ভুলের আপেক্ষিকত্ব (১/২)

জি.এম.তানিম এর ছবি
লিখেছেন জি.এম.তানিম (তারিখ: সোম, ২৪/০১/২০১১ - ৪:২২অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

(মাসকতক আগে বন্ধু সচল স্পর্শের কাছ থেকে একটা লিঙ্ক পাই, আসিমভের একটা প্রবন্ধের। বিজ্ঞান ও তার ক্রমঃরূপান্তর নিয়ে মানুষের মধ্যে যে ভুল ধারণা, তার জবাবে এই লেখা। লেখাটি পড়ে ভালো লেগেছিলো, তাই মনে হয়েছে বাংলা ভাষায় লেখাটি শেয়ার করা গেলে অনেকের উপকার হতো। সহজ ভাষায় রচিত লেখাটির অনুবাদ করতে গিয়ে একটু কঠিন করে ফেলেছি হয়তো; তবে লেখাটি পড়ে কেউ যদি বিজ্ঞানের ব্যাপারে আগ্রহী অথবা বিজ্ঞানমনস্ক হওয়ার পথে একধাপও ফেলেন, সেটিই অনেক বড়ো পাওনা হবে। হাতি সাইজের প্রবন্ধটি দুই ভাগে ভাগ করে প্রথম ভাগটি পোস্ট দিলাম আজ। প্রথমদফা প্রুফ দেখে দেওয়ার জন্যে সুরঞ্জনা হক আর দ্বিতীয়দফা প্রুফ দেখায় বুনোহাঁসকে ধন্যবাদ।)

সেদিন এক পাঠকের একটা চিঠি পেলাম। চিঠিটি খুদে খুদে অক্ষরে লেখা তাই পড়তে সমস্যা হচ্ছিল। তারপরও জরুরি কিছু হতে পারে ভেবে পাঠোদ্ধারের চেষ্টা করলাম।
প্রথম লাইনে তিনি লিখলেন, তিনি ইংরেজি সাহিত্যে মেজর করছেন, কিন্তু আমাকে কিছু বিজ্ঞান শেখাতে চান। (আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম, কারণ আমাকে বিজ্ঞান শেখাতে পারেন, এমন ইংরেজি সাহিত্যের মেজর খুব কমই আছেন । অবশ্য আমি আমার জ্ঞানের দীতার ব্যাপারে উদাসীন নই এবং যেকোনো শ্রেণীর যে কারো কাছ থেকেই কোনো কিছু শিখতে আমি প্রস্তুত, তাই চিঠিটি পড়তে থাকলাম।)
ওনার ভাষ্যমতে, আমি আমার অসংখ্য লেখার একটিতে খুব আনন্দের সাথে বলেছি যে আমরা এমন একটা শতাব্দীতে বসবাস করি যখন আমরা অবশেষে মহাবিশ্বের ভিত্তি সম্পর্কে সঠিক ধারণা অর্জন করতে পেরেছি।
আমি বিস্তারিত আলোচনা করি নি, কিন্তু আমি যা বলতে চেয়েছিলাম তা হলো এখন আমরা মহাবিশ্বের মূল নিয়মগুলো জানি। সেই সাথে জানি এর প্রধান উপাদানগুলোর মধ্যে মহাকর্ষীয় সম্পর্ক নিয়ে, যেটা ১৯০৫ থেকে ১৯১৬ এর মধ্যে তৈরি হওয়া আপেক্ষিকত্বের তত্ত্বে দেখানো হয়েছে। আমরা অতিপারমাণবিক কণা এবং তাদের আন্তঃসম্পর্কের মূল নিয়মগুলোও বিস্তারিত ভাবে জানি ১৯০০ থেকে ১৯৩০ এর মধ্যে তৈরি হওয়া কোয়ান্টাম তত্ত্বের মাধ্যমে। এছাড়াও ১৯২০ থেকে ১৯৩০ এর বিভিন্ন আবিষ্কার থেকে আমরা জানি ছায়াপথ ও ছায়াপথপুঞ্জ হচ্ছে মহাবিশ্বের প্রধান উপাদান।
এগুলো সবই বিংশ শতাব্দীর আবিষ্কার।
ইংরেজি সাহিত্যের সেই বিশেষজ্ঞ আমার লেখার বিভিন্ন অংশ উদ্ধৃত করে বিশদভাবে লেকচার দিয়ে গেলেন যে, প্রত্যেক শতাব্দীতে মানুষ মনে করতো তারা অবশেষে মহাবিশ্ব সম্পর্কে সম্পূর্ণ জ্ঞান লাভ করেছে, কিন্তু প্রত্যেক শতাব্দীতেই তারা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। এ থেকে এটাই বলা যায় যে, আমাদের আধুনিক “জ্ঞান” বলতে আমরা যেটা বুঝি সেটা ভুল
লোকটি এরপরে উদ্ধৃত করলেন সক্রেটিসের একটি উক্তি। সক্রেটিস যখন জানতে পারলেন ডেলফিক ওরাকল (ভবিষ্যৎবক্তা) তার সম্পর্কে বলেছেন তিনি গ্রীসের সবচেয়ে জ্ঞানী ব্যক্তি, তখন তিনি বললেন, “আমি সবচেয়ে জ্ঞানী ব্যক্তি কেবল এই কারণেই যে আমি একাই জানি যে আমি কিছু জানি না।” এর মাধ্যমে সেই বিশেষজ্ঞ বোঝাতে চাইলেন আমি যেহেতু অনেক জানি তাই আমি আসলে বোকা।
যদিও এটা আমার কাছে নতুন কিছু না। (খুব কম জিনিসই আমার কাছে নতুন, আর আমার আশেপাশের মানুষের এতদিনে এটা বুঝে যাওয়ার কথা।) বছর পঁচিশেক আগে জন ক্যাম্পবেল নামে এক লোক আমার উদ্দেশ্যে এমনই একটা তত্ত্ব দিয়েছিলেন। জন আমাকে বিরক্ত করার ব্যাপারে একজন ওস্তাদ ছিলো আর সে-ও বলতো সকল তত্ত্ব একদিন ভুল প্রমাণিত হয়।
আমার জবাব ছিল, “দেখো জন, মানুষ যখন মনে করতো পৃথিবী চ্যাপ্টা (সমতল) তখন তারা ভুল ছিলো। মানুষ যখন মনে করতো পৃথিবী গোলাকার, তখনও তারা ভুল ছিল। কিন্তু যদি তোমার মনে হয় যে পৃথিবীকে চ্যাপ্টা বলা, আর পৃথিবীকে গোলাকার বলা সমান ভুল, তাহলে তোমার দৃষ্টিভঙ্গি ঐ দুইটি ভুলের যোগফলের থেকেও বড় ভুল।”
আসলে সমস্যাটা হচ্ছে, মানুষ মনে করে করে, “ঠিক” আর “ভুল” সার্বজনীন একটা ব্যাপার, অর্থাৎ সবকিছুই হয় সম্পূর্ণ ঠিক নাহলে একদম ভুল।
যদিও আমি সেটা মনে করি না। আমার কাছে ঠিক আর ভুল দুটো ঝাপসা ধারণা, এবং এই লেখায় আমি সেটাই ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করব।

প্রথমে সক্রেটিসের একটা গতি করি, কারণ তুমি কিছুই জানো না সেটা জানার মানেই তুমি জ্ঞানী এই ভণ্ডামি দেখতে দেখতে আমি বিরক্ত।
এমন কেউ নেই যে কিছুই জানে না। জন্মের কয়েকদিনের মধ্যেই শিশু তার মাকে চিনে ফেলতে পারে।
সক্রেটিস অবশ্য এটা স্বীকার করবেন। জ্ঞান বলতে তিনি খুঁটিনাটি জিনিসের জ্ঞানকে বোঝান নি। তিনি বুঝিয়েছেন যে বিশাল বিমূর্ততা নিয়ে মানুষ বিতর্ক করে, সেটা শুরু করতে হবে পূর্বনির্ধারিত পরীক্ষানিরীক্ষা এবং চিন্তা ছাড়াই; এবং তিনি একাই সেটা জানেন। (কী অহংকারী রে বাবা!)
“ন্যায় কী?”, “সদগুণ কী?” এসব আলোচনায় তিনি এমন ভাব করেছিলেন যেন তিনি কিছুই জানেন না এবং অন্যদের কাছে জানতে চান। (একে “সক্রেটীয় বিদ্রুপ” বলা যেতে পারে, কারণ সক্রেটিস খুব ভালো করে জানতেন, এসব ব্যাপারে তিনি সেই বেচারাদের চেয়ে অনেক বেশি জানতেন।) না জানার ভান করে সক্রেটিস তাদের ঐসব বিমূর্ত বিষয়ে তাদের মতামত উপস্থাপনের জন্যে প্রলুব্ধ করতেন। এরপরে সক্রেটিস শুনতে বোকা বোকা এমন কিছু প্রশ্ন করে তাদের এমন একটা ফাঁদে ফেলতেন যে তারা আত্মবিরোধী ও অসঙ্গতিপূর্ণ জবাব দিতে দিতে অবশেষে হার মানতো ও স্বীকার করতো তারা যে ব্যাপারে কথা বলছে সে ব্যাপারে কিছু জানে না।
এটা আসলে এথেনীয়দের অটুট ধৈর্যের পরিচয় যে তারা দশকের পর দশক এটা সহ্য করেছে, সক্রেটিসের বয়স সত্তর হওয়া পর্যন্ত। এরপর আর তারা সহ্য করতে পারেন নি এবং তাকে বিষপানে বাধ্য করেছে।

তাহলে আমরা কোথা থেকে ঠিক এবং ভুলের অপরিবর্তনশীলতার ব্যাপারে ধারণা পাই? আমার মনে হয় এটা শুরু হয় খুব নিচের শ্রেণীতে, যখন বাচ্চারা খুব কম জানে এবং তাদের শেখায় শিক্ষকেরা যারা নিজেরা আরও কম জানে।
শিশুরা বানান এবং পাটিগণিত শিখে এবং সেখান থেকেই এই ধারণার সৃষ্টি।
আমরা ইংরেজিতে “sugar” বানান করি কীভাবে? s-u-g-a-r; সেটাই ঠিক, আর সবকিছু ভুল
২ আর ২ যোগ করলে কত হয়? সঠিক উত্তর ৪, আর সবকিছুই ভুল
এরকম যথাযথ উত্তর থাকার কারণে, কিংবা একেবারে নির্দিষ্ট ঠিক ভুল থাকার কারণে চিন্তা করার প্রয়োজনীয়তাটা অনেক কমে যায়, আর এতে শিক্ষক ছাত্র দুই পক্ষই খুশি থাকে। এ কারণে উভয়পক্ষই রচনামূলকের চেয়ে ছোট প্রশ্নোত্তর বেশি পছন্দ করে, ছোট শূন্যস্থান পূরণের চেয়ে বেশি নৈর্বক্তিক, আর নৈর্বক্তিকের চেয়ে সত্য/মিথ্যা।
কিন্তু আমার মতে ছোট প্রশ্নোত্তরের পরীক্ষা একজন শিক্ষার্থীর কোনো বিষয় বোঝার ক্ষমতার পরিমাপক হিসেবে কোনো কাজের জিনিস নয়। সেটা কেবল তার মুখস্থবিদ্যার পরীক্ষা।
ব্যাপারটা আপনারাও ধরতে পারবেন যদি আপনারা স্বীকার করে নেন ঠিক আর ভুলের ধারণাটা আপেক্ষিক।
আপনি “sugar” বানান করেন কীভাবে? মনে করি এলিস এটা বানান করে p-q-z-z-f আর জেনেভিভ বানান করে s-h-u-g-e-r এভাবে। দুইজনই ভুল করেছে কিন্তু এটা নিয়ে কি কারো সন্দেহ আছে এলিসের ভুলটা বেশি? তাছাড়া জেনেভিভের বানানটা ঠিক বানানের থেকেও এগিয়ে আছে এর পক্ষেও যুক্তি পাওয়া যাবে বলে আমার ধারণা।
অথবা মনে করি আপনি "sugar" বানান করেন s-u-c-r-o-s-e (চিনির বৈজ্ঞানিক নাম), অথবা C12H22O11(চিনির রাসায়নিক সংকেত)। প্রথাগতভাবে দুটো বানানই ভুল, কিন্তু এটা দেখে বোঝা যায় যে আপনি প্রথাগত বানানের থেকেও এই ব্যাপারে বেশি কিছু জানেন। এবারে মনে করুন, প্রশ্নটি যদি এমন হতো, তুমি কতভাবে "sugar” বানান করতে পারো? প্রতিটির পক্ষে যুক্তি দেখাও।
তখন শিক্ষার্থীদেরকে অনেক চিন্তা করতে হতো এবং শেষমেষ তারা কত বেশি বা কম জানে সেটা দেখাতে পারতো। শিক্ষকদেরও সেটা নিরীক্ষার সময়ে অনেক চিন্তা করতে হতো। দুই দলই খেপে যেত এ কথা বলে দেওয়া যায়।
আচ্ছা, দুই আর দুই আসলে কত? মনে করি যোসেফ বললো ২ + ২ = লালচে বেগুনি, আর ম্যাক্সওয়েল বললো ২ + ২ = ১৭। দুই জনেই ভুল কিন্তু এটা কি বলে দেওয়া যায় না যে যোসেফ বেশি ভুল?
মনে করি আপনি বললেন ২ + ২ = একটি পূর্ণ সংখ্যা। আপনি তো ঠিকই বলেছেন, নাকি? অথবা আপনি হয়তো বললেন ২ + ২ = একটি জোড় পূর্ণ সংখ্যা। এর মানে আগের উত্তরটির থেকেও এটি বেশি সঠিক। আর যদি বলেন ২ + ২ = ৩.৯৯৯, তার মানে তো আপনি সঠিকের খুব কাছে পৌঁছে গেছেন, তাই না?
একজন শিক্ষক যদি কেবল উত্তর হিসেবে ৪ প্রত্যাশা করেন আর অন্যান্য ভুলগুলোর মধ্যে পার্থক্য না করেন তাহলে সেটা বুঝবার ক্ষমতার উপরে অপ্রয়োজনীয় সীমাবদ্ধতা সৃষ্টি করে না?
মনে করি প্রশ্ন হচ্ছে ৯ + ৫ কত হয়? আর আপনি বললেন উত্তর ২। আপনাকে নিয়ে কি তখন হাসাহাসি করা হবে না? তীব্রভাবে সমালোচনা করে বলা হবে না যে ৯ + ৫ = ১৪?
যদি তারপরে বলা হয় যে মধ্যরাত্রির নয় ঘণ্টা অতিবাহিত হয়েছে, অর্থাৎ নয়টা বাজে, আর তারপরে যদি জিজ্ঞেস করা হয় আর ৫ ঘণ্টা পরে কয়টা বাজবে তখন আপনি যদি বলে যে ১৪ টা কারণ ৯ + ৫ = ১৪, তাহলেও কি আপনার সমালোচনা করে বলা হবে না যে ২ টা বাজবে? প্রকৃতঅর্থে সেক্ষেত্রে ৯ + ৫ = ২ বটে।
আবার মনে করি রিচার্ড বললো: ২ + ২ = ১১, তারপরে শিক্ষক তার মায়ের উদ্দেশ্যে লেখা একটি নোটসহ তাকে বাসায় পাঠানোর আগে সে যোগ করলো, “অবশ্য ত্রিমিক* রাশির ক্ষেত্রে।” তাহলে সে-ও ঠিক থাকবে।
আরেকটা উদাহরণ দেই। শিক্ষক জিজ্ঞেস করলো: “যুক্তরাষ্ট্রের চল্লিশতম প্রেসিডেন্ট কে?” আর বারবারা জবাব দিলো, “কেউ না।”
শিক্ষক বললেন, “ভুল! রোন্যাল্ড রিগ্যান যুক্তরাষ্ট্রের চল্লিশতম প্রেসিডেন্ট।”
বারবারা বললো, “মোটেই না। আমার কাছে যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের অধীনে যারা প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করেছেন তাদের তালিকা আছে, জর্জ ওয়াশিংটন থেকে রোন্যাল্ড রিগ্যান পর্যন্ত,আর সেখানে কেবল ৩৯ জনের নাম আছে। তার মানে চল্লিশতম প্রেসিডেন্ট বলতে কেউ নেই।**”
শিক্ষক বললেন, “হুম, কিন্তু গ্রোভার ক্লিভল্যান্ড দুই দফায় এই দায়িত্ব পালন করেছেন, একবার ১৮৮৫ থেকে ১৮৮৯, আরেকবার ১৮৯৩ থেকে ১৮৯৭। তাকে তাই দ্বাবিংশ এবং চতুর্বিংশ প্রেসিডেন্ট হিসেবে ধরা হয়। সে কারণে রোন্যাল্ড রিগ্যান ৩৯তম ব্যক্তি হিসেবে প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করলেও তিনি যুক্তরাষ্ট্রের চল্লিশতম প্রেসিডেন্ট।”
ব্যাপারটা হাস্যকর না? একজন মানুষের কার্যকাল আলাদা দফায় হলে সেটা দুইবার গোণা হবে, আর টানা দুইবার হলেও সেটা একবার হিসাবে গোণা হবে কেন? পুরোপুরি প্রথা। তাও বারবারার উত্তর ভুল হিসেবে ধরা হবে, সে যদি চল্লিশতম প্রেসিডেন্ট হিসেবে ফিদেল ক্যাস্ট্রোর কথা বলতো তাহলে যেমন ভুল হিসেবে ধরা হতো তেমন ভুল হিসেবে।
তাই, যখন আমার ইংরেজি সাহিত্যের বিশেষজ্ঞ বন্ধুটি বলেন যে প্রতি শতাব্দীতেই বিজ্ঞানীরা বলেন যে তারা মহাবিশ্বকে বুঝে ফেলেছেন এবং প্রতিবারই ভুল প্রমাণিত হন, আমি জিজ্ঞেস করি তারা কতটা ভুল? তাদের ভুলের মাত্রা কি সবসময়ই সমান? একটা উদাহরণ দেই।

সভ্যতার শুরুতে মানুষ মনে করতো পৃথিবী সমতল।
এর মানে এই নয় যে তখন মানুষ নির্বোধ ছিলো, কিংবা তারা ফালতু জিনিসে বিশ্বাস করতো।
তারা উপস্থিত প্রমাণের ভিত্তিতেই মনে করতো পৃথিবী সমতল। এমন না যে “পৃথিবী সমতল দেখায়” এই কারণে, কারণ বস্তুত পৃথিবী সমতল দেখায় না। পৃথিবী দেখতে উঁচু-নিচু, এবড়ো খেবড়ো, পাহাড়, গিরিখাত, উপত্যকা এসবে ভর্তি।
অবশ্য এটাও ঠিক, এমন অনেক সমতল জায়গা আছে পৃথিবীতে যেখানে একটা নির্দিষ্ট এলাকাজুড়ে ভূপৃষ্ঠ দেখতে বেশ সমতল। এমনই একটা সমতল হলো টাইগ্রিস-ইউফ্রেটিস এলাকা, যেখানে প্রথম সভ্যতা গড়ে উঠেছিল। কথাপ্রসঙ্গে বলে রাখি, সুমেরীয় সেই সভ্যতার মানুষ লিখতে জানত।
হয়তো এসব সমতলভূমির উপস্থিতির কারণে সুমেরীয়রা পৃথিবীপৃষ্ঠ সমতল এই সরলীকরণটি মেনে নিয়েছিল, অর্থাৎ যদি কোনোভাবে সব উঁচু ও নিচু এলাকাগুলো সমান করে দেওয়া যায়, তাহলে কেবল সমতলভূমিই থাকবে। বিস্তৃত জলাভূমির (পুকুর, হ্রদ প্রভৃতি) পৃষ্ঠ সমতল দেখায়, সেটিও এই ধারণার স্বপক্ষেই খোরাক জুগিয়েছে।
জিনিসটা আরেক ভাবে দেখা যেতে পারে এই প্রশ্নটার মাধ্যমে যে পৃথিবীপৃষ্ঠের “বক্রতা” কত? একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ দৈর্ঘ্যে পৃথিবীপৃষ্ঠ সম্পূর্ণ সমতল থেকে (গড়ে) কতটা বিচ্যুত হয়?
সমতল-পৃথিবীতত্ত্বে মনে হতে পারে পৃথিবীপৃষ্ঠ সমতল থেকে একটুও বিচ্যুত নয়, অর্থাৎ এর বক্রতা মাইলপ্রতি ০।
এখন অবশ্য আমাদের শেখানো হয়, সমতল ভূপৃষ্ঠ তত্ত্বটি ভুল, পুরোটাই ভুল, জঘন্য ভুল, সম্পূর্ণ ভুল। কিন্তু আসলে তা নয়। পৃথিবীর বক্রতা মাইলপ্রতি প্রায় ০, তাই যদিও ভূপৃষ্ঠ সমতল এই তত্ত্বটি ভুল, এটা আসলে প্রায় সঠিক। একারণেই এই তত্ত্বটি এত বছর টিকে ছিলো।
সমতল ভূপৃষ্ঠতত্ত্ব সন্তোষজনক না হওয়ার বেশ কিছু কারণ ছিলো। খ্রিস্টপূর্ব ৩৫০ সালের দিকে গ্রীক দার্শনিক অ্যারিস্টোটল সেগুলো একত্র করেন। প্রথমত, উত্তর দিকে যেতে থাকলে দক্ষিণ দিগন্তে কিছু তারা অদৃশ্য হতে শুরু করে, আবার দক্ষিণ দিকে যেতে থাকলে উত্তর দিগন্তের তারাগুলো অদৃশ্য হতে শুরু করে। দ্বিতীয়ত, চন্দ্রগ্রহণের সময় পৃথিবীর যে ছায়া চাঁদের গায়ে পড়ে সেটা সবসময় বৃত্তাকার। তৃতীয়ত, সমুদ্রের জাহাজ যেদিকেই যাক না কেন ধীরে ধীরে সেটা দিগন্তে অদৃশ্য হতে শুরু করে, হাল থেকে শুরু করে মাস্তুল পর্যন্ত।
ভূপৃষ্ঠকে সমতল ধরলে এই তিনটি পর্যবেক্ষণ ব্যাখ্যা করা সম্ভব হয় না, অন্যদিকে পৃথিবী গোলাকার এটা ধরে নিলে এগুলো সহজেই ব্যাখ্যা করা যায়।
এছাড়াও অ্যারিস্টোটল বিশ্বাস করতেন, সব কঠিন পদার্থের একটি প্রবণতা হচ্ছে কেন্দ্রগামী হওয়া, অর্থাৎ একটা কেন্দ্রের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করা। তাই যদি হয়, তাহলে সেটা একটি গোলকে পরিণত হবে। একটা নির্দিষ্ট আয়তনের পদার্থের জন্যে, অন্য যেকোনো আকারের চেয়ে গোলাকার ধারণ করলে সেটা গড়ে কেন্দ্রের সবচেয়ে কাছে থাকবে।
অ্যারিস্টোটলের প্রায় এক শতাব্দী পরে গ্রীক দার্শনিক ইরাটোসথিনিস লক্ষ্য করেছিলেন যে বিভিন্ন অক্ষাংশে সূর্যের আলোতে ছায়া বিভিন্ন দৈর্ঘ্যের হয় (পৃথিবীপৃষ্ঠ সমতল হলে ছায়ার দৈর্ঘ্য সমান হতো)। ছায়ার দৈর্ঘ্যের পার্থক্য থেকে হিসাব করে তিনি দেখান যে পৃথিবীর পরিধি ২৫,০০০ মাইল।
এমন একটা গোলকের বক্রতা প্রতি মাইলে ০.০০০১২৬, খেয়াল করুন সেটা প্রতি মাইলে ০ এর খুব কাছাকাছি, এবং প্রাচীন পদ্ধতিতে সেটা সহজে পরিমাপ করা সম্ভব ছিলো না। ০ আর ০.০০০১২৬ এর মধ্যের ফারাক খুবই সামান্য, তাই সমতল পৃথিবীর ধারণা থেকে গোলাকার পৃথিবীর ধারণায় আসতে মানুষের এত সময় লেগেছে।
খেয়াল করুন, ০ আর ০.০০০১২৬ এর মতো সামান্য একটা পার্থক্য কতটা তাৎপর্যপূর্ণ হতে পারে। ছোট ছোট পার্থক্যগুলোর সমষ্টি বড়ো হয়ে ওঠে। এই ক্ষুদ্র পার্থক্য যদি হিসাবে নেওয়া না হতো আর পৃথিবীকে যদি সমতলের বদলে গোলক হিসেবে কল্পনা না করা হতো, তাহলে একটা বিশাল এলাকাজুড়ে সঠিক ভাবে মানচিত্রায়ন করা যেত না। দীর্ঘ সমুদ্রযাত্রা হয়ে পড়ত অসম্ভব, কারণ পৃথিবীকে গোলাকার না কল্পনা করলে সমুদ্রে একজনের অবস্থান নির্ধারণ করা যেত না।
তার উপরে, সমতল পৃথিবীর ধারণা থেকে মনে হতে পারে পৃথিবী অসীম, অথবা এর কোনো “শেষপ্রান্ত” রয়েছে। গোলাকার পৃথিবী ধারণাটি একটি সীমাহীন অথচ সীমিত পৃথিবীর ধারণা দেয় এবং পরবর্তী সময়ে পাওয়া বিভিন্ন পর্যবেক্ষণের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ।
তাই যদিও সমতল-ভূপৃষ্ঠতত্ত্বটি সামান্যই ভুল, আর এর আবিষ্কর্তারা বাহবা পাওয়ার যোগ্য, তবু সবদিক বিচারে এটা গোলাকার-পৃথিবীতত্ত্বের সাথে তুলনায় বাদ পড়ার জন্যে যথেষ্ট পরিমাণ ভুল।

(আগামী পর্বে সমাপ্য)

অনুবাদকের নোট:
* ত্রিমিক রাশির ধারা এরকম: ০, ১, ২, ১০, ১১, ১২, ২০...
** লেখাটি সিনিয়র বুশের ক্ষমতা গ্রহণের আগে। রিগ্যানের পরে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হন।


মন্তব্য

স্পর্শ এর ছবি

করলি তাইলে শেষ পর্যন্ত!

অনুবাদ ভালো হইসে...


ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...

সুরঞ্জনা এর ছবি

চলুক

............................................................................................
এক পথে যারা চলিবে তাহারা
সকলেরে নিক্‌ চিনে।

ধূসর স্বপ্নরা এর ছবি

বেশ ভাল লাগল ... জি.এম.তানিম ভাই, চালিয়ে যান ...
আসল বইটির নাম দেয়া যায় নাকি ?

জি.এম.তানিম এর ছবি

আমি একটি অনলাইন লিঙ্ক থেকে অনুবাদ করেছি। সেটি দিলাম।

একই শিরোনামে লেখকের একটি রচনা সমগ্র আছে।

-----------------------------------------------------------------
কাচের জগে, বালতি-মগে, চায়ের কাপে ছাই,
অন্ধকারে ভূতের কোরাস, “মুন্ডু কেটে খাই” ।

সুহান রিজওয়ান এর ছবি

দুর্দান্ত অনুবাদ। বিষয়টাও ভালো বেছেছেন। লগিন করেই ফেললাম।

সক্রেটিসের 'গতি' করার বিষয়টায় মজা লেগেছে। পরের পর্ব দ্রুত নামান।

কনীনিকা এর ছবি

চমৎকার অনুবাদ! আসিমভ তো শুধুমাত্র একজন ইংরেজি সাহিত্যে মেজরের কথা বললেন, আর আমাদের দেশে বেশির ভাগ বিজ্ঞানে মেজরদেরও তো একই ধরণের মানসিকতা।

------------------------------------------------------------------
It is impossible to be a mathematician without being a poet in soul.

জি.এম.তানিম এর ছবি

সহমত হাসি

-----------------------------------------------------------------
কাচের জগে, বালতি-মগে, চায়ের কাপে ছাই,
অন্ধকারে ভূতের কোরাস, “মুন্ডু কেটে খাই” ।

তারাপ কোয়াস এর ছবি

একদম ঝরঝরে অনুবাদ আর বিষয়বস্তুটা চমৎকার। পরের পর্বের জন্য অপেক্ষা করছি।


love the life you live. live the life you love.

এস এম মাহবুব মুর্শেদ এর ছবি

অসাধারণ লাগল!! পেরীর বুদ্ধিভিত্তিক উন্নতির মতবাদ নামে একটা লেখা লিখেছিলাম অনেক আগে। স্কুলের উদাহরণের সাথে মিলে গেলো।

নাশতারান এর ছবি

চলুক

_____________________

আমরা মানুষ, তোমরা মানুষ
তফাত শুধু শিরদাঁড়ায়।

অনার্য সঙ্গীত এর ছবি

দেখো জন, মানুষ যখন মনে করতো পৃথিবী চ্যাপ্টা (সমতল) তখন তারা ভুল ছিলো। মানুষ যখন মনে করতো পৃথিবী গোলাকার, তখনও তারা ভুল ছিল। কিন্তু যদি তোমার মনে হয় যে পৃথিবীকে চ্যাপ্টা বলা, আর পৃথিবীকে গোলাকার বলা সমান ভুল, তাহলে তোমার দৃষ্টিভঙ্গি ঐ দুইটি ভুলের যোগফলের থেকেও বড় ভুল।

গড়াগড়ি দিয়া হাসি

আপ্নে আর তানভীর ভাই দুইজনই অমানুষ টাইপের অনুবাদক। ফাউন্ডেশন ট্রিলজি পড়ে আসিমভ'রে গুরু মানি। তার এই লেখা অনুবাদের জন্য আপনারে সালাম দিলাম। হাসি

______________________
নিজের ভেতর কোথায় সে তীব্র মানুষ!
অক্ষর যাপন

অতিথি লেখক এর ছবি

বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে এই বিষয়টাকেই বোধহয় রাসেল "Successive Approximation" বলে অভিহিত করেছিলেন।

মনমাঝি

অতিথি লেখক এর ছবি

বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে এই বিষয়টাকেই বোধহয় রাসেল "Successive Approximation" বলে অভিহিত করেছিলেন।

মনমাঝি

সজল এর ছবি

চলুক

---
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়

অতিথি লেখক এর ছবি

চমৎকার একটা বিষয়বস্তু। চলুক চলুক চলুক

চলতে থাকুক।

-অতীত

ধুসর গোধূলি এর ছবি

আচ্ছা ইঞ্চারর্জ, সুক্রোজ কি সুগারের বৈজ্ঞানিক নাম নাকি সুগারের একটা উপাদান? (ভুলের আপেক্ষিকত্বের হিসাবে কোনটার কাহিনি কী!) চিন্তিত

প্রায়ই দেখি পাবলিক "দীনতা" আর "দৈন্য"কে গুলায়ে ফেলে। "দৈন্যতা" শব্দটা 'প্রায় সঠিক', 'দৈত্যতা'র সাপেক্ষে। তবে 'দীনতা'র সাপেক্ষে ভুল।

অনুবাদ চরম লাগছে। পরের পর্ব কবে আসবে? ক্যালেন্ডারে দাগ কাটুম?

বাই দ্য ওয়ে, ধুগো ইন্টারন্যাশনালের নিখিলবাংলা শাখার একমাত্র ইঞ্চার্জের এই লেখাটারে অফিসিয়ালি সত্যায়িত করে দিয়ে গেলাম।

এই মর্মে এই অনুবাদটি ধুগো ইন্টারন্যাশনাল কর্তৃক সত্যায়িত করা হইলো
সত্যায়নকারী-
মাননীয় ধুগো
হেড কের্দান

(স্বাক্ষর অস্পষ্ট)
ধুগো ইন্টারন্যাশনাল
(আপনার দুঃখের দিনে এবং সুখের দিনে, সবসময় আপনার পাশেই আছে, ধুগো International)
সিল মারো ভাই, সিল মারো...

জি.এম.তানিম এর ছবি

উইকি বলছে সুগারের অনেকগুলো প্রকারের একটা সুক্রোজ। আবার টেবিলসুগার হিসেবে আমরা মূলত সুক্রোজই খেয়ে থাকি।

বানানপুলিশের হামলার পরে কিছু বানান ঠিক করলাম।

পরের পর্বের ১/৬ অংশ লেখা হয়েছে। বাকিটা সত্যায়িত করার পরে লেখার ইচ্ছা ছিলো। এখন যখন করে ফেলছেন, তাইলে তো আর দেরি করা যায় না।

-----------------------------------------------------------------
কাচের জগে, বালতি-মগে, চায়ের কাপে ছাই,
অন্ধকারে ভূতের কোরাস, “মুন্ডু কেটে খাই” ।

জি.এম.তানিম এর ছবি

ধন্যবাদ সকলকে।

-----------------------------------------------------------------
কাচের জগে, বালতি-মগে, চায়ের কাপে ছাই,
অন্ধকারে ভূতের কোরাস, “মুন্ডু কেটে খাই” ।

নৈষাদ এর ছবি

চমৎকার অনুবাদ!

জি.এম.তানিম এর ছবি

ধন্যবাদ।

-----------------------------------------------------------------
কাচের জগে, বালতি-মগে, চায়ের কাপে ছাই,
অন্ধকারে ভূতের কোরাস, “মুন্ডু কেটে খাই” ।

সাফি এর ছবি

পরের পর্বে সমাপ্য লেখা মাঝে মাঝে রেখে দেই এক সাথে পড়ব বলে, আজকে তাই এই লেখাটা পড়লাম। খুবই ঝরঝরে মচমচা হয়েছে অনুবাদ

সবজান্তা এর ছবি

চমৎকার একটা অনুবাদ! এতোদিন কেন চোখে পড়েনাই, এইটা ভেবে অবাক হলাম। যাই, পরের পর্ব পড়ে আসি।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।