ফেলানন্দ

নীড় সন্ধানী এর ছবি
লিখেছেন নীড় সন্ধানী (তারিখ: বিষ্যুদ, ১৯/০৩/২০০৯ - ৯:৪৫পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

'ফেলানন্দ' বলে কোন শব্দ বাংলা অভিধানে আছে কিনা জানা নেই। ব্যাপারটা সোনার পাথর বাটি ধরনের। পরীক্ষায় ফেল করে এক দঙ্গল ছোকরা আনন্দে ঘুরে বেড়াচ্ছে এরকম দৃশ্য খুব বাস্তব নয়। কিন্তু সেরকম একটা বিরল ঘটনার অংশীদার হয়েছিলাম ১৯৮৬ সালে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষার পর। এলাকার ১৫ জন পরীক্ষার্থী বন্ধুর প্রত্যেকের কোন না কোন পরীক্ষা খুব খারাপ হয়েছিল। সবগুলো পরীক্ষা ভালো হয়েছে এরকম একজনও ছিল না। পত্রিকায় রেজাল্ট প্রকাশের আগের দিন টুটুল খবর দিল আজ বিকেলে সিটি কলেজের নোটিশবোর্ডে ফলাফল টাঙানো হবে। দুজনেরই ম্যাথ পরীক্ষা চরম খারাপ হয়েছে। অতীব দয়ালু টিচার হলেও বড়জোর বিশ-বাইশ দিতে পারবে। তেত্রিশ ওঠার কোন সম্ভাবনাই নেই। বাকীদের অবস্থাও নানান বিষয়ে একই। কেউ ফিজিক্সে, কেউ কেমিষ্ট্রিতে, কেউ ম্যাথে।

টুটুল বললো -'কুছ পরোয়া নেহি - মনটা শক্ত কর। পরাজয়ে ডরে না বীর। ষ্টেশান রোডে নতুন 'ক্লিফটন' নামে একটা এসি রেষ্টুরেন্ট খুলছে । বিশাল মজার বিরানী। রেজাল্টে নাম না থাকলে আজকে ওইখানে রাতের দাওয়াত আমাদের।' কয় কী হারামজাদা। বিরানী দিয়ে ফেল উদযাপন? আমি অবাক হয়েও চমৎকৃত হলাম ওর বুদ্ধিতে। টুটুল বরাবরই রসিক। সৈয়দ মুজতবা আলীর সব রস কাহিনী ওর মুখস্থ। আশ্বস্ত হলাম।

ফেলানন্দের আধ্যাত্মিক যুক্তিও বের করা গেলো। পাশ-ফেল সব আল্লাহর ইচ্ছা। ফেল নিয়ে মন খারাপ করে আল্লার ইচ্ছার বিরোধিতা করবো নাকি? দুজনে পঞ্চাশ-পঞ্চাশ একশো টাকা পকেটে নিয়ে সন্ধ্যার মুখে কলেজে গেলাম। প্রচন্ড ভীড়। উঁকি ঝুঁকি মেরে যা বোঝার বুঝে গেলাম। থার্ড ক্লাস থেকে দেখা শুরু করে সেকেন্ড ক্লাস পর্যন্ত হালকা চোখ ঘুরিয়ে বের হয়ে এলাম। নেই। থাকলেই অবাক হতাম।

মন খারাপের ধার দিয়েও গেলাম না। সোজা হন্টন দিলাম ক্লিফটন পানে। তৃপ্তির সাথে পেটপুরে চিকেন বিরিয়ানী খেয়ে বোরহানির ঝাঁঝ ঢেকুর তুলতে তুলতে বাসায় ফিরলাম রাত নটার দিকে। মাকে বললাম- দাওয়াত ছিল, খেয়ে এসেছি। রেজাল্ট বিষয়ে টুঁ-শব্দ করলাম না। রাত দশটার দিকে বন্ধুদের আনাগোনা বাড়তে লাগলো। ছাদে বসে ফিসফাস করতে করতে যতটুকু জানলাম পারভেজ বাদে পাড়ায় আর কেউ সরস্বতীর আশীর্বাদ পায়নি।

সমবেত বন্ধুদের বিমর্ষভাব লক্ষ্য করে টুটুল আর আমি ঝেড়ে কাশলাম। সমাবেশকে আমাদের ফেল পরবর্তী বিরিয়ানী ভোজনের সংবাদ দিলাম। শুনে ফেলটু সমাজ যেন প্রান ফিরে পেল। তাই তো? পাশ-ফেল আল্লাহর ইচ্ছা। আমরা কী তার চেয়ে বেশী বুঝি। আল্লা যা করছে, ভালোর জন্যই করছে। একজন বললো- 'চল কাপ্তাই যাই কাল সকালে'। দি আইডিয়া- সাথে সাথে পরিকল্পনা হলো আগামীকাল সম্মিলিতভাবে ফেল উদযাপন করা হবে। কেউ দ্বিমত করলো না। কারন শহরের বাইরে কোথাও চলে গেলে অভিভাবক সমাজের কোপদৃষ্টি থেকেও রক্ষা পাওয়া যাবে।

পরদিন ভোরে ব্যস্ত হয়ে রওনা দিচ্ছি এমন সময় হকার পত্রিকা দিয়ে গেলো। প্রথম পাতায় ষ্ট্যান্ড করা নাদান ছেলেমেয়েদের হাসিখুশী মুখ, আমার ভেতরে কেমন গুড়গুড় করে উঠলো, অরুচি লাগলো তাকাতে। নিতান্ত অবহেলায় পত্রিকাটা সোফার তলায় ছুঁড়ে দিয়ে বেরিয়ে গেলাম। বাবা তখনো ঘুমে - মাকে বলেছি পিকনিকে যাচ্ছি।

সারাদিন কাপ্তাই লেকে নৌকা নিয়ে ঘোরাঘুরি, পানিতে দাপাদাপি, রামের পাহাড়, সীতার ঘাট সবকিছু ঘুরে শিলছড়ি বাজারে এসে দুপুরের খাবার খেলাম শেষ বিকেলে। আহা কী স্বাধীনতা, কী আনন্দ। উচ্ছ্বাসের তোড় এত বেশী ছিল যে সীতার ঘাটে গোসল করার সময় সাঁতার না জানা আমি ঘাটের পাথরে পিছলা খেয়ে লেকের পানিতে পড়ে গেছি সেটা বুঝতে সবার মিনিট খানেক লেগেছিল। আমার মরন চিৎকারে মাঝি তৎক্ষনাৎ ঝাঁপিয়ে পড়ে আমাকে উদ্ধার করে। ভাগ্যিস টের পেয়েছিল নইলে ভবলীলা ওখানেই সাঙ্গ হতো। সেই মাঝির কাছে আমি আজীবন ঋনী।

বিকেলের ফিরতি বাসে শহরমুখী যাত্রায়ও আনন্দের কমতি নেই পিকনিক ফেরত তরুন দলের। বাস থেকে নেমে রিকশায় ওঠার পরই আসল চিন্তা শুরু হলো। এলাকায় ইতিমধ্যে শোকের বন্যা বয়ে যাবার কথা। কলিজায় দুরু দুরু কম্পন। বাবার রাগী চেহারাটা কল্পনা করলাম।

বাসায় ঢুকতেই মা বললো - 'আজ তো রেজাল্ট দিছে।'
আমি আজলের মতো বললাম- 'তাই নাকি, কই দেখি?'
মা বললো - 'কী দেখবি, নেই তো।'
আমি যেন অবাক - 'নেই মানে?'
মা বললো - 'তোর রোল নেই।'
আমি আরো আজীব হলাম- 'মা তুমি এসব কী বলছো?'
মা মন খারাপ করে বললো - 'তোর নাম তো ওঠে নাই পেপারে। কী করে যে এমন হলো?'

শুনে আমি চেহারায় তীব্র হতাশা ও ক্রন্দনপূর্ন বিমর্ষভাব ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করলাম। কতটা পারলাম জানি না। কিন্তু মায়ের মন যে তাতে গলে গেল টের পেলাম পরবর্তী সংলাপে।
- 'মন খারাপ করিস না, বাবা। আরো কত ছেলেই তো ফেল করেছে। তুই একা না। তোর বাবা রাগ করেছে কিন্তু আমি তাকে বুঝিয়েছি। তুই আরো মন দিয়ে পড়, পরীক্ষা দিবি আবার।'

বাবাকে ম্যানেজ করা গেছে শুনে আমার বুকের ভেতর থেকে একটা বটগাছ নেমে গেল। পলিথিনের বালিমাখা ভেজা কাপড়গুলো খাটের নীচে চালান করে দিয়ে বাথরুমে ঢুকে গেলাম।

পরদিন বিকেলে টুটুলকে নিয়ে একমাত্র পাশবন্ধু পারভেজের বাসায় গেলাম। ওর মা জানে না আমরা সবাই জামাতের সাথে ফেল করেছি। খালাম্মা আমাদের মিষ্টি খাইয়ে জানতে চাইলঃ
-'তোমাদের কী খবর বাবা?'
-'জী খালাম্মা মোটামুটি।'
-'রেজাল্ট কী?'
-'ভালো না।'
-'ফেল?'
-'না না ফেল হবে কেন, এই থার্ড আর কি।' খুব লজ্জায় কোনমতে বলতে পারলাম।

কিন্তু ওখান থেকে বেরিয়ে টুটুল আমার উপর হুপপা গরম।
-'গাধা!!!, তুই থার্ডক্লাস বললি কেন? মিথ্যে যখন বললি সেকেন্ডই বলতি। থার্ড তো ফেলের চাইতেও খারাপ। অনেকে ফার্স্ট ক্লাস মার্কস পেয়েও ফেল করে। কিন্তু থার্ডক্লাস তো জন্ম গাধা। তুই ডোবালি, খালাম্মার কাছে ইজ্জত রইলো না।'

ইজ্জত মারা যাবার ব্যাপারটা বুঝে আমি চুপ। চির হাঁটুবুদ্ধির আমি আসলে মিথ্যাটা হালকা করতে গিয়েই গুবলেট করে ফেলেছিলাম। ভেবেছিলাম থার্ড ক্লাসের পরেই ফেলের অবস্থান। সেকেন্ড বললে মিথ্যাটা একটু কঠিনই হয়ে যায় কিনা!

একটা দারুন শিক্ষা হলো। কোন কোন ফেল থার্ড ক্লাসের চেয়েও সম্মানজনক।

নীড় সন্ধানী

১৯ মার্চ ২০০৯


মন্তব্য

সুহান রিজওয়ান এর ছবি

মজাক পাইলাম...

মৃদুল আহমেদ এর ছবি

এই বিষয়ে আমার বিরল এক্সপেরিয়েন্স আছে... বলব আরেকদিন।
আপনার লেখা খুবই চমৎকার লেগেছে। পরের বছর কী হল, সেটা বললেন না?
---------------------------------------------
আমাকে ছুঁয়ো না শিশু... এই ফুল-পাখি-গান সবই মিথ্যা!

--------------------------------------------------------------------------------------------
বললুম, 'আমার মনের সব কপাট খোলা ভোজরাজজী। আমি হাঁচি-টিকটিকি-ভূত-প্রেত-দত্যি-দানো-বেদবেদান্ত-আইনস্টাইন-ফাইনস্টাইন সব মানি!'

নীড় সন্ধানী [অতিথি] এর ছবি

পরের বছর তো কঠিন পাশ দিয়ে কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ে, কেউ সেনাবাহিনীতে(টুটুল, যে কদিন আগে বিডিআর যজ্ঞ থেকে প্রানে বেঁচেছে), কেউবা পিতার কারনিক, কেউ পড়া ছেড়ে দিয়ে কবি (শহীদ, যার বোধোদয় হয়েছে জগতে বড় হতে হলে প্রাতিষ্ঠানিক পড়ালেখার দরকার নাই। কাজী নজরুল ও সৈয়দ হক তাঁর আদর্শ)।

আপনারটা কখন আসছে, অপেক্ষায় থাকলাম।

ক্লান্ত পথিক [অতিথি] এর ছবি

পরের বছরের ঘটনা শুনতে মন চায়..................

নীড় সন্ধানী [অতিথি] এর ছবি

পরের বছর ষ্ট্যান্ড করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে মুরব্বীদের দোয়া চেয়েছিলাম।
দোয়া ঠিকমতো পড়ে নাই, তাই সেকেন্ড কেলাস মন খারাপ

দেবোত্তম দাশ এর ছবি

জব্বর হইছে রে ভাই ।
------------------------------------------------------
স্বপ্নকে জিইয়ে রেখেছি বলেই আজো বেঁচে আছি

------------------------------------------------------
হারিয়ে যাওয়া স্বপ্ন’রা কি কখনো ফিরে আসে !

পান্থ রহমান রেজা এর ছবি

হো হো হো হো হো হো

নীড় সন্ধানী [অতিথি] এর ছবি

ভাইজান কি ফেলানন্দে হাসিতেছেন ?

পান্থ রহমান রেজা এর ছবি

ফেলানন্দে না,গল্পানন্দে। চোখ টিপি

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

হো হো হো
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

সুলতানা পারভীন শিমুল এর ছবি

জোস লাগলো আপনার জোশিলা গল্প পড়ে। দেঁতো হাসি

...........................

সংশোধনহীন স্বপ্ন দেখার স্বপ্ন দেখি একদিন

...........................

একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা

এস এম মাহবুব মুর্শেদ এর ছবি

মজা হইছে। এটা পড়ে আমার ফেলের গল্পগুলি লিখতে ইচ্ছা করতেছে।

====
চিত্ত থাকুক সমুন্নত, উচ্চ থাকুক শির

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

আপনাদের জীবনেও ফেল আছে?
আমি তো ভাবছিলাম ওগুলা সব আমার একলার সম্পত্তি...

আমার লেখাপড়ার ইতিহাস, ফেল তো দূরের কথা রুটিন না জানায় পরীক্ষাতেই অংশ না নেওয়া... এসব মূর্খতার গল্প তাহলে লেখা শুরু করবো?
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

এস এম মাহবুব মুর্শেদ এর ছবি

আছে। চিটাগাং কলেজিয়েট স্কুলে ঢোকার পর বায়োলজী পরীক্ষায় প্রথম পার্বিক পরীক্ষায় প্রথম এবং শেষ ফেইলটা করি। আমি ফেইল করতে পারি সেটা কখনো চিন্তায় ছিল না আমার। তবে আমার নাম্বারটা মনে তৃতীয় স্থানে ছিল। স্যারটাও ছিল চরম খাইস্টা। আমার সামনের দুইজনই মাত্র বায়োলজীতে পাশ করেছিল সেবার। তবে চরম শিক্ষা হয়েছিল সেবার। বিজ্ঞান আর গণিত কখনও পরীক্ষার আগে পড়তে বসতাম না তার আগে। এর পরই ভর্তি হলাম গিয়ে শামসুদ্দীন মতিন স্যারের কাছে।

====
চিত্ত থাকুক সমুন্নত, উচ্চ থাকুক শির

নীড় সন্ধানী [অতিথি] এর ছবি

জলদি লিখে ফেলেন। ফেলটুস সঙ্গীসাথী দুএকজন পাইলে ভালো লাগে। কলেজিয়েটে কোন বছর আপনি? আমার প্র্যাকটিক্যাল ছিল কলেজিয়েটে এসএসসি'র সময়।

নিবিড় এর ছবি

মজা পাইলাম


মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড় ।

লীনা ফেরদৌস এর ছবি

Lina Fardows

দারুণ লাগল পাশ ফেলের গল্প

Lina Fardows

অনিন্দিতা এর ছবি

এত মজার পাশ ফেলের গল্প আর শুনিনি।

তানবীরা এর ছবি

বিরিয়ানী খাওয়াও আল্লাহর ইচ্ছা, খতনা থেকে চল্লিশা সব কারনেই তা খাওয়া যায় ঃ-}। লেখা জোশ হয়েছে।

তানবীরা
---------------------------------------------------------
চাই না কিছুই কিন্তু পেলে ভালো লাগে

*******************************************
পদে পদে ভুলভ্রান্তি অথচ জীবন তারচেয়ে বড় ঢের ঢের বড়

সংসারে এক সন্ন্যাসী এর ছবি

দুঃখ কেন ফেলে?
বরং
দুঃখকে দিন ফেলে! চোখ টিপি

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
যৌনদুর্বলতায় ভুগছি দীর্ঘকাল। দুর্বল হয়ে পড়ি রূপময়ী নারী দেখলেই...

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
টাকা দিয়ে যা কেনা যায় না, তার পেছনেই সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয় কেনু, কেনু, কেনু? চিন্তিত

অতিথি লেখক এর ছবি

চির হাঁটুবুদ্ধির আমি আসলে মিথ্যাটা হালকা করতে গিয়েই গুবলেট করে ফেলেছিলাম। ভেবেছিলাম থার্ড ক্লাসের পরেই ফেলের অবস্থান। সেকেন্ড বললে মিথ্যাটা একটু কঠিনই হয়ে যায় কিনা!
হাসি :)

ভালই লাগল।

অতিথি

অতন্দ্র প্রহরী এর ছবি

হা হা। খুব মজা লাগল।

s-s এর ছবি

চলুক

আদৌ কি পরিপাটি হয় কোনো ক্লেদ?ঋণ শুধু শরীরেরই, মন ঋণহীন??

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।