জ্বীন দেখা, স্কুল পালানো গপসপ

দুর্বাশা তাপস এর ছবি
লিখেছেন দুর্বাশা তাপস (তারিখ: বুধ, ১৯/০৯/২০০৭ - ৭:১০পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

শৈশবটা কাটে মামা বাড়িতে। অবশ্য আমার কোনো মামা নাই, তাই নানী বাড়ি বলাই শ্রেয়, নানা বাড়ি বললাম না কারন আমার কাছে তার কোনো স্মৃতি নাই, আমার স্মৃতি হওয়ার আগেই তিনি গত হয়েছেন। ছোট দুই খালার তখনো বিয়ে হয়নি, তাই দিন আমার আদর যত্নেই কাটছিল। কিন্তু এত সুখ সইবে কেন? পিতৃদেব দেখলেন অতি আদরে তার সাধের ছেলের লেজ তরতর করে বেড়ে উঠছে, লেখাপড়া গোল্লায় যাচ্ছে। তিনি এক লহমায় বুঝে গেলেন উপযুক্ত শাসনের অভাবই এর একমাত্র কারন। কাজেই উপযুক্ত শাসনে উপযুক্ত মানুষ হওয়ার জন্য আমি আমার নতুন আসল বাড়িতে স্থানান্তরিত হলাম।

নতুন স্কুলে ভর্তি হলাম। হেড স্যার ছিলেন বাবার ভাল বন্ধু তাই বিনা পরীক্ষাতেই আমার ভর্তির ব্যবস্থা হয়ে যায়। ভর্তি পরীক্ষা সম্বন্ধে আমার কোন ধারনা ছিলনা। ক্লাস টু পাস ক'রে এসেছি, কম কথা না; আমি গটগট ক'রে ক্লাস থ্রির প্রথম বেঞ্চিতে গিয়ে বসলাম। আমাকে প্রথম বেঞ্চি থেকে সোজা শেষ বেঞ্চিতে চালান ক'রে দেয়া হল। এখানে নাকি রোলনং অনুসারে সবার সিট নির্দিষ্ট, পরে ভর্তি হয়েছি ব'লে আমার রোল সর্বোচ্চ তাই আমার সিটও সবার পেছনে। কি আজব নিয়মরে বাবা!

আরো অনেক আজব জিনিষ দেখলাম। গত দুই বছরের শিক্ষাজীবনে আমার শিক্ষা বলতে স্কুল পালানো, এখানে দেখলাম এই বিদ্যায় সবাই কাঠ মূর্খ। ভাবলাম আমার জ্ঞানবৃক্ষের বীজ এখানে রোপন করা যাক। কয়েকজনকে নব্যজ্ঞানে আলোকিত করার চেষ্টা করলাম কিন্তু তেমন সাড়া পাওয়া গেলনা। জ্ঞানবিমুখ বালকদের উপর আমার প্রচন্ড রাগ হল, আমার জ্ঞানবৃক্ষের বীজ বুঝি অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়। একাএকা স্কুল পালিয়ে আর মজা কী, আমিও মনের দু:খে ঘাড় গুঁজে ক্লাস করতে থাকলাম। কিন্তু একদিন সুযোগ এসে গেল।

বছরের সেই সময়টায় ছিল মর্নিং স্কুল। সাড়ে দশটার দিকে টিফিন ব্রেকে মাঠে দাপাদাপি করছিলাম এমন সময় শুনলাম এক অদ্ভুত রোমাঞ্চকর খবর - পাশের গ্রামের এক মেয়েকে জ্বীনে ধরছে, সে এখন এক গাছের মগডাল থেকে আরেক গাছের মগডালে লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়াচ্ছে। এমন দৃশ্য মিস করলে মানব জীবনই বৃথা। আমি কল্পনায় স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম একটি মেয়ে হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে এক গাছ থেকে আরেক গাছে উড়ে যাচ্ছে। ঘটনাস্থল স্কুল থেকে বেশ দূরে, ক্লাস শুরুর আগে ফিরে আসা সম্ভব না। আমি এইবার মরিয়া হয়ে উঠলাম, কয়েকজনকে প্রানপণে ঘটনার গুরুত্ব বোঝাতে শুরু করলাম। এবার কাজ হল। ওদের মনেও নিশ্চই কৌতুহল জেগেছিল।

চুপিচুপি ক্লাস থেকে বইয়ের ব্যাগ নিয়ে স্কুলের পেছন দিক দিয়ে ছুট। পুরো রাস্তা ছুটতে ছুটতেই গেলাম। ঘটনাস্থলে বেশ ভিড়। পাশাপাশি দুটি বাড়ি, বাড়ির পেছনে একটা বেশ বড় দেবদারু গাছ, তারপর বেশ একটু মাঠের মত ফাঁকা জায়গা। সেই ফাঁকা জায়গাতেই সবাই ভিড় করে দাঁড়িয়েছে, সবার দৃষ্টি সেই দেবদারু গাছের দিকে। আমরা সাইজে সব হাফ ব্যাটারী, ফাকফোকর দিয়ে ঠেলতে ঠেলতে সবার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। তাকিয়ে দেখি দেবদারু গাছের বেশ মাথার দিকের একডালে বসে আঠার-উনিশ বছরের এক মেয়ে অন্যমনস্কভাবে পা দোলাচ্ছে।

এখন চিন্তা করে বেশ অবাকই লাগে, ওরকম একটি মেয়ের পক্ষে দেবদেরু গাছের অত উপরে ওঠা একেবারে অসম্ভব না হলেও প্রায় অসম্ভব, বিশেষত দেবদারু গাছের নীচের দিকে তেমন ডালপালা থাকেনা। কিন্তু সেই সময়ে আমি খুব হতাশই হয়েছিলাম, আমি কোনো অলৌকিক দৃশ্য দেখার প্রত্যাশায় ছিলাম। সম্ভবত আমারা সবাই বেশ হতাশ হয়েছিলাম, কিন্তু কেউ প্রকাশ করলাম না। ফেরার পথে জ্বীন নিয়ে অনেক তাত্ত্বিক আলোচনা চলল, রাস্তার পাশে বসেও অনেকক্ষন তর্ক চলল, তারপর স্কুল ফেরত ছেলেদের সাথে চুপিচুপি মিশে গেলাম। এরপর থেকে স্কুল পালানোটা আমাদের কয়েকজনের প্রায় রুটিন হয়ে গিয়েছিল।

এতসব কথা মনে পড়ত না, মনে পড়ল কারন কিছুদিন আগে গ্রামে গিয়েছিলাম আর সেই ছোটবেলার এক স্যারের সাথে দেখা হয়ে গেল। তিনি বললেন, এখনকার ছেলেগুলো মহা বদমাশ, খালি স্কুল পালায়। স্কুল পালানো যে অত্যন্ত খারাপ কাজ এ ব্যাপারে আমি তার সাথে একমত প্রকাশ করলাম। মনে মনে বললাম, এবার আপনাদের উচিত স্কুলের সামনে আমার একটা মর্মর মুর্তি স্থাপন করা।


মন্তব্য

ইশতিয়াক রউফ এর ছবি

দুর্বাশার ছেলেবেলা! চোখ টিপি

দ্রোহী এর ছবি

জটিল! আহারে পুরানা স্মৃতি জাগাইয়া দিলেন!


কি মাঝি? ডরাইলা?

দুর্বাশা তাপস এর ছবি

আপনারে আমি গুরু মানছি। আপনার ভাল লাগছে শুইনা ভাল লাগল।

==============================
আমিও যদি মরে যেতে পারতাম
তাহলে আমাকে প্রতি মুহূর্তে মরে যেতে হত না।

দ্রোহী এর ছবি

গুরু না গরু, কোনটা বললেন?


কি মাঝি? ডরাইলা?

দুর্বাশা তাপস এর ছবি

গুনাহ্গার কাইরেন না ওস্তাদ

==============================
আমিও যদি মরে যেতে পারতাম
তাহলে আমাকে প্রতি মুহূর্তে মরে যেতে হত না।

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

নস্টালজিয়া জাগানো লেখা।

জ্বিনের বাদশা এর ছবি

মনে পড়ে গেল শৈশব হাসি
========================
যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে,ঘড়ির ভিতর লুকাইছে

========================
যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে,ঘড়ির ভিতর লুকাইছে

প্রকৃতিপ্রেমিক এর ছবি

স্কুল পালানো কাহাকে বলে তা ৯ম শ্রেণীতে ওঠার আগে জানতাম না! আমার স্কুলজীবন মনে হয় পুরাটাই বৃথা।

দুর্বাশা তাপস এর ছবি

বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়ছি বেশ কয়েকমাস হয়ে গেল, কিন্তু ক্লাস না করার প্রবনতা আমার শেষ পর্যন্ত ছিল। অবস্থা ক্রমে এমন দাড়িয়েছিল স্যারেরা আমাকে খুঁজতে হলে লোক পাঠায় আরকি। বিশ্ববিদ্যালয়ে এ্যাটেনডেন্স এ মার্কস ছিল দশ, আমার অনেকবার শূন্য পাওয়ার রেকর্ড আছে হাসি

==============================
আমিও যদি মরে যেতে পারতাম
তাহলে আমাকে প্রতি মুহূর্তে মরে যেতে হত না।

দ্রোহী এর ছবি

বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বর্ষে আমার উপস্থিতির হার ছিল ৯২%। দ্বিতীয় বর্ষে সেটা দাড়ায় ৮১%। তৃতীয় বর্ষে এসে ৭৫% আর চতুর্থ বর্ষে ৪১%।

৭৫% না হলে পরীক্ষা দিতে দেয়া হত না। কিন্তু আমাকে কেন জানি আটকায়নি কেউ।


কি মাঝি? ডরাইলা?

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।