পরিবর্তনের উড়াল <সমাপ্ত>

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: মঙ্গল, ১১/০৮/২০০৯ - ১০:৪২অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

http://http://www.sachalayatan.com/guest_writer/26243 আগের লেখাটি

এর আগে আমাদের গাঁয়ে ধূমপায়ীদের মধ্যে তামাকের প্রচলন ছিলো। আমি দেখলাম সকলেই এখন সিগারেট ধরছে। আমাদের নদীতে অসংখ্য নৌকা যেত, আমরা গুনের নিচ দিয়ে পারতপক্ষে যাওয়ার পক্ষে ছিলাম না, কিন্তু সেখানে এলো ট্রলার, ভটভটি,। নদীর বুক দিয়ে প্রচণ্ড শব্দ করে ইন্জিন নৌকাগুলো চলে যাওয়ার সময় মনে হতো, অসহ্য চিৎকারে বুঝি দু'পাড়ের গ্রামগুলোর কণ্ঠ ছিঁড়ে যাচ্ছে। আমার গ্রাম নিবিড়তা হারালো, আমার গ্রাম হারালো পুরাকাল থেকে ধরে রাখা নির্জনতার ঐশ্বর্য।
একদিন সকালে ঘুম থেকে জেগে একটি সংবাদ আমার কানকে পাখির ডাক শোনা ভুলিয়ে দিলো। অনেকের মুখে কথা ছিলো, বিন্দুরা নেই। আমি ভাবলাম বিন্দুরা নেই! কোথায় গেছে! বিন্দুরা কোথায় যাবে! আমি আর কারো কথা বা তাদের বাড়ির বিশেষ কারো মুখ এতো স্পষ্ট ভাবে মনে করতে পারছি না। বিন্দুরা ছিলো, আমাদের প্রতিবেশি। বিন্দুর কথা আমার অধিক মনে পড়ে, কারণ তার সাথে কুস্তি করতাম, বেয়ারিংয়ে গাড়ি চালাতাম। তার বাবা বাজারে সবজি বিক্রি করতেন। আমি তাদের বাড়ি থেকে দশির সুতো আনতাম দিদির পুতুলের জন্য। বিন্দুরা নেই। বিন্দুরা কোথায় গেছে আমি জানিনা। বিন্দুরা কেনো গেলো? কেউ আমাকে বলেনা। আমি আমার ভাবনায় নতুন একটি পাখা গজাই, বিন্দুরা চলে যায়।
পরপর বেশ ক'টি পরিবার গ্রাম ছেড়া চলে যায়। ওরা কোথায় যায়, কেনো'ই-বা যায়, সেখানে তারা কেমন থাকে! অন্তহীন চলে যাওয়ার ঘটনা আমাকে ক্লান্ত করে। আমি দেখতে পাই তাদের ফেলে যাওয়া ঘরগুলো ভেঙে নিয়ে যায় যে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। সেই ভিটা দখলের জন্যে আসা মানুষগুলো ঝগড়া-মারামারি করে। শালিস হয়।

মানুষের এক-একটি পা এক-একটি কারণে এগোয়। এক-একটি পায়ের এক-একটি ভাষা, এক-একটি আলাদা ডানা। অর্থাৎ তখন আমার একটি চোখ ছিলো, এখন অসংখ্য পাখা, অর্থাৎ অসংখ্য চোখ, চোখেদের ডানা। আমি বুঝতে পারি বিন্দুরা মানচিত্র বদল করলেই কি মানুষ বদলে যায়, মানুষের অন্তর্গত মৌলিকভাষা বদলে যায়!
এখন আমি দেখতে পাচ্ছি, পাল্টে যাচ্ছে গ্রামে অবস্থানকারি মানুষের মানচিত্র। গ্রামের অনেক মানুষই এখন আর সেই সকালে ঘুম থেকে জাগেনা, জাগতে জাগতে তাদের বেলা বয়ে যায়। এমনও অসংখ্য মানুষ আছে গ্রামে থেকেও সূর্যোদয় দেখার সৌভাগ্য হয় না। নদীর শীতলজলে গা-ভাসানো তো দূরের কথা, টিউবলের জল তুলে তাতে গরম জল মিশিয়ে বাড়িতেই গোসল সারে।
গ্রামের মানুষ, যুবক, ছেলে বুড়োসহ আজকাল ন্যূড ছবি দেখে। রাত জাগে, সেখানে আজ আর তাঁতকল নেই, কৃষির জোয়ার নেই, মানুষ ঘৃণার চোখে দেখে কৃষিকে।
আমি দেখলাম আমার সরল গ্রামের ভেতর হাঁটছে অচেনা নগর। আমার ভাবনার ডানায় নব্য শহুরে-গ্রামের কৈশোর, কৈশোরত্তীর্ণাবস্থা দেখে আঁতকে ওঠলাম। আজকের গ্রামের মানুষদের ডানা নেই। তারা বিভিন্ন ক্ষেত্রে উড়তে পারেনা। গণ্ডীবব্ধ ভাবনায়, সহজলভ্যতার, এক নব্য-নাগরিকতার নিজেদেরকে এক-একটি ডানাহীন অচল মানুষ করে রেখেছে।

আমার খুব মাটির ঘরে ঘুমানোর শখ। আমি জানি, আমার ডানা উড়ে গিয়ে জেনে এসেছে আমার পূর্বপুরুষ মাটির ঘরে ঘুমোতো, কিন্তু আমি মাটির ঘরে ঘুমোইনি। এগুলো আমার স্বপ্ন, এগুলো একদিন সত্যি ছিলো। মানুষ জোনাকির মতো চোখ দিয়ে দেখতো, নদীর আয়নাজলে মুখ খুঁজে নিতো, সবুজ সোনালি মাঠে খুঁজে নিতো জীবনের শ্রী; তখন মানুষের সুখ এতোটা ঠুনকো, এতোটা সহজলভ্য ছিলো না, মানুষের সুখ ছিলো অপূর্ব উর্বর।

বালক


মন্তব্য

ভুতুম এর ছবি

সুন্দর লিখেছেন। ভালো লাগলো।

-----------------------------------------------------------------------------
সোনা কাঠির পাশে রুপো কাঠি
পকেটে নিয়ে আমি পথ হাঁটি

-----------------------------------------------------------------------------
সোনা কাঠির পাশে রুপো কাঠি
পকেটে নিয়ে আমি পথ হাঁটি

বালক এর ছবি

ধন্যবাদ। হাসি

____________________________________________________________________
"জীবনের বিবিধ অত্যাশ্চর্য সফলতার উত্তেজনা
অন্য সবাই বহন করে করুক;
আমি প্রয়োজন বোধ করি না :
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ হয়তো
এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।"

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

খুব সুন্দর... বেশ ভালো লাগলো
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

বালক এর ছবি

হাসি

____________________________________________________________________
"জীবনের বিবিধ অত্যাশ্চর্য সফলতার উত্তেজনা
অন্য সবাই বহন করে করুক;
আমি প্রয়োজন বোধ করি না :
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ হয়তো
এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।"

শাহেনশাহ সিমন [অতিথি] এর ছবি

বেশ ভালো লাগল চলুক

বালক এর ছবি

ফিরতি শুভেচ্ছা।

____________________________________________________________________
"জীবনের বিবিধ অত্যাশ্চর্য সফলতার উত্তেজনা
অন্য সবাই বহন করে করুক;
আমি প্রয়োজন বোধ করি না :
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ হয়তো
এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।"

অতন্দ্র প্রহরী এর ছবি

সুন্দর লেখা। ভালো লাগল। হাসি

বালক এর ছবি

শুভেচ্ছা জানবেন।

____________________________________________________________________
"জীবনের বিবিধ অত্যাশ্চর্য সফলতার উত্তেজনা
অন্য সবাই বহন করে করুক;
আমি প্রয়োজন বোধ করি না :
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ হয়তো
এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।"

জুয়েইরিযাহ মউ এর ছবি

আমার গ্রাম হারালো পুরাকাল থেকে ধরে রাখা নির্জনতার ঐশ্বর্য

লেখাটি পড়তে ভাল লাগলো।

বালক এর ছবি

শুভেচ্ছা জেনো বন্ধু, চোখ টিপি

____________________________________________________________________
"জীবনের বিবিধ অত্যাশ্চর্য সফলতার উত্তেজনা
অন্য সবাই বহন করে করুক;
আমি প্রয়োজন বোধ করি না :
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ হয়তো
এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।"

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।