মা দিবস এবং অদরকারী মা

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: মঙ্গল, ১৩/০৫/২০০৮ - ১১:৫৪পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

মা দিবস এল, চলেও গেল। আমাদের দেশে বছরের অনেক দিনেই অমুক-তমুক "দিবস" কোনও না কোনভাবে পালিত হতে দেখেছি। মোটামাথায় হাস্যকর কাগজের মুকুট পরে, বেসুরো ব্যান্ডের উচ্চনাদে র্র্যালীর নামে সরকারী-বেসরকারী চাকরদের রাজপথ আটকে ট্রাফিক-জ্যাম-বাঁধানো দিবসগুলো নিয়ে আগ্রহী হবার কোনো কারণ ছিলনা। যায়যায়দিনের উদ্যোগেই প্রথম ভালবাসা দিবসের বড়সড় আয়োজন দেখলাম। তার ক'বছর বাদে যোগ হল মা দিবস। বানিজ্যের বিপুল সম্ভাবনা এসব দিবসের আয়োজনকে সর্বব্যাপী করতে ভূমিকা রাখছে হয়তো, তবু ব্যক্তিগত কিছু সুকোমল ভাবনা, বলি বলি করেও চেপে থাকা কথা একটা তারিখকে উপলক্ষ্য করে প্রকাশিত হচ্ছে, এটাই বা কম কী।

আমি প্রায়-অনুভূতিহীন নির্বিকার মানুষ, জীবনসঙ্গীও জুটেছে তেমনই। এসব উপলক্ষের ছুতোয় কখনো কিছু করা হয়ে ওঠেনি। তবে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পত্রিকা পড়ার অভ্যাস থাকায় জেনে যাই কে কী করছে, বলছে, ভাবছে। এদের অধিকাংশই আবার তারকা- গোছের মানুষ। বিভিন্ন আকাশের। গতবছর মা দিবসে একটা পত্রিকা পাঁচতারা হোটেলে দারুণ সব আয়োজন করল, আজকাল তো কত কিসিমের পার্টনারও থাকে, পরদিন নেটে ঢুকে আয়েশ করে তার বিস্তারিত দেখছি । অভিনেত্রী কী করলেন, গায়িকা কী বললেন,কেকটা কে কাটলেন, আরো কত কী। তারকা-মা আর তারকার মা, কে নেই আনন্দের সেই হাটে? আছেন বুদ্ধিজীবি গোত্রীয় লোকজনও। তাদের মধ্যে একজন, নামের আগেপরে ড-বিসর্গ, "নারীনেত্রী ও গবেষক" পরিচিতি, আসর জমানো বক্তব্য দিলেন। ঐ পত্রিকার সম্পাদক তাঁর বড় স্বজন, রিপোর্টার তাঁকে হাইলাইট না করে যায় কোথায়। তিনি সতেজে বলেছেন, যেসব মায়েরা সন্তানের অজুহাতে নিজেদের ক্যারিয়ার বিসর্জন দেয়, তাদের এই আরোপিত মাতৃত্বের কোনো প্রয়োজন নেই। আরো জোরালো কিছু কথাবার্তা, কিন্তু আমার চোখ আটকে থাকে ওই বাক্যটিতে, স্থাণুর মতো বসে থাকি দীর্ঘক্ষণ, আমার আর পত্রিকা পড়া হয়না সেদিন। দিন যায়, দেশ-বিদেশের হাজারো খবর চোখে পড়ে, সেগুলো পড়ি, ভুলি, প্রতিক্রিয়ারা ফিকে হয়ে আসে... স্বদেশী নারীনেত্রীর উদ্ধত কথন আমার মাথায় বর্শাফলার মতো গেঁথে থাকে টনটনে অস্তিত্ব নিয়ে। তৃপ্তিদায়ক বহু সনদ আর নিখুঁত ক্যারিয়ারকে একরকম চুলোয় ফেলে বিলম্বিত বিকাশের অসুস্থ সন্তানের উন্নত চিকিৎসার জন্য আমি প্রবাসী হয়েছি, সবরকম সাধ্যের বিনিময়ে শুধু তার জন্য কার্যকর একজন শিক্ষক হয়ে ওঠার কঠিন চেষ্টাটা চালিয়ে যাচ্ছি, যেন আমার মৃত্যুর পর সে সমাজের বোঝা না হয়ে যায়- অনুমান করতে পারি এমন আছেন আরো অনেকেই- আমরা সবাই কি তাহলে আরোপিত মা? অদরকারী অপ্রয়োজনীয় মা?

স্বামীর শিক্ষক হবার সুবাদে অতি বিখ্যাত জনপ্রিয় এক ব্যক্তিত্ব আমারও আপনজন। স্যারকে কষ্টের কথাটা জানিয়ে মেইল করেছিলাম। উনি সংবেদনশীল মানুষ, মেইলটা নারীনেত্রীকে ফরোয়ার্ড করে দেন। ভদ্রমহিলা স্যারের কাছে দুঃখ প্রকাশ করে আমার খোঁজ জানতে চান। স্যার মাঝেমধ্যেই জানতে চান, আপা কিছু বলেছেন তোমকে? তখন আমার খুব হাসি পায়। সচলের মেয়ে পাঠকের সংখ্যা নাকি কম না। সফল মায়েদের জন্য এক অদরকারী মায়ের পক্ষ থেকে অভিনন্দন আর শুভকামনা।


মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

ধিক্ এমন নারী নেত্রী আর তার কথিত ক্যারিয়ারকে। আমি এখনো "মা" হইনি তবে আমার বোনের বাচ্চা দুটো যখন আমাকে "মা" বলে ডাকে তাদের আধো বোলে রাজ্যের আবদার করে তখন আমার মনে হয় সময়কে বলি "এখানেই স্থির হয়ে যাও আমি শুধু এরই মাঝে বেঁচে থাকতে চাই।

আপনার লেখার জন্য আপনাকে "বিল্পব"

কল্পনা আক্তার
কল্পনাআক্তার@হটমেইল.কম

.................................................................
সব মানুষ নিজের জন্য বাঁচেনা

অতিথি লেখক এর ছবি

মডুমহোদয়গণ

লেখাটা আমার- নাম দিতে ভুলে গেছি।

নুশেরা তাজরীন

স্নিগ্ধা এর ছবি

নুশেরা তাজরীন - আপনার জায়গায় যে দাঁড়ায়নি তার পক্ষে কখনোই আপনার যুদ্ধ এবং আপনার আনন্দ (আমি নিশ্চিত আপনার আত্মজ/আত্মজা আপনার আনন্দেরও উৎস) বোঝা সম্ভব নয়। তাই আমার কথাগুলো আপনাকে আহত করলে আমি ক্ষমা চেয়ে রাখছি।

আপনার মতো কোন কারণে বা কোন কারণ ছাড়াই যারা সজ্ঞানে বা স্বেচ্ছায় 'ক্যারিয়ার' বাদ দেয়, সেটা - আমার মতে - করার অধিকার তাদের অবশ্যই আছে। কিন্তু মুশকিলটা হচ্ছে সব দেশেই বা সব সমাজেই আর বিশেষ করে আমাদের উপমহাদেশীয় সমাজে ছোট বেলা থেকেই মেয়েদের ক্যারিয়ার গড়ার ব্যাপারটাকে ছেলেদেরটার তুলনায় অনেক কম গুরুত্ব দেয়া হয়। এটা কখনও একদম সরাসরি বলা হয়, কখনও পরোক্ষে শেখানো হয় বা আরোপ করা হয়। এখনও, এই সময়েও একটা মেয়ের জীবনে 'সংসার' আর 'মাতৃত্ব' সবচাইতে আগে আসে - ক্যারিয়ার এবং বাকি সব পরে। কোন মেয়ে যে স্বেচ্ছায় মা হতে না চাইতেও পারে এটা এখনো অভাবিত এবং অগ্রহনযোগ্য। আমার মনে হয় বক্তা এই জিনিষটাই একটু বেশী generalized করে বলেছেন, এবং আমি আপনার সাথে একমত - 'আরোপিত' কথাটা তার প্রেক্ষিত অনুযায়ী উপস্থাপন করা উচিৎ ছিলো।

কিন্তু তারপরও বলি - মাতৃত্ব নিয়ে অতিরিক্ত আবেগপ্রবণতার যে সংস্কৃতি আমাদের সেটা বড়ই একপেশে। পিতৃত্ব কোন অংশে কম দেয় আমাদের? সামাজিকভাবে 'তৈরী করা' ভারী ভারী নিয়মগুলোর খোলস ছাড়ালে কিন্তু দেখা যায় বাবারা বা পুরুষরাও কিছু কম ভালোবাসতে জানে না হাসি

কিন্তু আপনাকে, আলাদাভাবে, আমি স্নিগ্ধার পক্ষ থেকে - না কোন স্যালুট বা পাঁচ তারা, দশ তারা ওসব নয় - শুধুই হাত বাড়িয়ে দিলাম হাসি

অতিথি লেখক এর ছবি

নুশেরা তাজরীন

আপনার লেখাটা হৃদয় কে নাড়া দিয়ে গেল।
শ্রদ্ধা জানাই আপনাকে!

---
স্পর্শ

অতন্দ্র প্রহরী এর ছবি

"আরোপিত" শব্দটিতে আমারও আপত্তি আছে কিন্তু এছাড়া আমার কাছে মনে হয় সব মেয়েরই উচিৎ নিজের ইচ্ছামত পথে অগ্রসর হওয়া। কেউ যদি মাতৃত্বকে সবকিছুর উপর স্থান দিয়ে সংসারেই পরিপূর্ণভাবে মনোনিবেশ করেন, তো করতে পারেন। আবার কেউ যদি সফল ক্যারিয়ার গড়ার জন্য বেশি আগ্রহী হন তাহলে তাকেও আমি দোষ দেই না, এটা করার অধিকার তার আছে। আমাদের সমাজে নারীদের সংসারী হওয়ার প্রতি একটা সহজাত ঝোঁক আছে, তেমনি আছে সমাজের চাপ-ও! সবই তাকে সামলাতে হয়। কিন্তু সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে কতকিছুই তো পরিবর্তন করতে হয়। আজকাল নারীরা যেভাবে এগিয়ে আসছে তা সত্যিই প্রশংসার দাবীদার।

সুন্দর লেখাটার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।

অতিথি লেখক এর ছবি

কল্পনা আক্তার, স্নিগ্ধা, স্পর্শ, অতন্দ্র প্রহরী- ধন্যবাদ, নীরস লেখাটি কষ্ট করে পড়ার জন্য এবং সুলিখিত মন্তব্যের জন্য।

ব্যক্তিগত জীবনে জ্ঞান হবার পর থেকে মায়ের ক্যারিয়ার দেখেছি। নিজেরও উপার্জনী কর্মজীবন শুরু হয়েছিল মাতৃত্ব, সংসার, এমনকি একাডেমিক ছাত্রত্ব শেষ হবারও আগে। মেয়েদের ক্যারিয়ারের গুরুত্ব আমার কম বোঝার কথা না। ব্যক্তিগত পরিস্থিতি আর অভিজ্ঞতা সবার এক হয়না, তবে উপলব্ধিটা বোধহয় অমানবিক উপসংহারে প্রকাশিত হওয়া উচিত না। আবারও ধন্যবাদ সবাইকে।

নুশেরা তাজরীন

স্নিগ্ধা এর ছবি

তবে উপলব্ধিটা বোধহয় অমানবিক উপসংহারে প্রকাশিত হওয়া উচিত না।

ঠিক, আমিও একমত।

শামীম হক এর ছবি

বাইরে কাজ করার চাইতে না করাটা পরিস্থিতির কারণে অধিকতর যুক্তিযুক্ত হতে পারে কোনো কোনো সময়। পেশাজীবি মেয়েদের আলাদা সন্মান প্রাপ্য। তেমনি সংগত কারণে (অজুহাত থেকে নয়) যিনি ফুল টাইম মা, তারও আলাদা সন্মান প্রাপ্য। তাদের ক্ষেত্রে আরোপিত, অদরকারী, অপ্রয়োজনীয় এই শব্দগুলি অগ্রহণযোগ্য।

অতিথি লেখক এর ছবি

গোর্কি, পার্ল বাক, দেলেদ্দা- কার "মা" ক্যারিয়ারিস্ট ছিলেন? সর্বজয়া থেকে শুরু করে আয়েশা ফয়েজ- কোন্ মাকে কম শ্রদ্ধা করব আমরা? অন্য কোনকিছুকে মাপকাঠি না ধরে শুধু মাতৃত্বই কি একজন মাকে সম্মান করার জন্য যথেষ্ট না? নিদেনপক্ষে অসম্মান না করার জন্য... ?

নুশেরা তাজরীন

Sumy এর ছবি

Apu: Chokh vije jay-Congrats on your motherhood.

ইশতিয়াক রউফ এর ছবি

উক্তিটা অসাধারণ। মনের ভেতর অনুরণন তোলে।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।