প্রকৃতি যখন অসময়ে ডেকেছিল

নীড় সন্ধানী এর ছবি
লিখেছেন নীড় সন্ধানী (তারিখ: মঙ্গল, ২৪/০৩/২০০৯ - ১০:০০পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

১. গ্রামে

খুব ছেলেবেলা- আট কি নয় বছর বয়স। নানাবাড়ীতে গিয়েছি শীতের ছুটিতে। নানাবাড়ীর টয়লেটটা ছিল বাড়ী থেকে একটু দুরে জংলামতো নির্জন জায়গায়। তখন নানাবাড়ীর টয়লেট ছিল কাঁচা। বাঁশের বেড়ায় ঘেরা, আকাশ দেখা যেতো। নীচে বিশালাকার গর্তের ভেতর জমা হতো মানববর্জ্য। মঞ্চের মতো উঁচু জায়গায় দুটো তক্তার উপর দুই পা দিয়ে বসতে হতো। দুই তক্তার মাঝখানে ফুটো, সেটা দিয়ে নিক্ষেপিত হতো মানববর্জ্য। সেদিন প্রকৃতির আকস্মিক ডাকে ছুটে গেলাম সেই টয়লেটে। প্রয়োজনের তীব্রতায় দ্রুততম বেগে মঞ্চে আসীন হবার সাথে সাথে বিধাতার কোন অমোঘ নির্দেশে মঞ্চের একটা তক্তা ভেঙ্গে আমাকে সোজা নীচের বর্জ্যসাগরে নিক্ষেপ করলো। কোমর পর্যন্ত ডুবে গেল আমার। শহুরে টয়লেটে অভ্যস্ত আমি ভাগ্যের এ হেন ন্যাক্কারজনক কান্ডে নিশ্চল হয়ে গেলাম কয়েক সেকেন্ডের জন্য। সারা শরীরে মাখামাখি ঘৃনিত থকথকে মানব বর্জ্য। নিজে নিজে গর্ত থেকে উঠে আসার চেষ্টা করলাম, কিন্তু পা দুটো যেন আটকে গেছে তলার কাদায়। লাজলজ্জা ভুলে বাধ্য হয়ে চিৎকার দিলাম সাহায্যের আশায়। আমার চিৎকারে ছেলেপুলে দর্শকের ভীড় জমে গেল চারপাশে। দেখা গেল দর্শককুল আমার বিপদে যতটা না আলোড়িত, তার চেয়েও বেশী আমোদিন এই বিরল দৃশ্য দেখে। আরো দুর্ভাগ্য এই দুঃসময়ে আমাকে তোলার জন্য কেউ হাত বাড়ালো না। কারন যেই হাত আমাকে তুলবে সেই হাতে তরল গুয়ের মাখামাখি হবে। এতটা উদার হতে পারলো না কেউ। শেষে খবর পেয়ে মেজমামা এসে এক বালতি পানি ছুঁড়ে উপরাংশ থেকে বর্জ্যের খানিকটা সরিয়ে একটা লাঠি এগিয়ে দিলে, সেটা ধরে আমি বর্জ্য নরক থেকে উদ্ধার পেলাম। সেদিন আমাকে পরিষ্কার করতে কতটা ডেটল আর সাবান লেগেছিল সেকথা আর নাই বললাম।

২. ঢাকায়

যৌবনের শুরুতে একবার ঢাকায় বেড়াতে গিয়েছি খালার বাসায়। তখন কমলাপুর, মতিঝিল, মালিবাগ, শাহবাগ বাদে খুব বেশী জায়গা চিনি না । ফেরার আগের দিন কমলাপুর ষ্টেশানে টিকিট করতে গিয়ে হঠাৎ টের পেলাম প্রকৃতি ডাকছে। বড় কাজে অসময়ের ডাক, তবু আশ্বস্ত হলাম যে নিরাপদ জায়গায় আছি, এতবড় ষ্টেশানে নিশ্চয়ই টয়লেট থাকবে। কিন্তু খোঁজ খোঁজ করেও কোথাও টয়লেটের নিশানা পেলাম না প্ল্যাটফর্মে। সামনের রাস্তায় এলাম, আশে পাশে খুঁজলাম। কোথাও নেই। যেই কাজে ডাক পড়েছে, যেখানে সেখানে সারা যাবে না। কী মুশকিল! ঢাকা শহরে কি ঘরের বাইরে কেউ এই কাজ করে না? বাসায় গিয়ে সেরে আসতে পারি, কিন্তু খালার বাসা সেই শনির আখড়া, যেতে সময় লাগবে আধাঘন্টার বেশী। যেতে যেতে পথেই দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। বিকল্পের সন্ধানে এদিক ওদিক তাকালাম। তখন সামনের স্টপেজে মতিঝিল লেখা একটা পাবলিক বাস এসে দাঁড়াতেই কী জানি চিন্তা করে উঠে গেলাম। বাসটা ফাঁকা। ছাদের হ্যান্ডেল ধরে দাঁড়াতে কন্ডাকটর বললো -'ভাইজান বসেন সিট খালি আছে।' আমিও দেখলাম সিট খালি, তাও বসলাম না দেখে সে অবাক হলো। আসলে পশ্চাতদেশটা কোথাও ঠেকানোই রিস্কি মনে হচ্ছিল তখন। বাইরে তাকিয়ে দ্রুত ভাবছিলাম মতিঝিল কখন আসবে। মনে মনে একটা টার্গেটও সেট করেছি কোথায় কাজটা সারবো। বাস বায়তুল মোকাররম আসতেই লাফ দিয়ে নেমে গেলাম। পাশেই টিএন্ডটি অফিস, ওখানে একবার গিয়েছিলাম অনেক আগে। তাই জায়গা চিনি। দরকারী মানুষের মতো ঝাঁ করে ভবনে ঢুকে সোজা টয়লেটপুরীতে। জঘন্য বিশ্রী গন্ধযুক্ত নোংরা সমস্ত টয়লেটপুরী- বাট হু কেয়ারস। দরজা বন্ধ করেই বসে গেলাম এবং এবং প্রকৃতি ব্যাপক বজ্রপাত সহকারে আমাকে চিন্তামুক্ত করলো। কয়েক মিনিট পর পানির কলটা ছেড়ে সমাপনী পর্বের জন্য প্রস্তুত হলাম। কিন্তু কলের শব্দ শুনে আবছা আঁধারে খেয়াল করলাম সামনে বদনার বদলে একটা পুরোনো ডানোর টিন। ড্যাম কেয়ার আমি, ডানোর টিন হয়েছে তো কী হয়েছে- বিপদটা তো সারানো গেছে। এতেই চলবে আমার। কিন্তু ডানোর টিন ভরতে এত সময় নিচ্ছে কেন? হাতে তুলতে গিয়ে দেখি টিনের তলায় বিশাল ফুটো দিয়ে ঝরঝর করে সব পানি বেরিয়ে যাচ্ছে ফলে, কোন পানিই জমা থাকছে না টিনে। ছেলেবেলায় স্কুলে পড়া সেই চৌবাচ্চার অংকটা মনে পড়লো। এ কোন বিপদে পড়লাম মাবুদে এলাহি! একটা বিপদ সারাইছি এখন আরেকটা হাজির। এখানে কোন হেল্পও চাওয়া যাবে না। পকেটে খুচরা কয়টা বিশ পঞ্চাশ টাকার নোট আর ট্রেনের সদ্যকাটা টিকিট বাদে কিছুই নেই। টিকিট না টাকা কোনটা ব্যবহার করবো দ্বন্দ্বে পড়ে গেলাম। বাংলাদেশ রেলওয়ে না বাংলাদেশ ব্যাংক। শেষে বাংলাদেশ ব্যাংক জিতলো, রেলওয়ের টিকেট টয়লেটে গেল। যদিও টিকেটের দাম পকেটে থাকা সবগুলো টাকার যোগফলের চেয়ে বেশী ছিল, তবু ওটা টাকা এটা কাগজ।

৩. বিশ্ববিদ্যালয়ে

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মন ভোলানো ডিজাইনের নতুন ঝকঝকে লাইব্রেরী। এক দুপুরে বসে বসে পড়াশোনা করছিলাম এমন সময় ডাকটা এলো। আমি নিশ্চিন্তে হেলেদুলে টয়লেটের দিকে এগোলাম। চকচকে টাইলসে মোড়ানো বিদেশী ফিটিংসের টয়লেট। দেখেই মনটা ভরে যায়। রুচির প্রশংসা করি মনে মনে। দরজা বন্ধ করে বসতে যেতেই মনে হলো কী একটা যেন নেই বাথরুমে। বিদেশী ফিটিংস, টাইলস সব ঠিক আছে। কিন্তু কলের নীচে বদনা রাখার জায়গাটা খালি। অবস্থাটা সেই ঢাকার মতো সিরিয়াস না হলেও মেজাজটা খিঁচড়ে গেল। শালারা কোটি টাকা দিয়ে লাইব্রেরী বানাইছে আর দশটাকার একটা বদনা দিতে পারে নাই। বাসা থেকে বদনাও বয়ে আনতে হবে নাকি। অশ্রাব্য খিস্তি গজগজ করছে ভেতরে। এর একটা বিহিত করতে হবে। কাজ না সেরেই বেরিয়ে এলাম। এর কাছে ওর কাছে খোঁজ নিয়ে জানলাম, লাইব্রেরীয়ান স্যারের অনুমোদন লাগবে বদনা কিনতে। আমি সরাসরি গেলাম ওনার কাছে। বললাম, স্যার আমার একটা অভিযোগ আছে। স্যার না শুনেই বললেন, লিখিত দাও। আমি বললাম ঠিক আছে লিখে দেব, কিন্তু আমার কাছে কাগজ নেই। স্যার কাগজ দিতেই আমি অভিযোগ লিখে দিলাম। অভিযোগ পড়ে স্যার চোখ গোল গোল করে আমার দিকে তাকিয়ে সভয়ে বললো, 'এই ছেলে, তোমার কী বেশী সিরিয়াস, তুমি আমার টয়লেটে গিয়ে সারো, কোন অসুবিধা নাই।' আমি বললাম, 'স্যার শুধু আমার সারলে হবে না, আমি পুরো ছাত্রসমাজের পক্ষ থেকে বদনা চাই।' স্যার বললেন, 'আরে সবারটা পরে হবে আগে তোমারটা সামলাও।' আমাকে একরকম ঠেলে স্যার তাঁর বাথরুমে ঢুকিয়ে দিলেন। আমি আনন্দের সাথে কাজ সারতে সারতে ভাবতে লাগলাম, স্যার আমাকে এতটা সম্মান দেয়ার কারন কী, আমাকে কী নেতা নেতা লাগছিল? পরে বুঝলাম স্যার ভেবেছিল অবস্থা খুব সিরিয়াস আমার, দেরী করলে বোধহয় রুমের চেয়ার-টেয়ার নষ্ট করে ফেলবো। তাই তাড়াতাড়ি ধাক্কিয়ে নিজের টয়লেটে পাঠিয়েছিল।

৪. চলন্ত বাসে

রিপনের ঘটনাটা না বললে ইনিংসটা অসমাপ্ত থেকে যাবে। বন্ধু রিপন মোটা স্বাস্থ্যের জন্য বিখ্যাত ছিল। দেখতে হাবাগোবা হলেও মিচকা বুদ্ধির কমতি ছিল না। একবার বন্ধুদের সাথে নোয়াখালী থেকে বিয়ে খেয়ে ফিরছিল বাসে করে। কাঠের তৈরী পুরোনো আমলের লোকাল বাস। যাত্রা শুরুর ঘন্টাখানিকের মধ্যে বেরসিক প্রকৃতি রিপনকে ডাক দিল। কাজটা ছোট কিন্তু প্রয়োজনটা তীব্র। কন্ডাক্টরকে ঘটনা জানিয়ে বাসটা একটু সাইড করতে বলা হলো। কিন্তু ড্রাইভার ছিল ঘাড়ত্যাড়া। সে কিছুতেই থামবে না। ওদিকে গাড়ীর ঝাঁকুনিতে রিপনের প্রয়োজন আরো তীব্র হচ্ছিল। বেশ কিছুক্ষন ধৈর্য ধরার পর সে বেপরোয়া হয়ে কন্ডাক্টরকে বললো সে নেমেই যাবে। বাস থামলো। সে নেমে গেল। কিন্তু বাস ছাড়তেই বন্ধুরা দেখলো রিপন পেছনের বাম্পারে ঝুলে আছে। ঘটনা কেউ বুঝলো না প্রথমে। হঠাৎ একজন পেছনে উঁকি দিল- "ওই দ্যাখ দ্যাখ রিপইন্যা শালা কি করতাছে?" দেখলাম বদমাশটা ওখানে দাঁড়িয়ে একহাতে জিপার খুলে মহাসড়কে জলধারা বইয়ে দিয়ে হাত নাড়ছে সমগ্র বাংলাদেশের উদ্দেশ্য। এই বিরল দৃশ্য দেখার সৌভাগ্য আমাদের যেমন হয়েছে, তেমনি পেছনের গাড়ীর যাত্রীদেরও। আমরা হৈ হৈ করে ওঠাতে রিপন পেছনের জানালার ফোকড় দিয়ে বিদঘুটে ভঙ্গিতে হাসলো। তার মুখাবয়বের জিওগ্রাফিটা জানান দিচ্ছিল কতবড় মুসিবতের আসান হয়েছে।

নীড় সন্ধানী
২৪ মার্চ ২০০৯


মন্তব্য

বন্য রানা এর ছবি

ভাই, আপনার পোস্টটা পড়ে কিছু সময়ের জন্য বেশ নষ্টালজিক হয়ে গেছিলাম।
কতবার যে আমারও-----------

সুহান রিজওয়ান এর ছবি

ভালো লাগলো...।
বলতে নেই, এরকম অভিজ্ঞতা অন্য সবার মত কম-বেশী আমারও আছে...!!!

অতন্দ্র প্রহরী এর ছবি

হা হা হা। আপনার অভিজ্ঞতার ঝুলি তো দেখি সেইরকম! খাইছে

কীর্তিনাশা এর ছবি

নীড় সন্ধানী আপনি তো দেখি প্রকৃতির খুব প্রিয় পাত্র। যখন তখন ডেকে পাঠায় সে আপনাকে দেঁতো হাসি

-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।

-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।

নীড় সন্ধানী [অতিথি] এর ছবি

আপনি কইতে চান আপনেরে ডাকে না, এমনি এমনিই হয়া যায়!! দেঁতো হাসি

তাহমিনা এর ছবি

খুব হাসলাম, একেবারে হাসতে হাসতে গরাগরি!

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
When I'm right nobody remembers; when I'm wrong nobody forgets!

When I'm right nobody remembers; when I'm wrong nobody forgets!

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।