স্বপ্ন বোঝাই কাগজের নৌকা আমার ১

অমিত আহমেদ এর ছবি
লিখেছেন অমিত আহমেদ (তারিখ: শনি, ২০/১০/২০০৭ - ৮:০৯পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

বাবা আমাকে কখনও তেমন কোন খেলনা কিনে দেননি!

খেলনা পাবার তাগিদটা আমিও কোন অজানা কারনে কখনো অনুভব করিনি। ব্যাপারটা এমন যে আমাকে যে খেলনা কিনে দেয়া হয়নি - সেটাই আমি খেয়াল করেছি এই মাত্র ক’দিন আগে! কানাডার বন্ধুদের সাথে ছোটবেলার আলাপ হচ্ছিল। ওরা সবাই মিস্টার পটেটোহেড, জিআইজো, বারবি আর ট্রান্সফর্মারের ধাপ পার হয়ে এদ্দুর এসেছে।

সে আলোচনায় অংশগ্রহন করতে গিয়ে দেখলাম আমার আসলে সে সময় কোন খেলনাই ছিল না! একদম ছিল না বললে মিথ্যাচার হয়ে যাবে। মাথায় লাল-নীল বাতি সহ একটা খেলনা পুলিশের গাড়ি (আর টুকটাক কিছু খেলনা) আমার ছিল - সেটাকোন জন্মদিনে কারও উপহার দেয়া। সে গাড়িটাও সিড়ি থেকে ফেলে দিলে কি হবে সে আবিষ্কারের নেশায় শতটুকরো করা হয়েছিল।

আমার ছোট ভাই সমিত আমার চার বছরের ছোট। ওকেও কোন খেলনা কিনে দেয়া হয়নি। কাকতালীয় ভাবে সমিতের একমাত্র খেলনাটাও জন্মদিনে পাওয়া, সেটা আবার একটা পুলিশ মটর সাইকেল। সে মোটর সাইকেলে সানগ্লাস পরা, সটান বসা এক প্লাস্টিকের পুলিশও ছিল। আমার উদাহরণ থেকে শিক্ষা নিয়ে মা সেটাকে বেশিরভাগ সময় আমাদের নাগালের বাইরেই রাখতেন!

খেলনা না কিনে দেয়ার পেছনে কি কারণ থাকতে পারে সেটা নিয়ে আমি বেশ কিছুদিন থেকেই ভাবছি। বাবাকে জিজ্ঞেস করলেই অবশ্য জানা যায়, কিন্তু এখন দেশের বাইরে থাকি বলে অল্পতেই বাবা-মার ব্যকুল হয়ে ওঠার বদঅভ্যাস হয়েছে।

এখন আমাকে ছেলেবেলায় খেলনা কেন কিনে কেন দেয়া হয়নি সে কৈফিয়ত চাইলে দু’জনেই মহা পেরেশানীতে পড়ে যাবেন। ভাববেন, আহা ছেলাটা না জানি কত কষ্ট পাচ্ছে ছেলেবেলার সে ঘটনা মনে করে! এ নিয়ে আমাকে নিদেন পক্ষে দুই দিন ফোনে কথা বলে পরিষ্কার করতে হবে, মন খারাপ নয়, এমনিতেই জানতে চাইছিলাম।

আমার মনে হয় না এ নিয়ে কোন সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা বাবার ছিল। আমাদেরকে খেলনা কিনে দেয়া হয়নি কারন আমরা কখনও চাইনি। আর বাবাও প্রয়োজন বোধ করেন নি। ব্যাপারটা অর্থনৈতিক নয় - পরিবারের প্রথম সন্তানের আবদার মেটাবার সামর্থ্য বাবার পুরোদমেই ছিল।

খেলনার অভাবেই হয়তো, আমি পড়তে শিখেছি খুব তাড়াতাড়ি। ক্লাস টুতে থাকতেই আমি ধুমিয়ে রঙিন ছবিওয়ালা গল্পের বই পড়া শুরু করেছি। বাবা খেলনা কিনে না দিলে কি হবে, বই কিনে দেবার ব্যাপারে উদারপন্থী ছিলেন। ক্লাস থ্রীতে উঠতে না উঠতে আমার মণীষীদের ছেলেবেলার তিনটে খন্ডই পড়া শেষ।

আমার কল্পনা শক্তি যেটা আছে সেটা হয়তো ছোটবেলা থেকেই বই পড়ার অভ্যাসের কারনে। অন্যরা যখন ট্রান্সফর্মার পেন্সিল বক্স নিয়ে খেলতো, তখন আমি দেখতাম আমাদের বিল্ডিং বেয়ে তড়তড়িয়ে উঠে যাচ্ছে স্পাইডারম্যান। অন্যরা যখন লোগো সাজিয়ে গাড়ি বানাতে ব্যস্ত, তখন আমি পলিথিন কেটে বানাতাম প্যারাস্যুট।

আমার ছোট ভাইটাও ছিল একদম আমারই মত। ও হাঁটতে শেখার পর থেকে মনে হয় না কখনও আলাদা থেকেছি আমরা। আমাদের মধ্যে প্রতিযোগীতা ছিল, প্রতিদ্বন্দীতা ছিল, কাকে বাবা-মা বেশী গুরুত্ব দিচ্ছেন সে নিয়ে রেশারেশী ছিল, গুহামানবদের মত অদম্য মারামারিও ছিল, কিন্তু একজন আরেক জনকে ছেড়ে যে থাকা যায় সে ধারণাটা ছিল না। দেখা যেত এই হয়তো মারামারি-রক্তারক্তি হয়ে গেল, এর পরমুহূর্তেই দু’জনে মহানন্দে মার চোখ ফাঁকি দিয়ে শিরীষ কাগজ দিয়ে বারান্দার রেলিংয়ের রং সাফ করছি। ও পড়তে শেখার আগে আমিই পড়ে শোনাতাম কাঠুরের কুড়াল হারানোর গল্প কিংবা ছোট্ট মাছের বাঁধের পানিতে আটকা পড়ার গল্প।

ঢাকার বাতাসে গ্রামের গন্ধ

আমদের আদি বাসস্থান ছিল মিরপুরে। আমার জ্ঞান হবার পরে দেখেছি যতদূর চোখ যায় কেবল ধানি জমি। আউশ-বোরো দুইই ফলতো। ছিল পুকুর, যেখানে জেলেরা জাল ফেলে মাছ ধরতেন। আর ছিল সারি সারি আম, জাম, পেয়ারা, বড়ই আর করমচার গাছ। বেশি দিন আগের কথা না কিন্তু! অথচ এখন নিজের কাছেই নিজের অবাক লাগে ঢাকার বুকে এমন জায়গা থাকতে পারে ভেবে! তখন পীরেরবাগ নামের সে জায়গাটাতে রিক্সাও যেত না। শ্যাওড়াপাড়ায় নেমে গিয়ে কাঁচা রাস্তা ধরে হাঁটতে হতো।

প্রথমদিকে আশে পাশে উঁচু কোন বাড়ি ছিল না আমাদের তিনতলা বাড়িটা ছাড়া। আমাদের বাসার একদম সামনেই ছিল রিটায়ার্ড সৈনিক চৌধুরী চাচার একতলা বাসা। সে বাসার নামটাও সেই রকম টংকার মেশানো “রণকেলী”! চৌধুরী চাচারা থাকতেন সিলেটে, তাই বাসাটা খালিই পড়ে থাকতো। সে বাসার সামনে দুটো টেনিস কোর্ট ফেলা যায় এমন একটা উঠোন ছিল, আর সে উঠোন ঘিরে ছিল আম, জাম আর পেয়ারা গাছ।
ডান দিকে ছিল মিতুদের টিনশেড বাসা। মিতু আমার কয়েক বছরের ছোট হবে হয়তো।

মিতুদের বাসার সাথেই লাগানো ছিল সিদ্দিক চাচাদের টিনশেড বাসাটা। রবীন্দ্রভক্ত সিদ্দিক চাচার বাসাটার নামটা ছিল খুব সুন্দর “সোনার তরী”। সে বাসার সামনেই বোম্বাইওয়ালাদের পাকা একতলা দালান। ও বাসায় যাঁরা থাকতেন তাঁরা আসলে ভারতীয়, এসেছিলেন বোম্বাই (হালের মুম্বাই) থেকে... সেই থেকেই নাম হয়ে গেছে বোম্বাইওয়ালার বাসা। উনারা মিশতেন না কারো সাথেই, বাসার চারপাশে দেয়াল, আর সে দেয়ালের একমাত্র দরজাটা যে সব সময় তালাবন্ধ থাকতো তা বেশ মনে আছে।

আমাদের বামদিকে একটু দূরেই আট-দশটা পরিবারের একটা ছোটখাট বস্তি ছিল। সেখানে থাকতো রিক্সাচালক, মুড়ি বিক্রেতা, পুরানো সংবাদপত্রের সওদাগর সহ আরও কিছু খেটে খাওয়া লোক।

আমার বাবা-মাকে যেসব কারনে আমি সম্মান করি তার একটা হলো বাংলাদেশীদের মজ্জাগত অর্থনৈতিক বৈষম্যতার বোধটা তাঁরা কখনোই আমার মাঝে ইমপ্ল্যান্ট করার বদচেষ্টা করেননি। মিতু, সিদ্দিক চাচার মেয়ে শাকিলা, সুমিদের সাথে আমি যেমন খেলেছি, ঠিক তেমনি খেলেছি বস্তির রহিম, করিম, জাকির আর জোহরাদের সাথে।

ক্লাস টু-থ্রী পর্যন্ত সমিতকে বাসায় রেখে খেলতে যেতে হতো আমার। বস্তির ছেলেমেয়েদের সাথে সবাই যে খেলতে পারেনা সেটা আমি প্রথমদিকেই বুঝে ফেলি যখন দেখি ওদের সাথে খেলতে মানা আমার অন্য বন্ধুদের। আমি দু’দলেই সমান ভাবে ছিলাম বলে আমাকে নিয়ে একটা টানাটানি ছিল। অন্যদলে সমবয়সী কোন ছেলে ছিল না বলে আমি রহিম, করিম, জাকিরদের সাথেই তুলনামূলক বেশি সময় পার করেছি। স্কুল থেকে এসেই বেড়িয়ে পড়তাম। দলবেঁধে ধানক্ষেতের আইলে ঘুরে বুনো হাসের বাসা খুঁজে বের করতাম। পাটকাঠি দিয়ে ফাৎনা, বাঁশের কঞ্চি দিয়ে ছিপ আর এক টাকার চাঁপা শুটকি দিয়ে টোপ বানিয়ে ধরতাম মাছ। মায়ের সেলাইয়ের বাক্স থেকে সুতো সরিয়ে ঘুড়ির জন্য কখনও ডিম দিয়ে মারতাম ডিমমাঞ্জা আবার কখনও টিউবলাইট গুড়ো করে কাঁচমাঞ্জা। চলতো কোকের কর্ক এক মাথায় লাগিয়ে লাটিমের সুতো প্যাঁচানো আর পাউডারের কৌটো ফুটো করে নাটাই বানানো।

গ্রীষ্মকালে আমাদেরকে পাওয়া যেত গাছে। আম-জাম-পেয়ারা গাছে আমরা সারাটা দিন কাটিয়ে দিতাম। মা খুঁজে না পেলে প্রথমেই মাথা তুলে দেখতেন গাছের উপরে। কোন গাছে কি ফলেছে তার এত বেশি হিসাব থাকতো আমাদের কাছে যে কোন পেয়ারা গাছের কোন ডালের কোন পেয়ারাটা খোয়া গেছে তা আমরা ঠিক ঠিক ধরে ফেলতাম!

শামুক ঘষে আম ছিলার যন্ত্র তৈরী হতো, সেটা নিয়ে যাওয়া হতো পিঠাপিঠি দু’ভাই রহিম-করিমের ছাপড়ায়। সেখানে ওদের কর্মজীবী মা আমাদের ঘরে বিক্রির জন্য বানানো মুড়ির মোয়া খেতে দিতেন। ওদের বাসায় দুপুরের খাবার খাওয়ার অভিজ্ঞতাও আমার আছে। বস্তির ছোট-বড় সবার নির্লোভ ভালবাসা আমি আর আমার ছোট ভাই পেয়েছি।

দিন যাবার সাথে সাথে চোখের সামনে কেমন ধুম-ধাম পালটে গেল পীরেরবাগ! চোখের সামনেই বাড়লো দোকানপাট, উঠলো বহুতল অ্যাপার্টমেন্ট, ঢালাই হলো পাকা রাস্তা, আর সেই সাথে বাড়লো মানুষের ভিড়। সে সাথে বন্ধুর সংখ্যাও বাড়লো আমার। দূরত্ব বাড়তে শুরু করলো রহিমদের সাথে। ওদের চেয়ে নতুন বন্ধুদের সাথে ফুটবল, ব্যাডমিন্টন আর ক্রিকেট খেলাটাই বেশী লোভনীয় ছিল আমার কাছে।

বছর তিনেক আগের কথা। ঈদের দিনে মিরপুরের পুরানো বাড়িটায় যাচ্ছি, সেখানে এখনো আমার আত্মীয়রা থাকেন। যাবার পথে দেখা জাকিরের সাথে। সে রিক্সা থেকে হাত নেড়ে হইহই করে উঠলো, “অমিত, এই দিকে! এই দিকে!” আমি লাফ দিয়ে ওর রিক্সায় উঠে পড়লাম। সে রিক্সা চালনায় তার পারদর্শীতায় আমাকে মুগ্ধ করতেই হয়তো ঝড়ের বেগে রিক্সা ছুটালো! আমি ভয়ার্ত ভাবে দুই হাতে হুড ধরে বসে থাকলাম। সে নাকি সিজনাল রিক্সা চালক। নিজের দু’টো রিক্সা আছে। এমনিতে ভাড়া দেয়, কিন্তু যেসব দিনে ভাড়া বেশী ওঠে সেসব দিনে নাকি ও নিজেই একটা রিক্সা নিয়ে বেরিয়ে যায়। রিক্সা থেকে নেমে ঈদের কোলাকুলি করতে গিয়েছি, জাকির কেমন জানি বিব্রত হয়ে জড়সড় হয়ে গেল, কাঁচুমাচুঁ মুখ। অনুভব করলাম সে আড়ষ্ঠতায় শরীর শক্ত করে রেখেছে! ফেরত আসার পথে রহিমের সাথে দেখা। সে নাকি মুদির দোকান দিয়েছে। ওর সাথে কোলাকুলি করতে গিয়েও সেই একই ঘটনা!

বুঝলাম যে অসমতার বোধটা আমাদের আগে ছিল না সে বোধের বীজটা খুব যত্নের সাথেই আমাদের বুকের মধ্যে পুঁতে দিয়েছে আমাদের তথাকথিত সভ্যতা!

রান্নাবাটি আর বোমবাস্টিক

বস্তির ছেলেগুলো ছাড়া আর কোন সমবয়সী ছেলে ছিল না মহল্লায়, তাই ছেলেবেলায় মেয়েদের সাথে রান্নাবাটিও খেলেছি অনেক। আমি গৃহকর্তার ভাবগম্ভীরতা বজিয়ে রেজে ঝোপঝাড়ে বাজার করতাম। ইটের গুড়ো, ঢোল কলমি ফুল, কাঁটা গাছের লাল-লাল ফল আর থোকা বেলেঞ্চা। মেয়েদের সে কাল্পনিক রান্নার প্রশংসা কিংবা সমালোচনাটাও আমাকেই করতে হতো। এ খেলায় আমার ছোট্ট ভাইটাও আমার সাথে থাকতো। সে আমার চেয়েও গম্ভীর ভাবে মাছ কিনেছে এমন ভাবে গাছের পাতা ঝুলিয়ে নিয়ে আসতো। মেয়েদের সাথে আরও খেলতাম বউছি, কানামাছি, রুমালচোর। এমন অনেক হয়েছে আমি রান্নাবাটি খেলছি আর দূর থেকে রহিমরা টেনিস বল নাচিয়ে বোমবাস্টিকের লোভ দেখাচ্ছে আমাকে। সে সময়ে বোমবাস্টিকের সাথে রান্নাবাটিটাও সমান ভাবেই লোভনীয় ছিল।

অদল-বদল

বেস্টফ্রেন্ড বলে যদি কিছু থাকে তবে শর্মী আমার প্রথম বেস্টফ্রেন্ড। আমি টুতে পড়ার সময়ই মনে হয়, শর্মীরা আমাদের তিন তলাটা ভাড়া নিল।

শর্মীর সাথে ঘনিষ্টতা বাড়ার সাথে সাথে পাড়ার অন্যদের সাথে ঘনিষ্টতা কমতে লাগলো। শর্মী খেলাধুলা তেমন করতো না। ও ব্যস্ত থাকতো লেখাপড়া আর গানবাজনা নিয়ে। তাই মহল্লার খেলার মাঠে ওকে তেমন দেখা যেত না।

আমরা দু’জন সবসময় একসাথেই থাকতাম। ওকে নিচে রেখে আমি বানরের দক্ষতার পেয়ারা কিংবা আম গাছে উঠে পড়তাম। সে আম শর্মী আর ওর বড় বোন সীমা আপু কুচিকুচি করে কেটে চাটনি বানিয়ে ফেলতো। সে চাটনি আমরা আমাদের দেয়ালে পাশাপাশি বসে অমৃতের আনন্দে খেতাম। সমিত তখনো ছোট বলে বাসার গন্ডির বাইরে ওর যাবার মানা ছিল। তাই আমাকে-শর্মীকেও বাইরে যেতে দেবে না এমন একটা জিদ ছিল ওর। কখনো বড়ইয়ের লোভ, কখনো অন্যকিছু বলে আমরা ফাঁকি দিয়ে আমরা বেরিয়ে পড়তাম।

শর্মী আর আমি একই ওস্তাদের কাছে গান শিখতাম। আমার গানে আগ্রহ ছিল না বিন্দুমাত্র। মা গান করতেন তাই তাঁর ইচ্ছাতেই এই জগদ্দল পাথর আমার কাঁধে চাপানো হয়েছিল। আমার গান শেখা তাই বেশী দূর এগুলো না। শর্মী অসাধারণ গান করতো। সময়ে-অসময়ে রেয়াজ করতো মেয়েটা। আর সে শুনে আমাকে বকতেন মা, “দেখেছো, মেয়েটা কত রেয়াজ করে? তুমি বসো কখনো হারমনিয়ামটা নিয়ে?” সে একটা সময়েই কেবল প্রচন্ড রাগ উঠতো ওর উপর।

দিন বাড়ার সাথে সাথে আমাদের ঘনিষ্টতাও বেড়েছিল। যে সময়টায় আমাদের “প্রেম” শব্দটার মানে বোঝার বুদ্ধি হয় সে সময়ের আগে থেকে বন্ধুত্ব বলেই হয়তো আমাদের সম্পর্কে কোন জড়তা আসেনি। আমরা একজন আরেকজনকে বন্ধু ছাড়া অন্য কিছু ভাবিনি কখনো। কিন্তু তবু মহল্লার দেয়াল গুলো ভরে গেল “অমিত + শর্মী” লেখায়! আমার প্রচন্ড রাগ উঠতো সে লেখাগুলো দেখলে। সমিত আর শর্মীকে নিয়ে ইট ঘষে ঘষে মুছতাম সেসব লেখা। এ নিয়ে পরে শাকিলা-জোহরার সাথে ঝগড়াও লেগে গেল। হাতাহাতি হয়ে গেল রহিম-জাকিরের সাথে। তখন সমিতও বেশ কাবিল হয়েছে। ও স্পাইয়ের মত আমাকে এসে জানাত, “ভাইয়া, ওই দেয়ালে লিখেছে!”

ক্লাস সিক্সে প্রথম প্রেমপত্র পাই পাড়ার এক মেয়ের কাছ থেকেই। নামটা বলতে চাচ্ছিনা। মেয়েটা লাজুক লাজুক ভঙ্গিতে হাতে একটা চিঠি গুঁজে দিল। আমি খুলতে গেছি, সে বলে, “না অমিত! এখানে না! বাসায় গিয়ে পড়বে!”
আমি বললাম, “বাসায় গিয়ে পড়তে হবে?”
ও বলল, “হুম! কাউকে দেখাতে পারবে না! গোপন!”
কি রকম একগুঁয়ে ছিলাম আমি তাই ভাবি! মেয়েটার বেদনার্ত চোখের সামনে আমি চিঠিটা টুকরো টুওরো করে ফেললাম! বাতাসে উড়িয়ে দিয়ে বললাম, “আমি গোপন চিঠি পড়ি না!”

শর্মীরা বাসা ছেড়ে চলে যায় সম্ভবত আমি যখন সিক্স কি সেভেনে। আমার মনে আছে সেরকম দুঃখ আমি এর আগে আর কখনো পাইনি! যে মেয়েটা ছিল আমার সব কিছুর সঙ্গী, যে মেয়েটা আমার নাখ দিয়ে রক্ত পড়া দেখে কেঁদে ফেলতো, যাকে ছোট বলে আমি ঈদে সালাম করার ফতোয়া জারি করতাম, সে চলে যাবার অনেকদিন পরও আমি শর্মী আর কাছে নেই সে ধারণাটা আমি মেনে নিতে পারিনি। বিশ্ব উদ্ধার করে যখন সে ঘটনা বলার জন্য শর্মীর খোঁজ়ে বেরিয়েছি, খঁচ করে মনে পড়েছে ও নেই! তখন বয়সটা আবেগ ঢেকে রাখার বয়স। আমার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধুটির চলে যাওয়ার বেদনা আমি কাউকে প্রকাশ করিনি। এমন একটা ভাব করেছি, চলে গেছে তো কি হয়েছে! আমার কি বন্ধুর অভাব!

ক্লাস টু পর্যন্ত আমি পড়েছি সানরাইজ কিন্টারগার্টেনে। সে স্কুল এখনও টিকে আছে নাকি কে জানে। সে স্কুলটা হয়তো ইংলিশ মিডিয়াম ছিল না, কিন্তু ইংলিশে জোর দেয়া হতো ভালই। সে সময় ভাল স্কুল বলতে সবাই তিনটে স্কুলকে চিনতো - গভঃ ল্যাব, ধানমন্ডি গভঃ বয়েজ আর সেইন্ট জোসেফ। থ্রীতে ওঠার আগে বাবা ঠিক করলেন আমাকে ধানমন্ডি গভঃ বয়েজের ভর্তি পরীক্ষা দেয়ানো হবে। গভঃ ল্যাব বাতিল করা হলো কারন ফর্ম কিনতে যাবার দিন ঢাকা কলেজ আর গভঃ ল্যাবের ক্লাস টেনের তুমুল মারামারি - পুলিশের টিয়ারগ্যাস খেয়ে বাবা বললেন, “ওখানে পরীক্ষা দেয়ার দরকার নাই।” সেইন্ট জোসেফ বাতিল হয়ে গেল ইংলিশ মিডিয়াম বলে। এটাও আমার বাবা-মাকে শ্রদ্ধার আরেকটা কারন।

সে সময়ে বাচ্চাদের ভর্তিযুদ্ধ নিয়ে আমার কোন ধারণা থাকার কথা না, ছিলও না।

আমাদের পাড়ায় পিকনিক করার একটা রেয়াজ ছিল। বড় আপুরা সবার বাসা থেকে চাল-ডাল-মাংস নিয়ে “রণকেলী”র উঠোনে খড়ি-পাতা জ্বালিয়ে রান্না করতো। সে বাসায় কেউ থাকতো না বলে বাসার উঠোনটা আমাদের সবার হেডকোয়ার্টারের মত ছিল বলা যায়।

তেমনই এক পিকনিকে আমি এক বিশাল ম্যাসাকার বাঁধিয়ে শর্মীকে নিয়ে গুম হয়ে মাঠের এক কোনে বসে আছি। রণকেলীর ছাদের সিড়ি ছিল বাইরে। তো কাহিনী হয়েছে এই রকম, সেই সিড়ি দিয়ে একগাদা বড় বড় মাটির ঢেলা নিয়ে আমি আর শর্মী ছাদে উঠেছি। আমাদের পরিকল্পনা ছাদ থেকে লুকিয়ে বড় আপুদের গায়ে ঢিল মারা। প্রথম মাটির ঢেলাটা খুব তাক করে মেরেছি, সেটা গিয়ে পড়েছে ডালের পাতিলে। কেউ দেখেনি বলে রক্ষে। আমরা চোরের মত নেমে গিয়ে ভাল মানুষের মত মুখ করে মাঠের এক কোনায় গিয়ে বসেছি। এমন সময় দেখি বাবা গাড়ি থেকে নামলেন। এই দুপুরে বাবার অফিস ছেড়ে বাসায় আসার কথা না। আমি বুঝে গেলাম কিছু একটা ঘটেছে। তাও বাবার হাতে মিষ্টির প্যাকেট। আমরা যেই ছুটে কাছে গিয়েছি বাবা আমাকে কোলে তুলে সবার সামনে চুমু খেয়ে ফেললেন। আমি বাবার এ অবিবেচনায় জানপরনাই বিরক্ত হয়ে আড়চোখে ঘটনাটা কে কে দেখেছে ঠাওর করার চেষ্টা করছি, এদিকে মা গাড়ির শব্দ শুনে বারান্দায় চলে এসেছেন... বাবা চিৎকার করে বললেন, “ছেলে চান্স পেয়ে গেছে! রেজাল্ট নিয়ে এলাম।”

এতদিন চলে গেছে আমার যে কোন সাফল্যে বাবা-মার উত্তেজনা এখনও ঠিক আগের মত। পরীক্ষার রেজাল্ট হোক, রিসার্চ অ্যাওয়ার্ড হোক, মাস্টার্স কনভোকেশন হোক কিংবা হোক পিএইচডি অ্যাডমিশন, বাবা এখনো আগের মতই চিৎকার করে সারা দুনিয়াকে জানান, মা সেই আগের মতই গর্বের সাথে চোখের জল মোছেন। আসলে অনেক কিছুই বদলায় না। থেকে যায় ঠিক আগের মতই!

আবার বদলায় অনেক কিছুই। কলেজে পড়ার সময় এক বিয়ে বাড়িতে দেখা হয়ে গেল শর্মীর সাথে। আমার মা আর ওর মা খুব উত্তেজনা নিয়ে আমাদের দু’জনকে পাকড়াও করে একসাথে করে দিলেন। ছোট বেলার দুই বন্ধু দু’জনকে দেখে কি করে তা দেখার জন্য তাঁদের বাঁধ ভাঙা উত্তেজনা। আমি দেখলাম সালোয়ার-কামিজ পড়া এক তরুনী। এত্ত বড় হয়ে গেছে! ওকে তো ফ্রক ছাড়া দেখিনি কখনো! তেড়েফুঁড়ে বেড়ে ওঠা মেয়েটা আমাকে দেখে চোখ নামিয়ে নিল।
“কেমন আছ?” জিজ্ঞেস করে আর কিছু বলার খুঁজে পেলাম না আমরা। আমি আমার দু’হাত ভাজ করে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকলাম। আর ও ওড়নার এক প্রান্ত আঙ্গুলে প্যাঁচাতে লাগলো। আমাদের মা খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে, ওঁদের সামনে কথা বলতে পারছি না ভেবে আমাদের একা রেখে চলে গেলেন। ওঁদের চলে যাবার পরও আমরা নির্বাক দাঁড়িয়ে থাকলাম অনেকক্ষণ। প্রজাপতির মত হাজার চিন্তা মন থেকে গলা পর্যন্ত এসে কথা হয়ে বেরুতে না পারার কষ্ট হয়েই আটকে থাকলো। আমাদের আর কথা হলো না!

গার্ডিয়েন অ্যাঞ্জেল

সমিত আমার মতই প্রথমে সানরাইজ কিন্টারগার্টেনে ভর্তি হয়। সেখানে কেজি ওয়ান, টু পড়ে ও ধানমন্ডি গভঃ বয়েজের এলিমেন্ট্রি সেকশনের ক্লাস ওয়ানে ভর্তি হয়ে গেল। মর্নিং শিফটে এলিমেন্ট্রির ক্লাস হতো, আমরা বলতাম “ফীডার সেকশন”!

সে সময়টাতে আমার ছোট ভাইটা বেশ নাদুশ-নুদুশই ছিল। সে নিয়ে ওকে কেউ কিছু বললেই, হোক সেটা স্কুলে কিংবা পাড়ায়, সরাসরি আমাকে এসে নালিশ জানানো হতো। শুনে মাথায় রক্ত উঠে যেত আমার, ছোট ভাইকে নিয়ে সেই নচ্ছারের খোঁজ়ে রেরুতাম। এ নিয়ে কত মারামারি যে করেছি! ছোট ভাইয়ের নালিশ গুলো সাধারণত আমার কাছেই হতো। বাবা-মার কাছে নালিশ গুলো হতো আমাকে নিয়ে, “আম্মু, ভাইয়া আমাকে খেলতে নেয় না।” কিংবা “আম্মু, ভাইয়া মারে!” দু’জনে যতই মারামারি হোক না কেন, আমাদের দু’জনকে কখনো আলাদা করা যেত না। দাবা, ইয়ো-ইয়ো, হাউস অব ডেড, ফিফা 98, সিনেমা, বই, টিভি সবই আমরা একসাথেই করেছি! সেই আঠার মত লেগে থাকা ভাই এখন অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী। কানাডা-অস্ট্রেলিয়া সময় সমীকরণ মেলাতে না পারায় আমাদের দেখা নেই প্রায় চারটে বছর!

তবে আমাদের দুই ভাইয়ের মধ্যে যে পক্ষপাতিত্ত্বটা আগে ছিল সেটা এখনও পুরোদমেই আছে। আমি যাই করি না কেন, আমি নিশ্চিত থাকি ওর সমর্থন আমি পাব। সেও জানে যে কোন সমস্যায় ভাইয়া আছে সাথে।

মা-বাবা

আমার বাবার রাগ প্রচন্ড। আমরা দুই ভাই কত মার যে খেয়েছি বাবার হাতে। বাবার আবার মারার পরই মন খারাপ হয়ে যেত। সে মন খারাপ দূর করার জন্য আবার নানান বাহানা হতো। হয়তো হুট করে বের হয়ে ইগলুর এক বাক্স আইসক্রিম নিয়ে এলেন। পেটুক সমিতকে হাতে আনার জন্য অবশ্য সেটাই যথেষ্ট ছিল। সে লাফিয়ে লাফিয়ে বাবার কাছে গিয়ে বলতো, “আইসক্রিম? আব্বু??” ওর সব রাগ পানি! আমার রাগটাও বেশী, জিদটাও বেশী। আমি গুম হয়ে বলতাম, “খাব না”। বাবা সাধাসাধি করে না মানাতে পেরে রাগ করে চলে যেতেন। আর একটু পর পর মা কে ডেকে জিজ্ঞেস করতেন, “অমিত আইসক্রিম খেয়েছে?” রাগ আমারো ভাঙতো ঠিকই, একটু দেরি লাগতো, এই আরকি! তখন আমি বাবার গেঞ্জির ভেতরে পেটে মাথা রেখে শুয়ে থাকতাম। এ অভ্যাসটা আমার অনেকদিন পর্যন্ত ছিল।

বাবার সিগারেটের ভাল নেশা ছিল তখন। দিনে দেড় প্যাকেট গোল্ডলীফ লাগতো কম করে হলেও। সে বদঅভ্যেস ছাড়তে হলো প্রধাণত সমিতের জন্য। ওকে বোঝান হলো সিগারেট খারাপ, মানুষের খারাপ রোগ হয়। আর যায় কোথায়, সিগারেট দেখলেই চিৎকার করে বাসা তোলপাড় করতো ও। সব ভেঙে টুকরো-টুকরো করতো। একদিন মার খেয়েছে এজন্য বাবার কাছে। কিন্তু আমাদের জন্য ওর মায়াটা বোধহয় একটু বেশিই। মার খেয়ে সে হাউমাউ করে কাঁদছে ঠিকই কিন্তু সেই সাথেই বলছে, “আর খাবা না! বল আর খাবা না।” সেই বিলাপ শুনে কি হলো বাবার কে জানে, সেই যে সিগারেট ছাড়লেন, ছাড়লেনই। আর খাননি কক্ষণও!

মাঝে মাঝে আমাদেরকে নিয়ে এখানে সেখানে যেতেন বাবা। অফিসে, মেলায়, পার্কে এমনকি ঘরোয়া রাজনৈতিক মিটিংয়েও। বাংলাদেশের স্বাধীনতার মূল্য বই পড়ে জানতে হয়নি আমাদের, আমাদের রক্তেই ছিল সেটা। একটা ঘটনা বলি। বাবার সাথে কোন একটা মিটিংয়ে গেছি। বাবা একজন সাদামাটা লোককে দেখিয়ে বললেন, “উনার নাম কাদের সিদ্দিকী, খুব বড় মুন্তিযোদ্ধা!” আমার বয়স তখন কত হবে, ১০/১১। আমি পকেট থেকে খাতা বের করে উনার কাছে গেছি অটোগ্রাফ চাইতে। উনি বিস্ময় নিয়ে খাতায় স্বাক্ষর করতে করতে বললেন, “তুমি জান আমি কে?”
আমি বললাম, “মুক্তিযোদ্ধা!”
উনি বললেন, “মুক্তিযুদ্ধ কি তুমি জান?”
আমার জ্ঞান নিয়ে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে দেখে আমি গলায় আঁচ এনে বললাম, “জানবো না কেন? আব্বুর কাছে শুনছি না!”
উনি বললেন “বাবা, তোমার আব্বু কোথায়?” আমি হাত তুলে দেখিয়ে দিলাম।
উনি গিয়ে বাবার হাত ধরে ফেললেন, “আপনি নিশ্চই মুক্তিযোদ্ধা! একজন মুক্তিযোদ্ধাই পারে ছেলেকে এমন শিক্ষা দিতে!”

আমরা দুই ভাইই খুব মা ঘেঁষা ছেলে। মা যখন রান্না ঘরে সবজী কাটছে আমি তখন গুটিগুটি পায়ে গিয়ে মাকে পেছন থেকে জড়িয়ে থাকতাম। মাঝে মাঝে মটরশুটিটা-সজনেটা বেছে দিতাম। মার অনুমতি ছাড়া কখনো কিচ্ছু করতাম না আমি। ফ্রীজটা খোলার আগে পর্যন্ত জিজ্ঞেস করতাম, “আম্মু খুলবো?” আর প্রতিদিন মুখে তুলে খাইয়ে দেয়া তো আছেই। এ অভ্যেস গুলো এখনো অনেকটাই থেকে গেছে।

শর্মীর মা এটা নিয়ে খুব ঠাট্টা করতেন মনে আছে। উনি বলতেন, “বিয়ের পর কি হবে? কে খাইয়ে দেবে?” আমার খুব রাগ উঠতো তখন। বলতাম, “আম্মুই খাওয়াবে!”
উনি দুষ্টুমি ভরে বলতেন, “কেন বউ খাওয়াবে না?”
আমি সে প্রশ্নের জবাবও দেয়ার প্রয়োজন বোধ করতাম না!

সেন্টু চাচ্চু, মিলিন আর লিসা খালামনি

বাবারা দশ ভাই বোন। সাত বোন, তিন ভাই। বাবার বড় এক বোন, আর বাকি সবাই ছোট। বড় ছেলে বলে বাবার কাঁধেই সবার দায়িত্ব ছিল। এখন বুঝি কি কষ্টটাই না বাবা করেছেন পরিবারের জন্য। ছোট ভাই, সেন্টু চাচ্চু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তেন বলে আমাদের সাথেই থাকতেন। বাকিরা সবাই রাজশাহীতে।

সেন্টু চাচ্চুর খুব ভক্ত ছিলাম আমি। চাচ্চুর কাছে আমার আবদার থাকতো স্টিকারের। চাচ্চু নিয়ম ধরে প্রতিদিন পকেটে করে স্টিকার নিয়ে আসতেন, কক্ষণও ভুল হয়নি। চাচ্চুর ভূমিকাটা আমার কাছে ছিল অনেকটা বড় ভাইয়ে মত। ম্যাকগাইভার দেখার সময় ইংরেজী সংলাপের মানে আর মাঠে প্রথম সাইকেল চালানোর অভিজ্ঞতা এই চাচ্চুর সাথেই।

মনে আছে একবার ক্লাস ফোরে কি ফাইভে রাগ করে চিঠি লিখে দুপুরে বাসা থেকে পালিয়ে গেছি। রাস্তা কিছু চিনি না। দুই পাড়া বাদে একটা পুকুরের পাড়ে সন্ধ্যা পর্যন্ত বসে ভাবছি এখন থেকে রিক্সা চালাবো না ইট ভাঙবো। এমন সময় দেখি বড় বড় পা ফেলে চাচ্চু আসছে। আমি দিলাম ছুট। খানাখন্দ ছুটে আমাকে পাকড়াও করা হলো। আমি শক্ত বাহুডোরে হাত পা ছুঁড়ে বলছি, “বাসায় যাব না... ছেড়ে দাও! বাসায় যাব না! আব্বু-আম্মু ভালবাসে না। বাসায় যাব না!”

চাচ্চু সে অবস্থাতেই জাপটে ধরে বাসায় নিয়ে এলেন। আসতে আসতে বললেন, সমিত নাকি আমি চলে যাবার পর থেকে কাঁদছে আর মাকে বকাবকি করছে। মা নাকি দুপুর থেকে না খেয়ে আছেন। বাবা নাকি অফিস থেকে আগে চলে এসে পাগলের মত আমাকে খুঁজছেন। ভাল না বাসলে কেউ করে এমন? চাচ্চুর গল্পের সাথে সাথে আমার হাত-পা ছোঁড়াছুড়ি গতি শ্লথ হয়ে আসে। আমি চুপচাপ চাচ্চুর হাত ধরে বাসায় ঢুকে পড়ি।

ওই দিকে আমার চার খালা আর চার মামা। মা সিরিয়ালে পাঁচ নম্বর। ছোট দুই খালা আর এক মামা। তখন আমার কলেজে পড়া দুই ছোট খালা - মিলিন খালামনি আর লিসা খালামনিও বলতে গেলে আমাদের সাথেই থাকতেন। ছোট ভাইয়ের জন্ম দেবার আগে পরে মিলিয়ে মা ক’বছর অসুস্থ থাকেন, কমপ্লিট বেডরেস্ট। সে সময়টা আমার দুই খালা আমাদের জন্য এত করেছেন! আমাকে অনেক বয়স পর্যন্ত খাইয়ে দিতে হতো। মা তো আছেই। দুই খালার কাছেও কত যে খেয়েছি। বাবা আর কালেভদ্রে চাচার কাছেও খেয়েছি। আমার তখন হিসাব করা থাকত। আজ মা, পরদিন মিলিন তার পরদিন লিসা খালামনি। কারও উপর রাগ হলে আবার সে হিসাবের হেরফের ঘটতো। আমাকে খাওয়ানো বেশ ঝক্কির ব্যাপার ছিল। এক তো আমি এক জায়গায় থাকতাম না। মুখে খাবার গুঁজেই ছুট লাগাতাম। খাবার নিয়ে আমার পিছে পিছে ছুটতে হতো। আর মাঝে মাঝে আমার আবদার থাকতো গল্প শোনানোর। অনেক রূপকথার গল্প জানতো বলে লিসা খালামনির কাছেই আমার এ আবদার বেশী থাকতো। আরেকটা অভ্যাস ছিল খেতে খেতে হঠাৎ করেই বলতাম, “আর খাব না!” তখন বাকিটুকু খাওয়াবার জন্য নানান বাহানা করতে হতো।

ক্লাস থ্রীতে প্রথম লেখার হাতেখড়ি ছড়া দিয়ে। সে ছড়া প্রথমে লেখা হত রাফ খাতায়, পরে হাতের লেখা মুক্তোর মত বলে সে লেখা লিসা আর মিলিন খালামনিকে দিয়ে ফাইনাল খাতায় টুকিয়ে নেয়া হতো।

পা ছুঁয়ে সালাম করাটা আমাদের পরিবারে তেমন চলে না। তবু আমি তিন জনকে পায়ে ছুঁয়ে সালাম করি। আমার মা আর এই দুই খালা। আমি দেশে গেলে, কিংবা দেশে ছাড়ার সময় এখনও দুই খালা হাউমাউ করে কাঁদেন। আমার খালাত ভাইগুলো হিংসায় ছোট হয়ে আসা চোখে দেখে ওদের মা-রা ওদের পঁচিশ বছরের পিএইচডি করা তাগড়া ভাইটাকে এখনও মুখে তুলে খাইয়ে দিচ্ছেন!

স্কাউট, অগ্রদূত, বিশ্বসাহিত্য, গোদল আর টমাস আলভা

ধানমন্ডি গভঃ বয়েজ হাই স্কুলে ক্লাস সিক্স পর্যন্ত স্কাউটিং করেছি। কাব স্কাউটে গ্রীন ডেনের ডেন লিডার ছিলাম। লর্ড ব্যাডেন পাওয়েলের আদর্শে ইউনিফর্ম পরে জুনিয়রদের উপর খবরদারী, ওদের স্যালুট রিসিভ আর একা একা জঙ্গলে ক্যাম্পিংয়ের মধ্যে একটা হিরোইজম ছিল। সে মোহে আমার ধ্যান-ধারনায় তখন কেবলই স্কাউট। বাবা সিক্সে ঘোষণা দিলেন স্কাউটিং বন্ধ, আমার লেখাপড়া নাকি গোল্লায় যাচ্ছে! খুব মন খারাপ হয়েছিল তখন। এক তাড়া সার্টিফিকেট জমেছিল, সেগুলো সব ছিঁড়ে ফেললাম। আমার রোল ছিল তখন ১২। স্কাউটিং ছাড়ার পরই হয়ে গেল ২! বাবা তাঁর সিদ্ধার্ন্তের সাফল্যে মত আর পরিবর্তন করলেন না। সেই রোল নাম্বার আমার সাথে পাকাপাকি ভাবেই সেঁটে গেল! নাইন-টেনে দোস্তরা আমাকে ডাকতো “রোল-২-সাব্বির”।

ক্লাস সিক্স পর্যন্ত আমার জিগরী দোস্ত ছিল ইমরান। ওর সাথে বন্ধুত্ব যেমন ছিল, তেমনি ছিল নানান জিনিস নিয়ে ছেলেমানুষী প্রতিযোগীতা! পরীক্ষার ফলাফল দেবার পর আমরা দেখতাম কে কার চেয়ে কোন বিষয়ে বেশি নাম্বার পেয়েছে। আমি কোন বিষয়ে ফেল করলেও খুশি, যদি দেখি ইমরান তার চেয়েও কম পেয়েছে।

আমাদের দু’জনের কিছু ব্যাপারে মিল ছিল। আমরা দু’জনেই একগুঁয়ে, জেদি। দু’জনেরই দলনেতা হবার সহজাত প্রবৃত্তি। তাই রেশারেশীটা বেশি ছিল। সবাই আমাদেরকে প্রথম দেখেই সেটা আঁচ করতে পারতো। প্রায় সব বিষয়েই ইমরান অবশ্য আমাকে টেক্কা দিয়ে যেত। ও হলো ফাস্ট ক্যাপ্টেন, আমি সেকেন্ড। ও হলো স্কাউটের সবচে প্রেস্টিগিয়াস ব্লু ডেনের লিডার আমি তার প্রতিদ্বন্দী গ্রীন ডেনের। ও রেজাল্টও আমার চেয়ে ভাল হতো। আবার কিছু বিষয়ে আমি টেক্কা দিতাম ওকে। ক্লাস ফাইভে হাতের লেখা প্রতিযোগীতায় আমি হয়ে গেলাম ঢাকা জেলায় তৃতীয়, ও কোন পদক পেল না। আন্তজাতিক চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগীতায় (সম্ভবত ইউনেস্কোর আয়োজিত) আমি হয়ে গেলাম বাংলাদেশের পঞ্চম, ইমরান সেখানেও কোন পদক পেল না। কার কয়টা সার্টিফিকেট সেটা নিয়েও একটা গোনাগুনি চলতো প্রায়ই!

ক্লাস ফাইভে আমি আর ইমরান মিলে একটা লাইব্রেরী বানিয়ে ফেললাম। নাম দিলাম “অগ্রদূত পাঠাগার।” এখন ভাবি আর অবাক হই, সে বয়সে কতটা দক্ষ ম্যানেজমেন্ট পাওয়ারই না ছিল আমাদের! লাইব্রেরীটা ছিল আসলে ভ্রাম্যমান। আমি আর ইমরান সদস্য নিতাম। সবাইকে সপ্তাহে ২ টাকা করে দিতে হবে। ১৫ জন ২ টাকা করে দিলে ৩০ টাকা হয়ে যায়। তার মানে মাসে ৪টা সেবা প্রকাশণীর বই কেনার টাকা উঠে যেত - অনুবাদ, কিশোর ক্লাসিকস, তিন গোয়েন্দা আর মাসুদ রানার চাহিদা ছিল তখন। আমাদের খাতায় কে কত টাকা দিয়েছে তার হিসাব থাকতো। সে হিসাব ধরে আমরা বই ভাড়া দিতাম ১ দিনের জন্য। সদস্য নয় এমন কাউকে পড়তে হলে প্রতি বই ২ টাকা করে দিতে হতো। বই গুলো ভাগ করে আমার আর ইমরানের কাছে থাকতো। নতুব বই আমাদের ব্যাগেই থাকতো, কেউ পড়তে চাইলে বের করে দেয়া হতো। আর পুরান বই হলে পরদিন নিয়ে আসা হতো। সামান্য বিষয় নিয়ে ঝগড়া লেগে (আমি মাসুদ রানার বদলে ওয়েস্টার্ন কিনেছি, যেটা কিনা ওর আগেই পড়া) আমাদের সে শখের লাইব্রেরীটা ভেঙে গেল ৬/৭ মাস পরেই।

তখন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের বই পড়া কর্মশূচিতে নাম লেখালাম দু’জনে। প্রতি বৃহস্পতিবারে স্কুলে বইয়ের ট্রাক আসত। সেখান থেকে কে কত বই নিয়ে পড়তে পারে সে নিয়ে প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেল ইমরানের সাথেই। সে সুযোগে দু’জনের পড়া হয়ে গেল শাহনামা, সেক্সপিওর থেকে লিও টলস্টয়। ইমরানের সাথে বদ্ধুত্ব শেষ হয়ে গেল যখন আমি ডে-শীফট থেকে ট্রান্সফার করে ক্লাস সিক্সে মর্নিংয়ে চলে গেলাম।

“তিন গোয়েন্দার” পদক্ষেপ অনুসরণে ক্লাস সেভেন কি এইটে আমি, সমিত আর অনিক মিলে খুললাম আমাদের নিজেদের গোয়েন্দা দল গোদল (গো মানে গোয়েন্দা আগেই বলে নিচ্ছি কিন্তু!)।
অনিক আর ডালিয়া আপার কথা বলা হয়নি আগে। আব্বার বিজনেস পার্টনার মতিন চাচার ছেলে-মেয়ে ওরা। মতিন চাচার পরিচয় আব্বুর বিজনের পার্টনার কিংবা বন্ধু বললে আসলে কিছুই বোঝানো হয় না। মতিন চাচা আমার আপন চাচার মতই। সব সময় একসাথে ছিলাম ও আছি আমরা এই দুই পরিবার। মিরপুরে আমদের নিজেদের বাসা হবার ক’বছরের মধ্যেই মতিন চাচারাও আমাদের কাছেই বাড়ি বানিয়ে চলে এলেন। আমরা এখন বনানীতে যেখানে থাকি, সেখানেও আমাদের বাস উপরে-নিচে। যে কোন বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবার আগে দুই পরিবারের এক সাথে মিটিং হয়। অনিক আর আমার বছর চারেক বড় ডালিয়া আপাকে সে হিসেবে আমার চাচাত ভাই বোনই বলা যায়।

তখন শর্মীরা চলে গেছে। তাই আমাদের তিন তলায় বানানো হলো আমাদের গোদলের হেড কোয়ার্টার। সেখানে আমরা বাসা থেকে স্যান্ডউইচ আর শরবত নিয়ে আসতাম। আর অনিকের বাসা থেকে সাফাই করা চাকুটা ছোঁড়ার প্র্যাকটিস করতাম। নিয়মিত প্র্যাকটিসে আমাদের একটা দরজা ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেল। আমাদের গোয়েন্দা দলের একমাত্র সাফল্য গাঁথা বলতে সেটাই... যেটা ধরা পড়ার পর আমার সৈরাচারী মা আমাদের সেখানে যাবার অধিকার রোধ করলেন। গোদলও ভেস্তে গেল।

গোদল ভাঙার পরে সে তিনজনই আমরা একটা ল্যাবরেটরি বানিয়ে ফেললাম। এবার সেটা অনিকদের চিলেকোঠায়। নাম দেয়া হলো টমাস আলভা ল্যাবরেটরি। সেখানে আমরা সিরকা (একটিক এসিড) আর রাংতার (অ্যালুমিনিয়াম) রিঅ্যাকশনে পানির হাইড্রোজেন আলাদা করতাম। সেটা পলিথিনে ভরলে গ্যাস বেলুনের মত উড়তো। আমরা সেই বেলুন নিয়ে নোবেল জিতে নেয়ার মত করে পাড়া ঘুরে বেরাতাম। সেই ল্যাবও বন্ধ হয়ে গেল রান্না ঘর থেকে নিয়মিত সিরকা, বেকিং সোডা, লবন, লেবু খোয়া যাওয়া আর চিলেকোঠা থেকে অনিকের চাচার শখের রেডিওর ধ্বংসাবশেষ উদ্ধার করার পরে।

ডুপ্লিকেট, মাইকেল, মুনিয়া, ব্যাঙ-দল, খলশে, পিংকি আর লায়ন

পশু-পাখীর প্রতি যে টানটা আমি আর আমার ছোট ভাই পেয়েছি সেটা সম্ভবত এসেছে আমার দাদা-নানার কাছ থেকে।

আমার দাদাকে যে কি বলবো তাই ভাবি! উনাকে কৃষক বলা যায়। এক সময় উনি আক্ষরিক অর্থেই কৃষক ছিলেন। বাবার কাছে শুনেছি, সেই সূর্য ওঠার আগে তাঁকে মহিষের গাড়ি করে ক্ষেতে পাঠানো হতো। দাদা নামাজ পড়ে, নাস্তা করে, ধীরে সুস্থে পরে যেতেন। দাদা এক সময় গ্রামের বাজারে একটা দোকানও দেন। এমনকি মসজিদে ইমামতি করার অভিজ্ঞতাও তাঁর আছে। গ্রামের কৃষক মানেই গাড়ির মহিষটা, হালের বলদটা, উঠান ভর্তি মুরগী-হাঁস আর আরো হাজারো পশু-পাখি-গাছের প্রতি সীমাহীণ ভালবাসা।

আমার নানা ছিলেন পশু চিকিৎসক। তাঁরও ছিল পশু-পাখি আর গাছ-গাছালির প্রতি একটা অদম্য ভালবাসা। ঢাকার সাভারে তাঁর বাড়ি “মধ্যমনি”তে তিনি ফলিয়ে ছিলেন আতা, পেয়ারা, বড়ই, এমন কি আঙুর! তাঁর একটা অ্যালসেসিয়ান কুকুরও ছিল। আর একটা কথা বলা ময়না পাখি। সে কুকুর কিংবা ময়না আমার দেখার সৌভাগ্য অবশ্য আমার হয়নি।

আমার বাবা-মা তাঁদের বাবার প্রানী-প্রীতি পাননি কিন্তু উদ্ভিদ-প্রেমটা পেয়েছেন ঠিকই। বাবা পড়েছেন ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে, এমনকি বৃত্তি নিয়ে নেদারল্যান্ডে একটা ডিপ্লোমাও করেছেন। শাঈখ সিরাজের “মাটি ও মানুষে” বাবাকে প্রায়ই দেখা যেত। আমাদের বাসার পেছনের বিশাল খালি জমিতে আমার মা’র একটা চমৎকার বাগান ছিল। সেখানে খোপে খোপে ফলতো সীম, বরবটি, বেগুন, টমেটো, আলু, পটল, লাউ, মূলা, গাজর, ঝিঙা, করল্লা, পুঁই, পালঙ, লাল শাক থেকে শুরু করে কলা, আখ - যখন যেটার মৌসুম! আর আমাদের ছাঁদ ভর্তি ছিল সারি সারি টবে দেশী-বিদেশী ফুলের গাছ।

আমাদের দুই ভাইয়ের আগ্রহটা উদ্ভিদের চেয়ে প্রানীতেই বেশী ছিল। সেই ক্লাস টুতে আমাদের প্রথম পোষা প্রানীটি ছিল একটি দেশী কুকুর ছানা। সেটার নাম দিয়েছিলাম “ডুপ্লিকেট”। ডুপ্লিকেট কেবল দুই কি তিন মাস ছিল আমাদের সাথে। বাবা-মাকে কোন মতেই রাজী করানো গেল না ডুপ্লিকেটকে সাথে রাখার। তাকে মিলিয়ে দেয়া হলো আরো শত বেওয়ারীশ রাস্তার কুকুরের সাথে।

সেই ক্ষত শুকাতে না শুকাতেই দেখা গেল জাকির একটা কুকুর পালতে শুরু করেছে। সেটার নাম সে রেখেছে “মাইকেল”! সেই নামকরনের শানে নজুল জানতে চাইলে সে বলল,
“মাইকেল জেকসনের নাম শুনো নাই? হের নামে নাম রাখছি!”
আমি চরম বিস্ময় নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “তুমি মাইকেল জ্যাকসনকে চিন?”
সে বিরক্তি নিয়ে বলল, “মাইকেল জেকসনকে কেডায় না চিনে!”

বস্তিতে কুকুর পালা খুবই সহজ। খাবারের চিন্তা করতে হয় না। মাইকেল নিজেই আস্তাকুড়, মোড়ের কসাইয়ের দোকান আর বাশঝাঁড়ের বাজার থেকে নিজের খাবারের ব্যবস্থা করে নিত। আর বস্তিবাসী যারা আছেন তাঁরাও মনে চাইলে দু’একটা বিস্কুট কি একটু ভাতের মাড় দিতেন। গোসলের তো প্রশ্নই আসে না, কেবল বৃষ্টি হলে মাইকেলকে জোর করে সেই বৃষ্টিতে ভেজানো হতো। কিন্তু তাতে যে ময়লা দূর হয়না সেটা আমরা মাইকেল কাছে এলেই বুঝতে পারতাম। ভক করে একটা দূর্গন্ধ নাকে লাগতো। আর সেই সাথে গা ভর্তি উকুন তো আছেই। সে কথা আবার জাকিরকে বলা যেত না, বললেই সে রেগে মেগে একটা কান্ড করতো। এর মাঝে মুসলমানীর মত করে মাইকেলের লেজের আগা কেটে দেয়া হলো। এতে নাকি কুকুরের তেজ বাড়ে। তবে এত করেও মাইকেল বেশী দিন আর জাকিরের থাকলো না। বাশঝাঁড়ের বাজারে খাবারের সুবিধা বেশী বলে সে ওখানেই স্থায়ী আস্তানা গাড়লো। তবে আমাদের কিন্তু সে চিনতো ঠিকই। বাজারে গেলেই সে পরম আহ্লাদে কাছে এসে লেজ নাড়তো।

এর মাঝে আমার আর সমিতের পীড়াপীড়ি আর চিল্লাচিল্লী সহ্য করতে না পেরে বাবা এক খাঁচা ভর্তি মুনিয়া পাখি নিয়ে আসলেন। কুকুর বেড়ালের চেয়ে খাঁচার পাখি ঢের ভাল, ঝামেলা নেই বললেই চলে। দুই বেলা খাবার, আর ক’দিন পর পর গাছে পানি দেবার ঝাঁঝরি দিয়ে গোসল - ব্যাস, ল্যাঠা চুকে গেল। মুনিয়া পাখি চার মাস পর পরই পালক বদলায়, সে সাথে গায়ের রঙটাও বদলে যায়। সেটা এক চরম উত্তেজনার বিষয় ছিল। তবে কিছুদিন যাবার পরই খাঁচা ব্যাপারটা আমাদের দুই ভাইয়ের তেমন ভাল লাগলো না। ছোট্ট খাঁচায় গুটিশুটি মেরে ছয়টা মুনিয়া। ঠিক মত যে বসবে সে জায়গাটাও নেই। তাই একদিন আমি আর ছোট ভাই মিলে দিলাম সব গুলোকে উড়িয়ে। বাবা-মাকে না বলেই। ধারনা ছিল বাবা-মা জানলে তুলকালাম হবে। কিন্তু তা কিন্তু হয়নি, বরং বাবা-মা জানতে পেরে খুশিই হয়েছিলেন!

সে সময় হাতে পেলাম একটা বই, “খুদে বিজ্ঞানীর প্রজেক্ট”। সেখানে ব্যাঙের জীবনযাত্রার ছবি সহ বর্ণনা ছিল। কিভাবে ডিম থেকে ব্যাঙাচি, ব্যাঙাচি থেকে ব্যাঙ।

ব্যাঙ ডিম পাড়ে পানিতে, জন্মায়ও পানিতে। সে সময় কোন পা থাকে না, থাকে সাঁতারের জন্য লেজ আর থাকে শ্বাস নেবার জন্য মাছের মত কানকো। সময়ের সাথে সাথে সেই কানকো আর লেজ মিলিয়ে যেতে থাকে, গজাতে থাকে ফুসফুস আর পা! পূর্ণবয়স্ক ব্যাঙ লেজ আর কানকো হারিয়ে চার পা আর ফুসফুস নিয়ে উঠে আসে ডাঙায়! সে সময় আবার ডাঙায় থাকলে সে অক্সিজেন নেয় ফুসফুস দিয়ে আর পানিতে থাকলে চামড়া দিয়ে!

অ্যামফিবিয়ান গোত্রের এই রহস্যময় প্রানীটির প্রতি তখন আমার সীমাহীণ আগ্রহ! ছোট ভাইকে নিয়ে ঠিক করে ফেলি “ব্যাঙ পর্যবেক্ষণ প্রোজেক্টের” কার্যপদ্ধতি। “ব্যাঙ দেখলেই গা ঘিন-ঘিন করে” বলে অনিক আর শর্মীকে কোন ভাবেই এ প্রোজেক্টে জড়িত করা গেল না। তাই ছোট ভাইকে নিয়েই সংগ্রহ করে ফেলি ব্যাঙের ছ’সাতটা ডিম পাশের ধানক্ষেত থেকে। মায়ের রান্নাঘর থেকে একটা বড় গামলা সরিয়ে আমাদের বারান্দায় নিয়ে সেটায় বানানো হয় পুকুরের প্রোটোটাইপ। গামলার তলে বালি-কাদা আর তার মাঝে অর্ধেক পানির উপর উঠে থাকা একটা বড় পাথর, যেন পা গজালে ব্যাঙাচিরা সেটায় উঠে বসতে পারে। কিছু টোপা পানা, যাতে ব্যাঙাচি সেগুলোর শেকড়ের ফাঁকে ফাঁকে ঝুলে থাকতে পারে।

ডিম থেকে বাচ্চা ফোটার দিন আমরা দুই ভাই মাতৃ আনন্দে আত্মহারা। সব গুলো ডিম থেকেই বাচ্চা হয়েছে, নষ্ট হয়নি একটাও, সেটাই আনন্দের মূল কারণ। আমরা ক্যালেন্ডার ধরে ব্যাঙের জীবনযাত্রা লক্ষ্য করতে থাকলাম। পা গজানোর আগে দিয়ে ব্যাঙের প্রোটিনের দরকার হয়, সে প্রোটিনের জোগান দেয়া হলো সেদ্ধ ডিমের সাদা অংশ দিয়ে। সে খাবার দিয়ে রেখেছি, ব্যাঙাচি মুখেও দিচ্ছে না। আমরা সেটা নিয়ে জানপরনাই চিন্তিত, তাহলে কি এই প্রোটিনে চলবে না? মৃত মাছ লাগবে? ক’দিন পর যখন ব্যাঙাচি ডিম খাওয়া শুরু করলো, আমাদের আর পায় কে! বাসায় মেহমান আসলেই আমি আর ছোট ভাই নিয়ে যেতাম আমাদের বারান্দায়। সেখানে ততদিনে ব্যাঙাচির লেজ প্রায় বিলীন হয়ে চারটে পা গজিয়ে গেছে। তারা দিব্যি পাথরের উপরে বসে রোদ পোহায়। জন্ম থেকেই আমাদের দেখছে বলে মানুষ নিয়ে তাদের বিন্দুমাত্র ভয় নেই, মাথা ঘুরিয়ে আমাদের দেখে আবার নিজেদের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। লেজ পুরো অদৃশ্য হয়ে যাবার পর আমরা জানতাম ওদেরকে পুকুরে ছেড়ে দিতে হবে। সেদিন মন খুব খারাপ ছিল দু’জনের। এই কয় মাসেই আপন হয়ে গিয়েছিল ব্যাঙ গুলো। কোনটা পেটুক, কোনটা অলস আর কোন ব্যাঙটা রোদ বিলাসী তা ভাল মতই জানা হয়ে গিয়েছিল! আমরা আমাদের ব্যাঙ-দলকে পুকুরে ছেড়ে দিয়েও অনেকক্ষন বসে রইলাম। বৃথাই চেষ্টা করলাম অগুনতি ব্যাঙের ফাঁকে আমাদের প্রিয় ব্যাঙ গুলিকে খুঁজে বের করতে।

ব্যাঙ গুলো চলে যাবার পর পরই আমি একটা খোলশে মাছ পেয়ে গেলাম! আমাদের পাশের খালটাতে (এখন আর নেই) প্রায়ই জেলেরা মাছ ধরতে আসতেন। সেই মাছ ধরার সময়ই একটা খোলশে মাছ উঠে আসে। এত সুন্দর মাছ আমি আগে কক্ষনো দেখিনি! মাত্র এক ইঞ্চি লম্বা, ঝকঝকে সবুজ রঙ, তবে গোল্ডফিসের মত ন্যাতপ্যাতে শরীর ন, বরং বেশ শক্ত পোক্ত। খোলশে মাছের জান বড় শক্ত, আমি হাতে নিয়েই দিলাম ছুট, এক ছুটে বাড়িতে। বাসায় একটা বড় কাঁচের বয়াম ছিল, মা এটা-সেটা রাখতেন। সেটা খালি করে পানি ভরে খলশে মাছটাকে রেখেই দিলাম আরেক ছুট। জেলের কাছ থেকে জানতে হবে এ মাছ কি খায়। জানা গেল, খলশে খায় মাটি (জুও/সাইটোপ্লাঙ্কটন) আর টোপা পানার শিকড়।

খলশে মাছটাকে আমি বলবো আমার প্রথম সত্যিকারের পোষা প্রানী। একটা দূর্বোধ্য ভালবাসা ছিল আমার মাছটার প্রতি। ঘন্টার পর ঘন্টা কাটিয়ে দিতাম সেটাকে সাঁতার কাটতে দেখে। আর এর মালিকানা নিয়েও আমার মধ্যে একটা বাড়াবাড়ি ছিল। সমিতকে আমি খলশের কাছেই যেতে দিতাম না। কাছে গেলেই আমার হাঁকডাক শুরু হয়ে যেত। আমি নিজেই মাসে মাসে পানি বদলাতাম, নিজেই ক’দিন পর পর নতুন টোপা পানা আর পঁচা মাটি নিয়ে আসতাম, সাথে নিতাম না কাউকে। এমনকি মাঝে মাঝে কথাও বলতাম ওর সাথে! খলশেকে নিয়ে আমার ফ্যাসিনেশন এই পর্যায়ে চলে গেল যে একটা সময় আমার মনে হলো সে বড় একা, ওর সঙ্গী দরকার! সে দরকার মেটাতে আমি যত জেলে ছিল সবাইকে বলে দিলাম এই রকম আরেকটা মাছ আরেকটা পেলে যেন অবশ্যই আমাকে জানায়।

সেই প্রিয় খলশেকে নিয়ে একদিন একটা ভয়াবহ কান্ড ঘটে গেল! আমি স্কুল থেকে বাসায় এসেছি, এসেই গেছি খলশের কাছে। বাসায় আসায় পর প্রতিদিন এটাই আমার প্রথম কাজ ছিল। গিয়ে দেখি বয়ামের পানি রক্তে লাল হয়ে আছে, আর সে পানির উপরে ভাসছে আমার সবুজ খলশে! আমি তখন ক্লাস থ্রী কি ফোরে পড়ি। সেই প্রথম কোন মৃত্যু আমাকে নাড়া দিয়ে গেল। এত তীব্র ভালবাসা ছিল আমার মাছটার প্রতি, আমার মাথা মুহূর্তে ফাঁকা হয়ে গেল! মাছটা যে মরে গেছে, আর বেঁচে উঠবে না, এটাই আমি মেনে নিতে পারছিলাম না। আমি মাছটাকে হাতে নিয়ে আবার পানিতে ছাড়লাম, এই বুঝি সাঁতার কাটে। ঘোরের মধ্যে কতবার যে করেছি এ কাজ! ঘোর কাটতেই আমি ছুটলাম সমিতের খোঁজে, ও ছাড়া যে আর কেউ এটা করেনি এ বিষয়ে সন্দেহ নেই।

ওকে পাওয়া গেল ওর রুমে। চোরের মত মুখ করে বসে আছে। ওর সাথে আমার কথা হলো এরকম,
“দেখ আমি জানি তুই করেছিস! স্বীকার কর, করলে কিচ্ছু বলবো না। স্বীকার না করলে মারবো! এত প্রচন্ড মারবো যে তুই কল্পনাই করতে পারবি না!”
ও ভয়ে ভয়ে বলে, “স্বীকার করলে মারবা না?”
আমি ঠান্ডা গলায়, “না!”
“আমিই করছি...” ও বলে শেষ করেছে কি করেনি আমি শুরু করলাম মার। ওর সাথে আমার মারামারি হতো ঠিকই, কিন্তু আমার মাথায় থাকতো সব সময়, আমারই ছোট ভাই, জোরে মারা যাবে না, ব্যাথা পাবে। কিন্তু ওই দিন আমার মাথায় আর কিছু ছিল না। আমার চোখ দিয়ে দরদর করে পানি পড়ছে, আর আমি মারছি! কেজিতে পড়া সমিতও জানে দোষ করেছে, তাই মার খেয়েও সে কিন্তু মাকে ডাকেনি। কেবল কাঁদতে কাঁদতে বলেছে, “তুমি বলছিলা মারবা না, মারবা না বলছিলা ভাইয়া!”

খলশে কে আমি আর শর্মী মিলে কবর দিলাম। সে কবর দেয়ার সময় নেয়া হলো না সমিতকে। সে সময় বুঝিনি, আজ বুঝি, এই একটা ক্ষেত্রেই ওকে বঞ্চিত করেছিলাম আমি। আমার সব কাজেই আমার ছোট ভাইটা সাথে সাথে থাকতো, কিন্তু খলশের সাথে মালিকানার সীমানাটা মোটা দাগেই দেয়া ছিল, যেটা তখন ওর ছোট্ট মন সহ্য করতে পারেনি। এটা করে সে যে অনুশোচনায় ছিল এটাও বেশ বোঝা যেত। কোথায় কবর দিয়েছি সেটা তাকে জানতেই হবে, জানার পর আবার সেখানে গিয়ে ছোট্ট হাত তুলে দোয়াও পড়া হবে... আহারে!

ক্লাস ফাইভ কি সিক্সে রাস্তা থেকে দু’টো কুকুরের বাচ্চা তুলে নিয়ে এলাম আমি আর আমার ছোট ভাই। একটার চোখই ফোটেনি বলতে গেলে, আরেকটা বেশ পোক্ত হয়েছে। বাবা-মা খুব বিরক্ত হলেন, কিন্তু সে মুহূর্তে কিছু বললেন না। বড়টার নাম দেয়া হলো পিংকি, আর ছোটটার নাম দেয়া হলো লায়ন। লায়ন নামটা আমার মোটেই পছন্দ ছিল না, কিন্তু সেটা রাখতে হলো আমাদের বাসায় কাজ করা ছেলেটার পীড়াপীড়িতে। সে নাকি কবে কোন কুকুরের নাম দেখেছে “লায়ন” তাই আমাদেরটার নামও তাই রাখতে হবে। সেটাই রাখা হলো।

পিংকি আর লায়ন আমাদের চিলেকোঠা আর ছাদে থাকলো কয়েক মাস। এরপর বাবা-মার সাথে এ নিয়ে জরুরী সভা হলো। তাঁদের শেষ কথা, পিংকি আর লায়নকে যেতে হবে। কুকুর পোষা নাকি খুব কঠিন - কে ওদের খাওয়াবে, কে ওদের গোসল করাবে, হ্যান ত্যান। আমি আর সমিত যতই বলি আমরা করবো, বাবা-মা মানেন না। তাঁদের আরো দাবী রাস্তার কুকুর (যাকে চলতি ভাষায় আমরা বলি নেড়ী) নাকি পোষ মানে না, যতই শেখানো হোক কিচ্ছু শেখে না!

এ নিয়ে অনেক তর্কাতর্কি চললো, পরে ঠিক হলো কেবল একটাকে রাখা যাবে, তাও কয়েক মাসের জন্য। এর মধ্যে যদি আমরা তার ভাল যত্ন নিতে পারি তাহলে থাকবে, তা নাহলে সেটাকেও ফেলে দিয়ে আসা হবে। আমরা তখন সেটাতেই রাজী! বয়স কম বলে লায়নকেই রাখবো ঠিক হলো, পিংকিকে ছেড়ে দিয়ে আসা হলো অন্য পাড়ার রাস্তায়। পিঙ্কির জন্য মন খারাপ ছিল কয়েকদিন। মন খারাপ যে বাবা-মা’রও হয়েছে সেটা বুঝতে পারলাম পরে, যখন একদিন শুনে ফেললাম মাকে বলছে বাবা, “আজ পিঙ্কিকে দেখলাম রাস্তায়!”
মা আবার জিজ্ঞেস করেন, “কেমন দেখলে?”
বাবা বলেন, “ভালই! সাথে আরো কয়েকটা ছিল। দলে ঢুকে পড়েছে একেবারে!”

লায়ন আমাদের সাথে ছিল অনেক বছর। আমাদের চোখের সামনেই সে দেখতে দেখতে বড় হয়ে উঠলো। বাবা-মা, এমনকি সেন্টু চাচ্চুও বাইরে থেকে যতই দেখাক লায়নকে পছন্দ করে না, কিন্তু টানটা টের পাওয়া যেত ঠিকই। লায়নের জন্য বাজার থেকে মাংস আর মোটা চাল কিনে আনতেন বাবা। আর মা সেটা খুব যত্ন নিয়েই একসাথে মিলিয়ে সেদ্ধ করতেন। আড়াল থেকে দেখতাম, আমরা কাছে নেই ভেবে বাবা কিংবা চাচ্চু লায়নকে জড়িয়ে ধরে আদর করে দিচ্ছে। ভালো খাবার আর নিয়মিত যত্নে লায়ন অল্প কয়দিনেই বেশ তাগড়া হয়ে উঠলো। বাইরের লোকে অনেকেই বিশ্বাস করতেন না লায়ন আসলেই রাস্তার কুকুর।

নানার কাছ থেকে পরামর্শ নিয়ে লায়নকে আমি আর সমিত মিলে ট্রেনিং দেয়া শুরু করলাম। মাত্র ক’দিনেই লায়ন সুন্দর থাবা তুলে সবার সাথে হ্যান্ডশেক করতে শিখে গেল। তাকে বসতে বললে বসে, দাঁড়াতে বললে দাঁড়ায়, শুয়ে পড়তে বললে শুয়ে পড়ে, খাবার দিয়ে খেতে না বললে খায় না, অচেনা মানুষকে দেখলেই তেড়েফুঁড়ে ছুটে যায়, আবার থামতে বললে গর্জন থামিয়ে সুন্দর থাবা বাড়িয়ে দেয়! আমাদের বাসার সামনে লাগানো হলো একটা ছোট্ট সাইনবোর্ড, বাংলায় ও ইংরেজীতে যেখানে লেখা “কুকুর হতে সাবধান!” সে সাবধানবাণী যে ফাঁপা নয় সেটাও লায়ন প্রমান করে দিল দুই দুই বার রাতে ছিঁচকে চোর ধরে।

আমাদের পেছনে যে বাগানটা ছিল বলেছি সে বাগানের ফসল নষ্ট করতো নানান পাখি। সে পাখি তাড়ানোর কাজ নিজে থেকেই করতো লায়ন। তার পাখি ধরার দৃশ্যটা একটা দেখার মতই ব্যাপার। ঠিক যেন সিংহ শিকার করছে কোনো বুনো হরিন! চার পা গুটিয়ে আস্তে আস্তে মাটি ঘেঁষে কাছে গিয়েই এক লাফে পাখি থাবায় করায়ত্ত্ব! লায়নের গতিও ছিল ঠিক যেন চিতার মত! এই হয়তো সে ছাদে, মুহূর্তে সে বাগানে, এর পর মুহূর্তেই সে বারান্দায়।

লায়নকে প্রাকৃতিক কর্ম সারার কাজটা শেখাতে আমাদের সময় লেগেছে সবচেয়ে বেশি। কিন্তু শিখে ফেলার পরে সে নিজেই গিয়ে বাগানে কাজ সমাধা করে ফিট বাবুটি হয়ে হেলতে দুলতে বাসায় চলে আসতো! তার সিভিক সেন্সও ছিল বেশ টনটনে! শর্মীর বাবা-মা লায়নকে দেখতেই পারতেন না, বাসায় ঢুকতে দেয়া তো দূরের কথা। তাই ওদের দরজা খোলা থাকলেও সে কখোনো ভেতরে ঢুকতো না, চুপচাপ অপেক্ষা করতো বাইরে।

লায়ন মারা গেল খুব অনাকাঙ্খিত ভাবেই। যাঁদের কুকুরের শখ আছে তাঁরা জানেন, পেটের গোলমাল হলে কুকুর লতা-পাতা-ঘাস চিবুতে পছন্দ করে। সে সময় আমাদের বাগানে দেয়া হয়েছিল কীটনাশক। যে লোকটি কীটনাশক দিয়েছিল, সে যে কি পরিমানে দিয়েছিল তাই ভাবি! ঘাসে মেশা কীটনাশক খেয়ে মারা গেল আমাদের সবার প্রিয় লায়ন!

ওর অভ্যাস ছিল আমার আমার ছোট ভাইয়ের স্কুল থেকে ফেরার সময় হলেই বারান্দায় গিয়ে একটা টুলের উপর দাঁড়িয়ে থাকা। আমাদেরকে দেখলেই তার সে কি বাঁধভাঙা উল্লাস। গলা ফাটিয়ে চেঁচাতে চেঁচাতে এক ছুটে নিচে চলে যাবে, সেই সাথে উদ্দাম লাফালাফি, এই লাফিয়ে শরীরে উঠে পড়ে তো এই পাক দিয়ে ঘুরতে থাকে। সেদিন বিস্ময়জনক ভাবেই সেসব কিছুই হলো না। আমি মাকে জিজ্ঞেস করেছি, “আম্মু লায়ন কই?”
মা কেমন ভাবে জানি বলল, “আছে মনে হয় কাছে কোথাও!”
আমি আর পাত্তা না দিয়ে গল্পের বই নিয়ে বসেছি, ছোট ভাই বসেছে “বাঁটুল দি গ্রেট” নিয়ে। মা বারে বারেই কাছে এসে এটা সেটা বলছেন, আসল কথাটা আর বলতেই পারছেন না। শেষমেষ যখন বললেন আমি বিশ্বাসই করিনি! এইতো এই সকালে দেখলাম! কি প্রানবন্ত!

আমার ছোট ভাই শুরু করলো কান্না! কিন্তু আমি ততদিনে আবেগ চাপা দিতে শিখে গিয়েছি। শক্ত মুখে আমরা দুই ভাই মিলে কবর দিলাম লায়নকে। সে মারা যাবার পরই পোষা প্রানীর শখটা আমাদের দু’জনেরই কেন জানি চলে গেল। তবে এখনো কোন কুকুর দেখলেই আমার মনে পড়ে লায়নের কথা। কাছে গিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দেই, মনে মনে বলি, “তোকে আমরা ভুলিনি রে!”

লেখালেখি

লেখালেখির প্রসঙ্গ দিয়েই এ ঘ্যানঘ্যানে লেখাটা শেষ করে দিচ্ছি! আগেই বলেছি অনেক ছোটকাল থেকেই আমার লেখালেখির শখ। লেখালেখিতে উৎসাহটা আমি প্রধানত পেয়েছি আমার ছোট মামা আর আমার ছোট ভাইয়ের কাছ থেকে। বাচ্চু মামা নিজে চিত্রকর, কিছু লেখালেখিও করেন। উনি আমাকে এনে দিলেন বাংলা একাডেমির “শিশু” আর “ধানশালিকের দেশ”, বললেন, লেখা ভাল হলে নাকি ওসব পত্রিকায় ছাপান হয়। আমাকে তখন পায় কে। আমি তোড়া তোড়া লেখা লিখে মামাকে দিতাম।

আমার সব লেখার প্রথম পাঠক ছিল সমিত। ওর মতামত পেলে তবেই লেখা ফাইনাল করতাম আমি। এর আগে পর্যন্ত সে লেখায় কাঁটাছেড়া চলতো। ওর উৎসাহ না পেলে আমি লেখা সেই কবেই ছেড়ে দিতাম, সে নিয়ে সন্দেহ নেই। আমার বাবা-মার লেখা নিয়ে প্রথমে কোন আগ্রহ ছিল না। পরে সেটা কিভাবে আসলো সেটা আরেক কাহিনী, পরে বলবো না হয় একদিন!

একটু বড় হয়ে ক্লাস সিক্সে আমার প্রথম লেখা পাঠালাম “কিশোর পত্রিকায়”। মহাবিজ্ঞানী নিউটন বিয়ে করতে গিয়ে কি সমস্যার পড়েছিলেন তার এক রসালো বর্ণনা। প্রথম লেখাটাই ছাপানো হয়ে গেল। এর পর থেকে ধুমিয়ে লিখেছি “কিশোর পত্রিকায়”। ওরা লেখা ছাপানো হলে সৌজন্য সংখ্যার সাথে সাথে ১৫ টাকা সম্মানীও দিত। সেটা যে ক্লাস সিক্সের একটা ছেলের জন্য কতটা গৌরবের সেটা লিখে বোঝান সম্ভব না। পরে আমার শিশুতোষ লেখা গুলো ছাপানো হতে লাগলো “ছোটদের কাগজ”, “কিশোলয়” আর স্কুলের পত্রিকা গুলোতে। এমনকি “ঊন্মাদে” কার্টুন পাঠিয়েছিলাম কয়েকটা - সেগুলোও ছাপানো হয়ে গেল!

জাতীয় সংবাদপত্রে প্রথম লেখা পাঠাই কলেজের প্রথম বর্ষে “ভোরের কাগজে”। তখন সেটাই দেশের সেরা পত্রিকা। “ভোরের কাগজে”র সাপ্লিমেন্ট গুলোতে বিষয় ভিত্তিক লেখা চাওয়া হতো, সেখানে কালে ভদ্রে লেখা পাঠাতাম, সব গুলোই ছাপানো হতো। সেই সাথে শুরু করলাম “কিশোর পত্রিকায়” নিয়মিত গল্পধাঁধা লেখা। সেই চললো দু’বছর। এইচএসসি দেবার পর লেখার সংখ্যা বাড়িয়ে দিলাম। “ভোরের কাগজের” সাপ্লিমেন্ট “অবসরে” নিয়মিতই লেখা পাঠাতাম তখন। আরিফ জেবতিক ভাই তখন ছিলেন “পাঠক ফোরামের” দায়িত্বে। “পাঠক ফোরামের” তখন সেই রকম নাম-ডাক, সেখানে লেখা ছাপা হওয়া মানে সেই রকম ব্যাপার! সেখানে একটা বিষয় ভিত্তিক সংখ্যার সেরা লেখক নির্বাচিত হয়ে গেলাম। এর পরপরই একদিন দেখি “অবসরে” আমার লেখার নিচে ছোট্ট নোটিশ, “লেখককে যে কোন মঙ্গলবার ৪-৫টার দিকে ভোরের কাগজ অফিসের চারতলায় “অবসরের” সহসম্পাদকের (সেটা তখন ছিলেন রেজা ভাই) সাথে দেখা করার জন্য অনুরোধ করা হচ্ছে!”

এর পরের ঘটনা অন্য লেখার বিষয়বস্তু। তবে সব স্বপ্নের কাগজের নৌকা ডুবে এই একটা নৌকাই কিন্তু এখনো আমার একটা স্বপ্ন নিয়ে উত্তাল সমুদ্রে একা ভেসে আছে। সে নৌকার যাত্রা আর কতদূর, কতক্ষণ তাই ভাবি মাঝে মাঝে!

© অমিত আহমেদ

বিঃদ্রঃ এক) লেখার শিরোনামটা অঞ্জন দত্তের লেখা নীল দত্তের সুর করা শানের গাওয়া “মাঝি রে” গানটি থেকে ধার করা।
দুই) ব্যবহৃত ছবিতে বাসার ছাদে পানির ট্যাঙ্কির উপরে আমরা দুই ভাই। সেখানে মা আচারের জন্য বড়ই শুকাতে দিতেন। সে বড়ই আমরা দুই ভাই সাবড়ে দিতাম। ছবিটা সে সময়ে আমাদের সতর্ক না করে সেন্টু চাচ্চুর তোলা। আমাদের মুখ ভর্তি তখন শুকনো বড়ই!
তিন) এ লেখার আরো দু'টি পর্ব আমার ব্লগে প্রকাশ করার ইচ্ছে আছে, সেটা নিজের তৃপ্তির জন্যই!


মন্তব্য

বিবাগিনী এর ছবি

আপনার লেখাটা মোটেও ঘ্যান ঘেনে না!!!আমার খুব ভালো লেগেছে।বাকি পর্ব দুটির অপেক্ষায় রইলাম।

ছবিটা খুব সুন্দর। হাসি

‌::একাকিত্বের বিলাস আমার অনেকদিনের সাধ::

‌‌::একাকিত্বের বিলাস আমার অনেকদিনের সাধ::

আরিফ জেবতিক এর ছবি

বাকী দুই পর্ব নিজের ব্লগে দিবা মানে ?
এই লেখাগুলা কি তোমার নাকি?
এগুলা তো আমার মালিকানাধীন লেখা ।
বইয়ের দ্বিতীয় পর্ব নামতেছে ,জানো না ?

-----------------------------
কালের ইতিহাসের পাতা
সবাইকে কি দেন বিধাতা?
আমি লিখি সত্য যা তা,
রাজার ভয়ে গীত ভনি না।

অমিত আহমেদ এর ছবি

বিবাগিনী, আপনার কমেন্টে আমার দিল খোশ্‌!

আরিফ ভাই, দুই পর্বেই নিজের লেখা দেখতে লজ্জা লাগবে!


ভালবাসি, ভালবাসি, ভালবাসি তোমায়!
ব্লগস্পট | ফেসবুক | ইমেইল

অয়ন এর ছবি

যেখানেই দেন, নিজের ব্লগ কিংবা বই, অতিসত্বর দেন, অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি।

অমিত আহমেদ এর ছবি

অলৌকিক ভাই দ্বিতীয় পর্বে লেখা দিচ্ছেন নাকি?
জটিলস্য


ভালবাসি, ভালবাসি, ভালবাসি তোমায়!
ব্লগস্পট | ফেসবুক | ইমেইল

হাসান মোরশেদ এর ছবি

চলুক চলুক ।
-----------------------------------
মানুষ এখনো বালক,এখনো কেবলি সম্ভাবনা
ফুরোয়নি তার আয়ু

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

বিবাগিনী এর ছবি

অমিত,বেশি লজ্জা লাগলে বোরকা পরে লেখা দিয়েন।কিন্তু আমাদের deprive করবেন না।

(deprive এর বাংলা লিখতে ঝ এর পরের বর্ণ টা লাগবে।আমি ওইটা কিভাবে টাইপ করে খুঁজে পাচ্ছিনা।কেউ শিখাবেন প্লীজ?)

‌::একাকিত্বের বিলাস আমার অনেকদিনের সাধ::

‌‌::একাকিত্বের বিলাস আমার অনেকদিনের সাধ::

আরিফ জেবতিক এর ছবি

ঝ এর পরে কি আছে, "ঞ" নাকি ? (ভুলে গেছি )

ঞ=shift +i

বিপ্লব রহমান এর ছবি

কুল বড়ই দুই চোরের ছবি+কাহিনী আর কতো..চোখ টিপি

(অফটপিক: আরিফ ভাই, প্রথমে দুই চোখ, পরে হাতের মধ্যে গোল করে ধরা আগুন; আর এখন ...এই প্রথম আপনাকে বিপ্লব দিলাম!)


একটা ঘাড় ভাঙা ঘোড়া, উঠে দাঁড়ালো
একটা পাখ ভাঙা পাখি, উড়াল দিলো...

বিপ্লব রহমান এর ছবি

অমিত, ও বন্ধু আমার!...


একটা ঘাড় ভাঙা ঘোড়া, উঠে দাঁড়ালো
একটা পাখ ভাঙা পাখি, উড়াল দিলো...

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

অমিত
আপনের লেখাটা যে বড় হইলেও পঠনশীল তা তো আগেই বলছি পাঠ প্রতিক্রিয়ায়। আমার ধারনা দ্বিতীয় পর্বেও খারাপ লাগবেনা। আমি অন্তত খুব মনোযোগ দিয়া পড়নের অপেক্ষাতেই থাকবো। ভালো থাইকেন আর ভালো লেইখেন। আমিও একখান বৃহৎ ছেলেবেলা লেখতে লেখতে বুইড়া হওনের প্রস্তুতি নিতেছি।

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

ধুসর গোধূলি এর ছবি

- ধইরা তক্তা মারো তারকাটা।
মানে জলদি জলদি লেখেন মিয়া।
_________________________________
<সযতনে বেখেয়াল>

অমিত আহমেদ এর ছবি

নজরুল ইসলাম, অয়ন, আনোয়ার সাদাত শিমুল, আরিফ জেবতিক, বিবাগিনী, অলৌকিক হাসান, হাসান মোরশেদ, বিপ্লব রহমান ও ধুসর গোধূলি - আপনাদের অসংখ্য ধন্যবাদ! আমার নৈমিত্তিক ছেলেবেলাকে কি নিদারুণ ভালবাসাতেই না আপনারা অপরূপ করে তুলেছেন!


ব্লগস্পট | ফেসবুক | ইমেইল

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

আনোয়ার সাদাত শিমুলের কমেন্ট কি আসলেই দেখা যাচ্ছে, নাকি আমি দেখতে পাচ্ছি না কেবল?

অমিত আহমেদ এর ছবি

আয় হায়!
তোমার কমেন্ট কই গেল?

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

মীরপুরের তিন গোয়েন্দা কী বলে?
নতুবা কমেন্ট গায়েব রহস্য নিয়ে গোয়েন্দা ঝাকানাকাকে ডাকা হোক।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।