জীবন যেখানে যেমন ...

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: মঙ্গল, ০৫/০২/২০০৮ - ১০:৫৯অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

(রচনাকাল : ০৩/০২/২০০৮-০৪/০২/২০০৮)

লেখালেখিটা যেহেতু কাগজ-কলমে হয়না, কি-বোর্ড আর মনিটরের স্ক্রীনেই হয়, তাই "অনেকদিন কলম ধরা হয়না কিছু লেখার জন্য" এরকম কাব্যিক কথা বলা যাচ্ছেনা। মস্তিস্ক ইদানীং পুরোপুরি বিক্ষিপ্ত। একটা ভয়ই পেয়ে বসছিল, কিছু লিখতে চাইলেও বোধহয় একটা লাইনও আসবেনা ! অবশ্য কি-বোর্ড আর হাতের আঙ্গুলের সম্পর্ক অটুট আছে কিছু অফিসিয়াল কাজ কিনবা কিছু ব্যক্তিগত হিসেব-নিকেশ বুঝে নিতে।

আজ অফিস থেকে ফিরতি পথে মেজাজটা চড়ে গেল একটুক্ষনের জন্য আর তারপর পরই অনেকটা হাল ছেড়ে দেয়া অনুভূতিসহ ক্লান্তি ভর করল। ঠিক তখনই মনে হল অনেকদিন পর, আজকে কিছু লিখব...

ঠান্ডা বেশ কাবু করে ফেলেছে মানুষজনকে। ভোরবেলা গাঢ় কুয়াশা, সারাদিন রোদের লুকোচুরি , সাথে হিমেল বাতাস , নয়তো অপ্রত্যাশিত বৃষ্টি। এখন সন্ধ্যা নামে ঝুপ করে। তাই মানুষজনের ঘরে ফেরার তাড়া বেশী এবং তা যেন যে কোন ভাবে।

সরাসরি মিরপুর যাওয়ার জন্য একটা বাস সার্ভিসই আছে। বাস সংখ্যা কম ওদের। প্রায়ই দীর্ঘ সময় চাতক পাখীর মত বাস আসার অপেক্ষা করতে হয়; এই সার্ভিসটা কেন জানি যাত্রী লাইন নিয়ন্ত্রন করে না। একদিন মহাখালী ফ্লাইওভারের উপর বাস গেল বন্ধ হয়ে ! তবু ভাল শেষমেশ ফোনে যোগাযোগ করে আরেকটা বাসের ব্যবস্থা করা হলো যাত্রীদের জন্য। রাতের বেলা ফ্লাইওভারের উপর দাঁড়িয়ে থাকা! ব্যাপারটা খুব এক্সসাইটিং হতো তেমন সঙ্গী সাথে থাকলে। একাকিত্ব বোধ জেগে উঠে মন খারাপ করে দিতে পারে এই ভয়ে বাসের পথ দেখাটাই শ্রেয় মনে হলো।

কাঁটায় কাঁটায় ছ'টায় অফিস থেকে বার হয়ে রিকশা নিয়ে বাস স্ট্যান্ড । হুট করে বুট ভাজা ঠোঙা বাড়িয়ে দিয়ে কলিগের আবির্ভাব। আজ বাস একটু তাড়াতাড়িই আসল; তবে ঠাসাঠাসি অবস্থা। পরের বাসের অপেক্ষা করার সময় নেই; অন্যদিনের চেয়ে কম হলেও বেজায় ঠান্ডা বাইরে। উঠে পরলাম বাসে; সিট নেই; জানালার পাশে একটা জায়গায় কোনমতে দাঁড়িয়ে গেলাম। পা রাখার জো নেই; একজন আরেকজনের গায়ে পড়ে যাচ্ছে কিনবা গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃতভাবে। একটা মেয়ে কাউকে ধমক দিয়ে ঠিক মত দাঁড়াতে বলল; সেটা নিয়ে হালকা গোল বেঁধে গেল। অনেকদিন পর বাসের রড ধরে দাঁড়িয়ে থেকে ডান হাতের পেশীতে টান পরে খুব দ্রুত; কোনমতে নিজেকে মোচড় দিয়ে জানালার দিকে ফিরলাম। একহাতে জানালার ফ্রেম ধরে নিজের ভর অনেকটাই ছেড়ে দিলাম জানালার গ্লাসের উপর। ছুটন্ত বাস; আধখোলা জানালার একপাশ দিয়ে হিম বাতাসের ঝাপটা মুখে লাগে; চুল এলোমেলো; পরিপাটি করতে গেলেই ব্যালান্স হারাবো তাই ওভাবেই ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকি। কেউ একজন কড়া ধমক দিয়ে পেছনে চলতে থাকা তর্ক থামিয়ে দেয়।

কাকলীর মোড় পার হয়ে আরেক বাস স্টপেজে যাত্রীর লাইন; আমাদের বাস হালকা থামতেই অপেক্ষারত যাত্রীরা ঝাঁপিয়ে পড়ল। সুবিধা করতে না পেরে অনেকেই হাল ছেড়ে দিল; কিন্তু দু'জন বাইরে দরজার সাথে ঝুলতে লাগল। ভেতর থেকে কে যেন বলে উঠল, "ভাই, প্রাণটা হারায়েন না বাসে উঠতে যেয়ে..." । অবশেষে দুই ঝুলন্ত যোদ্ধা চলতি বাসের হাতল ছেড়ে দিল। আমার দাঁড়ানোর জায়গাটা একটু উঁচু ছিল; ওখান থেকে দু'টো মানুষকে ঝুলতে দেখে নিমিষেই আমাদের ঘুণে ধরা সিস্টেম আর "বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ" নামক মুখস্ত বুলিটার উপর বিরক্তি জন্মালো।

পেছনে, ভিড়ের ভেতর থেকে কলিগ বলে উঠল, "নেমে গিয়ে ক্যাব এ চলে যাবেন নাকি ?" আজকাল স্থিরতা নয়, স্থবিরতা পেয়ে বসেছে। যেখানে বসি কিনবা দাঁড়াই , সেখান থেকে আর নড়তে ভাল লাগেনা। আমি মাথা নেড়ে জবাব দেই, "নাহ্! এভাবেই যাই" ।

বানিজ্য মেলা পার হওয়ার পর সামনের সিটে বসা একজন নেমে যাবে বলে আমাকে বসার জায়গা দিল। সিটে বসে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। কলিগকে খুঁজে দেখলাম মাথা ঘুরিয়ে। পেছনে তাকাতেই হেসে জানালেন, "বসতে পেরেছি" । আমি আবার বাইরে তাকাই।

জ্যামের কারনে বাস বেশ ধীর গতিময়। একটা গন্ডগোলে চোখ আটকে গেল। ফুটপাতে কোন একটা তর্ক-বিতর্ক চলছে । তারপর হাতাহাতি। একজনকে ঘিরে আরো কয়েকজন। কার দোষ, কে দোষী - কে জানে ! আমরা কি অধৈর্য্য হয়ে যাচ্ছি দিন দিন ? নাকি শিষ্টাচার বিলুপ্তপ্রায় আর সেই সাথে হঠকারী হয়ে উঠছি একেকজন! উত্তর জানা নেই । তবে এসব দেখে চোখে ক্লান্তি নামে । দৃষ্টিন্দন কিছু খুঁজি ...

ক'দিন আগে পত্রিকায় দেখলাম মিরপুরের দিকে এক যুবককে ছিনতাইকারীরা ছুরিকাঘাত করে একটা মোবাইল ফোন নিয়ে গেছে। ছেলেটি মারা গেছে। কোন অভিযোগ করছিনা; আমার মাঝে মাঝে মনে হয় সৃষ্টিকর্তা ভাগ্যলিপি লিখতে গিয়ে মাঝে মাঝে অমনোযোগী হয়ে খেই হারিয়ে ফেলেন; তখনই কিছু খাপছাড়া ঘটনা ঘটে! এই ছেলেটি এশিয়ান ইউনিভার্সিটি থেকে এম.বি.এ করা, গ্রামীণফোনে কর্মরত ছিল। চমতকার ক্যারিয়ার প্রোফাইল ! সংসারের দ্বায়িত্ব ছিল নিশ্চয়ই; হয়ত নব্য বিবাহিত ছিল কিনবা হয়ত কোন প্রেমিকা ছিল ; যদি সত্যিই কোন প্রেমিকা থাকে তাহলে মেয়েটা নিশ্চয়ই শোকে বিহ্বল !

শুরুতে মনে হচ্ছিল কড়া কড়া কিছু শব্দ উগড়ে দেব আজকের লেখায়। কিন্তু লেখনিতেও স্থবিরতা পেয়ে বসেছে। দেখছি, শুনছি এবং অত:পর ভাবলেশহীন অভিব্যক্তি ! এটা কি মেনে নেয়া না মনে নেয়া ? অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছি কি এই ঘুণে ধরা সিস্টেম, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা আর ভাগ্যলিপির সাথে ... !!!

--------------------
আইরিন সুলতানা


মন্তব্য

স্নিগ্ধা এর ছবি

লেখার টান চমৎকার! আপনার গল্প লেখা উচিৎ হাসি

অতিথি লেখক এর ছবি

লেখার জন্যই তো এই ব্লগে আসা...আপনারা উতসাহ দিলে লেখা চালিয়ে যাব...ধন্যবাদ । হাসি

এই ব্লগে এটা আমার প্রথম লেখা (মন্তব্যগুলো বাদ দিয়ে) এবং আমার লেখায় প্রথম কমেন্ট আপনার...আবারো ধন্যবাদ । হাসি

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।