রাতভোর

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: মঙ্গল, ৩০/০৬/২০০৯ - ১০:৫১পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

মোমবাতিটা বাতাসের ঝাপটায় এক সময় নিভে যায়। জানালার খোলা শার্সিতে জমে থাকা ধুলো বৃষ্টির পানিতে গড়িয়ে পড়ে দেয়ালে। মসৃন কংক্রিটে অর্থহীন কিছু ছবি নেতিয়ে উঠে পুঁইয়ের ডগার মতো। একটা পিঁপড়ে বহুদূর হেঁটে এসে লেপের ওমে হারিয়ে যায়। আবার বাতাস ওঠে। কিছু গুটি আম বাতাসের ঝাপটায় আছড়ে পড়ে ঘরের মেঝেতে। তাদের গায়ের গন্ধে অন্ধকার বলগা হরিণ ছোটায়। পৃথিবী এসব কিছুই দেখছেনা। আরো গাঢ় কোনো অন্ধকার পৃথিবীর চোখে। ঝাঁক ঝাঁক দুরন্ত— বলগা হরিণ তার বুকের হাঁপরে রাতভর ঢিপ ঢিপ করে। পৃথিবী ঘুমোতে পারেনা। এ যেন পৃথিবী নয়, প্রাণশূণ্য একটা দেহ পড়ে আছে জীর্ণ বিছানায়। তবু, নিজেকে ফাঁকি দিয়ে সে একবার হেসে ওঠে । সুখের কোনো স্মৃতি মনে পড়লে মানুষ যেভাবে হাসে, সেভাবে নয়। এ হাসির মানে অন্যরকম। এ হাসি নিজেকে বিদ্রুপ করার মতোন। তিতির যেভাবে তাকে বিদ্রুপ করে, পৃথিবী যেন সেই একই ভাষায় নিজেকে বিদ্রুপ করছে। এও এক ধরণের মজা। কষ্টের অন্য একটি স্তর।

পৃথিবী কয়েকবার ভেবেছে সে মরে যাবে। কিন্তু জীবনকে কখন নিজের অজান্তেই সে ভালোবেসে ফেলেছে। জীবন আছে, তাই কষ্ট আছে। কষ্ট আছে, তাই তিতির আছে। পৃথিবী কিছুতেই বোঝেনা কষ্ট থাকলেও কেন তিতির থাকবে। একটা মানুষ সুখে-অসুখে দুই সময় কিভাবে থাকতে পারে? প্রচন্ড কষ্ট পেলেও বার বার কেন তাকে ভাবতে ভালোলাগে? নিজের ডানহাতটা দিয়ে সে চোখ কচলে নেয়। পায়ের কাছে পড়ে থাকা চাদরে নখ দিয়ে আঁচড় কাটে। সে ভাবতে চেষ্টা করে এখন তিতির কি করছে। পারেনা। তিতিতের মুখটাও মনে পড়ছেনা। বাতাসের ধাক্কায় বাঁ দিকের জানালাটা শব্দ করে বন্ধ হয়ে যায়।এতোক্ষণে পৃথিবী বুঝতে পারে, ঝড় উঠেছে, সে এখনো ঘুমিয়ে যায়নি। তার ভালোলাগতে শুরু করে। একবার এমন ঝড়েই তিতির এসেছিলো। তিতির ঝড় ভালোবাসতো খুব। বৃষ্টিতে ভিজলে তিতিরকে ভীষন সুন্দর দেখাতো। সেদিন অন্য এক তিতিরকে আবিষ্কার করেছিলো সে। ঘরময় সেদিনও বলগা হরিণ ছুটেছিলো। রক্তজবা ফুটেছিলো কয়েক মুহূর্তে। এ পর্যন্ত ভাবতে গিয়েই আবার ফিরে আসে পৃথিবী। মনে পড়ে ইফতির মুখ। তিতির কখনো বলেনি ওদের দু’জনের সম্পর্কের কথা, নিজেকেও না। আসলে তিতিরটা একটু ভিতু। সব ভয় তার নিজেকে নিয়ে। তাই, বারবার নিজেকেই হারিয়ে ফেলে। আশ্চর্য, এবার তার তিতিরের জন্যও কষ্ট হয়। বেচারা তিতির, কাউকে ভালোলাগা তো দোষের কিছু নয়। কিন্তু তাই বলে ভয় পাবে কেন? ঝেড়ে কাশলেই হয়। তাছাড়া পৃথিবীতো তিতিরের বন্ধুও হতে পারে। বন্ধু শব্দটায় এসে পৃথিবী হোঁচট খায়। না, শুধু বন্ধু হিসেবে তিতিরকে পেলে তার চলবেনা। পেতে চায় সে সবটুকু। সেখানে কেউ ভাগ বসাবে না। ভাবতে গিয়েই নিজেকে কেমন অচেনা লাগে। লাগুক, পৃথিবী ভাবে, সবাই নিজের ভালোটা কড়ায় গন্ডায় বুঝে নেয়! আজ সে মরে গেলে, কাল কবরে শোবে। কবরের জমি ভেদ করে কেউ তার খরব নেবেনা। যেটুকু চাওয়ার তা সময় থাকতেই চেয়ে নেয়া ভালো। মরে ভুত হলে চোখের সামনে যদি তিতির রিকশায় ঘোরে ইফতির সাথে, কি করবে পৃথিবী? হয়তো পৃথিবীর কথা তিতিরের কখনো মনে পড়বে। কষ্ট ঢাকতেই সে ছুটে যাবে ইফতির কাছে। না, পৃথিবীর মরা চলবেনা। মরে গেলে আর কিছুই করার থাকেনা। কেবলই হেরে যেতে হয়। তিতিরকে তার একা চাই। একটা জীবনে এতো ভাগাভাগিতে সে যেতে পারবেনা। এবার নিজেকে তার বড্ড ছোট মনে হয়। রাগ হয় তিতিরের ওপর। সে কেন ছেড়ে যাবে পৃথিবীকে? কেন সে নিজেকে হারিয়ে ফেলবে বারবার? কেনো সে ভালোবাসবে ইফতিকে? হয়তো বাসেনা, হয়তো বাসতো, হয়তো বাসবে, হয়তো পৃথিবীর চাইতে কম বাসে, হয়তো বেশী...এসব হয়তো নয়তো অসহ্য একটা চাকা হয়ে ঘুরতে থাকে তার মাথার ভেতর। উফ! তিতিরটা কেন যে এমন!

পৃথিবী উঠে বসে। ভেজা দেয়ালে বৃষ্টির আঁকা এলোমেলো ছবিগুলোতে আঙ্গুল ছুঁইয়ে সে আরো অগোছালো করে তোলে। কোনো ছবিই শেষ পর্যন্ত আঁকা হয়না। ঠান্ডা দেয়ালে হাত বুলাতে থাকে সে। তিতিরের পিঠে একটা কালো তিল আছে। রাতের অন্ধকারের মতো। পৃথিবী চায়না কোনো রাতের কাছে সে অন্ধকার চোখ মেলুক। পৃথিবী একা পেতে চায় সবকিছু। সব নিয়মের বাইরে আরো এক নিয়ম আছে। ভালোবাসা হবে সেই নিয়মে, পৃথিবী ভাবে। আসলে ভালোবাসা তো সেই অনিয়মের এক অংক। কিছুতেই তার হিসেব মেলানো যায়না। হঠ্যাৎ বাম হাতটা পেছনে নিয়ে একটা পিঁপড়ে পিষে মারে সে পিঠে। আর তক্ষুনি ঝড়ের শব্দ ছাপিয়ে আযান শোনা যায়। একটু পর চারিদিক ফর্সা হবে। হিসেবী মানুষগুলো বেহিসেবী সময়ে ছুটবে মসজিদ ঘরের দিকে। কতো তাদের প্রার্থনা। অর্থ, বিত্ত, সম্মান, সন্তান, অধিকার, রোগমুক্তি, দোযখ, বেহেস্ত, শাপমোচন, পাপমোচন এইসব ছাইপাশ। পৃথিবীর কোনো চাওয়া নেই। সবকিছু চাইতে নেই পৃথিবী জানে। তিতিরটা এখন কি করছে, পৃথিবী ভাবে। সে মারা গেলে তিতির কি ছুটে আসবে? খুব সস্তা চিন্তা। পৃথিবী জানালায় তাকিয়ে দেখে ঝড় থেমে গেছে, ঘোলা অন্ধকারে ধবধবে পাঞ্জাবী পড়ে কিছু লোক বেরিয়ে পড়েছে। সামনের দোকানের সিঁড়িতে একটা কুকুর আরামে ঘুমিয়ে আছে। একটা হুডখোলা রিকশা টুনটুন শব্দ তুলে চলে যেতেই কুকুরটা শান্তির ঘুম ছেড়ে খেঁকিয়ে ওঠে। রিকশায় বসে থাকা যুবতি সারা রাতের যন্ত্রণা নিয়ে চিৎকার করে ওঠে...চোপ হালা বাইনচোত। সাদা পাঞ্জাবীর ভেতরে কালো মানুষেরা সেদিকে ফিরেও দেখেনা। রিকশার যুবতির ঠোঁটের মতো কমলা রঙের সূর্য ওঠে। পৃথিবী সরে যায়না। তার ভালোলাগতে শুরু করে। ধোপদুরস্ত মানুষগুলোকে অবজ্ঞা করে রিকশার মেয়েটিকে তার প্রার্থনার মতো সুন্দর লাগে। ভোরের ভেতর এখনো কিছু অন্ধকারের কালো। মেয়েটির ভেতর যেন পুরোটাই সাদা। নিজেকে না লুকবার এই চেষ্টায় পৃথিবী অবাক হয়। তার চারপাশের মানুষগুলো লোলুপ কুকুরের মুখে মাংস তুলে দিয়ে তাকে ছোটায় স্বার্থের নেশায়। সেখানে সভ্যতার আদরপুষ্ট কুকুরটাকে থামিয়ে দেয় নীচুতলার কেউ। নীচুতলার! অন্ধকার ক্রমশ: গলে পড়ে আলোর পাঁজরে। সামনের মেহগনি গাছটার দিকে চোখ যায় পৃথিবীর। কাল বিকেলের পত্রশূণ্য গাছটা ভরে উঠেছে পাতায় পাতায়। সবুজ পাতাগুলো টিয়ে পাখীর মতো ডানা মেলেছে বাতাসে। লাল ঠোঁটের উষ্ণ আদরে এখনো তাকে ছুঁয়ে ফেলবে সূর্য। কাল বিকেলের পত্রশূণ্য সেই গাছটিকে এখন আর চেনা যায়না। এতো দ্রুত সে সারিয়ে তুলতে পারে নিজেকে! পৃথিবীর অবাক লাগে।

(চন্দ্রবিন্দু)


মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

গল্পটা ভাল লাগল...
আরও লিখুন....

(জয়িতা)

শাহেনশাহ সিমন [অতিথি] এর ছবি

চলুক

পুতুল [অতিথি] এর ছবি

দুর্দান্ত!

পান্থ রহমান রেজা এর ছবি

আর দুইদিন যাক, পৃথিবী নিজেকেও চমৎকারভাবে সারিয়ে তুলতে পারবে। চোখ টিপি তবে গল্পে পৃথিবী নামটা কেমন যেন খটকা লাগলো। পড়তে গিয়ে হোঁচট খেয়ে যাচ্ছিলাম, অতটা মনোযোগ না বসাতে পারাও এর কারণ হতে পারে। হাসি

চন্দ্রবিন্দু, আপনার সচল যাত্রা শুভ হউক। চলুক

মণিকা রশিদ এর ছবি

খুব সুন্দর! শব্দ নিয়ে খেলা খুব চমৎকার।
------
----সবটুকু বুঝতে কে চায়!

----------------------------------------------
We all have reason
for moving
I move
to keep things whole.
-Mark Strand

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

দারুণ দৃশ্যকল্প!

সাইফুল আকবর খান এর ছবি

বেশ ভালো।
নিক-টাও ভালো হয়েছে, তবে চন্দ্রবিন্দু'র বিষয়ে আমার কী জানি আছে একটা। এই নিক দেখে হঠাত্ একটু ঈর্ষামতোনই হৈলো কি না বুঝ্লাম্না! হাসি চোখ টিপি
চালায়া যাও। চলুক
___________
স্বাক্ষর?!
মাঝেসাঝে বুঝতে পাই- আমি
নিরক্ষর!

___________
সবকিছু নিয়ে এখন সত্যিই বেশ ত্রিধা'য় আছি

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।