---------তারপরও থাকে অপেক্ষা..। (মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি কথা)

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: শুক্র, ২১/০৮/২০০৯ - ২:০৮অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

১৯৭১ সালের ৩০শে জুন, রাত ১১টা, গ্রামের সবাই তখন উৎকন্ঠা আর উদ্বেগ নিয়ে ঘুমের ঘোরে। ১৯ বছরের টগবগে তরুন সাত্তার যুদ্ধে যাবার জন্য নিজেকে তৈরী করে নিলো। আস্তে আস্তে মায়ের ঘরের কাছে এসে দড়জায় টোকা দিলো। মা তামান্না বেগম প্রথম টোকাতেই ভয়ে লাফ দিয়ে উঠলেন। পাশে ঘুমিয়ে পড়া স্বামীকে ধাক্কা দিয়ে তুললেন। সাত্তার বিলম্ব দেখে আবার টোকা দিলো, আর সাথে বললো-"মা আমি, দড়জাটা খুলো।" তামান্না বেগম চকিত চরণে মুহূর্তের মধ্যে এসে দড়জা খুলে ছেলেকে চিলের মত ছু দিয়ে নিজের ঘরের ভেতর নিয়ে গেলেন। এবং সতর্ক হস্তে দড়জা বন্ধ করে দিলেন। ছেলেকে নিয়ে খাটে বসালেন। বাবা জব্বার ভু্ইয়া নির্বাক চোখে ছেলের দিকে চেয়ে আছেন। ছেলের চোখ দেখেই সে বুঝতে পেরেছেন এই ছেলেকে আর ঘরে রাখা যাবেনা, ওর রক্তে বইছে স্বদেশের ভাইদের হত্যার প্রতিশোধ নেবার আগুন। তাই নিজে কিছু বললেন না। ছেলের মাথায় শুধু একবার স্নেহের হাত বুলালেন। আশীর্বাদ করলেন মন থেকে। জব্বার সাহেব দোয়া করলেন মনে মনে -"হে আল্লাহ আমার ছেলেকে তুমি দেখে রেখো, যে পবিত্র দায়িত্ব পালনের জন্য ঘর থেকে বের হওয়ার পণ করেছে সেই দায়িত্ব পালনে ওকে তুমি সাহায্য করো। আমীন।"

মা তামান্না বেগম তখনো বুঝে উঠতে পারেনি ছেলে কেনো এতো রাতে তার ঘরে প্রবেশ করেছে। সে ছেলের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সাত্তার মার মা ছুয়ে সালাম করে-"মা আমি এদেশের জন্য স্বাধীনতার সুর্য আনতে যাচ্ছি, আমাকে দোয়া করো।" তামান্না বেগম চোখের জল ধরে রাখতে পারলেন না। ছেলেকে নিজের বুকে টেনে নিলেন। কপালে, গালে চুমু খেলেন। জব্বার সাহেব পাশ থেকে বললেন-"ওকে যেতে দাও, রাত অনেক হয়ে যাচ্ছে। ওর জন্য আশীর্বাদ করো, আল্লাহ যেনো ওকে সহি সালামতে রাখে।" তামান্না বেগম ছেলেকে ছেড়ে দিলেন, মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন -"যা বাবা যা, যারা নিরীহ মানুষ গুলোকে নির্বিচারে হত্যা করছে, আমাদের অধিকার হরন করতে চাচ্ছে, ওদের রুখে দাড়া, ভাইয়ের খুনের বদলা নে, স্বাধীনতার লাল সুর্য নিয়ে ঘরে ফিরবি, আমি তোর জন্য অপেক্ষায় থাকবো। আমাদের জন্য একটুও চিন্তা করবি না। মনে রাখবি এই দেশটাও তোর মা, এই মায়ের সম্মান রক্ষা করাও তোর দায়িত্ব। যেখানে থাকবি পারলে পত্র দিয়ে জানাবি।" -বলে চলে গেলেন আলমারীর দিকে। আলমারীর চাবি খুলে ড্রয়ার থেকে টাকা নিয়ে ছেলের হাতে দিয়ে-"এই টাকা কয়টা রাখ, কাজে লাগবে।"সাত্তার টাকা গুলো হাতে নিয়ে বুক পকেটে রাখলো। বাবা কে সালাম করতে গেলো। বাবা জব্বার সাহেব ছেলেকে জরিয়ে ধরলেন। নিজের অজান্তে কয়েক ফোটা চোখের জল ফেললেন। ছেলের কপালে চুমু খেয়ে বললেন-"বাবা কোন মায়ার টানে কখনো পিছ পা হবি না, শত্রুকে কখনো দূর্বল ভাববিনা, যতক্ষন বেচে থাকবি পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীকে এদেশ থেকে তারিয়ে সবুজের বুকে লাল সুর্যটা নিয়ে আসবি, আমি গ্রামের সবাইকে সেই পতাকা মুক্ত আকাশে উড়াবো।"

সাত্তার বাবা-মার কাছ থেকে বিদাই নিয়ে রাতের আধারে বের হয়ে গেলো। উদ্দেশ্য স্বাধীনতার লাল সুর্য ছিনিয়ে আনা। পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীকে দেশ থেকে তাড়িয়ে দেশটা শোষন মুক্ত করা। গ্রামের আরো কিছু ছেলেদের বট তলায় মিলিত হবার কথা। ওখান থেকে কমান্ডার রফিক ভাই ওদের নিয়ে যাবে কদমতলী ক্যাম্পে। প্রচন্ড আত্ববিশ্বাস আর প্রতিশোধের প্রতিহিংসা বুকে ধারন করে এগিয়ে গেলো সাত্তার।

-------------------- তারপর অনেক দিন কোন খবর নেই, চিঠি নেই। লোক মারফত কোন বার্তা নেই। মা তামান্না বেগম সারাদিন জায়নামাজে বসে ছেলের নিরাপত্তার জন্য আল্লাহর দরবারে মোনাজাত করেন। বাবা সাবধনী মানুষের মত খোজ-খবর নেবার চেষ্টা করেন। গ্রামের আর যারা যুদ্ধে গেছে ওদের অনেকের চিঠি আসে, লোক মারফত খবর আসে, কোথায় আছে, কি করছে, কিন্ত সাত্তারের কোন খবর পায়না। জব্বার সাহেবও পাচঁ বেলা নামাজে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেন ছেলের নিরাপত্তা আর দেশের শান্তির জন্য।

-------- এরপর ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর এলো, বাংলাদেশ স্বাধীন হলো। বিজয় উল্লাসে চারিদিক মুখরিত হলো। গ্রামের হাজার মানুষের সাথে জব্বার সাহেবও মিছিলে যোগ দিলো। জব্বার সাহেব জয় বাংলা শ্লোগানের ফাকে ফাকে উৎসুক দৃষ্টি নিয়ে নিজের ছেলের মুখ খুজতে লাগলো মিছিলে মিশে থাকা হাজার মুক্তিযোদ্ধার মাঝে। কিন্ত পেলেন না। তামান্না বেগম তখনো জায়নামাজে আসীন। ছেলের ফিরে আসার অপেক্ষা। সুস্থ শরীরে যেনো ফিরে আসে তার জন্য আল্লাহর নিকট নিবেদন। হাজার মাণুষের আকাশ ফাটা বিজয় শ্লোগানও তামান্না বেগমের ধ্যানকে একটুও চির ধরাতে পারলো না।

------এরপর অনেক সময় গেলো, মায়ের চোখের জল শুকাতে লাগলো। বাবা স্বল্পভাষী হয়ে গেলেন। মুক্ত আকাশে হাজার পাখি উড়ে বেড়াতে লাগলো। স্বাধীনতার লাল টকটকে সুর্য প্রতিদিন পূর্ব আকাশে উদয় হতে লাগলো, কিন্ত ছেলে সাত্তার মায়ের কোলে ফিরে এলো না। সময় বইতে লাগলো আপন গতিতে। মা তামান্না আর বাবা জব্বার ছেলের জন্য চেয়ে থাকলো গায়ের মেঠো পথে, যে পথে একদিন রাতের আধারে ছেলে যুদ্ধে যাবার জন্য বের হয়েছিলো। আজো রাতে দড়জায় ফের শব্দের আসায় জেগে থাকে মা তামান্না। ভোর হয়ে যায়, নতুন সুর্য উঠে, বাড়ে বাবা-মার আরেকটা দিনের অপেক্ষা।


মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

প্রিয় পাঠক প্লিজ মন্তব্য চাই। দয়া করে একটু মন্তব্য করবেন।

অতন্দ্র প্রহরী এর ছবি

অসাধারণ। অসম্ভব ভালো লাগল লেখাটা। ভীষণ ছুঁয়ে গেল। আরো লিখুন।

লেখার সাথে আপনার নামটা দিয়েন।

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ। আমি বেশ কয়েকটি ছদ্দনামে লিখি, তার মাধ্যে একটা হলো দলছুট।

তুলিরেখা এর ছবি

খুব ভালো লাগলো। আরো লিখুন।
-----------------------------------------------
কোন দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

ইশতিয়াক রউফ এর ছবি

ছুঁয়ে গেলো লেখাটা। আরও লিখুন মুক্তিযুদ্ধের ঘটনা/গল্প।

লেখার শেষে মনে করে নাম জুড়ে দিয়েন। সম্ভব হলে একটাই নিকে লেখার অনুরোধও রইলো। নয়তো আপনার নাম দেখলেই আলাদা করে সময় বের করার ব্যাপারটা হয়ে উঠবে না।

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ সুন্দর মতামতের জন্য। আমি দলছুট নামে লিখবো। আশা করি আমার লেখা গুলো পড়বেন।

ইশতিয়াক রউফ এর ছবি

অবশ্যই পড়বো। "দলছুট"-এর খোঁজ করবো এর পর থেকে অতিথি লেখকের লেখা পেলেই। শুরুতেই নিজের নাম জুড়ে দিয়েন।

মামুন হক এর ছবি

অসম্ভব আবেগের সঞ্চার হলো আপনার লেখাটা পড়ে।
সন্তান হারা এই মা-বাবাদের একটা রাতের কষ্টের প্রতিদান আমরা সারা জীবন ধরে চেষ্টা করলেও দিতে পারব বলে মনে হয়না।
মানুষ হয়ে জন্মানো অনেক কষ্টের।

অতিথি লেখক এর ছবি

সেই সব নরপশুদের লালসার কারনে আমাদের এইসব সন্তানদের হারাতে হয়েচে ওদের বিচার করতে পারলে মায়ের ঋন কিছুটা শোধ হবে।

ধন্যবাদ সুন্দর মতামতের জন্য।

ধুসর গোধূলি এর ছবি

- লেখাটা দেরী করে পড়া হলো। এমন লেখায় মন্তব্য করতে গেলে হাত কাঁপে। অনেক ভেতরে গিয়ে লাগে রে ভাই, অনেক ভেতরে গিয়ে লাগে।
___________
চাপা মারা চলিবে
কিন্তু চাপায় মারা বিপজ্জনক

অতিথি লেখক এর ছবি

ইংরেজীতে একটা কথা আছে না -"কোন দিন না করার চেয়ে দেরীতে শুরু করাও ভালো।" লেখাটা পড়ার জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ।

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

চলুক
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

নুরুজ্জামান মানিক এর ছবি

চলুক

নুরুজ্জামান মানিক
*******************************************
বলে এক আর করে আর এক যারা
তারাই প্রচণ্ড বাঁচা বেঁচে আছে দাপটে হরষে
এই প্রতারক কালে (মুজিব মেহদী)

নুরুজ্জামান মানিক
*******************************************
বলে এক আর করে আর এক যারা
তারাই প্রচণ্ড বাঁচা বেঁচে আছে দাপটে হরষে
এই প্রতারক কালে (মুজিব মেহদী)

ছায়ামূর্তি [অতিথি] এর ছবি

চলুক

মৃদুল আহমেদ এর ছবি

প্রিয় দলছুট, ভালো লেখা। চিরন্তন এক কাহিনী। আপনার বলার সরল ভঙ্গিতে আবার নতুন করে শুনলাম।
একটু বানানগুলো খেয়াল করুন না অনুগ্রহ করে! তাহলে আপনার চমৎকার লেখায় আর কোনো খুঁত থাকবে না। হাসি
যেমন,
দড়জা-দরজা
বিদাই-বিদায়
আরো আছে। সেগুলোর জন্য ইশতিয়াক রউফ আর মূলত পাঠক নামের দুইজন ভদ্রলোক আপনাকে প্রত্যক্ষ সহায়তা দেয়ার জন্য অপেক্ষা করে আছেন। আপনি শুধু গিয়ে বললেই হবে। চোখ টিপি
--------------------------------------------------------
বুদ্ধিমানেরা তর্ক করে, প্রতিভাবানেরা এগিয়ে যায়...

--------------------------------------------------------------------------------------------
বললুম, 'আমার মনের সব কপাট খোলা ভোজরাজজী। আমি হাঁচি-টিকটিকি-ভূত-প্রেত-দত্যি-দানো-বেদবেদান্ত-আইনস্টাইন-ফাইনস্টাইন সব মানি!'

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ আপনার সুন্দর মতামতের জন্য।
ওনাদের দুইজনকে কিভাবে পেতে পারি? প্লিজ একটু বলবেন কি?

মৃদুল আহমেদ এর ছবি

অসুবিধা নেই। আপনার মন্তব্য চোখে পড়লেই উনারা চলে আসবেন। হাসি
--------------------------------------------------------
বুদ্ধিমানেরা তর্ক করে, প্রতিভাবানেরা এগিয়ে যায়...

--------------------------------------------------------------------------------------------
বললুম, 'আমার মনের সব কপাট খোলা ভোজরাজজী। আমি হাঁচি-টিকটিকি-ভূত-প্রেত-দত্যি-দানো-বেদবেদান্ত-আইনস্টাইন-ফাইনস্টাইন সব মানি!'

ইশতিয়াক রউফ এর ছবি

এইত্তো এসে পড়সি!!

নতুন লেখক, মুক্তিযুদ্ধের গল্প, অনেক কিছুই টাইপিং-এর সমস্যা... এই সব মিলিয়ে বানান ভুল ধরিনি। পরের বার রেহাই নেই, দলছুট ভাই। হাসি

বেগুনী-মডু এর ছবি

আপনার অন্য একটি লেখা পূর্ব প্রকাশিত হওয়ায় সচলায়তনে প্রকাশ করা হল না।

এই লেখাটি ডুয়াল পোস্টিং-এর কারণে প্রথম পাতা থেকে সরিয়ে অতিথি লেখকের নিজের ব্লগে নেওয়া হল।

আপনি সচলায়তনে নতুন হওয়ায় বিষয়টি আপনার পোস্টে জানিয়ে দেওয়া হল। সচলায়তন অতিথি লেখকদের কাছ থেকে অনন্য লেখা প্রত্যাশা করে। পূর্বে প্রকাশিত লেখা সচলায়তনে প্রকাশ করা হয় না।

সচলায়তনে প্রকাশিত হওয়ার ৭২ ঘন্টার মধ্যে লেখাটি অন্য কোথাও প্রকাশিত হলে তা ডুয়াল পোস্টিং বলে গণ্য হয়। সেক্ষেত্রে লেখা প্রথম পাতা থেকে সরিয়ে নিজের ব্লগে নিয়ে যাওয়া হয়।

অনুগ্রহ করে নীতিমালায় এই বিষয়ে বিস্তারিত পড়ুন।

সচল থাকুন, সচল রাখুন। ধন্যবাদ।

সুলতানা পারভীন শিমুল এর ছবি

ভালো লাগলো।

...........................

সংশোধনহীন স্বপ্ন দেখার স্বপ্ন দেখি একদিন

...........................

একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।