আমার চলে গেছে সামনে, সামনে, শুধুই সামনে...।

অমিত আহমেদ এর ছবি

ভুল ধরিয়ে দেবার জন্য ধন্যবাদ। এটা ঠিক করে নিচ্ছি এক্ষুনি।


ভালবাসি, ভালবাসি, ভালবাসি তোমায়!
ব্লগস্পট | ফেসবুক | ইমেইল

দিগন্ত এর ছবি

আপনি যদি কোলকাতার আপার-মিডল ক্লাস নিয়ে লিখতে চান তাহলে আমি আপনাকে আরো কয়েকটা পয়েন্ট দিতে পারি যেগুলো এখানে পরিবর্তন এনেছে গত কয়েক বছর আর আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে দাড়িয়েছে-
১) সস্তার এয়ারলাইন্স (এয়ার ডেকান) (আগে লোকে ট্রেনে ছাড়া দিল্লী, চেন্নাই বা মুম্বই যেত না, আজকাল লোকে সস্তার প্লেনেই যায়, এরকমই আলোচনা)
২) সফটওয়্যার-এর চাকরি (আগে লোকে সরকারী চাকরি ছাড়া ভাল চাকরি বুঝত না, এখন যারা বেসরকারি চাকরি পায়না তারাই সরকারি চাকরিতে যায় এরকমই মতামত)
৩) বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য (মাঝে মাঝেই দোষ স্বীকার করে নেন আর লগ্নি নিয়ে অনেক কথা বলেন - ঠিকঠাক কমিউনিস্টেরা (যেমন বর্ধমানের) অপছন্দ করে কিন্তু কোলকাতার মানুষ পছন্দ করেন)
৪) নন্দীগ্রাম (পূঁজি আসা দরকার না মানুষের অধিকার - বিতর্ক চলতেই থাকে)।
৫) টেররিস্ট (পৃথিবী উচ্ছন্নে গেল - বিতর্ক হল আমেরিকাই এগুলো করাচ্ছে নাকি?)


পথের দেবতা প্রসন্ন হাসিয়া বলেন, মূর্খ বালক, পথ তো আমার শেষ হয়নি তোমাদের গ্রামের বাঁশের বনে । পথ আমার চলে গেছে সামনে, সামনে, শুধুই সামনে...।

অমিত আহমেদ এর ছবি

দিগন্ত আপনার পয়েন্টগুলো আমার কাজে আসবে। ভাবছি পর্ব-চার এ দীপক ও বন্ধুদের আলাপে আপনার সাজেস্ট করা কিছু বিষয় জুড়ে দেব। কলকাতা কেন্দ্রিক পরবর্তি পর্বেও কিছু আসবে। আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ!


ভালবাসি, ভালবাসি, ভালবাসি তোমায়!
ব্লগস্পট | ফেসবুক | ইমেইল

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।