অরুন্ধতী রায় : স্বাধীনতার স্পৃহা। শেষ।

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: বিষ্যুদ, ০৬/০৮/২০০৯ - ১২:৪৪পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

আইএসআই মিলে, আফগানি সোভিয়েত সরকারের বিরোধিতায় আফগানিস্তানে প্রচুর অর্থ ব্যয়ে এবং ৪০টি ইসলামি দেশের প্রায় ১০০,০০০ বিপ্লবী মোজাহেদিনকে সৈন্য হিসেবে নিয়োগ দান করে, কমিউনিজমের বিরুদ্ধে আমেরিকার প্রক্সি যুদ্ধে, আফগানিস্তানকে সোভিয়েত ইউনিয়নের ভিয়েতনামে পরিণত করে। মার্কিন রাজনীতি ও সামরিকতন্ত্রের এ এক ঐতিহাসিক পরিহাস হচ্ছে, আমেরিকা জানতো না যে সে তার নিজের বিরুদ্ধে এক ভবিষ্যৎ যুদ্ধের জন্যে অর্থ ব্যয় করেছিলো। আরো কৌতুককর হলো, ১৯৮৯-এ রাশিয়ার আফগান ত্যাগের পর মোজাহেদিনরা বৈপ্লবিক কর হিসেবে চাষীদের দিয়ে অপিয়াম চাষ করায়। আইএসআই ও সিআইএ মিলে পাকিস্তান-আফগানিস্তান সীমান্ত এলাকাকে পৃথিবীর বৃহত্তম হিরোইন চাষের ক্ষেত্রে পরিণত করে এবং আমেরিকার রাস্তায় রাস্তায় সুলভ জীবনবিধ্বংসী হিরোইনের উৎস হয়ে ওঠে ওই আফগানিস্তান।
(৫) মৌলবাদী তালিবান ১৯৯৫-এ মতার জন্যে লড়াই করলো সিআইএ-র দোসর আইএসআই-এর আর্থিক মদদে। তালিবান মতায় এসে নিজ দেশের জনগণ, বিশেষত, নারীকেই শত্রু জ্ঞানে বিপন্ন করে মারাত্মকরূপে। ভেঙে প্রস্তরীভূত হয় সমগ্র আফগান সমাজ ও সভ্যতা। দেশটি তৈরি করে নব্যপুঁজিবাদ ও কর্পোরেট গ্লোবালাইজেশনের আমেরিকা-নিয়ন্ত্রিত ক্ষেত্র। কিন্তু সে-দেশে হামলার অর্থ দাঁড়ায় অসংখ্য পাথরের পারস্পরিক স্থানান্তর, পুরোনো কবরগুলো ছত্রখান হওয়া এবং মৃতদের বিরক্ত করা ছাড়া আর কিছু নয়।
(৬) মৌলবাদী ভারত সরকার আশা করে আমেরিকা পাকিস্তানের চেয়ে বরং ভারতকেই আফগান যুদ্ধে ব্যবহার করবে। এ হলো আমেরিকাকে এ সুযোগে ভারতের জানালায় ঢিল মারতে আমন্ত্রণ জানানোর মতো। তৃতীয় বিশ্বের অন্য যেকোনো দেশের ক্ষেত্রেও এ কথা প্রযোজ্য। এ অবস্থা পৃথিবীব্যাপী সন্ত্রাস, অনিরাপত্তা এবং বোমাজনিত রুগ্নতা বিস্তারের কারণ হয়ে দাঁড়াবে। সন্ত্রাসবাদ হচ্ছে লক্ষণ, রোগ নয়। সন্ত্রাসবাদের কোনো দেশ নেই। সন্ত্রাস কোক অথবা পেপসি অথবা নিকি-র ধরনে পৃথিবীজোড়া সক্রিয় এন্টারপ্রাইজের মতো আন্তর্জাতিক। মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিগুলোর মতোই এক দেশে সমস্যার সম্মুখিন হলে সন্ত্রাসবাদ সফল সক্রিয়তার আশায় আরেক দেশে স্থানান্তরিত হয়। (৭) আমেরিকার রয়েছে অনেক যুদ্ধের ভূত। কোরিয়া, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, লেবানন, ইরাক, প্যালেস্টাইন, য়ুগোস্লাভিয়া, সোমালিয়া, হাইতি, চিলি, নিকারাগুয়া, এল সালভাদর, দ্য ডোমিনিকান রিপাবলিক, পানামা এবং পৃথিবীর আরো অনেক দেশে প্রত্যে ও পরোক্ষে আমেরিকা অবর্ণনীয় হত্যাযজ্ঞ চালায়। তারপরও দেশটি মনে করে, তাদের জীবনযাপন পদ্ধতিকে সমর্থন দেওয়ার অর্থই হচ্ছে যুদ্ধে তার বিজয়। (৮) আমেরিকা বলে, সে লাদেনকে আবিষ্কার করবে। কিন্তু আমেরিকা তাকে আবিষ্কার করে ১৯৭৯ সালে, সিআইএ-র পরিচালনায় আফগানিস্তানগামী জেহাদিদের মধ্যে লাদেন ছিলো। আমেরিকান রাজনীতির নগ্নতা এমন যে, সিআইএ লাদেনকে সৃষ্টি করেছিলো আর আজ এফবিআই তাকে খুঁজছে। আলোচ্যমান প্রবন্ধের বত্রিশতম অনুচ্ছেদটি বন্ধনির ভেতরে লেখা। এতে অরুন্ধতী ভারতের ভূপালে ১৯৮৪ সালে গ্যাস দুর্ঘটনার (এতে ১৬,০০০ মানুষ নিহত হয়েছিলো) জন্যে দায়ী আমেরিকান ওয়ারেন এন্ডারসনকে ভারত সরকারের কাছে অর্পণের জন্যে আমেরিকাকে প্রশ্নের আকারে আন্তরিক অনুরোধ জানান। (৯) ওসামা বিন লাদেন কে ? অরুন্ধতী তেত্রিশতম সাংঘাতিক সারগর্ভ অনুচ্ছেদে দ্বিতীয় প্রশ্ন তোলেন : ওসামা বিন লাদেন কী ? প্রশ্নকর্তার নিজেরই বিশ্বরাজনৈতিক প্রজ্ঞার অতল থেকে উঠে আসে এক বিশাল অনন্ত জবাব : ওসামা বিন লাদেন হচ্ছে আমেরিকার ফ্যামিলি সিক্রেট, গোপন পারিবারিক বিষয়। বিশ্বরাজনীতির রহস্য আরো এক চূড়ান্ত ধাপে আবিষ্কার করেন : বুশ এবং লাদেন হচ্ছে দুই যমজ ভাই যারা পরস্পর ঝগড়া করছে এবং ক্রমাগত হয়ে উঠছে একে অপরের দ্বারা বদলযোগ্য। বাকি দুই অনুচ্ছেদে অরুন্ধতী সেই সময়ে যুদ্ধের জন্যে প্রস্তুয়মান দুই যমজ ভাইয়ের রণকৌশলের পার্থক্য এবং পৃথিবীর রাষ্ট্রগুলোর প্রতি ‘‘যদি আপনি আমাদের সঙ্গে না হন, তাহলে আপনি আমাদের বিরুদ্ধে আছেন’’ বুশের এই ঘোষণার সঙ্গে বিশ্বজনমানুষের আকাক্সা, প্রয়োজন অথবা ঔচিত্যবোধের সম্পর্কহীনতার কথা প্রতিষ্ঠিত করেন।

২০০১-এর ২৯ অক্টোবর আউটলুক-এ বেরোয় অসামান্য তীরন্দাজ অরুন্ধতী রায়ের আরেক জঙ্গম গদ্য ওয়ার ইজ পিস (যুদ্ধ হচ্ছে শান্তি), যা পাঠের সময় সচেতন পাঠককে অন্ততঃ দু’একবার উঠে দাঁড়াতে হয়, আফগানে লোমহর্ষক হামলা চলাকালে এ গদ্য লিখিত হয়েছে বলেও। বিশ্বপুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদের জঘন্য কদর্যতাকে কালজয়ী দুর্মর ব্যঙ্গে বিদ্ধ করতে অরুন্ধতী মোটেও দ্বিধান্বিত নন। বুশ বলেন : আমরা শান্তিপূর্ণ জাতি। এর প্রতিধ্বনি তুলে ব্লেয়ার বললেন : আমরা শান্তিপূর্ণ জনগোষ্ঠি। এ ধ্বনি-প্রতিধ্বনির প্রতিক্রিয়ায় আমাদের লেখক বলেন : শুয়োরেরা হচ্ছে ঘোড়া, মেয়েরা হচ্ছে ছেলে আর যুদ্ধ হচ্ছে শান্তি। এ-গদ্যেই তিনি আবার বলেন : ভালোবাসা হচ্ছে ঘৃণা, উত্তর হচ্ছে দক্ষিণ আর শান্তি হচ্ছে যুদ্ধ। অরুন্ধতী রায়ের বিস্ময়কর সচেতনতার প্রমাণ এই প্রবন্ধেও বিধৃত রয়েছে ঐতিহাসিক-সামরিক-অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক তথ্যের অপরিমেয় সমাবেশে। এ তথ্যই তাঁর যুক্তি নির্মাণে সহায়ক হয় আর এ যুক্তিকে দান করে খণ্ডনঅযোগ্য বলিষ্ঠতা। তিনি যুদ্ধকালীন আফগান ভূখণ্ডে কান পাততে অনুরোধ করেন। মর্মবিদারী মহত্তম অনুরোধে ভেঙে পড়েন : প্লিজ, প্লিজ, স্টপ দ্য ওয়ার নাও!

সচেতনতার অকান্ত নির্ঝর : ২০০৩-এর ফেব্র“য়ারির তৃতীয় সপ্তাহের শুরুতে ভারতের কেরালা প্রদেশের ওয়েআনাদের প্রোটেক্টেড ফরেস্টে পুলিশের উন্মুক্ত গুলিবর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, নির্বিচার প্রহার ও ধরপাকড়ে অসংখ্য আদিবাসীর নিহত, আহত, নিখোঁজ এবং উদ্বাস্তু হবার ঘটনায় নিজে আমূল পীড়িত বোধ করেন অরুন্ধতী রায়। এই নরমেধযজ্ঞের এক সপ্তাহ পরে ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০০৩-এ মানবিক আবেদনে কোমল অথচ যৌক্তিক প্রতিবাদে দৃঢ় এক পত্র (সূত্র : আউটলুক ওয়েব) তিনি লেখেন কেরালার মুখ্যমন্ত্রীর কাছে। কেরালার প্রাদেশিক সরকার ঘটনার জন্যে আদিবাসী নেতৃত্বকে দায়ী করেন কিন্তু অরুন্ধতী এই চিঠিতে এ-সরকারকে স্মরণ করিয়ে দেন ৫৩,০০০ আদিবাসী পরিবারের জন্যে ভূমি সংস্থানের এখনো পর্যন্ত অকার্যকর থেকে-যাওয়া সরকারি প্রতিশ্রুতির কথা। এই প্রতিশ্রুতি পালন না করা প্রসঙ্গে তিনি মুখ্যমন্ত্রীকে লেখেন : আমরা এমন একটা জাতি যারা গড়ে উঠেছি রাজনীতিকদের পূরণ-না-করা প্রতিশ্রুতির খাঁজকাটা, ভাঙা ও ধারালো অনেক টুকরো দিয়ে। কেবল তাই নয়, তিনি এই নরমেধযজ্ঞকে জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে তুলনা করে আদিবাসীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষকে মতাবানের বিরুদ্ধে সম্পূর্ণ মতাহীন মানবগোষ্ঠির যথার্থ যুদ্ধ বলে অভিহিত করেন। তিনি বলেন, এ এমন একটি বিষয় যা থেকে পুরাণ রচিত হয়। পুলিশি আক্রমণের শিকার, আপনজন হারানো, ঘটনার পরে কারাবন্দি আদিবাসী মানুষদের প্রসঙ্গ বর্ণনার পর (নিজে আক্রমণ-পরবর্তী অবস্থা সরেজমিনে প্রত্য করবার পর) চিঠিতে তিনি মুখ্যমন্ত্রীকে প্রশ্ন করেন : ওদের জায়গায় আপনি হলে আপনার কেমন অনুভূতি হতো তা কি আপনি চিন্তা করতে পারবেন? সবশেষে অরুন্ধতী মুখ্যমন্ত্রীর কাছে তিপূরণ দাবি করেন এই বলে : আপনার দুই হাতে রক্ত, স্যার। আপনার ক্ষতিপূরণ দেবার প্রয়োজন রয়েছে। এবং অতিসত্ত্বর।

প্রোগ্রেসিভ-কে দেওয়া এক সাক্ষৎকারে তিনি বলেন : ভারত একই সময়ে কয়েকটি স্বতন্ত্র শতাব্দীতে বাস করে। তিনি অনেক রাত্রিবেলা ঘরের বের হয়েই দেখেন ডিজিটাল বিপ্লব সম্ভব করে তুলতে ফাইবার অপটিক ক্যাবল্ পোঁতার জন্যে অনেক শ্রমিক মাটি খুঁড়ছে মাত্র কয়েকটি মোমবাতি জ্বেলে। ভারতে এবং তৃতীয় বিশ্বের অনেক দেশেও আজ তাই ঘটছে। অরুন্ধতী রায় এ অবস্থাকে উপমিত করেন অনেকগুলো ট্রাকে সমবেত অনেক মানুষের অন্ধকারের দিকে সম্মিলিত যাত্রার সঙ্গে। তিনি বলেন : ওই অন্ধকারের যাত্রীদের কোনো কণ্ঠস্বর নেই; টেলিভিশনে তারা নেই; দৈনিকের পাতায় এদের কোনো স্থান নেই। এ বিশাল জনগোষ্ঠির বিপরীতে সুবিধাভোগী সংখ্যালঘুর অবস্থান তিনি চিহ্নিত করেন এভাবে যে, তারা ছোট্ট ট্রাক কনভয়ে ছুটে যাচ্ছে আলোর দিকে, যারা ওই প্রথমোক্তদের দেখার শক্তি সম্পূর্ণই হারিয়ে ফেলেছে। অবস্থা এমন যে, তিনি আরো যোগ করেন : যেন কোনো একটি জায়গায় কেউ উজ্জ্বল আলোকপাত করলে ওই স্থানের চতুর্দিকে ঘনিয়ে আসে গভীর অন্ধকার।

স্বাধীনতার অসাধারণ স্পৃহা : যে শক্তি পৃথিবীতে মানুষের সকল প্রকার এবং এমনকি বেঁচে থাকারও অধিকার হরণ করে তা অপশক্তি এবং তা-ই স্বাধীনতার শত্রু। আর এর করাল গ্রাস থেকে মুক্তি লাভের আকাঙ্ক্ষা ও স্পৃহা তাঁরই প্রবল, প্রখর, তীব্র, দীপ্র এবং অসাধারণ যিনি এই অপশক্তির কদর্যতা, জঘন্যতা, নিষ্ঠুরতা, নৃশংসতা ও ভয়াবহতাকে সম্পূর্ণ সার্থকভাবে শনাক্ত করতে সম। অরুন্ধতী রায়, এ উপমহাদেশের সন্তান, মুক্তির লড়াইয়ে আমাদের সমকালীন পৃথিবীর সেই সংশপ্তক। শত্রুকে যথার্থরূপে চিনতে না পারলে মুক্তির লড়াই, আকাঙ্ক্ষা ও স্পৃহা খণ্ডিত থেকে যায়। অরুন্ধতী এ দায় থেকে মুক্ত। শিক্ষিত মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত অনেকেও নিশ্চয় আমাদের এই বাংলাদেশেও আছেন যাঁরা তাঁর সমালোচক। হ্যাঁ, অপ্রকাশ্যে হলেও তাঁরা সমালোচক এ জন্যেই যে, অরুন্ধতী তাঁদের শ্রেণীভিত্তি ও সাংস্কৃতিক রুচিতেও আঘাত হেনেছেন সমাজ ও সভ্যতার অধীশ্বরকে নগ্ন করে এবং প্রান্তিক মানবমণ্ডলির প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ হয়ে। কিন্তু অরুন্ধতী রায় নিজে হচ্ছেন সেই সমালোচক যিনি বিশ্বপুঁজির সাম্রাজ্যবাদী আধিপত্যের বিরুদ্ধতায় নিরলস, নিরাপোষ এবং অনন্য। যা চাই তার জন্যে কী চাই না তা সুনির্দিষ্ট করা অতীব জরুরি কাজ। এ কথা এজন্যে বলা যে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সাহিত্যে (সৃজনশীল রচনা তো বটেই, মননশীল রচনা তথা প্রবন্ধসাহিত্যেও) অব্যবহিত প্রথম প্রত্য প্রতিপ পাকিস্তানি উপনিবেশের মুখোশ উন্মোচিত হলেও তার সঙ্গে সম্পর্কিত মূল এবং সর্বপ্রধান শত্রু মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের চেহারা উপযুক্ত পরিমাণে চিত্রিত হয় নি। এর ফলাফলই কি এই যে, দেশের প্রধান একজন কবি, সোনালি কাবিন-এর রচয়িতা, পথভ্রষ্ট হতে হতে আজ পশ্চিমা পোস্ট মডার্নিজমেই ইসলামি কবিদের (তাঁরই সাম্প্রতিক ঘোষণা অনুযায়ী) মুক্তি সন্ধান করছেন?

অরুন্ধতী রায় ২০০৩-এর ২৭ জানুয়ারিতে, ব্রাজিলে ওয়র্ল্ড সোশ্যাল ফোরাম ২০০৩-এ সাম্প্রতিক বিশ্বপরিস্থিতি বিষয়ে দীর্ঘ বক্তব্য রাখেন। সেখানে তাঁকে প্রশ্ন করা হয় : হাউ টু কনফ্রন্ট এম্পায়ার? কীভাবে আমরা সাম্রাজ্যকে ঠেকাবো? এ প্রশ্নকেই শিরোনাম করে আউটলুক ওয়েবে ৩০ জানুয়ারি ২০০৩ তা প্রকাশিত হয়। তিনি নব্য সাম্রাজ্যবাদকে সংজ্ঞায়িত করেন এভাবে :

ধনী-দরিদ্রে বৈষম্য যতো বাড়ছে, সম্পদ কুগিত করার সংগ্রামও ততো তীব্র হচ্ছে। আমরা যে শস্য ফলাই, যে জল পান করি, যে বাতাসে নিঃশ্বাস নিই, আর যে স্বপ্ন দেখি, সেগুলো হরণ
করার জন্যে বহুজাতিক কর্পোরেশনগুলোর দরকার দরিদ্র দেশগুলোতে তাদের অনুগ্রহভাজন, দুর্নীতিবাজ, স্বৈরাচারী সরকারসমূহের একটা আন্তর্জাতিক কনফেডারেশন, যারা তাদের জনগণের স্বার্থবিরোধী নানা সংস্কার করবে এবং সংঘটিত বিদ্রোহগুলো দমন করবে।

এই কর্পোরেট বিশ্বায়ন প্রক্রিয়া বা সাম্রাজ্যবাদের প্রয়োজন একটা সংবাদমাধ্যম, যে কিনা মুক্ত ও স্বাধীন সংবাদমাধ্যম বলে ভান করে। সাম্রাজ্যবাদের প্রয়োজন আদালত, যারা ভান করে যে তারা ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করছে। এর মধ্যে উত্তর গোলার্ধের দেশগুলো তাদের সীমান্ত আরো অনতিক্রম্য করেছে, নিজেদের হাতে গণবিধ্বংসী সব অস্ত্র জমা করেছে। তারা শুধু অর্থ, পণ্য, পণ্যের পেটেন্ট আর সেবার বিশ্বায়ন নিশ্চিত করতে চায়। পৃথিবীতে মানুষের মুক্ত বিচরণ নয়। মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধার বিশ্বায়ন তারা চায় না। জাতিগত বৈষম্য, রাসায়নিক বা আণবিক অস্ত্র কিংবা গ্রিনহাউস প্রভাব অথবা ন্যায়বিচার সংক্রান্ত কোনো আন্তর্জাতিক চুক্তি সম্পাদনের প্রয়োজন তারা বোধ করে না। এসব কিছু মিলিয়ে গড়ে উঠেছে এক ‘সাম্রাজ্য’। এই অনুগত কনফেডারেশন, মতার এই অশ্লীল পাহাড়, সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী আর সেই সিদ্ধান্তের ফলে ভোগান্তির শিকার মানুষের মধ্যে বিশাল ব্যবধান- এই হচ্ছে এখনকার সাম্রাজ্যবাদ।

এছাড়াও, অরুন্ধতী ব্রাজিলের অনুষ্ঠানে গুজরাটে সংঘটিত হিন্দু মৌলবাদীদের কল্পনাতীত, নৃশংসতম ধর্ষণযজ্ঞ-হত্যাযজ্ঞের হোতা ওই প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি প্রসঙ্গে বলেন : তিনি যদি সাদ্দাম হতেন, তাহলে অবশ্যই তাঁর নিষ্ঠুরতার দৃশ্যগুলো সিএনএন টেলিভিশনে ফলাও করে প্রচারিত হতো। কিন্তু মোদি যেহেতু সাদ্দাম নন, আর যেহেতু ভারতের ১০০ কোটি মানুষের ‘বাজার’ বিশ্বের বেনিয়াদের জন্যে খুলে দেওয়া হয়েছে, তাই এই হত্যাযজ্ঞ তাদের জন্যে একটুও অস্বস্তিকর হয় নি।

ইরাক-যুদ্ধ সম্পর্কে অরুন্ধতী বলেন : একজন বুশকে বাদ দিলে গোটা দুনিয়ার মানুষ ভালো থাকবে। আসলে বুশ সাদ্দামের চেয়ে অনেক অনেক বেশি ভয়ংকর। বক্তব্য আরো কিছুদূর এগুবার পর তিনি বুঝিয়ে দেন : একটা অনিষ্টকারী মিকিমাউস আর উন্মাদ মোল্লাদের মধ্যে কোনো পক্ষকে বেছে নেওয়ার প্রয়োজন বিশ্ববাসীর নেই।

আশার মুগ্ধ চন্দ্রিকা : তবুও আশার চাঁদ একেবারে মেঘাচ্ছন্ন নয়। কেননা, অরুন্ধতীর প্রাগুক্ত বক্তব্যে সার্থকতা এবং দৃঢ়প্রত্যয়ও উচ্চারিত হয় :

আমরা এই প্রবল, চতুর, প্রতারক সাম্রাজ্যকে তার পথের ওপর ঠেকিয়ে দিতে পারিনি বটে, কিন্তু আমরা তাকে উলঙ্গ করতে পেরেছি। আমরা তাকে তার মুখোশ খুলে ফেলতে বাধ্য করেছি। আমরা তাকে তার আসল চেহারা নিয়ে প্রকাশ্যে বেরিয়ে আসতে বাধ্য করেছি। এখন সে আমাদের বিশ্বমঞ্চের ওপর তার জান্তব এবং উলঙ্গ দৃর্বৃত্তের চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
আমাদের উচিত ‘সাম্রাজ্য’কে অবরোধ করা। সে যেন অক্সিজেন না পায়। তাকে লজ্জা দেওয়া, তিরস্কার করা, বিদ্রুপে বিদ্ধ করা : আমাদের শিল্প, আমাদের সঙ্গীত, আমাদের সাহিত্য,

আমাদের অনমনীয়তা, আমাদের আনন্দ, আমাদের প্রতিভা, আমাদের নির্ভেজাল নির্দয়তা এবং আমাদের নিজেদের গল্প বলার ক্ষমতা দিয়ে। যেসব গল্প আমাদের বিশ্বাস করানোর জন্যে মগজধোলাই করা হচ্ছে, সেসব গল্প থেকে ভিন্ন ধরনের গল্প।

অন্যরকম একটি পৃথিবী শুধু যে সম্ভব, তাই নয়; বরং সেই পৃথিবী আসছে। শান্ত নিরিবিলি দিনে আমি তার নিঃশ্বাসের শব্দ শুনতে পাই।

তবুও কেবলই অসমাপ্ত কথা : ২০ মার্চ ২০০৩-এর সকালে, সাম্রাজ্যবাদের নির্লজ্জ-নৃশংস অসমাপ্ত কর্মকাণ্ডের ধারাবাহিকতার সংবাদ পাওয়া যায়। বুশের দেওয়া আল্টিমেটাম অতিক্রান্ত হবার ৯০ মিনিট পরে (বাংলাদেশ সময় সকাল সাড়ে আটটায়) ঐদিন ইরাকে মার্কিন হামলা শুরু হয়। আজ আমি যদি মাতা-ভ্রাতা-স্ত্রী-কন্যাসমেত ইরাকের মানুষ হতাম, তাহলে, অভিজ্ঞতার যেকোনো একটি বিন্দু থেকে মহাকাব্য সৃষ্টি হতে পারে- এ সত্য অনুধাবনের আগেই হয়তো পশু-পাখির মতো নির্বিচারে সপরিবারে নিহত হতাম। এ মুহূর্তে আমার কলম স্তব্ধ হয়ে পড়ছে। আমার সমগ্র প্রতীতি স্পর্শ করতে চাইছে হামলা আরম্ভের পর থেকে আজ পর্যন্ত নিহত এবং শহীদ সকল ইরাকির রক্ত, জীবনের উপলব্ধিকে শত্রুর বিরুদ্ধে আগামী দিনের জন্যে আরো রক্তিম করবো ব’লে। এ অধিকার, এ বৈশ্বিক সময়ে, অরুন্ধতীই আমাকে দিয়েছেন।

বালক


মন্তব্য

জুয়েইরিযাহ মউ এর ছবি

ভালোবাসা হচ্ছে ঘৃণা, উত্তর হচ্ছে দক্ষিণ আর শান্তি হচ্ছে যুদ্ধ।

ওসামা বিন লাদেন হচ্ছে আমেরিকার ফ্যামিলি সিক্রেট, গোপন পারিবারিক বিষয়।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সাহিত্যে (সৃজনশীল রচনা তো বটেই, মননশীল রচনা তথা প্রবন্ধসাহিত্যেও) অব্যবহিত প্রথম প্রত্য প্রতিপ পাকিস্তানি উপনিবেশের মুখোশ উন্মোচিত হলেও তার সঙ্গে সম্পর্কিত মূল এবং সর্বপ্রধান শত্রু মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের চেহারা উপযুক্ত পরিমাণে চিত্রিত হয় নি। এর ফলাফলই কি এই যে, দেশের প্রধান একজন কবি, সোনালি কাবিন-এর রচয়িতা, পথভ্রষ্ট হতে হতে আজ পশ্চিমা পোস্ট মডার্নিজমেই ইসলামি কবিদের (তাঁরই সাম্প্রতিক ঘোষণা অনুযায়ী) মুক্তি সন্ধান করছেন?

লেখাটি বেশ ভাল হয়েছে, হে বালক।
বানানের কথা বললেতো মন খারাপ হয়, এই পর্বে ভুল বানানের সংখ্যাটাও কম, তাই আর বল্লামনা!! থাক! হাসি

বালক [অতিথি] এর ছবি

ধন্যবাদ আপনাকে।
এই লেখাটি পঠিত হয়েছে ৫৮বার, মন্তব্য ১টি আর সেটি আপনি। হাসি

পুতুল এর ছবি

লেখাটি আগেই পড়েছি। মন্তব্য করার সুযোগ ছিলনা।
আগের পর্বের মতই। খুব ভাল লাগল।

ধরেনিচ্ছি অরুন্ধতী রায়ের উদ্ধৃতী গুলো আপনার নিজের অনুবাদ। অনুবাদটা পড়ে তাঁর গড অব স্মল থিংক্সের কথা মনে পড়ল। বাংলায় পড়তে গিয়ে খুব কষ্ট হয়েছিল। অসম্ভব রকমের নীচু মানের অনুবাদ ছিল সেই বিক্ষ্যাত বইটি। সেক্ষেত্রে আপনার কোড করা অশংগুলোর অনুবাদ অসাধারণ লেগেছে।

আপনার নিজের বক্তব্য মূল লেখকের সম মানের (বাংলা)। আমি আপনার কাছ থেকে এই ধরনের আরো অনেক লেখা আশা করি। আপনার লেখার হাত ঈর্ষণীয়।

যেকোন জায়গায় লিখতে গেলে একটা পরিচিতি লাগে। আপনি নতুন এসেছেন, সেই জন্য অনেকের সাথেই পরিচয় হয়নি এখনো। ধৌর্য্য ধরে লিখুন। মন্তব্য করুন। আপনার সমালোচকের/পাঠকের/মন্তব্যকারীর অভাব হবেনা।

সত্যি বলতে কি, কমেডী টাইপের লেখার পাঠক অনেক বেশী। আপনি যে বিষয় নিয়ে লিখছেন, সে সব গভীর বিষয়ের পাঠকও কম। বানানের ব্যাপারগুলো লিখতে লিখতে ঠিক হয়ে যাবে।

চিন্তা বালক, আপনাকে স্বাগতম।
**********************
ছায়া বাজে পুতুল রুপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কি দোষ!
!কাঁশ বনের বাঘ!

**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!

বালক [অতিথি] এর ছবি

অনেক সুন্দর মন্তব্য করেছেন আপনি।
আসলে বলতে গেলে কি একটা লেখা কে ভালো করতে হলে কতটুকু শ্রম দিতে হয় তা আপনি জানবেন। আমি বলছিনা আমার এই লেখাটি খুব ভালো। তারপরও যদি লেখা হয়ে থাকে ( হয়েছে মনে হয় না হলে সচল কতৃক প্রকাশ করতো না।) আর তখন যদি পাঠকের সমালোচনাটাও প্রাপ্তি হয় না খুব খারাপ লাগে। যাই হোক ভাই আমি অন্য একজনের কথায় সচলে লেখা দিয়েছিলাম, দুটিই দিয়েছি, তার পি সি তে বসেই নেট ব্যবহার করি। কতটুকু আর লিখতে পারবো বুঝতেছিনা। তবে সুযোগ ও সময় পেলেই আরো লেখা দেবার চেষ্টা করবো। ধন্যবাদ আপনাকে...

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।