স্ট্যালিন বিরোধী মিথ্যাচারের উৎস সন্ধানে - ১

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: শনি, ১৫/১১/২০০৮ - ৩:১১পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

স্ট্যালিন বিরোধী মিথ্যাচারের উৎস সন্ধানে

প্রতিবছর ৮ মে পালন করা হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মিত্রশক্তির বিজয় এবং ফ্যাসিবাদী জার্মান বাহিনীর পরাজয়ের বার্ষিকী হিসাবে। এ উপলে বিভিন্ন দেশে, বিশেষত ইউরোপ আমেরিকাতে নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। আমাদের দেশেও সংবাদমাধ্যমে এ দিবসটি নিয়ে দু-চার কথা উচ্চারিত হয়। কিন্তু সর্বত্রই, দেশে ও বিদেশে, বিজয়ের মূল কৃতিত্ব দেওয়া হয় আমেরিকা বা ইউরোপিয় শক্তিগুলিকে। কেউ কেউ এমন কথাও বলেন যে হিটলার আসলে নিজের ভুলেই পরাজিত হয়েছে। অথচ এই বিজয়ের মূল নায়ক ছিলেন মহান স্ট্যালিন, যিনি ওই যুদ্ধে সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নের জনগণকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। কোনো আলোচনায় সোভিয়েত ইউনিয়নের কথা বলা হলেও স্ট্যালিনের অবদানের কথা বাদ দেওয়া হয়। শুধু যে ফ্যাসিবাদের আগ্রাসন থেকে পৃথিবীকে রার ইতিহাস আলোচনায় স্ট্যালিনের ভূমিকাকে খাটো করা হয় তাই নয়। স্ট্যালিন সম্পর্কে মিথ্যাচারেরও কমতি নেই। তাঁকে চিহ্নিত করা হয় স্বৈরশাসক রূপে। বলা হয় যে বিরুদ্ধ মত তিনি একদম সহ্য করতেন না। বিরুদ্ধ মত বা ভিন্ন মত পোষণ করার কারণে তাঁর আমলে অসংখ্য মানুষকে বন্দি অথবা হত্যা করা হয়েছে, অসংখ্য মানুষ গুম হয়েছে অথবা তাদের নির্বাসন দেওয়া হয়েছে Ñ এমন প্রচারও বেশ জোরালো।

শিা, স্বাস্থ্য, বিজ্ঞান, কৃষি, শিল্প ও সামরিক Ñ সবদিক থেকে সোভিয়েত সমাজতন্ত্রকে শান্তির পে এক মহাশক্তিধর রাষ্ট্রে পরিণত করেছিলেন তিনি। বিশ্বের শোষিত মানুষের চোখে তাই স্ট্যালিন হয়ে ওঠেন শোষণমুক্তি ও স্বাধীনতার প্রতীক। আর অন্যদিকে বিশ্বসাম্যাজ্যবাদ-পুঁজিবাদের চোখে তিনি মৃত্যুর আতঙ্কস্বরূপ। বিশ্বসাম্রাজ্যবাদ বুঝেছিল, স্ট্যালিনকে মসীলিপ্ত করতে না পারলে সাম্যবাদী আন্দোলনের অগ্রগতি আটকানো যাবে না, শোষণমূলক পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী নিষ্ঠুর ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখা যাবে না। তাই মিথ্যাপ্রচারের নিশানা বানানো হল স্ট্যালিনকেই। স্ট্যালিনকে আঘাত করা ও কালিমালিপ্ত করার দ্বারা তারা শোষিত মানুষের মুক্তির হাতিয়ার মার্কসবাদ-লেনিনবাদকেই নিশানা বানিয়েছে এবং নির্ভেজাল মিথ্যাকে প্রচারের জোরে এমন পর্যায়ে নিয়ে গেছে যে স্ট্যালিনকে দানব বা স্বৈরশাসক বলার জন্য কারো যোগ্যতা, মতা বা প্রমাণের দরকার হয় না। যে স্ট্যালিন ছিলেন হিটলার-মুসোলিনি-ফ্রাঙ্কোর ফ্যাসীবাদী আগ্রাসন ও অন্ধতার বিরুদ্ধে শান্তি, যুক্তিবাদ ও মানবতার রক, আজ তাকেই হিটলার বা অন্য যে কোনো স্বৈরশাসকের সাথে এক কাতারে তুলে দেওয়া হয়!

স্ট্যালিন সম্পর্কে এসব মিথ্যাচারের শিকার অনেকেই, এমনকি বহু বামপন্থিও। এই প্রচার এতই তীব্র যে কেউ কেউ হিটলারের চাইতেও স্ট্যালিনকেই মানবতা ও গণতন্ত্রের পয়লা নম্বর শত্র“ মনে করেন!
সুইডিশ কমিউনিস্ট পার্টির নেত্রী কমরেড মারিয়া সৌসা স্ট্যালিন-বিরোধী এইসব অপপ্রচার সম্পর্কে একটি অনুসন্ধান চালান। মুক্তিসাধক মেহনতি মানুষের সচেতন অংশ স্ট্যালিনবিরোধী মিথ্যাপ্রচারের মুখোস বহুলাংশে খুলে দিয়েছে, সত্য উদ্ঘাটিত করেছে।
সুইডিশ কমিউনিস্ট পার্টির নেত্রী মারিয়া সৌসার লেখাটি ধারাবাহিকভাবে পাঠকের কাছে তুলে ধরা হবে-

হিটলার থেকে হার্স্ট, কনকোয়েস্ট থেকে সোলঝিনিৎসিন

স্ট্যালিন আমলে সোভিয়েত ইউনিয়নে গুলাগ লেবার ক্যাম্পগুলিতে অসংখ্য মানুষের মৃত্যু ও খুন সম্পর্কে যেসব ভয়াবহ গল্প চালু আছে তার একটাও কখনো শোনেননি, এরকম মানুষ আজকের দুনিয়ায় বিরল। তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের ওই সব বন্দিশিবিরে নাকি ল ল বন্দিকে অনাহারে উপবাসে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছিল। এ রকমই আরও ল ল মানুষকে নাকি সেদিন সেখানে হত্যা করা হয়েছিল, শুধু এই কারণে যে তারা ক্ষমতাসীনদের বিরোধী। স্ট্যালিন আমলের সোভিয়েত ইউনিয়ন সম্পর্কে এইসব কাহিনী বহুল প্রচারিত। পুঁজিবাদী দুনিয়ায় এইসব গল্প বারে বারে নানা বইয়ে, খবরের কাগজে, রেডিওতে, টেলিভিশনে, চলচ্চিত্রে ফিরে ফিরে এসেছে। তাদের সরবরাহ করা তথ্যে গত ৫০ বছরে সমাজতান্ত্রিক দুনিয়ার তথাকথিত হৃদয়হীন নিষ্ঠুরতার শিকার এইসব মানুষের সংখ্যা প্রায় লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়ে চলেছে।

কিন্তু এসব কাহিনী কি সত্য? কোথা থেকে এসব কাহিনী এল? কারাই বা তা সরবরাহ করল? এই কাহিনীগুলোর লেখকরা বার বার দাবি করে এসেছেন যে, স্ট্যালিন আমলে সোভিয়েত ইউনিয়নে ল ল মানুষের মৃত্যুর যে কথাগুলি তারা বলে আসছেন তা নাকি অরে অরে সত্য। যেদিন সেদেশের সরকারি মহাফেজখানা খুলে গোপন নথি সকলের সামনে প্রকাশিত হবে সেদিন নাকি সবাই বুঝতে পারবে, এই কাহিনীগুলো খাঁটি সত্য। সোভিয়েত ইউনিয়ন আজ আর নেই। ১৯৯১ সালেই তার পতন ঘটেছে। ইতিহাস গবেষকদের কাছে তার সমস্ত গোপন নথিপত্রই আজ সম্পূর্ণ উন্মুক্ত। কিন্তু ওই সমস্ত গল্পগুলোর সপে কোনো তথ্যপ্রমাণ সেখানে পাওয়া গেল কি?

আজ সোভিয়েত আমলের সমস্ত গোপন নথিপত্রই ঘেঁটে দেখে খুব সহজেই বের করা সম্ভব, ঠিক কতজন সেদিন সোভিয়েত ইউনিয়নে বন্দি ছিলেন, কে কত বছর সেখানে বন্দিশালায় কাটিয়েছেন, কতজন বন্দি অবস্থায় মারা গেছেন, বা ঠিক কতজনকে সেদিন মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয়েছিল। প্রতিটি েেত্রই প্রকৃত সংখ্যা জানার েেত্র আজ আর কোনো বাধা নেই। কিন্তু কী পাওয়া গেল সেখানে? দেখা গেল, এতদিনের বহুল প্রচারিত গল্পের সাথে প্রকৃত সত্যের মিল নেই। কারা এই গল্পগুলো রটিয়েছিল তা খুঁজলে দেখা যাবে, হিটলার থেকে হার্স্ট, কনকোয়েস্ট থেকে সোলঝেনিৎসিন, সকলেই এর সঙ্গে যুক্ত।
স্ট্যালিনবিরোধী মিথ্যাপ্রচার শুরু হয় হিটলারের হাত দিয়েই

১৯৩৩ সালে জার্মানিতে ফ্যাসিবাদের অভ্যুত্থানের ফলাফল ছিল সুদূরপ্রসারী। পরবর্তী কয়েক দশক জুড়ে সারা পৃথিবীর উপরই এর প্রভাব পড়ে। ওই বছর ৩০ জানুয়ারি হিটলার জার্মানির চ্যান্সেলর হন এবং নতুন সরকার গঠন করেন। প্রচন্ড হিংসা ও প্রচলিত বিভিন্ন আইনকানুনের প্রায় কোনোরকম তোয়াক্কা না রেখেই এই সরকার শুরু করে তার কাজ। দেশের সমস্ত মতা পুরোপুরি নিজেদের কুগিত করতে ৫ মার্চ তারা নতুন করে নির্বাচনের ডাক দেয়। তার আগেই অবশ্য তারা সমস্ত প্রচারযন্ত্রকে নিজেদের কব্জায় এনে ফেলেছিল। এইভাবে নিছক প্রচারের জোরে তারা নির্বাচনে নিজেদের জয়কে সুনিশ্চিত করার চেষ্টা করে। জনগণকে বিভ্রান্ত করতে নির্বাচনের সপ্তাহখানেক আগে, ২৭ ফেব্র“য়ারি, নাৎসিরা নিজেরাই জার্মানির পার্লামেন্ট ‘রাইখস্টাগ’ ভবনে আগুন ধরিয়ে দেয় এবং মিথ্যা স্যাপ্রমাণ সাজিয়ে এই অগ্নিকান্ডের সমস্ত দায়ভার চাপিয়ে দেয় কমিউনিস্টদের ওপর। এই অবস্থায় যে নির্বাচন হয়, তাতে সারা জার্মানির প্রায় ১ কোটি ৭৩ ল ভোট পায় নাৎসিরা, যা ওই নির্বাচনে প্রদত্ত ভোটের প্রায় ৪৮ শতাংশ। রাইখস্টাগে তাদের ২৮৮ জন ডেপুটি নির্বাচিত হয়। কমিউনিস্ট পার্টিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। নাৎসিদের আক্রমণ এরপর পরিচালিত হয় সোস্যাল ডেমোক্র্যাট ও ট্রেড ইউনিয়নগুলোর দিকে। প্রথম দিকে যেসব কনসেনট্রেশন ক্যাম্পগুলি গড়ে ওঠে, নারীপুরুষ নির্বিশেষে বামপন্থি কর্মীসমর্থকদের ধরে ধরে এসব বন্দিশিবির ভর্তি করা হয়। এদিকে ওই একই সময়ে অন্যান্য দণিপন্থিদের সহায়তায় রাইখস্টাগে হিটলারের ক্রমাগত শক্তিবৃদ্ধি ঘটতে থাকে। ২৪ মার্চ, সেখানে একটা আইন পাস করানো হয়, যার বলে পরবর্তী চার বছরের জন্য হিটলারের হাতে দেশের সর্বময় মতা তুলে দেওয়া হয়। এই মতার বলে তিনি তখন থেকে পার্লামেন্টের অনুমতি ছাড়াই যে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতা হাতে পান। এই সময় থেকেই শুরু হয় খোলাখুলি ইহুদি নিধন। তাদেরকেও দলে দলে ধরে চালান করা হয় ওই কনসেনট্রেশন ক্যাম্পগুলিতে। ১৯১৮ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানির উপর বিজয়ী সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলি আন্তর্জাতিক চুক্তির মাধ্যমে যেসব সামরিক নিষেধাজ্ঞা জারি করে, সেগুলিকেই অজুহাত করেন হিটলার। সওয়াল করা শুরু হয় Ñ তার সর্বময় মতার সময়সীমা আরও বাড়ানো হোক। প্রচন্ড দ্রুতগতিতে শুরু হয় নতুন করে জার্মানির সামরিকীকরণের কাজ। নতুন করে জার্মান সেনাবাহিনীকে অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত করা হয়। জার্মানির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে স্ট্যালিনের রাশিয়া। ব্রিটেন-আমেরিকা-ফ্রান্স তখন সোভিয়েতের বিরুদ্ধে হিটলারকে প্রশ্রয় দিচ্ছে। গোটা সাম্রাজ্যবাদী দুনিয়ার লুঠের পথে কাঁটা সোভিয়েত ইউনিয়ন। এ রকম একটি আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে হিটলারের প্রচারদফতর সোভিয়েত ইউনিয়ন সম্পর্কে এমন সমস্ত ভয়াবহ গল্পকাহিনী তৈরি করে যা বিশ্বব্যাপী প্রচার করার দায়িত্ব নিয়েছিল মার্কিন দেশের সেইসব সংবাদপত্র, যারা চটকদার চাঞ্চল্যকর খবর ছেপে ব্যবসা করে।

হিটলারের দাবি Ñ ইউক্রেন জার্মান প্রভাবাধীন অঞ্চল
এ সময়ই হিটলারের প্রচারমন্ত্রী গোয়েবলসকে দায়িত্ব দেওয়া হয়, নাৎসিরা যেমনটি চায় সেই মনোভাব জার্মান জনসাধারণের মধ্যে চারিয়ে দিতে হবে। উগ্র জাত্যাভিমানের ভিত্তিতে এক বৃহত্তর জার্মানি গড়ে তোলার নেশা ধরানো হয়েছিল সেদিন জার্মান জনগণকে। বোঝানো হয়েছিল, খাঁটি আর্যরক্তের জার্মান জাতিই হবে সে দেশের একমাত্র অধীশ্বর। এই ল্েযই শ্লোগান তোলা শুরু হয়, ‘লেবেলস্রাউম’, অর্থাৎ বাঁচবার জন্য যথেষ্ট জায়গা চাই। আসলে এটা ছিল জার্মান সাম্রাজ্যবাদের উপনিবেশ দখলের আগ্রাসী লক্ষ্যের উপর উগ্র জাত্যাভিমানী মুখোস। এই তথাকথিত লেবেলস্রাউমের ল্েয যে সমস্ত অঞ্চল চিহ্নিত করা হয়, তারই এক অংশ ছিল জার্মানির পূর্বদিকে অবস্থিত এক বিশাল অঞ্চল, যার আয়তন ছিল খোদ জার্মানির চেয়েও অনেক বড়। কিন্তু এই সমগ্র অঞ্চলটিই ছিল তখনও পর্যন্ত জার্মানির অধিকারের বাইরে। অতএব অবিলম্বে তা দখল করা চাই। এর অনেক আগেই, ১৯২৫ সালে প্রকাশিত ‘মাইন কাম্ফ’ (আমার সংগ্রাম) গ্রন্থেই, হিটলার জার্মান লেবেলস্রাউমের জন্য ইউক্রেনকে এক অতি প্রয়োজনীয় অঞ্চল বলে চিহ্নিত করেছিলেন। তার কথায়, ইউক্রেন এবং পূর্ব ইউরোপের অন্যান্য অঞ্চলগুলি একমাত্র জার্মানির অধিকারে থাকলেই ওইসব অঞ্চলগুলির সম্পদের ঠিকঠাক ও পূর্ণাঙ্গ ব্যবহার হওয়া সম্ভব, নচেৎ নয়। ফলে নাৎসি প্রচারের মূল কথাই দাঁড়াল Ñ জার্মান জাতির স্বার্থে দরকার হলে তরবারির জোরেই এ অঞ্চলগুলিকে ‘মুক্ত’ করতে হবে। জার্মান জাতিকে বাঁচবার মতো প্রয়োজনীয় জায়গা করে দেওয়ার ল্েয এ কাজ অবশ্য প্রয়োজনীয়। অধিকার করার পর জার্মান উদ্যোগে, জার্মান প্রযুক্তির সাহায্যে সমগ্র ইউক্রেনকে জার্মানির জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্যের যোগানদার এক শস্যাগারে পরিণত করা হবে। তার জন্য প্রথমে সেখানে বসবাসকারী ‘ইতর’ জাতির মানুষদের হাত থেকে ইউক্রেনকে মুক্ত করতে হবে। এইসব জাতির মানুষদের অবশ্য জার্মান অর্থনীতির স্বার্থে েেতখামারে, কারখানায় বা জার্মান বাড়িতে পরিচারক হিসাবে দাসের মতো ব্যবহার করা চলতে পারে!

কিন্তু ইউক্রেন দখল করতে হলে সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে যুদ্ধ করা ছাড়া কোনো উপায় নেই। আর এই যুদ্ধের জন্য আগে থেকেই ব্যাপক প্রস্তুতি নেওয়া প্রয়োজন, প্রয়োজন যুদ্ধের উপযুক্ত উত্তেজনা তৈরি করা। সেই ল্য সামনে রেখেই গোয়েবলসের নেতৃত্বে নাৎসি প্রচারযন্ত্র শুরু করল মিথ্যা প্রচার যে, ‘বলশেভিকদের নেতৃত্বে ইউক্রেনে ব্যাপক গণহত্যা সংঘটিত হচ্ছে। স্ট্যালিনের নির্দেশ অনুযায়ী সেখানে পরিকল্পিতভাবেই ভয়াবহ দুর্ভি সৃষ্টি করা হয়েছে। খেতে না পেয়ে সেখানে দলে দলে মানুষ অসহায়ভাবে মরছে। এইভাবেই সোভিয়েত কর্তৃপ চেষ্টা করছে যাতে ইউক্রেনের কৃষকরা বাধ্য হয় তাদের হুকুম অনুযায়ী সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে মেনে নিতে।’ এসব মিথ্যাপ্রচারের আসল ল্য ছিল ইউক্রেনে আসন্ন জার্মান সামরিক অভিযানের সপক্ষে বিশ্ব জনমতকে প্রভাবিত করা। কিন্তু এই ল্েয নাৎসিদের প থেকে ব্যাপক প্রচার চালানো সত্ত্বেও বিশ্বজুড়ে আশানুরূপ সাফল্য অর্জন করতে তা ব্যর্থ হয়। ফলে হিটলার ও গোয়েবলস বুঝতে পারেন, তাদের প্রচারকে সারা পৃথিবীতে প্রয়োজনীয় মাত্রায় পৌঁছে দিতে হলে অন্যান্য দেশেও তাদের কিছু বন্ধু দরকার যারা এ বিষয়ে সাহায্য করতে পারবেন। এই সাহায্য এল মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীদের প থেকে।

ধনকুবের র‌্যানডল্ফ হার্স্ট এবং হিটলার Ñ হরিহর আত্মা
উইলিয়াম র‌্যানডল্ফ হার্স্ট ছিলেন একজন মার্কিন কোটিপতি। সোভিয়েত ইউনিয়নে বিরুদ্ধে জনমানস বিষিয়ে দেওয়ার কাজে নাৎসিদের প্রতি তিনি সাহায্যের দরাজ হাত বাড়িয়ে দেন। এই উইলিয়াম হার্স্টের আরও কতগুলি পরিচয় রয়েছে। তিনি ছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অনেকগুলি বিরাট সংবাদপত্রের মালিক। আজকের ‘ইয়েলো প্রেস’ বা চটকদার প্রচারমাধ্যম বলতে আমরা যা বুঝি, তারও জনক বলে হার্স্টকেই অভিহিত করা যায়। এসব বাজারি পত্রিকার কাজই হচ্ছে নানা প্রকারের গরম গরম উত্তেজক খবর পরিবেশন করা।
উইলিয়াম হার্স্ট সংবাদপত্রের সম্পাদক হিসাবে তার কর্মজীবন শুরু করেন ১৮৮৫ সালে। তার বাবা জর্জ হার্স্টও ছিলেন একজন কোটিপতি ও সফল ব্যবসায়ী। তিনি নানা খনি এবং সংবাদপত্রের মালিক ছিলেন। মার্কিন সেনেটের একজন প্রতিনিধি হিসাবেও তিনি দীর্ঘদিন কাজ করেন। ১৮৮৫ সালে তিনিই তার ছেলের হাতে ‘সানফ্রান্সিসকো ডেইলি এক্সামিনার’ পত্রিকার দায়িত্ব তুলে দেন। এটিকেই সংবাদপত্র দুনিয়ায় হার্স্ট-সাম্রাজ্যের সূচনা বলা যেতে পারে। উত্তর আমেরিকার বহু মানুষের জীবন ও চিন্তা-চেতনার উপর এই হার্স্ট-সাম্রাজ্যের প্রবল প্রভাব ল করা যায়। পরবর্তীকালে তার বাবার মৃত্যুর পর, উইলিয়াম হার্স্ট তার খনিশিল্পের সমস্ত শেয়ার বিক্রি করে দেন। এই সময় থেকে সংবাদপত্র দুনিয়াই হয়ে ওঠে তার পুঁজি বিনিয়োগের প্রধান ব্যবসা। প্রথমেই তিনি ‘নিউইয়র্ক মর্নিং জার্নাল’ নামে একটি পত্রিকা কিনে নেন। এটি ছিল যথেষ্ট ঐতিহ্যসম্পন্ন একটি পত্রিকা। কিন্তু তার হাতে যাওয়ার পর কিছুদিনের মধ্যেই পত্রিকাটির সম্পূর্ণ রূপান্তর ঘটে যায়। খুব দ্রুত এটি উত্তেজক খবর পরিবেশনকারী পত্রিকা হয়ে দাঁড়ায়। চটকদার চাঞ্চল্যকর গল্প কেনার জন্য তিনি কখনো পয়সার কার্পণ্য করতেন না। এমনকী যদি সেই মুহূর্তে কোনো ভয়াবহ অপরাধ বা খুনের মতো উত্তেজক ঘটনা নাও ঘটে থাকে, এই পত্রিকার সাংবাদিকদের এ ধরনের ‘সাজানো’ ঘটনার রিপোর্ট পরিবেশন করতে উৎসাহ দেওয়া হত। ‘হলুদ সাংবাদিকতা’র বৈশিষ্ট্যই ওটা। মিথ্যা এবং সাজানো নানা উত্তেজক খবরকে সত্যি বলে পরিবেশন করাই এ ধরনের পত্রিকার কাজ।

এইসব মিথ্যা সাজানো, কিন্তু উত্তেজক খবর পরিবেশন করে হার্স্ট কিছুদিনের মধ্যেই বহু কোটি টাকার মালিক হয়ে উঠলেন। সংবাদপত্র দুনিয়ায় ততদিনে তিনি হয়ে উঠেছেন এক গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। ১৯৩৫ সালে দেখা গেল, পৃথিবীর ধনীতম ব্যক্তিদের মধ্যে একজন হয়ে উঠেছেন তিনি। তার সম্পত্তির পরিমাণ তখন ২৯ কোটি ডলারেরও বেশি। ১৯৪০ এর দশকে দেখা গেল, তিনি মোট ২৫টি সংবাদপত্রের মালিক। শুধু তাই নয়, আরও ২৪টি সাপ্তাহিক সাময়িক পত্রিকা, ১২টি রেডিও স্টেশন ও ২টি বিশ্বসংবাদদাতা সংস্থার মালিকানাও তখন তার হাতে। এছাড়াও যে ‘কসমোপলিটান ফিল্ম কোম্পানি’ বিভিন্ন সিনেমা তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য সরবরাহ করত, সেটিও ছিল তার। আরও বহু সংস্থারই তিনি মালিক ছিলেন। ১৯৪৮ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম টিভি স্টেশনটিও তিনি কিনে নেন। বাল্টিমোরে স্থাপিত এই স্টেশনটির নাম ছিল ‘বি ডবলিও এ এল টিভি’। এই সময় দেখা যায়, হার্স্ট গোষ্ঠীর বিভিন্ন সংবাদপত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিদিন মোট ১ কোটি ৩০ ল কপি বিক্রি হয়। আর তার পাঠকের সংখ্যা প্রায় ৪ কোটি। শুধু তাই নয়, পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে বসে বহু মানুষ যেসব সংবাদ প্রতিদিন পড়েন তারও অনেকগুলি ওই হার্স্ট গোষ্ঠীর বিশ্বসংবাদদাতা সংস্থা থেকেই সংগৃহীত হত। সারা পৃথিবীতেই বিভিন্ন সংবাদপত্র গোষ্ঠী ও সিনেমা কোম্পানিগুলিও এইসব সংবাদদাতা গোষ্ঠীগুলি থেকেই তাদের প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করত ও নিজেদের ভাষায়, নিজস্ব আঙ্গিকে তা পরিবেশন করত। এসব তথ্য থেকেই বোঝা যায়, মার্কিন রাজনীতিতে হার্স্ট-সাম্রাজ্যের প্রভাব ছিল কী বিপুল! পরোভাবে বিশ্বরাজনীতিকেও যথেষ্ট প্রভাবিত করার মতা ছিল এই হার্স্ট-সাম্রাজ্যের। বহু বছর ধরেই তারা এ মতার পূর্ণ সদ্ব্যবহার করে এসেছে। বিভিন্ন ইস্যুতে, যেমন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়ন যে-পে লড়ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সে-পক্ষে যোগ দেওয়া আদৌ উচিত কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা, বা ১৯৫০-এর দশকে মিথ্যা অভিযোগে কমিউনিস্টদের হত্যার কাজে জেনারেল ম্যাক আর্থারের সপে মার্কিন জনমত সংগঠিত করা ইত্যাদি প্রতিটি েেত্রই এর প্রমাণ পাওয়া যায়। উগ্রজাতীয়তাবাদী, অতিরক্ষণশীল ও কমিউনিজমবিরোধী দৃষ্টিভঙ্গির মানুষ ছিলেন উইলিয়াম হার্স্ট। তার রাজনীতি ছিল প্রতিক্রিয়াশীল ও উগ্র দণিপন্থি।

১৯৩৪ সালে তিনি জার্মানি যান। হিটলার তাকে অতিথি ও বন্ধুর মর্যাদা দেন। হার্স্টের এই জার্মানি ভ্রমণের পর থেকেই তার মালিকানাধীন সংবাদপত্রগুলি আরও খোলাখুলিভাবে প্রতিক্রিয়াশীল মতামত প্রকাশ করতে শুরু করে। এমন কোনো দিন ছিল না যেদিন সেসব সংবাদপত্রে সমাজতন্ত্র, সোভিয়েত ইউনিয়ন বা বিশেষ করে স্ট্যালিনের বিরুদ্ধে কোনো না কোনো প্রবন্ধ প্রকাশিত হত। হার্স্ট এই সময় তার মালিকানাধীন সংবাদপত্রগুলিকে প্রায় নাৎসিবাদের নিজস্ব প্রচারপত্র করে তোলারও চেষ্টা করেছিলেন। এই উদ্দেশ্যেই সেখানে গোয়েরিং-এর লেখা প্রবন্ধাবলী ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করা শুরু হয়। কিন্তু নানা পাঠক এই ব্যাপারে তাদের অসন্তোষ ও প্রতিবাদ ব্যক্ত করায় শেষপর্যন্ত এই প্রবন্ধাবলী প্রকাশ করা বন্ধ করতে হয়।

হিটলারের জার্মানি থেকে ঘুরে আসার পর থেকেই হার্স্টের সংবাদপত্রগুলিতে সোভিয়েত ইউনিয়ন সম্পর্কে প্রতিদিন একের পর এক ভয়াবহ সংবাদ প্রকাশিত হতে থাকে। তার কোনোটি খুনের, কোনোটি নির্বিচার গণহত্যার, আবার কোনোটি বা বাধ্যতামূলক দাসত্বের, শাসকদের বিলাসবৈভবের বা সাধারণ মানুষের অভাব-দারিদ্র্য-অনাহারের। তাদের মতে, এই সবগুলিই ছিল সোভিয়েত শাসকদের চেপে রাখা তথ্য। প্রকাশিত সংবাদ-প্রবন্ধগুলিতে অত্যন্ত উত্তেজকভাবেই এসব ‘সত্য’ উদ্ঘাটন করা হত। প্রায় প্রতিদিন প্রকাশিত এইসব সংবাদ আসলে সরবরাহ করত নাৎসিদের কুখ্যাত ‘গোপন রাষ্ট্রীয় পুলিশ’ বা গেস্টাপো বাহিনী। প্রায়শই এসব সংবাদপত্রের একেবারে প্রথম পাতাতেই সোভিয়েত সম্পর্কে নানা মিথ্যা কথা ও তাকে ভিত্তি করে ব্যঙ্গচিত্র প্রকাশ করা হত। যেমন একটি ব্যঙ্গচিত্র ছিল যেখানে স্ট্যালিন একটি খোলা ছুরি নিয়ে যেন কাউকে হত্যা করতে উদ্যত। এখানে কিন্তু একটা কথা আমদের অবশ্যই ভুলে গেলে চলবে না যে, এসব সাজানো কথা, মিথ্যা কথা ও ব্যঙ্গচিত্রের পাঠকসংখ্যা কিন্তু শুধুমাত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেই ছিল দৈনিক ৪ কোটি। এছাড়াও অন্যান্য নানা সংবাদমাধ্যমের সাহায্যে সারা পৃথিবীর আরো কয়েক কোটি মানুষের কাছে এসব সংবাদ পৌঁছে যেত। এই হল স্ট্যালিনবিরোধী কুৎসা প্রচারের সূচনা।

[b]ইউক্রেনে দুর্ভিক্ষের বানানো গল্প[/b]
সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে হার্স্ট গোষ্ঠী প্রথম যেসব মিথ্যা প্রচার শুরু করে, যার প্রতিধ্বনি এখনও শোনা যায়, তার মধ্যে অন্যতম ছিল ইউক্রেনে ভয়াবহ দুর্ভিরে গল্প। হার্স্টের প্রচার অনুযায়ী ওই দুর্ভিে নাকি ল ল মানুষ না খেতে পেয়ে মারা যায়। ‘শিকাগো আমিরিকান’ কাগজে ১৯৩৫ সালের ৮ ফেব্র“য়ারি এই প্রচার প্রথম শুরু হয়। একেবারে প্রথম পাতায় বড় বড় হরফে ‘অনাহারে, ুধার জ্বালায় সোভিয়েত ইউনিয়নে ৬০ ল মানুষের মৃত্যু’ Ñ শিরোনামে প্রকাশিত হয় উত্তেজক এই খবর। নাৎসি জার্মানি থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে এরপর থেকে হার্স্ট গোষ্ঠীর কাগজগুলোতে একের পর এক প্রকাশিত হতে থাকে দুর্ভি-সম্পর্কিত বিভিন্ন বানানো গল্প।

কেন তারা স্ট্যালিনকে আক্রমণের নিশানা বানিয়েছিল? সমকালীন বিশ্বসাম্রাজ্যবাদী শিবিরের সঙ্কট, সাম্রাজ্যবাদী-পুঁজিবাদী দেশগুলির শ্রমিকশ্রেণীসহ গণতন্ত্রকামী-শান্তিকামী মানুষের সোভিয়েতের প্রতি প্রবল আকর্ষণ এবং সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলির যুদ্ধপ্রস্তুতির বিরুদ্ধে শান্তির শক্তি হিসাবে স্ট্যালিনের নেতৃত্বে সমাজতন্ত্রের অপ্রতিহত অগ্রগতিতে আতঙ্কিত সাম্রাজ্যবাদ-পুঁজিবাদের মরণভীতির পটভূমিতেই বুঝতে হবে, কেন হার্স্টের মাধ্যমে ফ্যাসিস্ট শক্তি স্ট্যালিনবিরোধী কুৎসার ঝড় তুলেছিল। ১৯৩৫ সাল সোভিয়েতের ইতিহাসেও সন্ধিণ। ১৯৩৫ সালে ফ্যাসিস্ট ইতালি আবিসিনিয়া দখল করে বাস্তবে বিশ্বযুদ্ধের সূচনা ঘোষণা করে। লেনিনের মরদেহ স্পর্শ করে সমাজতন্ত্র রার যে শপথ স্ট্যালিন নিয়েছিলেন, ব্যক্তিগত চরিত্রহণনকে উপো করে এই মহান বিপ্লবী মানবসভ্যতাকে রার স্বার্থে সেই শপথ রায় ছিলেন অবিচল। এই সময়েই স্ট্যালিন বুঝেছিলেন, সামগ্রিক যুদ্ধপ্রস্তুতি ছাড়া সাম্রাজ্যবাদের আসন্ন আক্রমণ রোখা যাবে না। সমাজতন্ত্র রার সামগ্রিক প্রস্তুতির অঙ্গ হিসাবে শিল্প ও কৃষিেেত্র দ্রুত অগ্রগতি ঘটানো সোভিয়েতের জন্য মরণবাঁচন প্রয়োজন হয়ে দাঁড়ায়। দৃঢ় হস্তে স্ট্যালিন সেই প্রস্তুতি নেন। যেজন্য যৌথখামার প্রবর্তনের ওপর জোর দিয়ে তিনি বিপ্লবের মাধ্যমে মতাচ্যুত কুলাকদের (কৃষি পুঁজিপতি) চোখের বালিতে পরিণত হন। মতাচ্যুত কুলাক তথা রুশ পুঁজিপতিদের স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করতেন বুখারিন, ট্রটস্কি প্রমুখ। বুর্জোয়া উদারনীতির প সমর্থনের জন্য আজও বহু বুদ্ধিজীবী বুখারিনের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। ফলে দেশের বাইরে মরণভীত সাম্রাজ্যবাদী শক্তি এবং দেশের অভ্যন্তরে মতাহারা পুঁজিবাদী শক্তি যখন স্ট্যালিনের বিরুদ্ধে ছুরিতে শান দিচ্ছে, সেই মুহূর্তে ফ্যাসিস্টদের মস্তিষ্কপ্রসূত কুৎসা ও আক্রমণ বিশ্বজুড়ে প্রতিক্রিয়াশীলরা লুফে নেয়। পরবর্তীকালে স্ট্যালিন সমাজতন্ত্র ও মানবমুক্তির প্রতীকে পরিণত হওয়ায়, মানবতার শত্র“রা সকলে একজোট হয়ে ফ্যাসিস্টদের কুৎসাকে দুনিয়াময় প্রচার করেছে এবং আজও করছে।

হার্স্ট-প্রচারিত সব গল্পের মূল কথা ছিল একটাই Ñ বলশেভিকরা নাকি ইউক্রেনে ইচ্ছাকৃতভাবে এক প্রকট খাদ্যসঙ্কট তৈরি করেছে। তার ফলে সেখানে ল ল মানুষ না খেতে পেয়ে মৃত্যুমুখে পতিত হচ্ছে। বাস্তবে এটা ছিল যৌথখামার কর্মসূচি বানচালের চক্রান্ত। সত্য ছিল সম্পূর্ণ বিপরীত। ১৯৩০-এর দশকের শুরুর দিনগুলিতে সোভিয়েত ইউনিয়নে বাস্তবে যা ঘটেছিল, তা ছিল একেবারেই অন্য জিনিস। এইসময় সেখানে একটি বড় ধরনের শ্রেণীসংগ্রাম পরিচালিত হচ্ছিল। সেই সংগ্রামে গরিব ভূমিহীন ছোট কৃষকরা ধনী, প্রচুর জমির মালিক, বড় কৃষক বা কুলাকদের বিরুদ্ধে লড়াই করছিলেন। এটা ছিল বাস্তবে যৌথখামার গড়ে তোলার সংগ্রাম।

গোটা দেশের জনগণকে জড়িত করে এতবড় একটা আন্দোলনের টানাপোড়েনে কৃষি উৎপাদনে কিছুটা অনিশ্চয়তা দেখা দেয়। কিছু কিছু অঞ্চলে এই সময় শস্যের ফলনও খানিকটা কম হয়েছিল। কিন্তু তা এত কম নয় যার জন্য খাদ্যাভাবে মানুষের মৃত্যু ঘটতে পারে। বাস্তবে ওই সময়ে শুধু ইউক্রেনেই নয়, পৃথিবীর বহু অঞ্চলেই একটি মারণব্যাধি মহামারীরূপে ছড়িয়ে পড়েছিল এবং তাতে বহু মানুষেরই মৃত্যু হয়েছিল। এই রোগটির নাম ছিল স্প্যানিশ ফু। এর সাথে খাদ্যাভাবের কোনো যোগ ছিল না। ১৯১৮ থেকে ’২০ সালের মধ্যে মধ্যে এই মারণব্যাধি মহামারীর আকারে সমগ্র ইউরোপ ও আমেরিকা জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছিল। বিশ্বজুড়ে এই রোগে অন্তত ২ কোটি মানুষের প্রাণহানি ঘটে। কিন্তু এজন্য কেউ এইসব দেশের সরকারগুলির বিরুদ্ধে এই বলে অভিযোগের আঙুল তোলেনি যে, তারা নিজেরাই নিজেদের নাগরিকদের খুন করেছে। অথচ তাদের প্রচারে, একই কারণে ইউক্রেনে মানুষের মৃত্যু হলে গেল যৌথখামার গঠনে স্ট্যালিনীয় সন্ত্রাসের নমুনা! এই হল তাদের সততা। আসলে সেই সময় কোনো সরকারের পইে এেেত্র তেমন কিছু করার ছিল না। কারণ স্প্যানিশ ফুয়ের কোনো ওষুধ ছিল না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন সময়ে পেনিসিলিন নিয়ে গবেষণা আর অনেকটা অগ্রসর হলে কেবল তখনই এই ধরনের রোগ প্রতিরোধের উপায় মানুষের করায়ত্ত হয়। কিন্তু সে তো আরো পরে সেই ১৯৪০’র দশকের কথা।
হার্স্ট-এর প্রচারমাধ্যম এইসব ব্যাপারে টুঁ-শব্দটিও করেনি। বরং তারা বিস্তারিতভাবে ছক কেটে কীভাবে কমিউনিস্টদের ইচ্ছাকৃতভাবে সৃষ্ট ভয়াবহ দুর্ভি ও খাদ্যসঙ্কটে ফলে ইউক্রেনে অসহায়ভাবে ল ল মানুষের মৃত্যু ঘটছে, তা নিয়ে পাতার পর পাতা সাজানো মিথ্যা কিন্তু গরম খবর পরিবেশন করতে থাকে। এই সাজানো মিথ্যাকে যাতে সত্য বলে প্রতিভাত করা যায়, তার জন্য তাদের চেষ্টার কোনো ত্র“টি ছিল না। এইভাবে তারা বিভিন্ন পুঁজিবাদী দেশের জনমতকে প্রভাবিত করতে অনেকটা সফলও হয়। সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রচারের দ্বারা এইভাবেই তারা বিশ্বজুড়ে একটা ব্যাপক বিরুদ্ধ-জনমত সংগঠিত করতে থাকে। এগুলো ব্যাপক প্রচার পায়, কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়নের বক্তব্য এসব প্রচারমাধ্যমে তুলে ধরা হয়নি। সোভিয়েতের প থেকে হার্স্ট-গংয়ের এইসব মিথ্যাচারের প্রতিটিরই জবাব দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু কোনোটিই যথোপযুক্ত গুরুত্বসহকারে পশ্চিমী সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়নি। ফলে সাম্রাজ্যবাদী মিথ্যার স্বরূপ উদ্ঘাটনের জন্য সোভিয়েতের যুক্তিগুলো কেউ জানতেই পারল না। ১৯৩৪ থেকে শুরু করে ১৯৮৭ পর্যন্ত প্রায় ৫০ বছর এই ছিল আসল পরিস্থিতি।

গণমাধ্যম দুনিয়ায় হার্স্টের সাম্রাজ্য Ñ ১৯৯৮ সালের পরিস্থিতি১৯৫১ সালে ক্যালিফোর্নিয়ার বেভারলি হিলসে তার নিজের বাড়িতেই স্ট্যালিনবিরোধী মিথ্যার একনিষ্ঠ প্রচারক উইলিয়াম হার্স্টের মৃত্যু ঘটে। কিন্তু তিনি রেখে যান এক বিশাল গণমাধ্যম সাম্রাজ্য, যার আধিপত্য আজও সারা বিশ্বজুড়ে বজায় রয়েছে। আজও তারা নানা প্রতিক্রিয়াশীল সংবাদ সরবরাহ করে চলেছে। আজকের বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তর এন্টারপ্রাইজ হল হার্স্ট কর্পোরেশন যার অধীনে রয়েছে ১০০টি কোম্পানি। ১৫ হাজারের বেশী কর্মী সেখানে কাজ করে। অসংখ্য ম্যাগাজিন, রেডিও, টিভি, কেব্ল টিভি, নিউজ এজেন্সি, বই ও মাল্টিমিডিয়া আজ তাদের মালিকানায় প্রকাশিত ও প্রচারিত হয়।

চলবে............


মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

লেখকের কাছে প্রশ্ন পশ্চিমা কি শুধু সমাজতন্ত্র বিরোধীতা করার জন্যই স্ট্যালিনের বিরুদ্ধে এই অপপ্রচারে লিপ্ত হয়েছিল?

অতিথি লেখক এর ছবি

I just wanted to know whther this writer ever visited any ex-USSR republics or did he really read Soviet archives? I am afraid not, 'cause his words could be different if he really knew the fact. I am not at all supporter of western politics. But Soljenitsin's Gulag stories are not fairy tales, those were real happeings.

I am living in Ukraine since 1982, so know thing's inside stories.

বিপ্লব পাল এর ছবি

কিছু কিছু অঞ্চলে এই সময় শস্যের ফলনও খানিকটা কম হয়েছিল। কিন্তু তা এত কম নয় যার জন্য খাদ্যাভাবে মানুষের মৃত্যু ঘটতে পারে।

>>>
ভুল। উৎপাদন যা কমেছিল তাতে দুর্ভিক্ষ হয় না। দুর্ভিক্ষ হয়েছে, কারন কৃষকদের খাবার আন্তর্জাত্তিক মার্কেটে বেচে স্তালিন শিল্প যন্ত্রপাতি কিনছিলেন। এরা শিল্পায়নের বলি।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।