বিবেক

দুর্বাশা তাপস এর ছবি
লিখেছেন দুর্বাশা তাপস (তারিখ: মঙ্গল, ১৮/০৯/২০০৭ - ৪:৫৮পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

বিলু, এই বিলু। পেছন থেকে ডাক শুনে ফিরে তাকাই। তাকাতেই দেখি এক পরিচিত হাসি মুখ আমার দিকে সরল আন্তরিকতায় এগিয়ে আসছে। পরিচিত, কিন্তু চিনতে পারছি না; মুহূর্তে আমার স্মৃতির চাকা প্রবল বেগে পেছন দিকে ঘুরতে থাকে এবং আমার মনে পড়ে যায় - বিপ্রদা!
- বিপ্রদা তুমি এখানে? কোত্থেকে?
- তুই তো আমার সামনে দিয়াই আইলি, আমিতো প্রথমে চিনতেই পারি নাই, কতদিন দেখা হয় না।
কথাগুলো এক নিশ্বাসে বলে বিপ্রদা দম নিচ্ছিলেন। আমি তার দিকে ভাল করে তাকাই। এই কি সেই বিপ্রদা? কোথায় সেই বাবরি চুল, কোথায় সেই পাকানো শরীর। গাল বসে গেছে, চুলে পাক ধরেছে, স্বাস্থ্য ভেঙ্গে গেছে। গুলিস্তানের ভিরের মধ্যে এভাবে দেখা হবে কখনো ভাবি নি। আহত বিস্ময়ে দেখতে থাকি আমার শৈশব কৈশরের বিস্ময়কে। মনটা খারাপ হয়ে যায়। কি বলব বুঝতে পারি না। কোনরকমে বলি - এখানে কোত্থেকে?
- তর বউদির লিগা ওষুধ কিনতে আইছিলাম, অনেকদিনতো ঘরে পড়া।
- ও। তোমার শরীরওতো ভাল মনে হয় না। চলো বাসায় চলো সব শোনা যাবে।
- নারে, আইজ থাক, দিনে দিনেই বাড়িতে ফিরতে হইবো। দেরী হইলে বাস পামু না। তর বউদি রুগী মানুষ একা রইছে।
- কেন রুপা?
বিপ্রদা হাসলেন- অরে তো কবেই বিয়া দিয়া দিছি। কত বছর হয় গেরামে যাস না খেয়াল আছে? তা গেরামে আসস না ক্যান?
আমি একটু বিব্রত বোধ করি। - জ্বী যাব যাব করে আর যাওয়া হয় না। এবার ঈদে যাব ভাবছি। চল ওই হোটেলটায় গিয়ে বসি। চা খেতে খেতে কথা বলা যাবে।
- না থাক এমনিতেই অনেক দেরী হইয়া গেছে। তা তুই ভাল আছসতো?
প্রশ্নটার মধ্যে কিছু ছিল। শুধু কুশল জানতে চাওয়া নয়, আরো বেশী কিছু।
আমি আমতা আমতা করে বলি- এইতো চলে যাচ্ছে।
- আচ্ছা ভাল থাকিস, আমার দেরী হয়ে যাচ্ছে ।
- চলে যাবে? তোমার সাথে অনেক কথা ছিল।
- গেরামে আসিস, কথা হবে। আচ্ছা চলি।

বিপ্রদা চলে যায়। আমি স্থানুর মত কিছুক্ষন দাড়িয়ে থাকি, তারপর হাটতে হাটতে একটা বাসে উঠে বসি। বিপ্রদার এই চেহারা যেন আমার মস্তিস্ক কিছুতেই স্মৃতি হিসেবে রাখতে রাজি নয়, উগরে দিতে থাকে পুরোনো স্মৃতি।
সেই শৈশব! সেই রঙ্গীন শৈশব আর দুরন্ত কৈশর। শৈশব কৈশরের পুরোটাই আমার কাটে গ্রামে। বিপ্রদার তখন যুবক বয়স, ঝাকড়া বাবরি রেখে দাপিয়ে বাড়াত আর ছিল যতরকম বাউন্ডুলেপনা। তার উৎসাহেই শীতকালে যাত্রাপালার আয়োজন হত। মনে আছে যাত্রায় কোন এক দৃশ্যে দুইজন মঞ্চে দাড়িয়ে আছে, একজন হাতে কোকের বোতল নিয়ে বলছে- দাদা, এই আমি রক্ত বিক্রি করতে যাচ্ছি। ওই দেখেই আমরা আনন্দ পেতাম, ওটা কোকের বোতল না আসলেই রক্ত তা নিয়ে আমাদের মাথা ব্যাথা ছিল না, মজা পেলেই হল। আর একবার বন্ধুরা সবাই একসাথে বসে যাত্রা দেখছি। শেষরাতের দিকে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। সকালে যখন ঘুম ভাঙ্গে নিজেকে আবিষ্কার করি পাটক্ষেতে; বন্ধুদের বদান্যতা। বিপ্রদা বরাবর বিবেক। কোনোদিন গান শেখেনি কিন্তু গলায় মেঠো সুর ছিল। সাদা কাপড় প'রে লম্বা বাবরি নিয়ে যখন বিবেকের গান ধরত তখন চারিদিক স্তব্ধ হয়ে যেত। আজ বিপ্রদাকে দেখে কে বলবে এই সেই বিবেক।

বাসের কন্ডাকটরের ডাকে বাস্তবে ফিরি। তাড়াতাড়ি গন্তব্যে নেমে পড়ি। আমার চোখে আবার ভেসে ওঠে একজোড়া তোবড়ান গাল, ভাঙ্গা স্বাস্থ্য, সাদা চুল। হঠাৎই আমার খুব হাসি পেয়ে যায়, ভাবি আমাদের বিবেক যে এখনো বেঁচে আছে এই ঢেড়।


মন্তব্য

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি

মন ছুঁয়ে যাওয়া লেখা।

-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।