সেন্টমার্টিন অভিযানঃ ১৯৯৪ (দ্বিতীয় পর্ব)

নীড় সন্ধানী এর ছবি
লিখেছেন নীড় সন্ধানী (তারিখ: সোম, ১৩/০৪/২০০৯ - ১১:১৭পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

প্রথম পর্ব

[তিনহাজার শব্দের পেটমোটা ২য় পর্বটা দুইদিন আগেই দিয়েছিলাম, সচল সার্ভারে লেখাটা পৌঁছেছে বা বদহজম হয়েছে কিনা জানিনা, ছোট আকারে আবারো দিলাম তাই।]

টেকনাফে বেপথু হাঁটা

টেকনাফ তো নামলাম। এবার? বাবলু ভাইরে কই পাই? শুরু হলো খোঁজ। অত সোজা না। মোবাইল যুগ হলে মাঝপথেই ফট করে মোবাইল করে দিতাম- "আমরা পেরায় আইসা পড়ছি ভাইজান, আপনে অ্যাটাচ বাথের তিনটা ডাবল রুম, ডিনারে সামান্য চিংড়ি ভুনার সাথে বেগুন ভর্তা আর কলিজার সাথে অল্প মগজের ঘুনঘুনি অর্ডার দিয়া দেন, রূপচান্দা মাছের ঝামেলায় যাবার দরকার নাই, আজ রুচি নাই, বেশী খেতে পারবো না। আইসা জাষ্ট বইসা পড়বো টেবিলে।"

কিন্তু সেই যুগে মোবাইল ছিল না। টিএন্ডটির ফোনও মেলা ভার। মোটকথা বাবলু ভাই জানেই না আমরা এসে পড়েছি। তাকে খুঁজতে একমাত্র ভরসা তাঁর ও তাঁর কোম্পানীর নাম। সমীর বলেছিল- টেকনাফ ছোট জায়গা, বাবলু ভাইকে এক নামে চেনে সবাই। জিজ্ঞেস করতে করতে এগিয়ে যাচ্ছি। এ পথ, সে পথ ঘুরতে ঘুরতে গ্রাম্য মেঠো পথে চলে এলাম। তবু বাবলু ভাইয়ের মৎস্য খামারের দেখা নেই। পরে জেনেছি এখানকার লোকজনের দুরত্বজ্ঞান আমাদের চেয়ে ভিন্ন। কেউ যদি বলে 'এই একটু সামনে', তাইলে বুঝতে হবে মাইলখানেক। কেউ যদি বলে - 'মাইলখানেক', তাহলে বুঝতে হবে মাইল পাঁচেকের কম না।

ইটের রাস্তাটা যেখানে শেষ সেখানে পৌছে সেখানে একজনকে জিজ্ঞেস করতে সে নির্দেশক আঙুলটা অসীমের দিকে তুলে ইঙ্গিত করলো দুর প্রান্তরের মাঝখানে টিমটিম করে জ্বলতে থাকা একটা বাতির দিকে। 'উই দেহা যাদ্দে ওন্ডে'(ওই দেখা যাচ্ছে ওখানে)। খোলা প্রান্তরে নেমে গেলাম সবাই। উপরে এক আকাশ ভর্তি তারার মেলা। কী স্পষ্ট একেকটা তারা। বিপুল এই মহাবিশ্বে যেন আমরা কজন ছাড়া আর কেউ যেন নেই। জনমানবহীন খোলা ময়দান। ঠান্ডা গা শির শির করা বাতাস। অদ্ভুত অনুভুতির দোলা দেহে মনে। কোথায় যাচ্ছি জানি না। এখানে কী বাবলু ভাই আছে? অচেনা একটা জায়গায় অনিশ্চিত গন্তব্যে হাঁটছি অথচ এটা নিয়ে কারো দুশ্চিন্তা নেই। জুনায়েদ তো রীতিমতো গান ধরেছে। ইকবাল এক কাঁধে ব্যাগ আরেক কাঁধে লাইফ জ্যাকেট নিয়ে হাঁটছে।

বাতিটা অত কাছে ছিল না। যেতে প্রায় দশ মিনিট লাগলো। অসমতল প্রান্তরে হোঁচট খেতে খেতে যখন বাতির কাছাকাছি পৌঁছালাম দেখলাম লাইন ধরে বেশ কয়েকটা বাঁশের তৈরী ঘর ওখানে। কোন সাইনবোর্ড নেই। এই কী সেই বাবলু ভাইয়ের আস্তানা? অবশেষে খুঁজে পেলাম? মনটা ফুরফুরা হয়ে উঠছিল। এক ঘন্টার মতো এলোপাথাড়ি হাঁটা হয়েছে। এবার বিশ্রাম নেয়া যাবে। যে ঘরটার সামনে বাতি জ্বলছিল তার কাছে গিয়ে সমীর 'বাবলু ভাই' বলে হাঁক দিল। ভেতর থেকে কোন সাড়াশব্দ নেই। আবারও ডাক। নাহ, কেউ সাড়া দিল না। দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। মানে ভেতরে লোক আছে, কিন্তু আওয়াজ দিচ্ছে না। আজব! হঠাৎ করে ভেতরে লাইট বন্ধ হয়ে গেল, ধুপধাপ শব্দ হলো, সম্ভবত পেছনের দরজা খুলে কেউ ছুটে বেরিয়ে গেল। আমরা ঘটনাটা বুঝলাম না। সবাই মুখ চাওয়া চাওয়ি করলাম। সমীরের পোষাক এবং চুলের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ সন্দেহ হলো, ভেতরের লোকটা ওকে বিডিআর মনে করেনি তো? সমীরের গায়ের খাকি জ্যাকেটটা দেখতে বিডিআরের পোষাকের মতো। ওর মাথার ছোট করে ছাঁটা চুল, লম্বা চওড়া শরীর দেখে সন্দেহ করতেই পারে। টেকনাফের নানা জায়গায় চোরাচালানী ভর্তি। ওই ব্যাটাও নিশ্চয়ই চোরাচালানী ছিল। ভেবেছে বিডিআর রেইড দিছে, সাথে সাথে ভেগেছে। চারপাশ ঘুরে বুঝলাম এটা মৎস্য খামার নয়। ভুল তথ্য ছিল।

এইবার আমরা পুরোপুরি দিশাহীন। ক্লান্ততে বসে পড়লাম একটা আলের উপর। এখানে তো আর আশা নেই। বাবলুভাইকে সারারাত খুঁজলেও পাওয়া যাবে না এভাবে। ভীষন বোকামি হয়ে গেছে। কলোনীতে একবার বাসা খুঁজতে এসে এক লোক ঠিকানা বলতে পারছিল না। শুধু নামটাই জানে। আমরা জিজ্ঞেস করলাম লোকটার অন্ততঃ একটা বৈশিষ্ট্য বলে যাতে চিনতে পারি। সে বললো, 'আগে লুঙ্গি পরতো, এখন প্যান্ট পরে।' দীর্ঘদিন ঘটনাটা কৌতুক হিসেবে ব্যবহার করেছি কলোনীর লোকজন। আজকে বাবলু ভাই অনুসন্ধানটা প্রায় সেরকমই হলো। আবার ফিরে যেতে হবে শহরে যেখান থেকে শুরু করেছি। তবে শেষবার চেষ্টা করে দেখা যাক।

আবারো বেপথু হাঁটা। এই বিশাল মাঠের কোথাও নিশ্চয়ই বাবলু ভাই থাকে। আশায় বুক বেধে কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে চারপাশে চোখ বুলাতে বুলাতে এগিয়ে চললাম ছয়জন। কিছুদুর গিয়ে আরেকটা খুপড়ি ঘর দেখা গেল। কেরোসিন কুপি জ্বলছে ভেতরে। বয়স্ক একজন ভাত রাঁধছিল, ফেন উঠা ভাতের সুবাসে আমাদের খিদেটা চাড়া দিল যেন। সমীরকে বললাম একটু দুরে থাকতে। নইলে এইলোকও ভেগে যেতে পারে। আমি এগিয়ে যথাসম্ভব এলাকাবান্ধব স্বরে খুবই ভদ্র ভাষায় জিজ্ঞেস করলাম বাবলু ভাইয়ের কথা। বুড়ো আমাদের সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখলো একনজর। আমি অভয় দিয়ে বোঝালাম আমরা কত বিপদগ্রস্থ। বাবলুভাই আমাদের কত আত্মীয়। তারপর বুড়ো বিড়বিড় করে যা বললো তার সারমর্ম হলো- সে বাবলু ভাইকে ভালো করেই চেনে। ডানপাশের খানিক দুরের খামারটায় বাবলু ভাই কাজ করে। তবে আজ সকালে বাবলু ভাইকে দেখেছে বার্মা যাওয়ার উদ্দেশ্যে নৌকায় উঠতে। তিনি কখনো দিনে দিনেও চলে আসে, কখনো আবার দু-তিনদিন থেকে আসে।

তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন তথ্য যেটা দিল সেটাই আমাদের এই নিশীথ রাতে বেপথু চলার হাত থেকে রক্ষা করলো। বাবলু ভাই রাতে এখানে থাকেন না। রাতে থাকেন টেকনাফ শহরের হোটেল নিরিবিলিতে।

[চলবে]

নীড় সন্ধানী
১১ এপ্রিল ২০০৯


মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

প্রথম পর্ব ভাল লেগেছিল। দ্বিতীটি পড়া শুরু করলাম...

তাহসিন গালিব

নীড় সন্ধানী [অতিথি] এর ছবি

ধন্যবাদ তাহসিন

মুস্তাফিজ এর ছবি

বাবলু ভাই রাতে এখানে থাকেন না। রাতে থাকেন টেকনাফ শহরের হোটেল নিরিবিলিতে

আহ্‌ এই কথাটার মত মধুর বানী মনে হয় সেই রাতে আর হতে পারতোনা।

...........................
Every Picture Tells a Story

নীড় সন্ধানী [অতিথি] এর ছবি

সে আর বলতে! বড় বাঁচা বেচে গিয়েছিলাম হাসি

নীড় সন্ধানী [অতিথি] এর ছবি

লেখাটা আরো বড় সাইজে দিতে পারলে পর্ব সংখ্যা কমানো যেত। কিন্তু সচল সার্ভারে বড় সাইজের পোষ্ট পৌছে না। প্রথমবার দিয়েছিলাম বড় সাইজে গত পরশু, সেটি হারিয়ে গেল। আজ আবার ছোট করে এটা দিলাম। এটি বাঁচল। সমস্যাটা ধরতে পারছি না। পোষ্টের ম্যাক্সিমাম সাইজ কত বড় হতে পারবে তার কোন নির্দেশিকা আছে কী?

কিংকর্তব্যবিমূঢ় এর ছবি

চমৎকার বর্ণনা চলুক
................................................................................................
খাদে নামতে আজ ভয় করে, নেই যে কেউ আর হাতটাকে ধরা ...

নীড় সন্ধানী [অতিথি] এর ছবি

ধন্যবাদ, কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থা হয়েছিল হাসি

পান্থ রহমান রেজা এর ছবি

যাক, বাবলু ভাইকে খোঁজার কষ্টের রাত তো শেষ হলো। এবার নিশ্চয় রূপচাঁদা মাছের সুস্বাদ আসবে! পরের পর্বে সেসবের অপেক্ষায়।

নীড় সন্ধানী [অতিথি] এর ছবি

শুধু রূপচাঁদা নয়, আরো বিচিত্র খবর আছে, সাথে থাকুন।

...অসমাপ্ত [অতিথি] এর ছবি

সে বললো, 'আগে লুঙ্গি পরতো, এখন প্যান্ট পরে।'

দেঁতো হাসি

....এ পর্ব পড়ার পরে পেটমোটা লেখাটার জন্য আফসোস হল। ...আরো একটু বড় হলে তো আরো একটুক্ষণ মজা করে পড়া যেত।

নীড় সন্ধানী [অতিথি] এর ছবি

কী করবো বলুন সচল সার্ভারের হেঁচকিতে পেটমোটা লেখাটা আদৌ পৌঁছাতেই পারেনি। পেটমোটা লেখা হয়তো তার অপছন্দ। মন খারাপ

কীর্তিনাশা এর ছবি

চমৎকার বর্ননা !

তৃতীয় পর্বের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় রইলাম হাসি

-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।

-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।

সুলতানা পারভীন শিমুল এর ছবি

একটা বৈশিষ্ট্য - 'আগে লুঙ্গি পরতো, এখন প্যান্ট পরে।' হো হো হো
সহজ-সাবলীল লেখা আপনার। ভালো লাগছে খুব।

...........................

সংশোধনহীন স্বপ্ন দেখার স্বপ্ন দেখি একদিন

...........................

একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা

সিরাত এর ছবি

হুম বেশ ন্যাচারাল লেখা। আরেকটু কনটেক্সট-সেনসিটিভ করেন আমাদের মত জেনারেল পাঠকদের জন্য। তবে এরকম দেশঘোরা লেখা আমার বড়ই প্রিয়!

নীড় সন্ধানী [অতিথি] এর ছবি

এই তো মুশকিলে ফেললেন। আমি তো 'কনটেক্সট-সেনসিটিভ' জিনিসটাই বুঝিনা। কলমের আগায় থুক্কু আঙুলের গুঁতায় কীবোর্ড দিয়ে যা বেরোয় সেটা বাদে আর কিছু বোঝার ক্ষমতাও নেই। কিন্তু শব্দ চয়নে মাঝে মাঝে দ্বিধায় পড়ে যাই। আপনি পড়েছেন জেনে আনন্দিত হলাম।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।