স্বাধীনোত্তর ভারত কতটা ক্রীতদাসত্বে বিশ্বাসী? - "লোকহিত" প্রবন্ধের অনুরণনে

দিবাকর সরকার এর ছবি
লিখেছেন দিবাকর সরকার [অতিথি] (তারিখ: শনি, ১৬/০৮/২০০৮ - ২:৩১পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

প্রাচীরে আজ স্বাধীনতা দিবসের ছবি রাজনৈতিক দেওয়াল লিখনে অদৃশ্য। আজ ১৫ অগস্ট। ১৯৪৭-এ, যে-ছেলেটির পূর্বেই জন্মানোর কথা ছিল, জন্মালো, জন্মানোদের সাহায্য পেয়ে। কোনো এক অদৃশ্য মায়ের গর্ভ সিজার করে চিরে বের করে আনে শিশুটিকে। নাম রাখা হয় ভারতবর্ষ। বাড়ির বড়োরা হিন্দুস্তান, বাড়ির মেজোরা অসংখ্য দাঁড়ি-কমা সমেত এই লেখা সেই দেশেরই মুক্তিযোদ্ধাদের দুঃখী হৃদয়ের কাছাকাছি। যাঁরা শাসন করেছিলেন, তাঁদের বেশির ভাগই মারা গেছেন। আমরা, যারা তাদেরই বরপুত্র, এমএনসি-র ক্রীতদাস হয়ে পড়লাম। বুকে টেনে নিলাম। অতিথিকে স্বাগত জানালাম স্বসাফল্যের উদ্দেশে।
আর যেখানেই সাফল্য, সেখানেই কোথাও যেন স্বার্থপরতার ইঙ্গিত মেলে। মানুষকে বুকে টানার নাট্যভঙ্গিটা তাই অতি চমৎকার হয়ে ওঠে। "ভোটের জন্য নন্দীগ্রাম" উভমুখী বিক্রিয়ায় পড়ে "ভোগের জন্য নন্দীগ্রাম" হয়ে যায়। হয়ে যায় "হননের জন্য নন্দীগ্রাম"। অর্থোদ্ধত রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ শাইলককে হার মানিয়েছে লোভরিপু অসংবরণের মানদণ্ডে। প্রবল ঈর্ষা বিকীর্ণ হচ্ছে চারিদিকে।
আসলে আমার মনে ধিক্‌‌ধিক করে জ্বলছে একটা রাগ। আর সেই রাগ (নিছক বিরাগজনিত কারণেই হয়ত) আমি চেষ্টা করছি নিজেরই চোখের জল দিয়ে নিভাতে। যে-শিক্ষা ধর্মের জোরে, রাজনীতির বেল্টে আবদ্ধ হয়ে সমৃদ্ধি লাভ করার গোপন ইচ্ছায় চুলবুল করে যুবক হচ্ছে, তার মহানির্বাণ গৌরবগাথায় পালিত হচ্ছে আইটি সেক্টরে। তারাও ত্রস্ত।
কিছু মানুষ মাস গেলে হাতে পাচ্ছেন বেঢপ-মোটা অঙ্কের মাইনে। সেই সব মহাজন-কে জমি ছাড়তে বলা হচ্ছে না। জমি ছাড়তে বলা হচ্ছে তাদের, যাদের সহায়-সম্বল বলতে জমিটুকুই। আসলে আমাদের প্রায়-প্রত্যেকের অন্তরে লালিত হয় একবার দেশের শপিং মলগুলোয় ঢোকার। আর শপিং মল এমন একটি জায়গা, যেখানে কোনো গরিব ঢোকে না; তাদের ঢোকার অনুমতি নেই। তাই কোনো এক কালে দারিদ্র্য দূরীকরণের মহামন্ত্র মন্ত্রণার ঔরসে জারিত হয়ে অতি দ্রুত দরিদ্র দূরীকরণের যজ্ঞে মেতে ওঠে। "গ`রিবি হটাও" অতি দ্রুত রূপান্তরিত হয় "গরিব হটাও"-তে। কাজেই শোষণ শব্দটা অনেকক্ষেত্রে শোষিত হয়ে যায়।
"... শ্রমজীবীর দল যতই গুমরিয়া গুমরিয়া উঠিতেছে ততই তাহাদিগকে ক্ষুধার অন্ন না দিয়া ঘুম পাড়াইবার গান গাওয়া হইতেছে; তাহাদিগকে অল্পসল্প এটা-ওটা দিয়া কোনো মতে ভুলাইয়া রাখিবার চেষ্টা।"
মন্ত্রণাকক্ষে বসে ছিলিমে টান দিয়ে মন্ত্রীমহোদয় অতিস্নেহযত্নপূর্বক বলে ওঠে, "উহাদের বাসা একটু ভালো করিয়া দাও।" মন্ত্রীর জামার হাতারা, মানে কুশলী চামচারা নিম্নপদস্থ চামচদের উদ্দেশে বলে ওঠে, "যাহাতে উহারা দু চামচ সুপ খাইয়া কাজে যাইতে পারে তাহার বন্দোবস্ত করো"।
আর যাদের অর্থ এসেছে একেবারেই আর্থসামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিতে নয়, তাদের কী অবস্থা! "এমনি করিয়া ধনের প্রকাণ্ড জালের মধ্যে আটকা পড়িয়া লোকসাধারণ ছট্‌‌ফট করিয়া উঠিয়াছে।"

"আমাদের দেশের জনসাধারণ আজ জমিদারের, মহাজনের, রাজপুরুষের মোটের উপর সমস্ত ভদ্রসাধারণের দয়ার অপেক্ষা রাখিতেছে; ইহাতে তাহারা ভদ্রসাধারণকে নামাইয়া দিয়াছে। আমরা ভৃত্যকে অনায়াসে মারিতে পারি, প্রজাকে অনায়াসে অতিষ্ট করিতে পারি, গরিব মূর্খকে অনায়াসে ঠকাইতে পারি – নিম্নতনদের সহিত ন্যায় ব্যবহার করা, মানহীনদের সহিত শিষ্টাচার করা নিতান্তই আমাদের ইচ্ছার 'পরে নির্ভর করে, অপরপক্ষের শক্তির 'পরে নহে – এই নিরন্তর সংকট হইতে নিজেদের বাঁচাইবার জন্যই আমাদের দরকার হইয়াছে নিম্নশ্রেণীয়দের শক্তিশালী করা। সেই শক্তি দিতে গেলেই তাহাদের হাতে এমন একটি উপায় দিতে হইবে যাহাতে ক্রমে তাহারা পরস্পর সম্মিলিত হইতে পারে – সেই উপায়টিই তাহাদের সকলকেই লিখিতে পড়িতে শেখানো।" (লোকহিত, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)
তবুও আজ স্বাধীনতা দিবস। স্কুলে স্কুলে পালিত হচ্ছে প্রতীকী স্বাধীনতা। বীজমন্ত্র মরে যাচ্ছে প্যারেডেই। আর কোনো স্বাধীনতা সংগ্রামী কাঁদছেন। মুম্বাই সিরিয়্যল ব্লাস্টে উড়ে যাওয়া ছেলের মা কাঁদছেন। বেঙ্গালুরু থেকে কিডন্যাপ্‌‌ট হওয়া সফটওয়্যার এঞ্জিনিয়ারের মা কাঁদছেন। যে বালিকা স্কুলে স্বাধীন শিক্ষকের স্বাধীন লিঙ্গের কাছে শরীরী আদরের শিকার, আজ তার 'কুলটা' গর্ভে পালিত অপরিপক্ব ভ্রূণেরও স্বাধীনতা দিবস। রক্তস্নাত নন্দীগ্রামেরও আজ নাকি স্বাধীনতা দিবস। এমন স্বাধীন দেশের নাগরিক হয়েও স্বাধীনতার আভিজাত্যের কাছে হেরে যাচ্ছেন কত শতসহস্রলক্ষকোটি মানুষ। তাঁদের জন্য, তাঁদের জন্যই, সচলায়তন-এর পক্ষ থেকে, আমার অতিথিসত্তার পক্ষ থেকে আন্তরিক প্রণাম রেখে যাচ্ছি – ভারতের মাটিতে, জলে, পর্বতকন্দরে, মহাবিশ্বে, মহাবিশ্বান্তরে ছড়িয়ে থাকা মহাভারতীয়ত্বে।
আগামীকাল ১৬ অগস্ট। পূর্ণিমা। দ্যাখা যাক, চোখে নীল স্বপ্ন নিয়ে, আমার সুলুকসন্ধান যদি চাঁদের উদ্‌‌ভ্রান্ত আলোয় বিভ্রান্ত হয়ে ভ্রান্ত বলে পরিগণিত হয়...


মন্তব্য

রেজওয়ান এর ছবি

লেখাটি ছুঁয়ে গেল।

ভারতে প্রথম যাই ১৯৯১, তখন ভারত একরকম ছিল। শেষ গেলাম বছর দেড়েক আগে। প্রচুর তফাত, বাজার অর্থনীতির প্রভাব বোঝা যায়। বেতন বহুগুণ হয়েছে, জিনিষপত্রের দাম বেড়েছে অনেক। ধনী গরিবের ব্যবধানটা আরও বেড়েছে। বারিস্তার এক কাপ কফি ৬৫ টাকা, অনেকের কাছে নস্যি, আবার অনেক পরিবারের একদিনের খরচ মিটে যায়।

এমএনসিদের দৌড়াত্ব কোথায় না আছে বলুন। তাও তো আপনাদের ওখানে ম্যানুফ্যাকচারিং হয়। টাটা, মারুতী গাড়ীর পার্টসের জন্যেই শত শত ছোট ইন্ডাস্ট্রি হয়েছে, প্রচুর কর্মসংস্থান হয়েছে। আমাদের মত আমদানী নির্ভর নয় এতটা।

বিপিওর জন্যে অনেকে শুরুতেই মোটা মাইনে পাচ্ছে। কিন্তু সবাইতো ওই কিউবিকলে বন্দী। নিজস্বতা আছে কি? আর তাদের বেতন সাবার করার জন্যে চটকদার বানিজ্যিক আয়োজন ও কনজ্যুমারিজম। এই ট্রেন্ড চলে গেলে কি সংস্থান হবে এদের সেটি কি প্লান করা হচ্ছে?

তবে এই উপমহাদেশের দেশগুলোর মধ্যে ভারতের অনেক অর্জন। স্থায়ী কার্যকরী (অনেকাংশেই) গণতন্ত্র। বিশাল দেশ, এত বৈচিত্র সহও বিপুল জাতিগোত্রের মানুষ একসাথে আছে, এক দেশকে ভাল বাসে। ভারতের সরকার এখন ধনী। আশা করব অস্ত্রের ঝনঝনানির দিকে টাকা না থরচ করে সেগুলো প্রত্যন্ত অঞ্চলের ইনফ্রাস্ট্রাকচারে তারা কাজে লাগাবে।

স্বাধীনতা তখনই এই উপমহাদেশ প্রকৃতভাবে পাবে যখন আমাদের মধ্যে ধনী-গরিব, ধর্ম-গোত্রের যে বড়াইগুলো আছে সেগুলো দুরে ঠেলে আমরা সবাইকে সমান ভাবতে শিখব। তবে এটাও মানি শুরুটা কিন্তু নিজের ঘরের থেকেই করা উচিৎ এবং আমরা মুখে যা বলি কাজে তা করি না।

ভারতকে স্বাধীনতা দিবসের শুভেচ্ছা।

পৃথিবী কথা বলছে আপনি কি শুনছেন?

মাহবুব লীলেন এর ছবি

যাদের ঘরে খাবার নেই
কিল থেকে বাঁচার জন্য পিঠে কোনো কূলা নেই

স্বাধীনতা শব্দটাইতো তাদের কাছে একটা হাস্যকর বিষয়
তারউপর স্বাধীনতা দিবস....

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।