"মা" শব্দটির অর্থের খোঁজে...

দিবাকর সরকার এর ছবি
লিখেছেন দিবাকর সরকার [অতিথি] (তারিখ: শুক্র, ০৪/০৭/২০০৮ - ১২:২৩অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

"মা" শব্দটি এত ছোটো হলেও ভাগ করলে অবশিষ্ট অনেক কিছুই থাকে,

কিন্তু তা মূল শব্দের হলুদ-মাখা হাতের গন্ধ আর যৌথতাময় পাঁচ আঙুলের বাটনা বাটার দৃঢ় লাবণ্যকে অস্বীকার করতে পারে না। ভেঙে ভেঙে পাঁচ ভাইয়ের বাড়িতে রাখা যায় তাকে। এক বাড়িতে কালোজিরে, দ্বিতীয় বাড়িতে ঘুম থেকে দেরি করে ওঠার জন্য বকাবকি, তৃতীয় বাড়িতে এঁটো মোছা, চতুর্থ বাড়িতে পুজোর ঘরে গুন্‌‌গুন, পঞ্চম বাড়িতে চাকরিতে বাইরে চলে যাওয়ার দিন বুকে জড়িয়ে কান্না – রেখে আসাই যায়, এ ভাবে, মাকে। কিন্তু এক বাড়িতে থাকলে সবকিছুই অল্পবিস্তর পাওয়া যায়।
মা শব্দটি আসলে বিশাল একটা ডিকশনারির মতো। মোটামুটি সব শব্দ, প্রতিশব্দ, ভাষা, উপভাষা, ব্যুৎপত্তি বিলক্ষণ আছে সেখানে। সেখানে আদর আর বকুনির এন্তার সে সিনোনিম পাওয়া যায়। তবে অনেকটা মখমলের মতো সেগুলো মেলে। মেখলার মতো উড়ে বেড়ায়। দ্যাখা যায় না শব্দগুলো। কারণ শব্দ সেখানে শব্দের আকারে থাকে না, মুগ্ধতার আকারে থাকে, মানে মুগ্ধতার নিরাকারে। এখানে শব্দ মাতৃত্বের স্পর্শে ব্রহ্ম।
দ্যাখা যাক, মা শব্দটায় কী কী আছে। ব্যঞ্জন /ম্/, আ-কার, তার ভিতর রাশিরাশি আশীর্বাদ, হাসি, কান্না, বোকামো, খেয়াল, উদ্‌‌বেগ, কল্যাণ, দুঃখ, সন্ধের শঙ্খঘোষ, স্নেহ, সোয়েটার বোনা, লেবুর আচার, কোশাকুশি, নাড়ু, চরণামৃত, চালের পায়েস, রাত জাগা, অপেক্ষা, ক্লান্তি, দুশ্চিন্তা, হারিকেনের কাচ মোছা, আরেকটু খা, তারকেশ্বরের সুতো, নীলষষ্ঠী, ছেলেটার কিছু হচ্ছে না...
নাঃ, এই মুহূর্তে আর মনে পড়ছে না।
সেখানে ফ্রেঞ্চি আছে, ভিআইপি নেই। সেখানে বাসস্থান আছে, ফাইভ স্টার নেই। আর আছে পান, লুকিয়ে জর্দা, চমনবাহার। আর পত্রশেষে, ইতি আশীর্বাদিকা মা।
আমাদের মা-মাসিদের কুসংস্কারের মধ্যে হঠাৎই আমার বাঁচতে ইচ্ছে করছে। যে-কুসংস্কারগুলোর ঘোরতর বিরোধিতায় আমি গতকাল-পর্যন্ত রেগে অগ্নিশর্মা হয়ে যেতাম, যুক্তির বিন্যাসে মা-কে পরাভূত করতে চাইতাম; সেই কুসংস্কারগুলো অনেক বড়ো। তাঁরা কোনো দিনই পরিবারকে চ্ছিন্ন করতে চাননি। আজকের রাষ্ট্রনেতারা হত্যাকারী হয়ে ওঠেন যেকোনো মুহূর্তে। তারা পৃথিবীকে পরিবার হিসেবে দ্যাখেন না।

বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষাব্যবস্থা জনিত উন্নয়ন প্রথমে পরিবারকে শতচ্ছিন্ন কাপড়ে পরিণত করে, তারপর টুকরো টুকরো করে তাকে ছড়িয়ে দ্যায় ক্ষুধার্ত বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে।

এই মুহূর্তে যাকে পাশে পাওয়া ভীষণ দরকার, এই জল-অচল ব্যবধানে, এই বৈষম্যের নাগপাশে, সেই শব্দের নাম "মা"।

এই শব্দটা উচ্চারণ করলেই ব্রহ্মকে ছোঁয়া যায়, সারা পৃথিবীর সমগ্র বাসিন্দাকে এক পরিবারের অন্তর্ভুক্ত বলে মনে হয়। মনে হয়, রাষ্ট্রনেতারা হত্যাকারী হতে পারে, বীরবাহু হতে পারে, গড়তে পারে অসংখ্য অচলায়তন, তবু তারা জীবনে কোনো দিন "মা" শব্দটির তলানিটুকু নিঃশ্বেষে পান করবেন না।


মন্তব্য

শ্যাজা এর ছবি

এই মুহুর্তে শুধু একটা কথাই মনে আসছে- চমৎকার...


---------
অনেক সময় নীরবতা
বলে দেয় অনেক কথা। (সুইস প্রবাদ)

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

দিবাকর... আপনার লেখা এই বুঝি প্রথম পড়লাম... ভালো লাগলো বেশ... নিয়মিত লিখুন... পড়ার আগ্রহ রইলো।
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

মুশফিকা মুমু এর ছবি

সুন্দর! হাসি
------------------------------
পুষ্পবনে পুষ্প নাহি আছে অন্তরে ‍‍

------------------------------
পুষ্পবনে পুষ্প নাহি আছে অন্তরে ‍‍

পরিবর্তনশীল এর ছবি

এই লেখায় এমন কতগুলো বাক্য পড়লাম যেগুলো কপালের মাঝখানে কিংবা বুকের একপাশে চিরদিনের জন্য লালন করা যায়।

অসাধারণ একটা সাহিত্যকর্ম। নিয়মিত লিখুন প্লীজ।
---------------------------------
ছেঁড়া স্যান্ডেল

ফেরারী ফেরদৌস এর ছবি

হৃদয় ছুঁয়ে গেল।

বিপ্রতীপ এর ছবি

মা-কে নিয়ে যেকোন লেখা পড়লেই চোখ ঝাপসা হয়ে উঠে কেন জানি...
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
বিপ্রতীপ ব্লগ | ফেসবুক | আমাদের প্রযুক্তি

মাহবুব লীলেন এর ছবি

সচলায়তনে প্রথম লেখার (?) অভিনন্দন দিবাকরকে

দুর্দান্ত একটা লেখা

তীরন্দাজ এর ছবি

রাষ্ট্রনেতারা হত্যাকারী হতে পারে, বীরবাহু হতে পারে, গড়তে পারে অসংখ্য অচলায়তন, তবু তারা জীবনে কোনো দিন "মা" শব্দটির তলানিটুকু নিঃশ্বেষে পান করবেন না।

খুবই সুন্দর করে বলেছেন দিবাকর!
**********************************
কৌনিক দুরত্ব মাপে পৌরাণিক ঘোড়া!

**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব

জুলিয়ান সিদ্দিকী এর ছবি

উদ্ধৃতি
এই শব্দটা উচ্চারণ করলেই ব্রহ্মকে ছোঁয়া যায়, সারা পৃথিবীর সমগ্র বাসিন্দাকে এক পরিবারের অন্তর্ভুক্ত বলে মনে হয়। মনে হয়, রাষ্ট্রনেতারা হত্যাকারী হতে পারে, বীরবাহু হতে পারে, গড়তে পারে অসংখ্য অচলায়তন, তবু তারা জীবনে কোনো দিন "মা" শব্দটির তলানিটুকু নিঃশ্বেষে পান করবেন না।

খুব ভালো লাগলো।
____________________________________
ব্যাকুল প্রত্যাশা উর্ধমুখী; হয়তো বা কেটে যাবে মেঘ।
দূর হবে শকুনের ছাঁয়া। কাটাবে আঁধার আমাদের ঘোলা চোখ
আলোকের উদ্ভাসনে; হবে পুন: পল্লবীত বিশুষ্ক বৃক্ষের ডাল।

___________________________
লাইগ্যা থাকিস, ছাড়িস না!

অমিত আহমেদ এর ছবি

"মনের মুকুরে"র কল্যাণে এই সুন্দর লেখাটি পড়া হলো। আপনার লেখা দেখি না অনেকদিন।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।