সবুজ বিপ্লবের জন্য প্রত্যাশিত দূরদৃষ্টি নিয়ে দেখুন বায়োম্যাস প্রযুক্তি

জিজ্ঞাসু এর ছবি
লিখেছেন জিজ্ঞাসু (তারিখ: বুধ, ১৯/১১/২০০৮ - ৯:৫১পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

কিছু প্রযুক্তি টেকসই, কিন্তু তাকে কাজে লাগাতে ব্যবহারকারীর যথেষ্ট প্রযুক্তিগত জ্ঞান প্রয়োজন। জ্বালানি ক্ষেত্রে তেমনি একটি প্রযুক্তি হল বায়োম্যাস প্রযুক্তি। দেশে কোন একটা উদ্যোগ নেয়ার আগে যখন আমরা জ্বালানির কথা, বিদ্যুতের কথা চিন্তা করি, তখন হতোদ্যম হতে হয়। প্রয়োজনীয় তথ্যের অভাবে আমরা সঠিকভাবে ঘরোয়াপ্রযুক্তি ব্যবহারেও ব্যর্থ হই। সাফল্যের সাথে বায়োম্যাস প্রযুক্তি উন্নত বিশ্বে ব্যবহৃত হলেও আমাদের দেশে সফলতা বলতে গেলে শুন্যের কোঠায়। বায়োগ্যাস এ ধরনেরই একটি টেকসই প্রযুক্তি।

আমাদের দেশে বায়োগ্যাস উৎপাদন ও ব্যবহার শুরু হয়েছে আশির দশকের শেষ দিকে। তখন গবেষক ছাড়া অন্যরা এর নাম তেমন একটা জানত না। এখন দেশের সবাই নাম জানলেও এ ব্যাপারে বেশ বিভ্রান্ত। কারণ বিভিন্ন সময়ে যত লোক আগ্রহ নিয়ে বায়োগ্যাস প্ল্যান্ট স্থাপন করেছে তাদের এ ব্যাপারে সন্তুষ্টির অভিজ্ঞতা নেই। অধিকাংশ উদ্যোক্তার ব্যক্তিগত বায়োগ্যাস প্ল্যান্টগুলো প্রথম দু’এক বছর সাফল্যের সাথে চললেও একসময় বন্ধ হয়ে গেছে। এমন বহুলোকের গ্যাস প্ল্যান্ট এখন পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে।

আজকাল 'বায়ো', 'ইকো', 'পরিবেশ বান্ধব' ইত্যাদি শব্দ এনজিও কর্মী এবং সরকারি কিছু কর্মকর্তা ব্যাপকভাবে ব্যবহার করছেন তাদের প্রকল্পকে আকর্ষণীয় করার জন্যে। এতে দেশের প্রকৃত উপকার হোক বা না হোক তাদের ব্যক্তিগত উন্নয়নে কোন বাধা আর থাকছে না। কিন্তু প্রযুক্তিকে ভারি ভারি কাঠামোবদ্ধ কথা দিয়ে কাগজেপত্রে সীমাবদ্ধ করে রাখলে তো আর সাধারণের উন্নয়ন সম্ভব না। বিজ্ঞানীদের নিজস্ব জারগনকে অনুবাদ করে সাধারণ মানুষের জারগনে রূপ দিয়ে সেই প্রযুক্তিকে ইউজার ফ্রেন্ডলি করে সবার মাঝে বিস্তার ঘটাতে হবে। আমাদের ছোট দেশ, ছোট্ট পরিসর। এখানে যত সহজে একটা প্রযুক্তিকে সাধারণ্যে বিস্তার ঘটানো যায় অন্য বড় দেশগুলোতে মনে হয় তত সহজে করা যায় না। উদাহরণ সরূপ দেখুন চারটি ওয়াইম্যাক্স কোম্পানির প্রত্যেকে ২১৫ কোটি টাকা (রেকর্ড মূল্য) দিয়ে লাইসেন্স নিয়েছে, কারণ তাদের যুক্তি স্বল্প পরিসরে কম সময়ে ও কম খরচে তারা এ প্রযুক্তির বিস্তৃতি ঘটাতে সক্ষম হবে এবং ব্যবসায়িক সাফল্য পাবে। বিদ্যমান মোবাইল ফোন কোম্পানিগুলোর ক্ষেত্রেও একথা সত্য।

কিন্তু সরকার দেশের সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠান হলেও কোন কাজ কত ধীরগতিতে সম্পন্ন করে! অনেক কারণের মধ্যে একটি কারণ সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের দক্ষতার দারুণ অভাব। আর আমলাতান্ত্রিক জটিলতা তারা ইচ্ছাকৃতভাবে করে। কারণ বেশিরভাগ কর্মকর্তা কার্যনির্বাহ করার তরিকা সম্বন্ধে ওয়াকেবহাল না। তাই আমলাতান্ত্রিক ছকেবাঁধা পেঁচঘোচের মধ্যে একটা প্রজেক্ট ছেড়ে দিয়ে তার কাজ শেষ। কাজ নিষ্পন্ন করার মানসিকতা নেই। ঘুষ, দুর্নীতি ইত্যাদিও আছে সাথে। বোঁঝার ওপর শাকের আঁটি হল রাজনীতির অনৈতিক হস্তক্ষেপ।

যাই হোক এগুলো কথার কথা। গুরুত্বপূর্ণ কথা হল বায়োম্যাস প্রযুক্তিকে আমি টেকসই প্রযুক্তি বলেছি। কারণ এই প্রযুক্তিকে টেকসই হিসেবে আমেরিকায় সীমিত আকারে ও সুইজারল্যান্ডসহ ইউরোপের দেশগুলো ব্যবহার করছে ব্যাপকভাবে। টেকসই প্রযুক্তি বলার আরেকটি কারণ হল এটা নবায়নযোগ্য বা রিনিউয়েবল শক্তির উৎস। এই প্রযুক্তির কার্বন ফুটপ্রিন্ট অনেক কম। অর্থাৎ এতে দুষণের পরিমান সীমিত। প্রথমত বায়োগ্যাস ব্যবহরের ফলে এমনিতে বায়ুমণ্ডলে অব্যবহৃত মিথেন উবে গিয়ে পরিবেশের যে ক্ষতি হতে পারে তা থেকে আমাদের রক্ষা করবে; জ্বালানি সাশ্রয় হবে এবং এ প্রক্রিয়ায় ক্ষতিকর গ্যাস নির্গমনের হার নগণ্য।

আমাদের দেশে পঁচিশ বছর আগে যে প্রযুক্তির প্রকাশ তা এখনও ব্যাপকতা পায়নি, বিকাশলাভ করেনি শুধুমাত্র অনভিজ্ঞতা ও বিস্তারিত তথ্য ও গবেষণার অভাবে। স্বতন্ত্র সৌরপ্রযু্ক্তির ক্ষেত্রে যে ধরণের জ্ঞান, কলাকৌশল বা শিল্পোদ্যোগ প্রয়োজন এক্ষেত্রে ততটাও প্রয়োজন নেই। ব্যয়বহুল নয়। তাহলে বায়ো ম্যাস প্রযুক্তির সমস্যাটা কোথায়।

ছোট ছোট ব্যক্তিগত প্রকল্পগুলোতে খুটিনাটি (meticulous) জ্ঞানের অভাব রয়েছে। বড় পরিসরে বায়োগ্যাস প্রকল্পের জন্য প্রকৌশলগত পরিশীলিত জ্ঞান যেমন দরকার পাশাপাশি বড় রকমের অর্থায়নও প্রয়োজন। এজন্য বড় উদ্যোক্তা ছাড়াও সরকারিভাবে বা সমবায়ের মাধ্যমে আমাদের দেশে এই প্রযুক্তি সফলভাবে ব্যবহার সম্ভব।

বায়োম্যাস হচ্ছে প্রাকৃতিক উৎসে প্রাপ্ত জৈবকণা। গ্যাস তৈরিতে যে অ্যানেরোবিক ডাইজেশন সূত্র কাজে লাগানো হয় তাতে যে কোন অরগানিক বস্তু ব্যবহার করা সম্ভব। তবে কনভেনশনালি খড় কুটো, গাছের পাতা, গম, ভূট্টা বা ধানের খড়, কুড়া, গোবর, পোল্ট্রি আবর্জনা, রান্নার আবর্জনা ইত্যাদি ব্যবহৃত হয়ে আসছে। পাঠ্যবইয়ের মূল সূত্রে বলা হচ্ছে যেকোন অরগানিক বস্তুর গ্লুকোজ, স্টার্চ, সেলুলুজ ও ফ্যাট বায়ূনিরোধক আধারে অক্সিজেনের অনুপস্থিতিতে অ্যানেরোবিক ব্যাক্টেরিয়ার বিক্রিয়া ঘটানোর মাধ্যমে মিথেন উৎপাদন সম্ভব। এ প্রক্রিয়ার বাইপ্রডাক্টটা আবার ব্যবহৃত হতে পারে সার হিসেবে মাটির উর্বরতা বৃদ্ধির কাজে। যা রাসায়নিক সারের ব্যবহার কমাতে সাহায্য করবে। ফলত পরিবেশ দুষণ হ্রাস পাবে।

ব্যক্তিগত উদ্যোগের সাফল্য ও ব্যর্থতা
অ্যানেরবিক (without air) অর্থ হচ্ছে বায়ূহীন অবস্থায়, সুনির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে - অক্সিজেনর অনুপস্থিতিতে। বায়ূহীন অবস্থায় বিক্রিয়া ঘটানোর জন্য যে আধার তৈরি করা প্রয়োজন তা হওয়া দরকার নিখুঁত অর্থাৎ ত্রুটিমুক্ত এবং দীর্ঘস্থায়ী। এটা কংক্রিটের তৈরি হতে পারে, প্লাস্টিক বা ধাতব হতে পারে। যেহেতু ধরে নিচ্ছি বানিজ্যিকভাবে গৃহীত বড় আকারের বায়োগ্যাস প্রকল্পে প্রয়োজনীয় লোকবল এবং দক্ষ প্রকৌশলিরা কাজ করবেন। তাদের সফলতা নিয়ে কথা বাড়াব না। কিন্তু আমাদের দেশে কেন ব্যক্তিগত প্রকল্পগুলো দীর্ঘস্থায়ী হচ্ছে না বা জনপ্রিয়তা পাচ্ছে না এবং ব্যাপকহারে ব্যাবহৃত হচ্ছে না সেদিকে আলোকপাত করতে চাই। প্রথমেই বলে নেয়া দরকার উন্নত বিশ্বে ব্যবসায়িকভাবে এবং ব্যক্তিপর্যায়ে বায়োগ্যাস উৎপাদন হয়ে থাকে। তাদের জ্বালানির সংকট আমাদের মত এতটা প্রকট নয় তবুও প্রত্যন্ত অঞ্চলে ব্যক্তিগতভাবে বিকল্প জ্বালানির চাহিদা পুরণে তারা বায়োগ্যাস ব্যবহার করছে। কারণ এটা পরিবেশবান্ধব।

আমাদের পাশ্ববর্তী দেশ ভারত, নেপাল ও চীনেও বায়োগ্যাস ব্যক্তিগত উদ্যোগে পরিবারের রান্না ও রাতে বাতি জ্বালানোয় ব্যবহৃত হচ্ছে। ভারতের একজন বেসরকারি উদ্ভাবক Dr Anand Karve ব্যক্তিগত উৎপাদনের ক্ষেত্রে বলতে গেলে একটি যুগান্তকারি উদ্ভাবন করেছেন যার জন্য তিনি ইংল্যান্ড থেকে Ashden অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন। কনভেনশনালি মনে করা হচ্ছিল গোবর ছাড়া ছোট্ট পরিসরে বায়োগ্যাস প্রস্তুত করা সম্ভব না। কিন্তু Karve বিষয়টার গোড়ায় গিয়ে দেখলেন যেহেতু যেকোন জৈব বস্তুকণায় বিদ্যমান গ্লুকোজ, স্টার্চ, সেলুলুজ ও ফ্যাট বায়োগ্যাস উৎপাদনের মূল নিয়ামক সেজন্য তিনি প্রশ্ন করলেন শুধু গোবর দিয়ে কেন তাহলে? যেকোন অর্গানিক বস্তুদিয়েই গ্যাস উৎপাদন সম্ভব। এটা তাকে ভাবতে হয়েছে এ কারণে যে সবাই গবাদিপশু পালন করে না বা ভারতীয়রা হিউম্যান ওয়াস্ট থেকে উৎপন্ন বায়োগ্যাসে আগ্রহী নয়। তাই তিনি উদ্ভাবন করলেন কিভাবে শুধুমাত্র রান্নাঘরের প্রতিদিনের জৈব উচ্ছিষ্ট থেকেই একটা পরিবারের জন্য পর্যাপ্ত গ্যাস উৎপাদন সম্ভব হয়।

গবেষণা করে তিনি প্লাস্টিক দিয়ে একটা প্যাকেজ কিট তৈরি করলেন যাতে কংক্রিটের গ্যাস ডোমের বিভিন্ন রক্ষণাবেক্ষণ সমস্যা ও খরচ এড়ানো যায়। এতে ভারতে সাধারণ জনগণ যারা গরুছাগল পালন করেন না তারা তাদের সামান্য রান্নাঘরের উচ্ছিষ্ট (প্রতিদিন ২ কেজি জৈব আবর্জনা) থেকেই প্রয়োজনীয় গ্যাস উৎপাদন ও ব্যবহার করে আসছেন। তার এই প্লাস্টিকের কিট সহজে স্থাপনযোগ্য এবং রক্ষণাবেক্ষনযোগ্য।
নেপাল, ভারত ও চীনে এই নতুন উদ্ভাবিত প্রযুক্তি ছাড়াও ব্যক্তিগতভাবে কনভেনশনাল কংক্রিটের গ্যাসডোমও ব্যবহৃত হচ্ছে। তিব্বতিরা তাদের পরিবেশের দুষণ কমাতে ইদানিং বায়োগ্যাসের প্রতি বেশ আগ্রহী হয়েছে।

আমাদের দেশে জনসংখ্যা বেশি এবং প্রতিবছর জ্বালানি কাঠের জন্য নির্ভর করতে হয় গাছপালার উপর। তাতে একদিকে যেমন গাছপালা নির্বিচারে কেটে বন উজার করছে এবং পরিবেশের ক্ষতি করছে তেমনি লাকড়ি যোগাড় করতে গিয়ে সাধারণ জনগণের অন্যান্য আর্থনীতিক ও উৎপাদনশীল কাজের সুযোগ হারাচ্ছে। তাছাড়া যদিও এক্ষেত্রে আমাদের কার্বন ফুটপ্রিন্ট অতি নগন্য তবুও বায়োগ্যাস ব্যাপকহারে ব্যবহার করতে পারলে আমরা গ্রিনহাউজ গ্যাস নির্গমন উল্লেখযোগ্যহারে কমাতে সক্ষম হব যা বর্তমান বিশ্বে বাঙলাদেশের জন্য অতি জরুরি।

আগে উল্লেখ করেছি যে অ্যানেরবিক ডাইজেশন এর জন্য বায়ুনিরোধক আধার প্রয়োজন। তারপর যেটা প্রয়োজন সেটা হলো ফিডস্টক অর্থাৎ গোবর, গাছের পাতা, মনুষ্য বর্জ্য, তুষ, কুড়া, হাসমুরগীর বিষ্টা ইত্যাদি। আর যেটা প্রয়োজন সেটা হল প্রয়োজনীয় তাপমাত্রা বজায় রাখা ও প্রয়োজনীয় পিএইচ নিয়ন্ত্রণ। তাহলে গ্যাস উৎপাদন হবে। সাধারণ অর্থে পিএইচ নির্দেশ করছে ব্যবহৃত উপাদানের অম্লতা বা ক্ষারতা। পিএইচ এর মান ৬.৬ থেকে ৭.৬ এর মধ্যে এসিড তৈরির ব্যাক্টেরিয়া ও মিথেন তৈরির ব্যাক্টেরিয়া কাজ করতে পারে। এখন আমাদের দেশে গ্রীষ্মকালে হয়তো গ্যাসডোমের অভ্যন্তরস্থ তাপমাত্রা প্রয়োজনীয় পরিমান বজায় থাকে কিন্তু শীতকালে অনেক সময় তাপমাত্রা প্রয়োজনীয় মাত্রার চেয়ে নিচে নেমে যেতে পারে, ফলে উৎপাদন ব্যহত হতে পারে। আবার পিএইচ নিয়ন্ত্রণে না থাকলে চাহিদামত গ্যাস উৎপাদন হবে না। তখন লোকজন হয়তো মনে করতে পারেন গ্যাসডোম আর কাজ করছে না বা নষ্ট হয়ে গেছে। এ কথা ভেবে একবার পরিত্যাগ করলেন এবং পরে এর প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। অন্যদিকে কিছু কাল অতিবাহিত হলে এসব ছোট গ্যাসডোমে তলানির স্তর উচু হয়ে কন্টেইনার ভরে উঠতে পারে এবং গ্যাস উৎপাদন কমে চুলায় প্রয়োজনীয় গ্যাস সরবরাহ বন্ধ হয়ে যেতে পারে। তখনও এসব ব্যক্তিগত প্রকল্পগুলো বাংলাদেশে পরিত্যক্ত হয়। তাছাড়া নির্মাণ ত্রুটির কারণে গ্যাস ডোম ভালভাবে বায়ুনিরোধক না হলে কিংবা কিছুদিন কার্যকর থাকার পর ব্যবহারের একপর্যায়ে কোন কারণে ডোমটি ক্ষতিগ্রস্ত হলেও গ্যাস উৎপাদন ব্যহত হবে। অনেক সময় বড় গাছের পাশে যদি গ্যাস ডোম করা হয় তাহলে গাছের শিকড়ের চাপে গ্যাস ডোম ফেটে যেতে পারে যা বাহ্যিকভাবে চোখে পড়বে না। এবং ফলত এই প্রকল্প পরিত্যক্ত হবে। এজন্য যেকোন ব্যক্তিকে একটা গ্যাসডোম নির্মাণ করার আগে এ বিষয়গুলো জানা অত্যন্ত জরুরি। আবার কংক্রিট কন্সট্রাকশনের মাধ্যমে বায়ূনিরোধক করতে গেলে নির্মাণ সামগ্রি উৎকৃষ্টমানের হওয়া প্রয়োজন।

এসব দিক বিবেচনা করে একটা পরিবারের জন্য একটা ক্ষুদ্র প্রকল্প থেকে বায়োগ্যাস এর ব্যবহার দীর্ঘদিন ধরে (কমপক্ষে বিশ বছর) নিশ্চিত করা গেলে টেকসই প্রযুক্তি হিসেবে বায়োগ্যাস আমাদের বিকল্প জ্বালানির উৎস হতে পারে। এতে আমাদের বনাঞ্চল নির্বিচারে ধ্বংসের হাত থেকে যেমন রক্ষা পাবে আমাদের অর্থনীতিও সমৃদ্ধ হবে। আমি বিশ্বাস করি অর্থনীতিতে কৃষিবিপ্লব আসবে। কারণ প্রতিটি পরিবারে জ্বালানি প্রয়োজন সেক্ষেত্রে বিকল্প এই জ্বালানির ব্যাপক ব্যবহার যদি নিশ্চিত করা যায় তা গ্রামাঞ্চলের অর্থনীতির উপর বিশেষ ইতিবাচক অবদান রাখবে। গ্যাস উৎপাদনের বাইপ্রডাক্ট হিসেবে যে সার পাওয়া যাবে তাও দেশজুড়ে মাটির উর্বরতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করবে। সারাদেশে উল্লেখযোগ্য হারে রাসায়নিক সারের ব্যবহার হ্রাস পাবে যা থেকে সরকার এবং কৃষক উভয়েই লাভবান হবে। রাসায়নিক সারের ক্ষেত্রে সরকারের ভর্তুকি বাবদ খরচ কমে যাবে। আমদানি সংকোচনের ক্ষেত্রে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি ও খাদ্যে সয়ংসম্পূর্ণতার দিকে আমাদের যাত্রা আরও একধাপ এগিয়ে যাবে। সবমিলিয়ে টেকসই উন্নয়নের জন্য বিকল্প জ্বালানির এই প্রযুক্তিকে জনগণের মাঝে আস্থাপূর্ণভাবে ছড়িয়ে দিতে হবে।

একই সাথে আবাসন শিল্পের নামে, কলকারখানার নামে দেশের কৃষিজমি ধ্বংস করা বন্ধ করতে সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে এগিয়ে আসতে আহ্বান করছি।

ভারতে যে সমস্যা আমাদেরও সেই সমস্যা সবার যথেষ্ট হাঁসমুরগি, গরুছাগল না থাকা। গোবর বা মলমূত্র থেকে উৎপাদিত বায়ো গ্যাস ব্যবহারে অনীহা, ইত্যাদি বিবেচনা করলে মানুষকে এই দিকে আকৃষ্ট করার জন্য আমাদের ভারতীয় উদ্ভাবকের সেই প্রযুক্তি ধার করতে কোন দোষ দেখি না। সেদিকেও আমাদের চিন্তার পথ খোলা রাখা প্রয়োজন। আমাদের উদ্ভাবকদের এ নিয়ে গবেষণা করা অত্যন্ত জরুরী। খুবই সহজ প্রযুক্তি সরকারি উদ্যোগে বা বেসরকারি উদ্যোগেও করা সম্ভব। এক্ষেত্রে ভারতীয় বিজ্ঞানি যে প্লাস্টিকের গ্যাস ডোম তৈরি করেছেন সে ধরনের প্লাস্টিক কন্টেইনার (পানির প্লাস্টিক ট্যাংক) আমাদের দেশে তৈরি হচ্ছে। গ্যাসডোম আকারে তৈরির জন্য বিদ্যমান এই প্রযুক্তিকে কাজে লাগানো সম্ভব। ইউরোপের কোথাও কোথাও ভিন্ন ধরনের প্লাস্টিকের কিট পাওয়া যায়। সেটা আবার ফ্লেক্সিবল বা প্লাস্টিকের বেলুনের মতো। সরাসরি কিনে নিয়ে এটাকে মাটিতে গর্তকরে স্থাপন করতে হয় এবং ফিড দেয়ার পর গ্যাসের চাপে একসময় তা ফুলে ডোমাকৃতি হয়।

জনগণ সে প্রযুক্তি ব্যবহার করবে যাতে জটিলতা কম এবং ব্যবহার সহজ, কোন ‘বাগ’ থাকবেনা এবং রক্ষণাবেক্ষনও সহজ হবে। কারণ কিছুকাল পরপর যদি একটা সিস্টেমে সমস্যা দেখা দেয় তখন ব্যবহারকারি এর প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে যা বিদ্যমান প্রকল্পগুলোতে দেখা দিচ্ছে। একটা নির্দিষ্ট মেয়াদের শেষে পুরনো গ্যাসডোম ভেঙে ফেলে পুননির্মান করা দরকার হবে কিন্তু তার জন্য প্রকল্পগুলোকে কমপক্ষে বিশ বছর বা তদুর্ধ মেয়াদের হওয়া বাঞ্ছনীয়।


মন্তব্য

দিগন্ত এর ছবি

সুন্দর লেখা হাসি পড়ে অনেককিছু জানলাম।


হাতি ঘোড়া গেল তল, মশা বলে কত জল।


পথের দেবতা প্রসন্ন হাসিয়া বলেন, মূর্খ বালক, পথ তো আমার শেষ হয়নি তোমাদের গ্রামের বাঁশের বনে । পথ আমার চলে গেছে সামনে, সামনে, শুধুই সামনে...।

জিজ্ঞাসু এর ছবি

ধন্যবাদ দিগন্ত। আমার উদ্দেশ্য এ নিয়ে একটা ব্যাপক গণজাগরণ তৈরি করা। দেশের গবেষকগণ এগিয়ে আসবেন কি? এনিয়ে বিটিভিতে শাইখ সিরাজের 'মাটি ও মানুষ' এর কল্যাণে আমার স্কুলে পড়াকালিন বায়োগ্যাস প্রযুক্তির প্রতি আগ্রহ জাগে। খোঁজ নিতে গিয়ে এখন দেখি বিদ্যমান প্ল্যান্টগুলো ঠিকমত কাজ করছে না। এনজিওরা টেকনিকেল ও আর্থিক সহায়তা দিয়ে অনেক প্রকল্প করে দিচ্ছে এবং তাদের টাকা তারা সুদসহ কিস্তিতে তুলে নিচ্ছে। তারপর কৃষকের প্ল্যান্টগুলো একসময় পরিত্যাক্ত হচ্ছে। তাছাড়া গরুছাগল পালন এর সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। এ কারণে আমি তথ্য খুঁজতে গিয়ে যা জানলাম তা তুলে ধরেছি। বায়োগ্যাস প্রযুক্তি কার্যকরভাবে কাজে লাগাতে পারলে আসলেই দেশে এর বহুমুখী সুফল পাওয়া সম্ভব।

___________________
সহজ কথা যায়না বলা সহজে

দুর্দান্ত এর ছবি

সুন্দর লেখাটির জন্য অশেষ ধন্যবাদ।
বেসরকারি উদ্দোগে লাভজনকভাবে বায়োগ্যসের ব্যবসা করা সম্ভব। তবে এযাবত নেয়া "এক পরিবার - এক কিট" ব্যবসায়িক নকশাটি নিয়ে আমার সন্দেহ আছে। ঊন্নয়নশীল অর্থনৈতিক পরিবেশের কয়েকটি সৌরশক্তি, বায়োমাস থেকে বিদ্যুত ও বায়ুশক্তির প্রকল্প কাছ থেকে দেখার অভিজ্ণ্তা থেকে বলছি, পরিবার পর্যায়ের প্রকল্পগুলির চাইতে কমিউনিটি পর্যায়ের প্রকল্পগুলির কার্যসম্পাদন ক্ষমতা বেশী ও এরা বেশী টেকশই; কমিউনিটি পর্যায়ের প্রকল্পগুলিকে প্রথম দেখায় বেশী ঝুঁকিপূর্ণ ও খরুচে মনে হয়, কিন্তু শেষমেষ এগুলোরই মাথাপিছু খরচ কম ও কম ঝামেলার।

কঁাচামাল ও প্রযুক্তির সাথে সাথে ব্যবসায়িক নকশা নিয়ে ভাবার আছে। জ্বালানীর মত জরুরী বিষয়কে কুটিরশিল্পের মত করে দেখার দিন পেরিয়েছে।

জিজ্ঞাসু এর ছবি

দুর্দান্ত এ নিয়ে আপনার অভিজ্ঞতালব্ধ ভাবনাগুলো পোস্ট করুন। আমি উৎসাহ বোধ করছি। ধন্যবাদ।

___________________
সহজ কথা যায়না বলা সহজে

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।