ভূত ও ভাবী - জীবনের স্রোত আছড়ে পড়ে কংক্রিটের পাষাণে

জিজ্ঞাসু এর ছবি
লিখেছেন জিজ্ঞাসু (তারিখ: বুধ, ১৮/০৩/২০০৯ - ৯:০০পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

একদিন সকালে কৃষকেরা দেখে তাদের জমিতে রাতের আঁধারে চাটাইয়ের ঘর তোলা। সীমানা বেড়া ঘেরা বিশাল এলাকা জুড়ে। আর অপরিচিত মানুষের ভীড় সেখানে। শহরের সীমানার খুব কাছেই তাদের ধানের জমিগুলো। বর্ষায় প্রায় সারাবছর ডুবে থাকে। ধান ফলে শুধুমাত্র শীতের ক'টা মাস। তাও তেমন ভাল ফলন হয় না। শহরের আবর্জনার পানি খাল বেয়ে নদীতে এসে পড়ে। শহরের বিষ নেমে যায় এসব খাল দিয়ে। নদীর পানিতেও বিষ। আগে এসব নদীতে মাছ ছিল অনেক। এখন তেমন নেই। বিচিত্র সব মাছের আনাগোনা ছিল নদীগুলোতে। এখন তারা সবাই হারিয়ে গেছে। যেভাবে শহরের ইট, সুরকির নিচে হারিয়ে গেছে নদীর সচল প্রবাহ।

ডাকাতিয়া নদীগুলোর বুকে জেগে ওঠেছে বিশাল দৈত্যকায় কংক্রিটের স্তুপ, আর দীর্ঘ কাল সাপের পিঠের মত পিচঢালা পথ। হারিয়ে যেতে যেতে নদী আর খালগুলোর মরা লাশটুকুও অবশিষ্ট নেই। শহরের হৃদয়হীন রক্তচক্ষু আর লালসার শিকার হয়ে তাদের কবরটুকুও বাকি নেই। যেখানে এককালে ভরা নদী জোয়ার ভাটায় মানুষের মনের আনন্দ বেদনাকে ভাগ করে নিত, নিতে নিতে বহুদূর নিয়ে ছড়িয়ে দিত বিশ্বচরাচরে তাদের নামটুকুও আর অবশিষ্ট রইল না। কোথাও তাদেরকে লেক নাম দিয়ে বন্দী করা হল আর মানুষের মলমুত্রে এক একটা সেপটিক ট্যান্ক হয়ে উঠল। তাদের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ একদিন আবারও কোন এক যন্ত্রদানবের চাকায় পিষ্ট হয়ে পচে গলে বিলিন হবার প্রতীক্ষায়।

কোথাও নদীগুলোকে চারদিক থেতে আষ্টেপৃষ্ঠে ঘিরে ধরে এগোতে লাগল, এককালের প্রিয় মানুষগুলো তাদের কলিজার রক্ত পান করার জন্য। তাই যক্ষা রোগির মত জীর্ণশীর্ণ, ক্ষীণকায় হয়ে কোনমতে বেঁচে থাকার চেষ্টা করেও শেষ পর্যন্ত শহরের সুয়ারেজ গলান হয়ে বন্দী হল পাথরের বেড়ে।

নদীগুলোর মত তাদের পরিচিত মানুষগুলোও বিলীন হয়ে গেল। আসলো নতুন মানুষ, নতুন দাঁত আর রোমশ হাত নিয়ে। আসলো পিস্তল, কাটারি, রামদা, খুর, ডেগার নিয়ে। ওরাই শহরের হাত আর দাঁত হয়ে খেয়ে চলল চারদিকের নদী, খাল, জলাধার, মাটি, পানি, বাতাসকে। আর ধীরে ধীরে অক্টোপাসের মত ডালপালাওয়ালা হাতের কাছে যা পেল তা গিলতে গিলতে শহরটা বিশাল এক মহীরূহে পরিণত হল। একসময় আশা ফুরানোর জন্য আসা মানুষগুলোর আশা জেগে থাকলেও তাদের আয়ু দিন দিন ফুরিয়ে যেতে লাগল এই শহরে। গ্রামের অকৃত্রিম মানুষগুলো আশা ফুরানোর জন্য এই শহরে আসতে আসতে তাদের জীবনের শেষ নিঃশ্বাসটুকুও ফুরিয়ে গেলে তারা দিন দিন হারিয়ে যেতে লাগল অকালে। এই শহরের মানুষের লাইফ এক্সপেকটেন্সি কমে গেল। কিন্তু শহর থামল না। মানুষকে তবুও সে আশার মরিচিকা দেখিয়ে যেতে লাগল। একটুকরা জমির জন্য, ভেজাল খাদ্যের জন্য, ভেজাল আশার রঙীন আহ্বানে সাড়া দিয়ে মানুষ আসতেই থাকল শহরে। আর ধীরে ধীরে মানুষগুলো এই শহরের সব কায়দা কানুন রপ্ত করে মনের পিঞ্জরে কংক্রিটের হৃৎপিণ্ড স্থাপন করে নিল। তাই মানুষ মরলেও যেখানে আর চোখে জল আসে না সেখানে নদী, খাল, জলাশয় বা ধানক্ষেতের মৃত্যু তাদের কীভাবে ভাবাবে। গাঁটে টাকা থাকলে যেখানে কৃত্রিম স্বাদে ভরা মাগুর, তেলাপিয়া, পাঙ্গাশ, কই, রুই, পাওয়া যায় সেখানে প্রকৃতির অকৃত্রিম বাঘার, বোয়াল, চিতল, পাবদা, টাটকিনি, পুটি, শিং, মাগুর, টাকি, নদীর পাঙ্গাশ, খলসে, বাইন, বাউস, শোল, গজার, কাতল, মৃগেল এসব মাছের কথা কংক্রিটের মন থেকে বিলিন হতে খুব বেশি সময় লাগে না।

যার পকেটে টাকা নেই নিওন বাতির ল্যাম্পপোস্টের আলোয় তার স্বপ্নেও সেসব মাছ ঠিকভাবে আর ধরা দেয় না। স্বপ্নগুলোও অন্যরকম হয়ে যায়। তখন পচা, দুর্গন্ধযুক্ত চালের একমুঠ ভাতের স্বপ্নও হলুদ হয়ে যায় নিওন বাতির হলদে ছটায়। হলদে শহরের হলদে মানুষগুলো তবুও আশা ফুরানোর জন্য এ শহরে ঘর থেকে বের হয় প্রতিদিন ভোরে। নিওন আলো তখনও নেভেনি। ফিরবে আবার নিওন আলো মাথায় করে। প্রভু আর ভৃত্যের এই শহরের আশাগুলো তবুও জ্বলজ্বল করে। শহরের মৃত্যুর ফাঁদে পা দিয়ে সেখানেই বুবি ট্র্যাপে পড়ে থাকার জন্য শহরের মাটির নাগাল না পেলেও একটা চিলে কোঠা হলেও দখলে নেয়া যায় কীভাবে সেই রেসে দৌড় লাগায় প্রতিদিন। গৃহিনীরা স্বপ্ন দেখে রৌদ্রদিনে রঙীন চশমার আর শীতের দিনে লিপজেলের। গ্রামের নরম রোদ তাদের চোখ কখনও ধাঁধিয়ে দেয়নি। কোনদিন ঠোঁটের মসৃণতাও হারায়নি যাদের তাদের আজ ঠোঁট ফাটে, রঙ ফর্সা করার ক্রিম লাগে। হায় রঙ ফর্সা করার ক্রিম। তাতে বিষ ছাড়া কিছু জোটে না তাদের। ত্বক আরও রুক্ষ হয়, ঠোঁট আরও ফাটে তবুও আশায় বুক বাঁধে, যদি কোনদিন আশা ফুরায়, যদি কোনদিন কপাল ফাটে।

অন্ধকার সিড়িতে স্বামীকে বিদায় দিতে দিতে হয়তো কোন গৃহীনি ভাবেন, "রাজপথ দিয়ে চলে এত লোকে, এমনটি আর পড়িল না চোখে, আমার যেমন আছে।" ভাবতে ভাবতে সিড়ির অন্ধকারেই ভাবনা রেখে তাকে ব্যস্ত হয়ে পড়তে হয়।
এভাবে স্বপ্ন দেখা মানুষগুলোর, আশা ফুরানোর মন্ত্রে বিভোর মানুষগুলোর স্বপ্নের কথা কেউ কেউ জেনে ফেলে। তারা শহরে তাদের কংক্রিটের ভাগ নেবার স্বপ্নের কথা জেনে যায়। তারাও তখন নিজের একটা বাড়ি, বা ফ্ল্যাটের স্বপ্ন দেখাতে শুরু করে আরও দ্বিগুন তেজে। টিভির পর্দায় চোখ রেখে রেখে গৃহিনী প্রতিদিন অপেক্ষা করে তার নায়ক কখন মেশিনের ঘষায় মিনিকেট হয়ে যাওয়া ইরি চাল, ভেজাল তেল, মেলামিন মেশানো গুঁড়ো দুধের ডিব্বা নিয়ে হাজির হবে- নিশ্বাসে একগাদা সীসা নিয়ে, সারা গায়ে কার্বনের কালো প্রলেপ নিয়ে।

বাচ্চারা স্কুলে কী যে করে, কী যে পড়ে! সারাবছর প্রাইভেট টিউটর লাগে। অথচ স্কুলের ব্যাগে বই আর খাতার বোঝা গাধার বোঝার মত ভারি। এত বই, এত খাতা লাগে। লাগবে না কেন সবাই এ শহরে এসেছে আশা ফুরানোর জন্যই তো। এত অল্পে চলবে কেন। ভেজাল খেতে খেতে গৃহিনীর চর্বিদার শরীরেও একসময় বাসা বাঁধে নতুন নতুন নাম না জানা সব রোগ। গৃহকর্তারও আজ কিডনি তো কাল হার্ট নিয়ে ডাক্তারের কাছে দৌড়াতে হয়।

এ শহরের ডাক্তারও একই আশা ফুরানোর মন্ত্রে দীক্ষিত। তাই কাজের চেয়ে ডাক্তারের বিল বেশি গুরুত্বপূর্ণ। চিকিৎসার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বেশি ডায়াগনোসিস। কিন্তু কোথাও একবার ডায়াগনোসিসে ধরা পড়ে না রোগ। এ শহরের ইটের ভাগ নেবার স্বপ্নে বিভোর ডায়াগনোস্টিক সেন্টারগুলো তাই ঠিকমত রিপোর্ট দিতে পারে না। দশ জায়গায় ডায়াগনোসিস করলেও রোগ খুজেঁ পাওয়া যায় না। ততদিনে ইট সুরকির স্বপ্ন রেখে গৃহকর্তা পরলোকের পথে রওয়ানা দেন। আশা তার ফুরায় না। তার সন্তান আছে, আশা ফুরালে চলবে? সন্তানের মধ্যে সে আশা সঞ্চারিত করে যান।

কাপড়ের ব্যবসা, রেস্টুরেন্টর ব্যবসা, ওষুধের ব্যবসা রেখে স্বপ্নের ব্যবসা শুরু করে দিয়েছে কিছু লোক ইতিমধ্যে। অক্টোপাসের টেন্টাকলের মত ধীরে ধীরে তাই শহর তার থাবা প্রসারিত করার উদ্যোগ নেয়।
তাই একদিন সকালের নরম রোদে ইতিমধ্যে শহরের গরম হাওয়ার আঁচ গায়ে লাগা কৃষকেরা দেখে তাদের জমিতে জবরদখল। কিন্তু চিরকাল ক্ষেতে হল্লা করে বেড়ানো কৃষকেরা মানতে চায় না তা। তারা লাঠিসোটা নিয়ে তাড়াতে আসে জবরদখল। কিন্তু তাদের যেতে হয় জেলে। জেলে গিয়ে তাদের আরও বিস্ময় বাকি থাকে। তারা পরদিন আদালতের সামনে হাজির হয় মামলার আসামী হয়ে। জবরদখলকারি উল্টো তাদের নামে মিথ্যে মামলা সাজায়। তারা হয়ত জামিনেও ছাড়া পায় একসময়। কিন্তু মাসে মাসে কোর্টে হাজির হওয়া আর উকিলের হয়রানির শিকার হয়ে তারা বাধ্য হয় টাকার ক্ষমতার কাছে নতিস্বীকার করতে। তারা তাদের জমি হারায়। শহরের কংক্রিটের ভাগ চাওয়া, উকিল, মোক্তার, জজ, ব্যরিষ্টার, আর্দালি, চাপরাশি, পুলিশ, মন্ত্রী, ম্যাজিস্ট্রেট সবার কাছে হার মানে কৃষক। বিলীন হয় কৃষকের জমি। মাছের জলা। জলের নদী আর খাল। ধীরে ধীরে সব কংক্রিট হয়ে ওঠে। কম্পিউটার এনিমেশানের বদৌলতে দশ হাত জলের নিচের মাটিও শুনতে পায় লোহা, লক্কড়, আর কংক্রিটের শব্দ, বুলডোজারের গড়গড়ানি হুঙ্কার।

গ্রামের দেশ, কৃষকের দেশ কবেই হয়ে উঠতে শুরু করেছে বেনিয়ার দেশ। বাঁধানো আঙিনায় বেড়াতে চায় কৃষকের সন্তানেরা। পিচঢালা পথে গাড়িঘোড়ায় চড়ার স্বপ্নে বিভোর হয়। প্রেমিকাকে নিয়ে ফাস্টফুডের দোকানে বা ওয়ান্ডারল্যান্ডের রাইডে চড়ে আইসক্রিম খেতে খেতে বিলেতি ছবির নায়ক নায়িকা হয়ে উঠে তারা ক্ষণিকের তরে হলেও। জীবনে এটাই বা কম পাওয়া কিসের।

তারপর মোবাইলে রাতভর কথা বলার পরদিন স্কুল কলেজ পাঠশালায় গিয়ে সময় নষ্ট করার সময় থাকে না। চারিদিকে পয়সা রোজগারের হাতছানি। বইয়ের বোঝা টেনে সময় নষ্ট করার সময় আছে কি? গায়ে জোর, হাতে বন্দুক, হকিস্টিক থাকলে আর মনে যদি থাকে সিড়ি বেয়ে ওপরে ওঠার স্বপ্ন তাহলে পয়সা এসে ধরা দেয় আপনি। এতদিন রাতভর কথা বলা প্রেমিকার সাথে কথা বলার প্রয়োজন আর হয় না। নাচঘরে, ক্যাবারে নর্তকীদের নাচের ছন্দে মন ভরে যায়। নতুন করে আশা ফুরানোর স্বপ্ন নিয়ে লাল লাল নীল নীল বাতির নিচ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে কখনও আরেক স্বপ্নবাজের সাথে টক্কর খেয়ে ঝরাপাতার মত আছড়ে পড়ে। আবার কখনও উড়তে উড়তে তারাদেরও ছুঁয়ে ফেলে।

শহরের বেনিয়ারা বাইরের দুনিয়ায় নিত্তই ছুটে চলে। ঘুরে বেড়িয়ে তাদের আকাশকে বিস্তৃত করে। কিন্তু আকাশ তাদের উদার হতে সেখায় না। আকাশ তাদের শেখায় কীভাবে উড়তে হয়। কীভাবে বাজি জিততে হয়। তারা উড়ে বেড়ায় ঈগলের মত। বিশ্ববাজারের মন্দার প্রভাবে বেনিয়াদের খটকা লাগে, তারা তাদের ভিত মজবুত করতে সরকারের কাছে বেইল আউট ফান্ড তৈরির দাবি জানায়। সত্তর হাজার কোটি ডলার না, মাত্র ছয় হাজার কোটি টাকার উদ্ধার প্যাকেজ পেতে চায় তারা।

সরকারতো তাদেরই রক্ষা করবে। কৃষকের ভোটে তো আর ক্ষমতায় যায় না কেউ। ভোট তো একটা নাটক মাত্র। সেই নাটকের পরিচালক তো আমলা, মন্ত্রীরা। নাটক প্রযোজনা করেন তো বেনিয়ারা। তাহলে কৃষককে বেইল আউট করতে হবে কেন? বেইল আউট করতে হবে বেনিয়াদের। বিজ্ঞানীদের প্রতি যুগে যুগে আশির্বাদ। তারা কী না করেছে। বাঙালির প্রধান খাদ্য চালও হয়ত একদিন তারা বানাতে পারবে গবেষণাগারে। আমরাও ধীরে ধীরে মেট্রোসেক্সুয়াল শহুরে হয়ে উঠছি। বিদেশি কর্পোরেশনে চাকরির সুবাদে আমাদের নবীন একজিকিউটিভদের পকেটে খরচের টাকার অভাব হচ্ছে না। এ শহরের সীসামিশ্রিত বিষাক্ত বাতাসে তাদের বেনসন সিগারেটের ধোঁয়াও মিশে যায়, তাদের নিশ্বাসে হাইনিকেনের গন্ধও উবে যায় রাতভোর হতে হতে। তাদের দেখে স্বপ্নচারীরা আরও স্বপ্নাপ্লূত হয়ে পড়ে। শহরের কংক্রিটের ভাগ পেতে চায় আরও আরও বেশি লোকে। মেট্রোসেক্সুয়াল বেনিয়াদের ধাঁধায় পড়ে যায় পুরো জাতি।

তাদের কল্যাণে সীমিত আয়ের লোকেরা বাজারে কিছুই কিনতে পারে না। ভাল মাছটা, ভাল চালটা, ভাল ডালটা, তেলতেলে মুরগিটা চলে যায় তাদের বাজারের ডালিতে। বাজার ভারসাম্যহীন হয়। কৃষক জমি হারাতে থাকে। তারপর জীবন হারায়।

কৃষকের সন্তানেরাই আজ কৃষকের শত্রু হয়ে দাঁড়িয়ে যায়। তারাই আইন করে। তারাই জজ, ব্যরিস্টার হয়ে কৃষকের জমিতে বুলডোজার চালায়। সীমিত চাষযোগ্য জমির এই দেশে যেখানে মানুষের আবাসন আর খামারের পাশাপাশি অবস্থান সেখানে শিল্পকারখানার মত আবাসন ব্যবসায় কি তেমন কোন শিল্প হতে পারে। এটা দেশের কৃষককে প্রান্তিক ও ভূমিহীন কৃষকে পরিণত করার চর্চা। কৃষককে, এবং কৃষি জমিকে কীভাবে উপযুক্ত ব্যবহারের মাধ্যমে জাতি সর্বোচ্চ লাভবান হবে তা ঘনবসতিপূর্ণ এই দেশের কি জনবিরল কোন দেশের উদাহরণ থেকে শিখবে, নাকি নিজস্ব পরিপার্শ্ব যাচাই করে নিজেদের আত্মরক্ষামূলক ব্যবস্থা নিতে হবে?

শহরের মন্ত্রী, এমপিরা মিথ্যুক। তারা জনগণের সেবা রেখে ক্ষমতার চর্চায় মেতে উঠেছে। তারা আইন প্রণয়নের জন্য নির্বাচিত হয়ে উপজেলায় অন্য নির্বাচিত প্রতিনিধিদের উপর ক্ষমতার দাপট দেখাতে ব্যস্ত। সরকার তাদের উপর ন্যস্ত করেছে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভার। তারা এখন ছাত্রভর্তি, শিক্ষক নিয়োগ ইত্যাদি দায়িত্ব সুচারুভাবে সম্পন্ন করবে। সেখান থেকে তাদের যা আয় হবে তাতে তাদের আগামী ইলেকশনের খরচাও আগাম জোগাড় হয়ে যাবে। তারা কেউ সংসদে যাবেনই না, কেউ সংসদে যাবেন ঘুমানোর জন্য।

কৃষক কাকে বলে? কৃষি জমি বাঁচানোর জন্য সুস্পষ্ট নীতিমালা তারা তৈরি করবেন কেন? কৃষক তো আর বলরুমে দাওয়াত করে না তাদের। হাইনিকেন, ভদকা বা শ্যাম্পেন তুলে দেয়না ডিনারে। রমনীয় নারীগণ তাদের স্বাগত জানায় না কৃষকের রসুইঘরে। বরং গেলবার ইলেকশানে ভোট চাইতে গিয়ে এসব নোংরা চাষাদের হাত বাড়িয়ে দেয়া উপেক্ষা করতে পারেনি বলে বিদেশি সাবান দিয়ে হাত ধুতে হয়েছে অনেক। কি নোংরা ওদের হাত! তবুও খিদে পেলে এসব নেতাদেরও প্রয়োজন হয় ভাত। সে ভাত কৃষকই ফলায়। রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে। তাদের জমি যেন কোন অকৃষক কিনতে না পারে। শিল্পায়নের নামে যেন কৃষক ভূমিহীন না হয় তার জন্য কোন আইন প্রণয়নের দরকার পড়েনা তাই।

তাইতো শহরে শহরে হিড়িক পড়ে যায় নতুন শিল্পোদ্যোগ চর্চার। নতুন ইন্ডাস্ট্রির ব্যঙের ছাতার মত গজিয়ে ওঠা। তার নাম রিয়েল এস্টেট ইন্ডাস্ট্রি। আবাসন শিল্প। এ শিল্পের কল্যাণে মানুষের বাপদাদার ভিটে হারায়, কৃষি জমি বিলীন হয়, কারও কারও জীবনটাও যায় বিনা প্রশ্নে। নতুন করে গজিয়ে ওঠা এই আবাসন শিল্পের মূল কাঁচামাল হল পেশিশক্তি আর ধোঁকাবাজি। কৃষকের জমি কেড়ে নিয়ে আবার ধোঁকা দেয় আশার স্বপ্নের স্বপ্নচারীদের। টাকা দিয়েও তারা ফ্ল্যাট, প্লট পায়না, কারণ প্লট তখনও বিশ ফুট পানির নিচে যেখানে একসময় ছিল জীবনের মতই প্রবাহমান নদী। জীবনকে থামিয়ে দেবার সব আয়োজন আজ সম্পন্ন হয়েছে। জীবন থেমেও গেছে। জীবন থেমেও যায়। তবুও স্বপ্ন ফুরায় না।

এ শহরে এসে আমাদের আশাও ফুরায় না।


মন্তব্য

রাগিব এর ছবি

এটার চাইতে আরো বড় একটা সমস্যা আছে, যা নিয়ে আমার পরিচিত একজন অর্থনীতিবিদ কয়েকদিন আগে অনেক কথা বললেন আমাকে। বাংলাদেশে একটা গুরুতর সমস্যা হলো, কৃষিজমির ঘরবাড়িতে রূপান্তর। উনি একটা হিসাব করে দেখালেন, গ্রামে বছর বিশেক আগেও ঘরবাড়ি ভিটা মাটি যত শতাংশ ছিলো মোট জমির, তার চেয়ে এখন অনেক বেড়ে গেছে। জনসংখ্যা বাড়ার হার হিসাব করতে গেলে অল্প কদিন পরে কৃষিজমি আরো কমে যাবে। তার সাথে কিন্তু এই পোস্টের জমি দখলের সেই ভয়াবহ ব্যাপারটার সম্পর্ক নেই ... জমি দখল হোক বা দখল না হোক, কৃষিজমির ক্ষয় হতেই থাকবে এভাবে ঘরবাড়ির কবলে। মন খারাপ

----------------
গণক মিস্তিরি
জাদুনগর, আম্রিকা
ওয়েবসাইট | শিক্ষক.কম | যন্ত্রগণক.কম

জিজ্ঞাসু এর ছবি

মন্তব্যের জন্য অনেক ধন্যবাদ রাগিব। আশা করছি আপনার উল্লেখিত বিষয়ে আমার ভাবনাগুলো লেখব পরবর্তী লেখায়। একান্তই আমার নিজস্ব ভাবনা থেকে।

___________________
সহজ কথা যায়না বলা সহজে

নীড় সন্ধানী [অতিথি] এর ছবি

কৃষকের সন্তানেরাই আজ কৃষকের শত্রু হয়ে দাঁড়িয়ে যায়। তারাই আইন করে। তারাই জজ, ব্যরিস্টার হয়ে কৃষকের জমিতে বুলডোজার চালায়। সীমিত চাষযোগ্য জমির এই দেশে যেখানে মানুষের আবাসন আর খামারের পাশাপাশি অবস্থান সেখানে শিল্পকারখানার মত আবাসন ব্যবসায় কি তেমন কোন শিল্প হতে পারে।

আনুপাতিক হারে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশী আবাদযোগ্য ভুমির দেশ বাংলাদেশ। কয়েক বছর আগেও ৭০% ছিল আবাদযোগ্য ভুমির পরিমান। এখন ৬৭%-এ নেমে এসেছে। দিন দিন কমছে কমবে। এটাই বাস্তবতা। কিন্তু এই আবাদযোগ্য ভুমির বিরাট অংশে অপরিকল্পিত আবাদ হয়, আর নানা কারনে অনাবাদী থাকা জমির পরিমানও কম নয়। দুঃখজনক হলো বাংলাদেশে এখনো সরকারের কোন নির্দেশনা নেই কোন অংশে আবাদ হবে কোন অংশে শিল্প হবে। শিল্প এলাকা সৃষ্টির সময় যদি এই বিষয়গুলোকে গুরুত্ব না দেয়া হয়, তাহলে বাংলাদেশ অচিরেই অসহনীয় খাদ্য ঘাটতির দেশে পরিনত হবে। এখন পর্যন্ত আমরা তেমন বড় খাদ্যঘাটতি মোকাবেলা করিনি। কিন্তু ভবিষ্যতে করতে হবে। অদুর ভবিষ্যতে সারা পৃথিবীর দুটি প্রধান সমস্যা হবে খাদ্য ও জ্বালানী। বাংলাদেশকে দুটোই ভোগাবে যদি এখনই ভূমি ব্যবহার নিয়ন্ত্রন করা না যায়।

আজকে ঢাকা চট্টগ্রামের মতো শহরগুলোতে নগরায়নের যে সমস্যা সমস্যা দেখা যাচ্ছে তার প্রধান কারন সরকার থেকে কোন নির্দেশনা পরিকল্পনা না থাকা। কোথায় বাড়ী হবে, কোথা দিয়ে রাস্তা যাবে, কোথা দিয়ে নর্দমা যাবে এই ব্যাপারগুলো নগর গড়ে ওঠার আগেই করতে হয়। তাহলে সম্পদের অপচয় করে বিল্ডিং ভেঙ্গে রাস্তা বের করতে হয় না।

শুধু ঢাকা নয়, সারাদেশকেই মাষ্টার প্ল্যানের আওতায় আনতে হবে।

জিজ্ঞাসু এর ছবি

ধন্যবাদ। আপনার সাথে একমত।

___________________
সহজ কথা যায়না বলা সহজে

রানা মেহের এর ছবি

ভালো লাগলো লেখাটা
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

জিজ্ঞাসু এর ছবি

ধন্যবাদ রানা মেহের।

___________________
সহজ কথা যায়না বলা সহজে

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।