একটা ব্লগ লিখেই ফেলি সমাজ বদলের (ব্লগ লিখলেই সমাজ বদল হয় না)

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: শনি, ১৭/১১/২০০৭ - ৯:১৬অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

আমি এখনও মাঝে মাঝে স্বপ্নে দেখি পুরোনো সেই দিন গুলির কথা। ৮৬'-৮৮' এর দিকেও বাংলাদেশে ফুটবল খেলার বেশ জোয়ার ছিলো। তখন আবাহনী-মোহামেডানের খেলা মানে চারিদিকে শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্হিতি। যারা আবাহনীর সাপোর্টার তারা রেডী রাখতো লাঠি-বাশ আর যারা মোহামেডান সাপোর্টার তারা রেডী রাখতো হকি-ডেগার, যেনো অবশম্ভাবী কোনো রায়টের অপেক্ষা। খেলা দেখা হতো সেই চরম উত্তেজনাগুলোকে মাথায় রেখেই। কিন্তু খেলা শেষ হলে যে দল হারতো তারা খুব বেশী হলে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া করতো খেতো। আমি আমার পুরো শৈশবই কাটিয়েছি ফরিদপুরের পূর্ব খাবাস পুরে। তখন তাল তলার মাঠে সবচেয়ে জনপ্রিয় দুটো দলের খেলা হতো প্রতিবছর, লালদল আর এসি মিলান। এদল গুলোর বেশীর ভাগ খেলোয়াড় থাকতো পূর্বখাবাস পুর আর ঝিলটুলিতে।অনেকে বলতো এদের খেলা মানে প্রচুর দর্শক, পাড়ায় একটা ঈদ উতসব। ফরিদপুরের স্টেডিয়ামেও এত লোক হয়না। নারী পুরুষ নির্বিশেষে সবাই এসে জুটতো এ খেলা দেখতে। তখন খেলা ধুলার একটা বেশ ট্রেন্ড ছিলো।

বিকেল হলেই মাঠ জুড়ে যুবক কিশোরেরা কেউ ক্রিকেট কেউ ফুটবল নিয়ে নেমে পড়তো। বিকেলটা খুব সুন্দর কাটতো কারন অন্তত যেকোনো খেলাই খেলি না কেন লোকের অভাব হতো না। কিন্তু এখন পরিস্হিতি ভিন্ন। বিকেল হলে এলাকাটা শূন্য হয়ে যায়। যুবক শ্রেনীর ছেলেপেলেগুলো আর মাঠে জড়ো হয় না। জড়ো হয় নির্দিস্ট জায়গায়। তাদের কারো হাতে থাকে ডিপি, অথবা টিক্সি, অথবা টাকা পয়সা বেশী থাকলে ফেন্সিডিলের বোতল। পুলিশ মাঝে মাঝে রেইড দেয়। কিন্তু কিছু দিন পর যা ছিলো তাই থেকে যায়।

এসব নেশার উপদ্রব শুরু হয়েছিলো ৯৩'-৯৪' এর দিকে আর প্রকট আকার ধারন করে ৯৬'-৯৭' এর দিকে। প্রথমে শুরু হয় ফেন্সিডিল দিয়ে যার মূল আখড়া ছিলো আলিপুর আর পূর্ব খাবাসপুরের বাশতলা। যারা এসব নিয়মিত খেতো তাদের মধ্যে কিছু কিছু লক্ষন ছিলো সুস্পস্ট। ফেন্সিডিলে উচ্চামাত্রায় কোডিন ফসফেট থাকার কারনে লিভারের কার্যক্ষমতা কমে যেতে থাকে। এতে হজম বা পরিপাক তন্ত্রে অসুবিধার সৃস্টি করে, ফলে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ভেঙ্গে পড়ে। এছাড়া অন্যান্য কেমিক্যালের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ার কারনে যৌন ক্ষমতা হ্রাস পায় এবং পরে ভয়াবহ শরীরিক জটিলতায় ভুগতে হয়। এই নেশার বদৌলতে ফরিদপুর শহরের পুরো একটা প্রজন্ম নস্ট হয়ে গেছে আর এখনও হচ্ছে। আমি এখনও যখন ফরিদপুরে যাই, দেখি যুবক ছেলেগুলো ডিপি, ড্রাই জীন, বাংলা মদ বা স্পিরিটে ডুবে আছে। এরা সব কিন্তু আমারই পরিচিত। এরা কেউ হয়তো রাজেন্দ্র কলেজ থেকে ডিগ্রি বা অনার্স মাস্টার্স শেষ করেছে। অথবা কেউ ইন্ডিয়া থেকে ডিগ্রি এনেছে, অথবা কেউ এখনও ঢাকায় পড়া লেখা করছে। কিন্তু বেশীর ভাগের একটাই সমস্যা এই নেশা যার মূলে হচ্ছে বেকারত্ব থেকে সন্ঞ্চিত হতাশা।
ইকোনমিক্সের ভাষায় বেকারত্ব হচ্ছে কর্মক্ষম কেউ নিজের চাহিদা অনুযায়ী বেতনের কাজ না পেলে সে কর্মহীন বা বেকার থাকছে। আসলে কথাটা এখানে এভাবে এ্যাপ্লাই করা যায় যে পাশ করার পর এরা প্রাসন্গিক কোনো কাজ খুজে পাচ্ছেনা। এরা যা শিখেছে তা এ্যাপ্লাই করার জায়গা পাচ্ছে না। ফলে তাদের মধ্যে একটা চরম হতাশা বিরাজ করে যার ফলে একটা অজানা হীনমন্যতায় তারা ভুগে। প্রতিদিন কর্মহীন এক পৃথিবীতে একই মানুষের অন্যরকম দৃস্টি যা তাদের মনে বারে বারে ক্ষতের সৃস্টি করে। ফলে তারা তাদের নিঃসঙ্গতা বা হতাশা ঢাকবার জন্য ফিরে যায় এসব নেশাকর ওষুধের কাছে।

এখন বাজারে এক বোতল ফেন্সিডিলের দাম অফটাইমে ৫০০ টাকা প্রতি বোতল আর পিক টাইমে ৭০০ টাকা যার হয়তো আসল মূল্য ৩৫-৪০ টাকা। আর টিক্সির একটা ৩৫ টাকার বোতল ১৬০ টাকা যা মাঝে মাঝে পাওয়াও যায় না। প্রতিদিন না হলেও দু বা তিন দিন পর পর এসব তাদের খেতে হয়।এসব খেয়ে হাতে থাকা মাল্টিমিডিয়া সেল ফোনে এক্সটেন্ডেড মোমোরী লাগিয়ে আদান প্রদান করছে সস্তা পর্ন। এবং এগুলো চলছে রাস্তার পাশে বসেই। মাঝে মধ্যে নেশা একটু বেশী চড়ে গেলেই মোবাইলে ফুল সাউন্ড দিয়েই দেখছে। রাস্তা দিয়ে কে হেটে যাচ্ছে তার কোনো খেয়াল নাই। এগুলো অবশ্য আসে ইন্টারনেট থেকেই। এভাবেই নস্ট হচ্ছে একটা উজ্জল প্রজন্ম।
এঘটনা শুধু ফরিদপুরের না। আমি চট্টগ্রামে যখন ছিলাম, তখন দেখতাম জিএসই এর মোড়ে গেলে বা নিউমার্কেটের চিপায় গেলে এই ডাইল বেশ সস্তায় পাওয়া যায় তবে লুকে চুপে। বরিশাল শহরের পশ্চিম দিকে এলাকার নামটা মনে আসছে ওখানেও দেখলাম এগুলো বিক্রি হচ্ছে। আমাকে আমার প্রফেশনগত কারনে দেশের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে হয়। মিশতে হয় নানা মানুষের সাথে প্রয়োজনে- অপ্রয়োজনে। অপ্রয়োজন এজন্য যে আমি নিঃসঙ্গতা পছন্দ করি না। যেখানেই যাই কাউকে না কাউকে খুজে নেই। তাই দেখা যায় সমাজের উচু থেকে শুরু করে নীচু স্তরের অনেকের সাথেই পরিচয় হতে পারি। পরিচয় হতে গিয়ে দেখি সমাজ বা পুজিবাদের কালো রূপ।
আমার এক বন্ধুকে বলেছিলাম এ কথা, সে একটা সুন্দর কথা বলেছিলো আমায়," এখনও ছেলে পেলে ৫ পায় , এখনও ছেলেপেলে অস্ট্রেলিয়াকে হারায়, এখনও বাইরের বড় বড় স্কলারশীপে ভালো কম্পিটিশন দেয়।" আসলেই তো তাই। ও ঠিকই তো বলেছে, তবেই কেনইবা আমার চোখে এসব অসঙ্গতি ধরা পড়ে? আমি তখন চিন্তা করলাম, এবং পরক্ষনেই ধরতে পারলাম সমস্যাটা কোথায়! আমাদের ৯৬'এর ম্যাট্রিকের ব্যাচের প্রায় ১২৫ জনের ছাত্র ছিলো জিলা স্কুলে। একটা ওভার অল হিসাব করলে দেখা যায় এর মধ্যে ৩০ থেক ৪০% ছেলে কিছু না কিছু করে খাচ্ছে যেমন চাকরি বা ব্যাবসা। এদের মধ্যে এডিকশনের হার ধরা যায় ২০ থেকে ২৫% ছেলে। আর যারা বাকী বেকার ৬০ থেকে ৭০%, এদের মধ্যে একটা বড় অংশ মোটামুটিভাবে ৭০ থেকে ৭৫% ছেলে নেশা বা জুয়ায় বা উভয়েই আসক্ত। এই চিত্রটা কিন্তু আসলেই ভয়ন্কর। এই প্রজন্মটা দেখা যাচ্ছে এই নেশাটার কারনে ধ্বংসের দিকে চলে যাচ্ছে।
এক্ষেত্রে প্রশাসন মাঝে মাঝে টাইট দেয় আবার বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে লুজ দেয়। কিন্তু এসবের বিক্রি কখনো থেমে থাকেনা। কারন একজন নেশাখোর জানে এগুলো কিভাবে জোগাড় করতে হয়। তাহলে এ থেকে বুঝা যাচ্ছে বেকারত্ব থেকে আসা চরম হতাশা কিভাবে নস্ট করে ফেলছে কতগুলো জীবন!

আমি ইন্টারে থাকতে একটা জিনিস চিন্তা করেছিলাম যদি প্রতি পাড়ায় একটা জীম করে যায়, তাহলে এ থেকে অনেকখানি মুক্তি পাওয়া যেতে পারে। সেটা হলো যখন একটা ছেলের মধ্যে শরীর গঠনকে নেশা হিসেবে ঢুকিয়ে দেয়া যাবে তখন সে কখনো সিগারেট টানার কথাও চিন্তা করতে পারবে না। কারন সিগারেট টানলে সে পুশ আপ বেশি মারতে পারবে না জাস্ট দমের অভাবের কারনে। তার তখন পিওর ফুড যেমন কলা, ডিম, গোস্ত দরকার আর দরকার নিয়ম শৃঙ্খলার জীবন। কিন্তু পাড়ায় পাড়ায় জীমের কনসেপ্টটা এখনও বাংলাদেশে অতটা গ্রো করেনাই। ঢাকায় অলিত গলিতে যত জীম দেখা যায়, ঢাকার বাইরে এগুলো বেশ রেয়ার!

দ্বিতীয় চিন্তা হিসেবে ধরা যায় ইন্টারনেট। সিটিসেলের জুম, ওয়ারিদের জিপিআরএস, গ্রামীন ফোনের এজ আর সিআইসি, লোকাল আইএসপি, দেশে খুব দ্রুত ইন্টারনেট ছড়িয়ে দিচ্ছে।কিন্তু বাস্তবতা হলো এদের আইপি বা ম্যাক এড্রেস থেকে যেসব সাইটে হিট বেশী পাওয়া যায় ,তাহলো পর্ন সাইট গুলো। ইন্টারনেটের মজা বলতে এটাই বুঝে তারা। কিন্তু তারা সবাই শিক্ষিত, ক্ষেত্র বিশেষে মেধাবীও বটে। তাহলে আমরা একটা কাজ করি না কেন, আমাদের বাংলা ব্লগিং সাইট গুলো যেমন সামহোয়্যার ইন, সচলায়তন, প্যাচালী ইত্যাদি গুলো তাদের হাতে তুলে দেই না কেন?
আমি একটা কথা বিশ্বাস করি: দুঃখ গুলো ছড়ি্য়ে দিলে তা অনেক কমে যায় আর সুখ হাসিগুলো ছড়িয়ে দিলে তা বাড়তে থাকে। যত বেশী ইন্টারেকটিভ হতে পারবে তারা, তাদের মধ্যে থেকে স্কিতজোফ্রনিক মনোভাব ততবেশী কাটবে। তখন এই ব্লগগুলো হবে তাদের নিত্য দিনের ডায়েরী। এক্ষেত্রে বলা যায় তারা অন্তত নেশার পিছনে সময় নস্ট আর অসতসঙ্গে আড্ডা না দিয়ে এই ব্লগের মাধ্যমে বিশ্বের সব জায়গা থেকে ছড়ি্য়ে ছিটিয়ে থাকা বাঙ্গালীদের মাধ্যমে পরিচিত হতে পারবে। ফলে এখান থেকে আমরা একটা ক্রিয়েটিভ প্রজন্ম পাবো বলে মনে হয়।
আসলে আমাদের বেকার যুবসমাজের জন্য আমাদের একটা ভালো হাতিয়াড় দরকার যার মাধ্যমে তারা তাদের মনের কথা গুলো বলতে পারে, কিছু একটা সাহস দেখাতে পারে মহত কিছু করে দেখানোর!

আশা করি সবাই আমার ইচ্ছেটা বুঝতে পেরেছেন?

*উল্লেখ্য, এই লেখাটি সামহোয়্যার ইনে প্রকাশিত!


মন্তব্য

guest_guest এর ছবি

ভাই খুবই সুন্দর প্রস্তাব

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।