দাসভিদানিয়া

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: শুক্র, ০১/০৫/২০০৯ - ৬:২৯অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

সুরাজ ফার্মার অমর কলের দিনটা শুরু হয় টু-ডু লিস্ট দিয়ে। তাড়াতাড়ি মা'র কানে হিয়ারিঙ এইডটা শক্ত করে গুঁজে দিয়েই অফিসের জন্যে ছুট লাগায়।

এই অফিস, কলিগদের টীকাটিপ্পনী, আর বসের ধ্যাতানি - এই সব নিয়েই বেশ চলছিল। সেই সাথে রোজকার লিস্টি তো ছিলই, আজকে গিজার সারাও, তো কালকে হিয়ারিঙ এইডের ব্যাটারি বদলাও।

অনেক বলেকয়ে বসের পারমিশন নিয়ে আজ অফিস থেকে একটু তাড়াতাড়িই বেরোয় অমর। ডাক্তারবাবুর সাথে অ্যাপো আছে।

নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারেনা। ভাবে ডাক্তারবাবু তার সঙ্গে মজা করছেন। তার তো সবে সাঁইতিরিশ কমপ্লিট হয়েছে। কি করে পেটের ক্যান্সার হতে পারে এই বয়সে?

মনের দু:খ ভুলতে একটা বারে মদ খেতে ঢোকে অমর। সেখানে তার সাথে একটা অদ্ভূত লোকের পরিচয় হয়। সে মদ-সিগারেট খায়না, কোনোদিন মারামারি করেনি, নারীদোষও নেই - এসব সদগুণের ফিরিস্তি শুনে লোকটা হাসতে হাসতে মরে আর কি। দুর শালা! এমন নিরিমিষ্যি লাইফের চেয়ে তোর তো মরে যাওয়াই ভালো।

পরের দিন একটা মজার কান্ড হয়। লিস্ট বানাতে বানাতে খেয়ালই করেনি। অবিকল তার মতো দেখতে একটা লোক কখন তার ঘরে এসে ঢুকেছে। নাটকীয় ভঙ্গিতে জানায় সে তারই বিবেক। আরো বলে, হাতে তো মাত্তর তিন মাস সময়, মরার আগে কি কি করতে চাস তার ফর্দ বানা বরং।

প্রথমেই একটা নতুন কার চাই। ভাবে অমর। লোনের জন্যে অ্যাপ্লাই করে দেয় অফিসে। কিন্তু লোনটা রিজেক্ট হয়ে যায়। ভীষণ খেপে গিয়ে, বসের দিকে জুতো ছুঁড়ে নয়, তার মাথায় কোল্ড ড্রিঙ্কস ঢেলে দিয়ে এতোদিনকার সমস্ত অন্যায়ের প্রতিবাদ করে সে।

চাকরিটা চলে যায়। তবে গোল্ডেন হ্যান্ডশেকে যা পায় তা নতুন গাড়ি কেনার পক্ষে কাফি। হাজার হোক অ্যাকাউন্টস ম্যানেজার ছিল তো।

মনের আনন্দে ড্রাইভ করে অমর। পাশে ঐ শোরুমেরই সুন্দরী সেলস-এক্সিকিউটিভ। কিন্তু যখন সে গাড়ি থেকে নেমে তার বয়ফ্রেন্ডের বাইকে গিয়ে ওঠে, একটা দীর্ঘনি:শ্বাস ফেলা ছাড়া আর কিছুই করতে পারেনা। এমন অবস্থায় আবার বিবেকের আবির্ভাব ঘটে। তার ছোটোবেলার ক্রাশ নেহার কথা মনে করিয়ে দেয়।

এবার তার ছোটোবেলার স্বপ্নটা পূরণ করবে ঠিক করে অমর। স্যাভিও দারুণ গীটার বাজায়। তার কাছে স্ট্রামিঙের লেসন নিতে আরম্ভ করে। এদিকে তার টিচারের নিস আবার টেলিফোন কোম্পানিতে কাজ করে। তার সাহায্যেই নেহার ঠিকানাটা বের করে ফেলে।

নেহার একটা ফুটফুটে মেয়ে আছে। বর ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকার। ডিনার টেবিলে ডাম্ব শ্যারাড খেলতে খেলতে কোনোরকমে নিজের কান্নাটা চাপে অমর।

কয়েকটা দিন প্রচন্ড বিষণ্ণতার মধ্যে দিয়ে কাটে। নেহার দেওয়া ছোটোবেলায় তোলা একটা ব্ল্যাক্যানহোয়াইট ছবির ফ্রেমে হাত বুলিয়ে ভারমুক্ত হতে চায়। কিছু দিন পরে আবার অমর নেহার বাড়ি যায়, সেদিন, একদিন বৃষ্টিতে বিকেলে। একটু ভুল হলো, বিকেল না, সন্ধ্যে। আকাশ থেকে নেমে আসা জলের ফোঁটাগুলো তার গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়তে পড়তে দেখে, সে এতোদিন ধরে তার বুকে লুকিয়ে রাখা তিনটে শব্দ নেহাকে বলছে, মুখে শিশুর সারল্য। সেই একই সরলতা। টার্মিনালের নভরস্কিও বোধ হয় জানতো, খুব যখন কান্না পায় তখন বৃষ্টি গায়ে মেখে নিতে হয়, যাতে আর কেউ বুঝতে না পারে আমি কাঁদছি।

বুকের বোঝাটা একেবারে হালকা হয়ে যায় অমরের। তার লাঙ্গোটিয়া ইয়ারকে ফোন করে। ছোটোবেলার বুজুম ফ্রেন্ড রাজীবকে দেখতে থাইল্যান্ডে উড়ে যায়। আসলে এক ঢিলে দুই পাখি মারে। তার উইশলিস্টে ফরেন ট্রিপও ছিল যে। এবার রথ দেখা আর কলা বেচা দুটোই হবে।

বন্ধুর বাড়িতে এসে কয়েক ঘন্টাও হয়নি - এর মধ্যেই মনটা খারাপ হয়ে যায়। সুচিভাবীকে ঘরের ভেতর থেকে বলতে শোনে, সে কি ফ্রিতে ট্রিটমেন্ট করতে এসেছে? তার ওষুদপত্তর দেখে বন্ধুপত্নীর মনে এই সন্দেহটাই উঁকি দেয়। এদিকে তার ডাক্তারবন্ধু রাজীব তো ভীষণ রেগে যায় স্ত্রীর উদাসীনতা দেখে।

আপনমনে এরাস্তা সেরাস্তা দিয়ে হাঁটতে থাকে অমর। গলিঘুঁজি থেকে রাজপথ। এমন সময় রাশিয়ান রূপ কি রাণীর একটা দল তাকে ঘিরে ফেলে। একজন ইশারা করে জানায় রজনী এখনো তরুনী।

মাঝরাতে সানরাইজ সহ্য হয়না সবার। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে তাকে চলে যেতে বলে আমাদের অমরবাবু। উত্তেজনায় হাতের হটডগের কেচাপ ছিটকে গিয়ে লাগবি তো লাগ সেই উন্নত কাঞ্চনজঙ্ঘা যুগলে!

এতোবড়ো আস্পর্ধা? সবাই মিলে একটা সলিড পিটুনি দেয় যাওয়ার আগে। মেয়েদের হাতে মার খাওয়ার অপমান ভুলতে না পেরে জলে ঝাঁপ দিয়ে সুইসাইড করবে ঠিক করে অমর।

কিন্তু এতো তাড়াতাড়ি স্বর্গে যাওয়া তার ভাগ্যে নেই। ব্রীজের থেকে লাফিয়ে পড়ার আগের মুহূর্তে ঘাড়ে একটা হেঁচকা টান অনুভব করে। আবারও সেই রাশিয়ান রম্ভা!

তাতিয়ানা মেরা নাম। আকারে-ইঙ্গিতে ভাব বিনিময় হয় দুজন ভিনদেশীর। নিজের বাড়িতে গর্মাগরম খানা পরিবেশন করে হিরোইন এবার জানতে চায় অমরের বাড়ি কোথায়?

বম্বে! তার মানে তো বলিউড? এতোক্ষণ পরে নিজের চেনা একটা টপিক পেয়ে তাতিয়ানার খুশি আর ধরেনা। একটা গান চালিয়ে দিয়ে নাচতে থাকে। অমরের হাত ধরে টানাটানি করে যোগ দেওয়ার জন্যে। প্রথম দিকটা একটু লজ্জা লাগলেও আস্তে আস্তে মজা পেয়ে সেও নাচতে থাকে কিশোরদার সুরে, পল ভর কে লিয়ে কোই হামে পেয়ার কর লে, ঝুটা হি সহি!

এক আগ্রাসী চুম্বনের মাধ্যমে হিরোর কৌমার্যভঙ্গ হয় অবশেষে।

ট্রু লাভের ট্রেজার আইল্যান্ডে কয়েকটা দিন যেন কয়েক সেকেন্ডের মতো কেটে যায়। এদিকে রাজীবদম্পতি তো তার জন্যে উৎকন্ঠাকুল। অমর আশ্বস্ত করে তাদেরকে, সে বিন্দাস আছে, তার সাথে এও জানায় সে ফিরে যাচ্ছে।

তার ট্রিটমেন্টের সব অনুরোধ এক রসিকতায় উড়িয়ে দেয়। এয়ার্পোর্টে ফ্র্যাপোতে চুমুক দিতে দিতে বন্ধুর সাথে খুনসুটি করে, কিছু টাকা যেন কম মনে হচ্ছে ওয়ালেটে, ভাবী কি কিছু সরিয়েছে?

বম্বেতে ফিরে আসে অমর। সাথে লেড-জেপেলিনের টি। তাতিয়ানা গিফ্ট দিয়েছে। আর তাদের দুজনের একসাথে একটা ছবি। আরো একটা ফটো। যেটা শুধু সেই দেখতে পায়। যাওয়ার আগে হাত নেড়ে নিজের প্রেমকে বলছে, দা স্ভিদানিয়া, বিদায়।

দেশে ফিরে অমর তার ভাইয়ের সাথে যোগাযোগ করে। সে যখন তার কাছে মাকে নিয়ে রাখতে বলে, ভাই উল্টে প্রশ্ন করে দাদাকে, পরিবারের অমতে বিয়ে করে আলাদা হয়ে যাওয়ার সময় সে কেন তাকে সাপোর্ট করেনি। আর উপায় না দেখে অবশেষে নিজের মারণব্যাধির কথা অকপটে খুলে বলে অমর।

সেই কথা মা শুনতে পেয়ে যান ভাগ্যক্রমে। আরম্ভ হয়ে যায় বাবাথেরাপি। অমরের প্রাণ তো ওষ্ঠাগত। তবু তার মধ্যেই সে খুশি। সম্পর্কের অদৃশ্য দিওয়ারটা আজ আর নেই। অনেক দিনের জমানো মানঅভিমান তার গীটারে গান হয়ে যায়। পরিবারের সব সদস্যরা মেতে ওঠে অনুভবের আনন্দে।

অমর চলে যায়। ফেলে রেখে যায় অ-নে-ক কিছু। তার গীটারগুরুর জন্যে কার, বসের জন্যে গীটার, হোক না তা পুরনো - আর নেহার জন্যে ছোটোবেলার ফটো অ্যালবাম। বড়ো যত্নে এতোদিন আগলেছিল।

তাতিয়ানার জন্যে একটা বলিউড মুভির ডিভিডি রেখে যায়। রাজীব মেঘদূতের ভূমিকা পালন করবে। সেই সেলস-গার্লের কথাও ভোলেনা। তার জন্যে রেন্টে নিজের অ্যাপার্টমেন্টটা।

রাজীব অবশ্য কিছুই পায়না। কেন? ছোটোবেলা থেকে জীবনের প্রত্যেকটা জিনিসের বড়া হিস্যাটা তো অমর তাকে দিয়ে এসেছে।

আসলে মৃত্যুহীন প্রাণ হয়তো দান করা যায়, কিন্তু খোদ মরণের বেলায় কোনো ভাগবাঁটোয়ারা হয়না, করতে নেই।

নাইন আউট অব টেন। নট ব্যাড। বিড়বিড় করে রাজীব। পাশ থেকে অমরের ভাই তাকে শুধরে দেয় সেদিনের কাগজটা দেখিয়ে, অবিচুয়ারি বেরিয়েছে থার্ড পেজে, তার সর্বশেষ ইচ্ছে ছিল নিউজপেপারে ফটো বেরোবে ফ্রন্ট পেজে।

রাজীবের তর্জনী আর বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠের মাঝে ধরে থাকা পেনটা যখন অবলীলাক্রমে দশে দশ লিখে দেয় কাগজটাতে - ঠিক সেখান থেকে ছবির ক্রেডিটস আরম্ভ হয়। দেখতে দেখতে অন্যমনস্ক হয়ে যাই। রাশিয়ান হরফে নাম দেখানোর রহস্য এতোক্ষণে পরিষ্কার হয়। মনের মধ্যে একটু অপরাধবোধও হয়। নায়ক মরে গেলো, কই কষ্ট হচ্ছে না তো, কির'ম ট্র্যাজেডি ছবি এটা?

ভাবতে ভাবতে বুঝতে পারি আগাগোড়াই ভুল ছিলাম ভাবনায়। এটা তো একটা কমেডি, জীবনের ছবি, জীবনমুখী ছবি।

টেররিজম থেকে রিসেশনের বন্ধুর পথ পাড়ি দিতে গেলে একটা মণ্ত্র জানতে হয়, জাস্ট একটাই, কার্পে ডিয়েম।

( DASVIDANIYA by SHASHANT SHAH )

nick : potolbabu / পটলবাবু
emailid :


মন্তব্য

অনিন্দ্য রহমান এর ছবি

এই ছবিটা আমি দেখেছি। অসাধারণ লেগেছে। আপনার বর্ণনাটাও চমৎকার।


রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক

অতিথি লেখক এর ছবি

আমিও দেখলাম ছবিটা। খূব ভাল। বাংলায় পড়ে আরো ভাল লাগলো॥

তন্ময়

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

ইন্টারেস্টিং...

শাহেনশাহ সিমন [অতিথি] এর ছবি

দেখতে হবে

অতন্দ্র প্রহরী এর ছবি

হুমম, ইন্টারেস্টিং...

অতিথি লেখক এর ছবি

আপনাদের ছবিটা ভালো লেগেছে শুনে ভাল লাগলো । কিন্ত একটা ব্যতিক্রমী কথা না বলে থাকা গেলো না । ছবিটার গল্পটা ভালো কিন্ত নতুন নয় । এই ছবিতে অন্তত গোটা পাঁচেক বলিউডি হিন্দি ছবির মালমশলা রয়েছে । আর এর আগে অমরের চরিত্রে অভিনয় করা বিনয় পাঠক "ভেজা ফ্রাই" বলে আরেকটি ছবি করেন । তাতেও তার চরিত্রটা এরকমই একজন সাধারণ লোকের ছিল । এই পরিচালক সেই ছাপটা কাজে লাগাতে চেয়েছেন । এটা হিন্দি ছবির একটা নতুন ফর্মুলা ।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।