আজব খেলা 'লুডু'

তাহসিন আহমেদ গালিব এর ছবি
লিখেছেন তাহসিন আহমেদ গালিব [অতিথি] (তারিখ: রবি, ১২/০৪/২০০৯ - ১২:৩১পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

গেল কোরবানির ঈদের ছুটিতে গ্রামের বাড়ি গিয়েছিলাম বেড়াতে। গ্রামের নাম ইউসুফপুর। অনেকে মিলে ঠিক করি ঈদের পরের পরদিন সকালে রওনা দিব। যেমন কথা তেমন কাজ, যথাসময়ে গ্রামের বাড়ি রওনা দিলাম। সঙ্গী ছিল অনেকেই, যাদের মধ্যে কয়েকজন সমবয়সী চাচা, এছাড়া ফুফা-ফুফু আর ছিল কয়েকজন কাজিন।

গ্রামের বাড়ির টানে আমি সেখানে প্রায় প্রতিবছর-ই ঈদের ছুটি কাটাতে দলবলসহ রওনা দেই। সেবারও এর ভিন্নতা হয় নি। গ্রামের বাড়িতে ঈদের মৌসুমে অনেকেই ঢাকা থেকে ঈদ করতে আসে, তাই শুরু থেকেই সেখানে সীমাহীন আনন্দ করা হয়। ক্রিকেট খেলা অথবা পান খেলা দিয়ে সকালের শুরুটা হয় আমাদের। 'পান খেলা'র নাম হয়তো অনেকেই কখনো শুনেই নাই। এটা একটা আঞ্চলিক খেলা এবং বেশ মজাদার। খেলাধুলা পর্ব শেষে শুরু হয় 'ডাব পর্ব'। অতঃপর পুকুরে গোসল সেরে খাবার খেয়ে যার যার মত একটু ঘুমিয়ে বিকেলের আগেই হওনা দেই বাজারে। বাজারে হরেক রকম মিষ্টির দোকান, অপেক্ষা রাখে না আমরা সেখানে মিষ্টি, নিমকি, চা-বিড়ি খাই। সন্ধ্যায় বাড়িতে বসে তাসের আসর; গ্রাম-বাংলার অন্যতম প্রিয় খেলা 29। আমি এই খেলায় খুব একটা সুখ লাভ করি না। খেলোয়ার সংখ্যা বেশি থাকলে অন্য কাউকে বসিয়ে আমরা কয়েকজন কাজিন মিলে চোর-ডাকাত, গানের কলি ইত্যাদি খেলি। রাতে ঘুমাতে যাবার আগে পুকুরপাড়ে বসে লক্ষ লক্ষ তারাঁর আকাশে নিজের নাম লিখি, আর যদি আকাশে থাকে ফকফকা একখানা চাঁদ তবে তো কথাই নাই, এক একজন হয়ে যাই রবীন্দ্রনাথ-জীবনানন্দ।

গতবার যখন গ্রামে গিয়েছি আমরা বেশ বড় একটা দল ছিলাম, নয় জনের। জানতে পারি আমার ছোট ফুপি নাকি এবার গ্রামে ঈদ করতে এসেছে, তার শ্বশুর বাড়িতে। আমাদের কাছে এটা খুবই আনন্দের একটি সংবাদ ছিল কেননা, গ্রামে হলেও আমার ছোট ফুপির শ্বশুর বাড়ি ছিল উড়াধুরা অত্যাধুনিক। অত্যাধুনিকের কিছু নমুনা দেই যেমন, সেই বাসাটি একতলা বিশিষ্ট বিরাট এক বাড়ি। বাড়িতে মোট রুম সংখ্যা ১২টি। সন্ধ্যার পর বাড়ির চারপাশে জ্বলে উঠে ৮টি নিয়ন বাতি। এক ধরণের কাঠের পুল দিয়ে সেই বাড়িটিতে যাওয়া লাগে এবং বাড়িটি দ্বীপ সদৃশ। অনেকগুলো বাথরুমেই রয়েছে গোসলের জন্য বাথটাব। এছাড়া পোষা কুকুর জার্মান সেফার্ডটি তো ছিল মূল আকর্ষন। বড় দুই ভাইয়ের নির্দেশে আমার ছোট ফুফা অসাধারণ ডিজাইনে বাড়িটি নির্মাণ করিয়েছেন। যাই হোক, সেই বাড়িতেই যখন আমাদের নিমন্ত্রণ করা হয় আমরা সকাল সকালই রওনা দিয়ে দেই। গ্রামের নাম প্রজাপতি। আমাদের গ্রাম থেকে দুইবার রিক্সা বদল করে যেতে হয়। মোট ভাড়া ১৫+৩০ টাকা। চারপাশে বাড়িঘর খুব একটা নেই। বড় রাস্তাটা পার হয়ে একটা ছোট পাঁকা রাস্তা ধরে কিছুটা গেলেই ছোট ফুফার বাড়ি। বাড়ির নাম 'সাদা বাড়ি'। সেখানে খুব আনন্দময় কিছু সময় আমরা প্রত্যেকে কাটিয়ে এসেছি এতে কোন সন্দেহ নাই।

এবার গ্রামে যাবার পর থেকেই সবার মাঝে নতুন কোন খেলা খেলার জন্য এক ধরণের অস্থিরতা দেখা যাচ্ছিল। আমি ছিলাম মূল ভাবনায়। প্রত্যেকবারের পান খেলা, লুডু, চোর পুলিশ-এসবে আর আগের মত আগ্রহ পাচ্ছিল না কেউ। তাছাড়া আমরা এখন আর ছোট নেই, ওসব লুডু কিংবা চোর-ডাকাত নাকি ছোটদের খেলা! তাই ঠিক করি এবার আর ছোটদের খেলা খেলবো না। কিন্তু ভাবলেই তো হবে না, সময় কাটানোর জন্য কিছু তো একটা করা চাই...কি করি, কি করি। আমি প্রস্তাব করি, "নতুন এক খেলা আবিষ্কার করা হোক, পুরান খেলা বহুত খেলেছি"। সবাই যার যার মত চিন্তা করতে থাকি। একজন বলে উঠে "র‌্যাব-জেএমবি" খেলা খেলবে যার নিয়মটা হুবুহু চোর-পুলিশ এর মতই, নামটা ভিন্ন এই যা। কিন্তু কেউ আর রাজি হই না, কেননা সবার-ই এক কথা নতুন কিছু চাই। একজন বললো, পলান্তিস খেলবে অর্থাৎ পলানটুকটুক খেলা। বাহিরে ঠান্ডা থাকায় সেটার প্রতিও আর কারও আগ্রহ দেখি না। সবশেষে আমি ঠিক করি যে লুডু-ই খেলা হবে কিন্তু এটা ঠিক লুডু খেলা না, আমি খেলাটার নাম দেই "twenty-20 LUDU"।

খেলার নিয়মঃ
লুডু খেলার যে পাশে সাপ-এর বোর্ড আছে সে পাশেই মূলত খেলাটা খেলতে হবে। খেলায় ৪ জন বা ততোধিক খেলোয়ার অংশ নিতে পারবে। ছক্কায় ১ উঠলে একজন খেলোয়ার খেলায় তার গুটি চালা শুরু করতে পারবে, ছয় উঠলে কোন দান নাই। যেহেতু "twenty-20 LUDU" খেলায় আলাদা কোন বোর্ড নেই তাই ৫০ ঘর পর্যন্ত মোট ঘর ধরে নিয়ে প্রচলিত বোর্ডেই খেলা খেলতে হবে। ৫০ ঘরের মধ্যে যেসব সাপ বা মই আছে সেগুলা যথারীতি কার্যকর থাকবে। যে প্রতিযোগী সবার আগে ৫০তম ঘরে তার গুটি পৌছাতে পারবে সেই "twenty-20 LUDU" খেলার বিজয়ী হবে।

ছোট ফুপির বাসাতেই আমরা প্রথম আমার আবিষ্কৃত খেলা "twenty-20 LUDU" খেলার বিশ্বকাপ এর আয়োজন করি। প্রথম অবস্থায় মোট খেলোয়ার থাকে ৯জন। খেলায় যে হারবে সেই বাদ, এই নিয়মে সেদিনের বিশ্বকাপ খেলা এগিয়ে যায়। ফাইনালে উঠি আমি আর শহীদুল জহির কাকা। কেবলমাত্র ফাইনালের দুই প্রতিদ্বন্দ্বীর মধ্যে ৫টি ম্যাচের আয়োজন করা হয় যার সবগুলো ম্যাচে আমি জয়ী হয়ে ৫-০ তে এদেশের প্রথম অনুষ্ঠিত "twenty-20 LUDU" খেলায় বিশ্বকাপ অর্জন করি। এ উপলক্ষে সেদিন ছোট ফুফার নেতৃত্বে আমরা সবাই রাত ১টায় খিচুরী উৎসব করি। সবাই মিলে হাসি, গান আর আনন্দের জোয়ারে ভেসে চমৎকারভাবে সে বারের ঈদের ছুটি কাটাই।

তাহসিন গালিব


মন্তব্য

মূলত পাঠক এর ছবি

ভালো লাগলো ইউসুফপুর আর প্রজাপতি গ্রামের ছবির মতো বর্ণনা। আরেকটু বড়ো হলে আরো ভালো লাগতো।

অতিথি লেখক এর ছবি

ইদানিং খুব একটা সময় করে উঠতে পারছি না। পড়ালেখার ফাঁকে ফাঁকে সময় বের করে যতটুকু লিখি তাও দিনের বেশিরভাগ সময়-ই বিদ্যুৎথাকে না।

ভবিষ্যতে প্রজাপতি গ্রামের বর্ণনায় একটা কিছু লিখার ইচ্ছা আছে।
পাঠক ভাইয়া আপনাকে ধন্যবাদ।

(তাহসিন গালিব)

নীড় সন্ধানী [অতিথি] এর ছবি

কারো গ্রামের বাড়ী বেড়ানোর বর্ননা পড়লে মুহুর্তেই স্মৃতিকাতর হয়ে পড়ি। এবারও তার ব্যতিক্রম হলো না। ভালো লেগেছে আপনার বর্ননা।

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ আপনার মন্তব্যের জন্য। সাথে থাকুন।

মুশফিকা মুমু এর ছবি

দারুন মজা পেলাম তোমার ঈদের মজা শুনে হাসি প্রজাপতি নামটাই খুব সুন্দর হাসি আরো লিখো, তোমার ইনভেনটেড লুডুর খেলা শুনে আমার বানানো খেলা গুলিও লিখতে ইচ্ছা করছে, সেগুলো অবশ্য লুডুর না।
লেখা খুব ভাল লাগল! চলুক

------------------------------
পুষ্পবনে পুষ্প নাহি আছে অন্তরে ‍‍

অতিথি লেখক এর ছবি

তোমার ইনভেনটেড লুডুর খেলা শুনে আমার বানানো খেলা গুলিও লিখতে ইচ্ছা করছে, সেগুলো অবশ্য লুডুর না।

লেখা খুব ভাল লেগেছে শুনে খুব খুবই খুশি হলাম। আরও খুশি হব যদি আপনার বানানো খেলাগুলো আমাদেরকে জানান... কে জানে, আগামী ঈদে হয়তো আপনার বানানো খেলাটাই প্রজাপতি গ্রামে খেলা হবে (ইনশাআল্লাহ)। হাসি

মুস্তাফিজ এর ছবি

প্রজাপতি গ্রামের বট গাছটা দারুন

...........................
Every Picture Tells a Story

অতিথি লেখক এর ছবি

জ্বি, দারুন এবং অদ্ভূত!!
একটা পরিত্যাক্ত ভাঙ্গা মন্দিরের উপর গাছটি সটান দাঁড়িয়ে আছে।

কারুবাসনা এর ছবি

ভালো লাগলো।


----------------------
বিড়ালে ইঁদুরে হলে মিল, মুদির কিন্তু মুশকিল ।


----------------------
বিড়ালে ইঁদুরে হলে মিল, মুদির কিন্তু মুশকিল ।

অতিথি লেখক এর ছবি

থ্যাংক ইউ!

লুৎফুল আরেফীন এর ছবি

ভালো লাগলো গ্রামের বর্ণনা। আমরা আসলে শহরকে গ্রামে নিয়ে ভরতে পারলে অনেক বেশী আনন্দ পাই। সেটাও আবার টের পাওয়া গেল প্রজাপতি গ্রাম নিয়ে আপনার বর্ণনাতে।

ভালো থাকুন।
___________________________
বাংলাদেশ আমার বাংলাদেশ

অতিথি লেখক এর ছবি

এই শহরেই আমার জন্ম। তবুও আমি গ্রামকে যেভাবে স্মরণ করি অনেকেই সেভাবে করে না। আমার এতে কোন দুঃখবোধ নেই কিন্তু আমি তাদের উদ্দেশ্যে বলতে চাইঃ ''ভাই সময় সুযোগ করতে পারলে আপনার গ্রামটি একটু ঘুরে আসুন, নয়তো বেলা শেষে আপসোস করতে হলেও হতে পারে''

আপনার মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।

ধুসর গোধূলি এর ছবি

- লুডু খেলায় ওপেন চ্যালেঞ্জ। চুরিদারী সব এ্যালাউড, কিন্তু ধরা পড়লে জরিমানা। এই শর্তে খেইলাও জিইতা গেছি লুডুতে চুরি করে করে অভ্যস্ত আমার এক কাজিনের সাথে। আমি লুডু খেলতে বসলেই জিতি, কোনো অন্যথা নাই। হাসি

জার্মান শেফার্ডের কথা আর কইয়েন না মিয়া ভাই। দেখলেই অন্তরাত্মা শুকায়া কাঠ হয়া যায়। মন খারাপ
___________
চাপা মারা চলিবে
কিন্তু চাপায় মারা বিপজ্জনক

অতিথি লেখক এর ছবি

আমি লুডু খেলতে বসলেই জিতি, কোনো অন্যথা নাই।

তাইলে তো ভাই আমি আপনাকেই মনে মনে খুঁজি। আসেন একদান হয়ে যাক 'twenty-20 লুডু' হাসি

আর একখান জার্মান শেফার্ড থাকলে গ্রাম দেশে নাকি অতিথিও আসার আগে ১০ বার ভাবে... কেউ যদি অতিথি আপ্যায়নে সাশ্রয়ী হতে চান, জার্মান শেফার্ড কিনে ফেলুন একটা, কী আছে জীবনে!!

সুলতানা পারভীন শিমুল এর ছবি

আপনার লেখা ভালো লাগলো।
এই অদ্ভুত গাছটা কি সত্যি সত্যিই আছে ওখানে?

...........................

সংশোধনহীন স্বপ্ন দেখার স্বপ্ন দেখি একদিন

...........................

একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা

অতিথি লেখক এর ছবি

জ্বি, এই অদ্ভুত গাছটা সত্যি সত্যিই আছে ওখানে ।
আপনি ফটোগ্রাফার হলে চলে যেতে পারেন। খুব-ই জটিল একটা জায়গা।
গ্রাম- প্রজাপতি, থানা- সিধলাই(সম্ভবত), জেলা-কুমিল্লা।

বিপ্লব রহমান এর ছবি

ছবিটি খুবই সুন্দর। লেখাটি ভালো লাগলো। চলুক


একটা ঘাড় ভাঙা ঘোড়া, উঠে দাঁড়ালো
একটা পাখ ভাঙা পাখি, উড়াল দিলো...


একটা ঘাড় ভাঙা ঘোড়া, উঠে দাঁড়ালো
একটা পাখ ভাঙা পাখি, উড়াল দিলো...

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ...ধন্যবাদ...ধন্যবাদ !!

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।