কনে দেখা সন্ধ্যায় পুরোনো আড্ডায়

অছ্যুৎ বলাই এর ছবি
লিখেছেন অছ্যুৎ বলাই (তারিখ: রবি, ০৬/০১/২০০৮ - ৮:২৮পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

১.
সারাটা দিন দৌড়ের ওপর। ঢাকা শহরের ধোয়া-ধুলো খেয়ে এবং শহরের হবু অ্যানেক্স এক এলাকায় ইটের রাস্তায় রিক্সায় চেপে মেরুদন্ডের বারোটা বাজিয়ে যখন বাসায় ফিরে কুসুম গরম পানিতে ক্লান্তি ঝেড়ে ঘুমানোর দিবাস্বপ্ন দেখতে শুরু করেছি, তখনই আসিফের ফোন - মেয়ে দেখতে যেতে হবে।

মেয়ে দেখা মানে ভার্সিটি লাইফের সেই বিকেলগুলোয় ইস্টার্ন প্লাজায় সুদৃশ্য বাহনে চেপে আসা সুসজ্জিত ললনাদের দেখে দেখে চোখের প্রশান্তি নয়; এ মেয়ে দেখা মানে একটা পরীক্ষা। ঈষৎ তরল চরিত্রের গুণে পরীক্ষা আবার আমার জন্য মহাপরীক্ষায় রূপান্তরিত হলো। মেয়ের সাথে জমায়া পুরা বন্ধুর মতো আড্ডা মারতে হবে এবং একই সাথে তার খুঁত ধরার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করতে হবে; মেয়েকে পছন্দ করতে হবে এবং পছন্দ করে আরেকজনের হাতে তুলে দিতে হবে - এরূপ কনফ্লিক্টিং কনসেপ্টের যাঁতাকলে পড়ে বন্ধু আসিফ; কিংবা তার সম্ভাব্য হবু বউ মিতুর চেয়ে আমার অবস্থা অনেক বেশি করুন। সাথে আবার নিজের বউ। একটু বেশি হাসাহাসি করলে মাশাল্লা বাসায় এসে কত ইউরোতে কত টাকা সুদে আসলে বুঝায়া দিবে।

এতসব টেনশনের মধ্যেও জমায়া ফেললাম। আমার ভাঁড়ামিতে ড্রিংক্সের গ্লাস হাত থেকে ফেলে মিতু যখন 'দোস্ত কেমন আছিস' টাইপ অবচেতন ভঙ্গিতে আমার পিঠে চাপড় মেরে বসলো, তখনই বুঝলাম আমার কাম শ্যাষ, এইবার যার যার মাল সে-ই হ্যান্ডেল করো! আমি ফুটলাম।

২.
বুয়েটে আড্ডার কথা ছিলো সন্ধ্যা ৬ টায়। এ ক'দিনে দেশের শব্দ এবং সময়ের সাথে আবার অনেকটাই খাপ খাইয়ে নিয়েছি। রিক্সা চেপে হাতিরপুলের অলি-তস্যগলির জ্যাম ভেঙ্গে যখন ক্যাম্পাসে পৌঁছাই, তখন ঘড়িতে ৭ টা বেজে আঠেরো মিনিট; কিন্তু ক্যাম্পাসে মোটামুটি ব্যাজার মুখে ব্যাচেলর মামা শাহরিয়ার ছাড়া আর কেউ নেই। অবশ্য কিছুক্ষণের মধ্যেই এক এক করে সবাই আসতে লাগলো। কেউ ছেলে কোলে, কেউ দুই মেয়েকে দু বগলে চেপে, কেউ নতুন বিয়ে করা বউয়ের সগর্বে হাত ধরে।

সেই পুরোনো বুয়েট ক্যাফে, ভালো লাগা, হৃদয়ের সহজাত টান, সময়গুলো ভরে ওঠে সোনার আলোয়। ছবি তোলা হয়, ফুচকা খাওয়া, ছোট্ট প্লাস্টিকের কাপে আবারো কফিকে চুমুক দেওয়া। নিপার মেয়েগুলো চুপচাপ। সোহানের ছেলে কিছুদিন হলো হাটতে শিখেছে। সে কিছুতেই বসে থাকবে না। ক্যাফেময় দৌড়াদৌড়ি শেষে এক সেমিস্টার শুরুর বুয়েট সুন্দরীর টেবিলে গিয়ে হামলা করেছে। তার কোলে চেপে সে-ই যে বসেছে, টানাটানি করতে গেলেই বিদ্রোহ করছে।

সঞ্জয় আসে নি। আজই সে প্রথম ছেলের বাপ হলো। সঞ্জয়ের কাহিনীটা অদ্ভূত। বিয়ের পরপর তার প্লান ছিলো আগামী ৬ বছরে সে কোনো বাচ্চা নিবে না; কিন্তু বৌদি আসার ৬ দিনের মধ্যেই সে অ্যাক্সিডেন্ট ঘটিয়ে ফেললো। বুয়েট জিমে আমার সেকেন্ড গুরু সঞ্জয় যোগব্যায়ামের অনেকগুলো আর্ট শিখিয়ে ছিলো। যৌনশক্তিবর্ধক আইটেমও স্বভাবতই বাদ যায় নি। সবার সন্দেহ, ওই যোগব্যায়ামই এই অঘটনের নামে সুঘটনের পেছনে মূল কলকাঠিনাড়ক।

রাত বাড়ে, সেই সাথে বাড়ে সবার ঘরে ফেরার তাড়া। নতুন প্রজন্মের চোখগুলো তখন ঢুলুঢুলু, বেরিয়ে পড়ি সবাই।

৩.
পলাশীর মোড়ে বেবিট্যাক্সি ধরার জন্য ফাইট দিতে হয়েছে টানা ৫ বছর। নাখালপাড়ায় টিউশনি ছিলো। অনেকবারই এমন হয়েছে, এক ঘন্টা দৌড়াদৌড়ি করেও ট্যাক্সি না পেয়ে ক্লান্ত হয়ে স্টুডেন্টকে ফোন করেছি, আজ আর আসবো না।

সেই বেবিট্যাক্সি আজ আর নেই; কিন্তু সিএনজি কিংবা ক্যাব ধরার জন্য পলাশীর মোড়ে দাড়িয়ে বুঝলাম, অবস্থা বোধহয় আরো বেগতিকই হয়েছে। রাত বাড়ছে। হাটি। ইডেন কলেজ, গার্হস্থ্য অর্থনীতি পার হয়ে নিউ মার্কেটে এসেও তেমন কোনো লাভ হয় না। সিএনজি বা ক্যাবে টাকা বাড়ানোর ফর্মূলা আগেরবারই শিখেছিলাম; কিন্তু খালি ক্যাব না থাকলে সে ফর্মূলা অ্যাপলাই করার স্কোপ কই?

অবশেষে এক ঘন্টার ওপরে ফাইট করে যখন সিএনজি পেলাম, তখন সারাদিনের ক্লান্ত আমার যেন কিছুতেই কিছু যায় আসে না। দুই লেনের রাস্তায় ৫ লাইন করে গাড়ী চলছে, সামনে পেছনে ডান বামে কয়েক ইঞ্চির ব্যবধান বজায় রাখার অসাধারণ কৌশলে, জ্যামের পর জ্যাম ঠেলে গুটি গুটি পায়ে এগোচ্ছে সবাই, একটু ফাঁকা পেলেই জোরসে টান, পেছনে কাঁধের ওপর এসে হার্ড ব্রেক করছে বিশাল দেহী ট্রাক, রাস্তার রাজা লোকাল বাসগুলো দলবেঁধে ব্লক করে দিচ্ছে পুরো রাস্তাটাই। আমার তখন কিছুতেই কিছু এসে যায় না। মাইট ইজ রাইট যেমন বিশ্বজগতের একমাত্র আইন, অস্ট্রিচ অ্যালগরিদমও হয়তো তেমনই সবচাইতে শান্তির সমাধান।


মন্তব্য

লুৎফুল আরেফীন এর ছবি

তুমুল বর্ণনা। বিশেষ করে বুয়েটের চত্বরে আড্ডাটা খুব হাতছানিময়! আমি তো ২০০৮ এ দেশে যামু না ভাবছিলাম। আপনি তো গড়বড় করে দিবেন মনে হচ্ছে।

করে ফিরবেন বলে মনে করেন? নাকি থেকেই যাবেন?!

অছ্যুৎ বলাই এর ছবি

দেশে আসার দরকার আছে। অনেকদিন পর পর হলেও। কিছু কিছু পরিবর্তন এখানে বাস করে বুঝা যাবে না, হঠাৎ আসলে চোখে পড়বে। এক অফিসে কাজ ছিলো। ঝামেলাবিহীনভাবে অল্পসময়ে শেষ হয়েছে। দেশ ইউরোপ আমেরিকা হচ্ছে। অবৈধ তত্ত্ব সরকারকে ধন্যবাদ। হাসি

বুয়েটে পোলাপানের খরাচাপাতি বেড়েছে। অ্যাডমিশনের সময় নাকি ১২/১৩ হাজার টাকা লাগে। এক ছেলের কাহিনী শুনলাম, অ্যাডমিশন টেস্টে ৫০এর মধ্যে থেকেও এই ফিস-এর জন্য ভর্তি হয় নি। অনেকেই নাকি টাকাটা দিতে চেয়েছিলো, সে নেয় নি। অভিমানী বোকা ছেলে!

শুনলাম, খুব শীঘ্রই টিউশন ফি আরোপিত হবে। ফ্রিতে পড়া ছেলেগুলোকে সুশীল করতে এর নাকি বিকল্প নেই। সুশীল হওয়াই এখন চল। জানো, প্রধান উপদেষ্টা মাঝে মাঝে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়সমূহের নীতি নির্ধারণের জন্য 'সুশীল' সমাজের সাথে আলোচনায় বসেন? জানো, এলাকায় এলাকায় 'সুশীল পাড়া' গড়ে উঠছে, উঠেছে? ডঃ অছ্যুৎ বলাই ফিরে এলে ঠিকই একজন মহাসুশীল হয়ে পসার জমিয়ে ফেলবে। চোখ টিপি

---------
চাবি থাকনই শেষ কথা নয়; তালার হদিস রাখতে হইবো

শেখ জলিল এর ছবি

ব্লগকথনটা বেশ রসালো হইছে।

যতবার তাকে পাই মৃত্যুর শীতল ঢেউ এসে থামে বুকে
আমার জীবন নিয়ে সে থাকে আনন্দ ও স্পর্শের সুখে!

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি

উত্তম রচনা।

-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!

ফ্রুলিক্স এর ছবি

ব্যাপক বর্ননা।
শেষ পর্যন্ত দোস্তের কনে পছন্দ হয়েছে? কনের যে হালকা বর্ননা দিলেন তাতে তো খবরই আছে। হাসি

সবজান্তা এর ছবি

রচনাটা চমৎকার লাগলো, কিন্তু অস্ট্রিচ অ্যালগরিদম কি তা না জানা থাকার কারনে, শেষ বেলায় কিঞ্চিত রসবঞ্চিত বোধ হচ্ছে।

এ ব্যাপারে একটু ভেঙ্গে বলা যেতে পারে।
--------------------------------------------------------
অলমিতি বিস্তারেণ

অছ্যুৎ বলাই এর ছবি

কোনো সমস্যার অস্ট্রিচ সমাধান হলো, সমস্যা যে আছে, এইটা পুরো ইগনোর করা। হাসি

উইকি লিংক

---------
চাবি থাকনই শেষ কথা নয়; তালার হদিস রাখতে হইবো

ধুসর গোধূলি এর ছবি

- যে সুশীল খুশি সে সুশীল হোন, পিরোবলেম নাই। তবে কি জানি একটা যোগব্যায়ামের কথা কইতাছিলেন, হুইনা তো কাশী আয়া পড়লো! চোখ টিপি

যোগব্যায়াম শিখতে গেলে বেবাকেই তাইলে ঐ জিনিষটা শিখে দেঁতো হাসি
_________________________________
<সযতনে বেখেয়াল>

অছ্যুৎ বলাই এর ছবি

জিনিসটা স্ট্রেচিংয়ের মধ্যে পড়ে বোধহয়। ঐটা না শিখে উপায় আছে!!

---------
চাবি থাকনই শেষ কথা নয়; তালার হদিস রাখতে হইবো

ঝরাপাতা এর ছবি

আর বইলেন না, আমি ও পড়ছিলাম মহাবিপদে। প্রথমত আমার পড়াশোনার সবটাই চিটাগং-এ, ঢাকা ভালো কইরা চিনি না। তারপরে আবার ঢাকায় অনেক রোডে রিকশা যাইতে দেয় না। সি.এন,জি. পাওয়া একেক সময় আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়ার মতো হয়ে যায়। এখন কিছুটা লাইনে আসছি। তা আবার উড়াল দিচ্ছেন কখন?


রোদ্দুরেই শুধু জন্মাবে বিদ্রোহ, যুক্তিতে নির্মিত হবে সমকাল।


বিকিয়ে যাওয়া মানুষ তুমি, আসল মানুষ চিনে নাও
আসল মানুষ ধরবে সে হাত, যদি হাত বাড়িয়ে দাও।

অছ্যুৎ বলাই এর ছবি

উড়াল নিয়া প্যাচে পড়ে গেছি। একটা থার্ডপার্টি ঝামেলায় কিছুটা দেরি হতে পারে।

---------
চাবি থাকনই শেষ কথা নয়; তালার হদিস রাখতে হইবো

রানা মেহের এর ছবি

বুয়েটে টি্উশন ফি বসাবে মানে?
একেও কি সরকারি প্রাইভেট ইউনিভারসিটি বানিয়ে ফেলবে?
পড়াশোনা কি হয়ে যাবে ধনীদের একার সম্পত্তি?

-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

অছ্যুৎ বলাই এর ছবি

চামেচিকনে সে চেষ্টা করা হতে পারে। আমেরিকা-অস্ট্রেলিয়া-ইউরোপপ্রবাসী সাবেক বুয়েটপড়ুয়াদের একাংশও সম্ভবত সেরকমটাই চায়। সুখের কথা হলো, এ অংশটা এখনো সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে ওঠতে পারে নি।

---------
চাবি থাকনই শেষ কথা নয়; তালার হদিস রাখতে হইবো

অছ্যুৎ বলাই এর ছবি

কাকু, জুবায়ের ভাই এবং ফ্রুলিংক্সকে অকৃত্রিম ধন্যবাদ।
@ফ্রুলিংক্স, দোস্তের আজ বিয়ে ছিলো। আমি যেতে পারি নাই, অন্যত্র প্রোগ্রাম থাকায়।

---------
চাবি থাকনই শেষ কথা নয়; তালার হদিস রাখতে হইবো

অমিত আহমেদ এর ছবি

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।