গল্প: পালাতে গিয়ে চির প্রস্থান। (দ্বিতীয়- পর্ব)

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: বিষ্যুদ, ০৮/১০/২০০৯ - ২:০৫অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

প্রকৃতির এই আহবানকে উপেক্ষা করার কৌশল আজ পর্যন্ত কেউ শিখেনি। যত ক্ষমতাধর, শক্তিশালী বা বিত্তশালী হোক না কেন প্রকৃতির এই ডাককে অবজ্ঞা করার ক্ষমতা কারো নেই। গ্রামের মরুব্বীদের কাছে ছোট বেলায় একটা কথা শুনতাম "-----ইয়ে ধরলে নাকি বাঘের ভয়ও থাকে না।" আর এখনতো আলোকিত দিন, সাথে চার বন্ধু, সুতরাং সাজ্জাদেরতো ভয় পাওয়ার প্রশ্নই উঠে না। আর লজ্জা! সেটাতো সাজ্জাদের প্রথম দিকে ছিলো, আস্তে আস্তে ব্যাপারটা জানাজানি হয়ে গেলে সেই লজ্জাও উবে যায়। সাজ্জাদ সম্পর্কে পূর্বানুমান থাকার কারণে শিপন অগত্যা গাড়ি থামাতে বাধ্য হল।

"শালা তখন যে বললাম" গাড়ি ব্রেক চেপে শিপন বলল।
"এখানেতো তেমন ঝোপ নেই শালায় বইব কই?" তমাল কিছুটা বিরক্তি নিয়ে বলল। বাকিরা সবাই চুপচাপ সাজ্জাদের কীর্তিকলাপ দেখার জন্য মুহূর্তে গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়াল। সাজ্জাদ কোনো কথা না বলে টিস্যু আর পানির বোতল নিয়ে খোলা মাঠের দিকে ছুটল।একটু দূরে গিয়ে ছোট একটা ঝোপের আড়ালে প্যান্ট খোলে বসে পড়ল। সবাই ওর কাণ্ড দেখে কোরাস হাসতে লাগল।
"আমি আগেই কইছিলাম ওরে আনার দরকার নাই, ও একটা প্রোবলেমেটিক বয়, দেখলিতো? মাত্র শুরু, আরো কত কী বাকি আছে আল্লাহ্ জানে।" কথাটা বলে তমাল সবার হাসির লাগামটা টেনে ধরল। ।
"সবাই আইতাছি ওরে না আনলে খারাপ দেখা যায় না? ভাববো টাকার জন্য ওরে আনি নাই।" মিঠু সাজ্জাদের প্রতি সহানুভূতি জানিয়ে বলল । কেননা এর আগে শুধু টাকার জন্য সাজ্জাদ কুমিল্লা বার্ডের ট্যূরে যায় নি। সেদিন সাজ্জাদের অনুপস্থিতি সবাই অনুভব করেছিল।
"এই রকম দুই একজন না থাকলে ঠিক জমে না। মনে নাই, কুমিল্লা গিয়ে আমরা বলেছিলাম সাজ্জাদরে নিয়ে আসলেই পারতাম। " জাকির অতীত মনে করিয়ে দিয়ে বলল। তখন তারা একটা মাইক্রো বাস ভাড়া করে গিয়েছিল, শিপনের গাড়িটা তখনো পায়নি। নূন্যতম চাঁদাটা সাজ্জাদ দিতে পারে নি। তাই কাজ আছে বলে সেই যাত্রা সাজ্জাদ সঙ্গী হয় নি। কিন্তু সেই দিন সাজ্জাদের মনে যেমন কষ্ট লেগেছিল, ঠিক তেমনি বন্ধুদের কষ্ট লেগেছিল কারণ জানার পর।
"শালার লেইগা সূর্য ডোবাটা দেখতে পারুম না আজ।" শিপন বিরক্ত হয়ে সাজ্জাদের দেরী দেখে বলল।
"দোস্ত তাড়াতাড়ি কর।" উচ্চস্বরে হাঁক দিয়ে মিঠু বলল।
"শালার কী হেঁই জ্ঞান আছে?" রাগ আর বিরক্তি মিশানো স্বরে বলল তমাল।
পাক্কা পনের মিনিট পর হাসি হাসি মুখে সাজ্জাদ গাছের আড়াল থেকে বের হয়ে আসল। কাছে এসে একটা তৃপ্তির হাসি দিল। "আহ্ কী শান্তি"

একটা চায়ের দোকান দেখে গাড়ি থামাল শিপন। "যার যার মাইনাস করার দরকার করে নে।" বলে শিপন গাড়ি থেকে নেমে নিজে একটা গাছের আড়ালে গিয়ে দাঁড়িয়ে গেল। তার দেখাদেখি বাকিরাও জামাতে অংশ নিল। শুধু সাজ্জাদ গাড়িতে বসে থাকল। নিজেদেরকে হালকা করে সবাই চায়ের দোকানের টুলে বসল।
"গাধাটায় নামে নাই?" সাজ্জাদকে না দেখতে পেয়ে তমাল বলল। জাকির কথার উত্তর না দিয়ে গাড়ি থেকে সাজ্জাদকে ডেকে নিয়ে এল। সবাই চা-বিড়ি খাচ্ছে।
সাজ্জাদ একটা কলা হাতে নিয়ে বিস্কুটের বইরমটা খুলতেই "ওই তুই কী আবার রাস্তায় হাগু করতে চাস? এই হাবিজাবি বিস্কুট না খাইলে কী শালা মারা যাবি?" বলে তমাল চেঁচাল। অগত্যা সাজ্জাদ আর বিস্কুট নিল না, শুধু কলা খেয়ে চা নিল।

তমাল দাম মিটিয়ে দিল। সবাই আবার উঠে এল গাড়িতে। গাড়ি ছুটে চলল গন্তব্যের লক্ষ্যে। আঁকা বাঁকা পাহাড়ি পথে সাপের মত মোচড় কেটে কেটে গাড়ি চলছে। শেষ বিকালের ম্রিয়মান রোদের আলো এসে পড়ে সবুজ পাতা গুলির উপর। সেই কোমল রোদের স্পর্শে চিকচিক করে উঠে কচি সবুজ পাতা। মাঠের কাজ সেরে কৃষকেরা বাড়ি ফেরার আয়োজন করছে। রাস্তার পাশে গড়ে উঠা বসতি বাড়ি গুলিতে সন্ধ্যা প্রদ্বীপ জ্বালাবার জন্য বউ ঝি রা ব্যস্ত। ঝাঁকে ঝাঁকে পাখিরা নীড়ে ফিরে যাচ্ছে। হ্যাপি আখন্দের সেই গানের মত " পাখি গুলি নীড়ে ফিরে চলছে, গানে গানে কী যে কথা বলছে।"

হোটেল সী গালে আগেই বুকিং দেয়া ছিল। পাঁচ জনের জন্য তিনটা রুম। একটা সিঙ্গেল রুম বাকি দুটো ডাবল। একা সিঙ্গেল রুমে কেউ উঠতে চাইল না। তাই সাজ্জাদকেই উঠতে হল। গরীবের প্রতি সবলদের অত্যাচার শুধু সমাজ জীবনেই না বন্ধুদের বেলাতেও ঘটে। ধুরন্ধর তমাল উঠল বিত্তশালী শিপনের সাথে এক রুমে, আর শান্ত শিষ্ট জাকির উঠল লম্বু মিঠুর সাথে। সন্ধ্যা সাতটা ত্রিশ মিনিটে তাঁরা বের হলো। সী গালের সামনের বীচে কিছুক্ষণ বসল। তমাল গান ধরল "এই মুখরিত জীবনের চলার বাঁকে------, বাকীরা সোলসের এই জনপ্রিয় গানের সাথে পরিচিত থাকায় কোরাস ধরল। তাদের আশে পাশে কয়েকটা কপোত-কপোতীর জুটি দেখতে পেল। খুব কাছাকাছি বসে আছে তাঁরা। যেন দুই মন এক দেহ। "দেখ্ দেখ্" বলে সাজ্জাদ সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করা চেষ্টা করল। সবাই গান থামিয়ে দিয়ে সাজ্জাদের দিকে তাকাল। সাজ্জাদ ইশারায় পাশের জুটির কার্যকলাপ দেখাল।
"শালা সবাই কী তোর মত নীরস? নিজের মরদ নাই একটা মাইয়া পটানোর, নির্লজ্জের মত অন্যেরটা দেইখা মজা লইতে চাস?" গানের মাঝখানে বামহাত দেয়ার জন্য বিরক্তি নিয়ে বলল তমাল।
"বাদ দে তমাল গান ধর আবার।" মিঠু বলল। শিপন মেয়েটাকে একবার দেখল। তমাল এবার মৌসুমী ভৌমিকের গানটা ধরল "আমি শুনেছি সেদিন তুমি সাগরের ঢেউয়ে চেপে নীল জল দিগন্ত ছুঁয়ে এসেছ।" শিপন গানের ফাঁকে আবার মেয়েটার দিকে তাকাল। অন্ধকারে ঠিক চেহারা দেখতে পারল না। মেয়েটার শারীরিক গঠন শিপনকে সদ্য অতীত হওয়া নিভার কথা মনে করিয়ে দিল।" হ্যাঁ ঠিক যেন নিভার প্রতিকৃতি। সেই চুল, বসার ধরন। শিপন গানে গলা মিলানোর চেয়ে মেয়েটার দিকে বেশি মনোযোগ দিল। তবে কিছুতেই চেহারা দেখতে পেল না। মিঠু আড়চোখে শিপনকে লক্ষ্য করছিল। "কিরে মাইটা কী কমন পড়ে গেল?" গান থামিয়ে শিপনকে জিজ্ঞাসা করল মিঠু। মুহুর্তে গান থেমে গেল। যেন হঠাৎ ছন্দপতন। সাগরের শোঁ শোঁ শব্দ। তমাল আর সবার বেসুরা সুরের গানের কারণে একটু আগেও শব্দটা জোরাল মনে হয় নি, এখন যেমন মনে হচ্ছে।
"পড়তেও পারে, শালায়তো ২৫ বছর জীবনে কম প্রেম করল না। শেষেরটা মিলিয়ে ২০/২২ টাতো হবেই।” বলল তমাল। সবাই জোড়ে হাসতে লাগল, সাগরের শোঁ শোঁ শব্দটা আবার একটু যেন ম্লান হল।

শিপন অন্যমনষ্ক, বন্ধুদের ব্যঙ্গ বিদ্রূপের হাসিও তাকে আড্ডায় ফিরিয়ে আনতে পাড়ল না। তাঁর মনে ভেতর এখন হেঁটে বেড়াচ্ছে নিভা। শেষ বার যখন নিভার সাথে আশুলিয়া গিয়েছিল, নিভা ঠিক এইভাবে শরীর লাগিয়ে শিপনের সাথে তিন ঘণ্টা বসে ছিল। মাথা ছিল তাঁর কাঁধে, এক হাত দিয়ে শিপনকে জড়িয়ে ধরে আরেক হাত দিয়ে শিপনের হাত নিয়ে খেলেছিল। অতীত বড় খারাপ জিনিস সুযোগ পেলেই সামনে এসে হাজির হয়। মনকে বিষিয়ে দেয়, আনন্দকে মাটি করে দেয়, যেমন দিল এখন শিপনের। এতকষ্ট করে গাড়ি চালিয়ে এসেছে বন্ধুরা মিলে আনন্দ করবে অথচ নিভা নামের অতীতটা বাগড়া দিচ্ছে। শিপনের কাছে প্রেম ভাঙ্গা গড়া মামুলি ব্যাপার, কিন্তু নিভার কাছ থেকে প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পর থেকে শিপন ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। নিভার শোঁকটা এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি। সে হয়তো পারবে কিন্তু এই মুহূর্তে নিভা মনের ভেতর বেশ যন্ত্রণা দিচ্ছে।

"কী রে দোস্ত, কী ভাবতাছস?" জাকিরের কথায় শিপন চেতনা পেল।
"কই কিছু না। গান বন্ধ করলি কেন তমাল, শিপন বলল।
"তুই যে ভাবে ঐ মেয়েটার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকায় আছস, তাতে কী গান গাওয়া যায়?" বলে একটা হাসি দিল, সবাই তমালের হাসির সাথে তাল দিয়ে অযথা হাসি দিল।

"গান বাদ দে, ক্ষিদা লাগছে, চল গাইয়া লই ।" সাজ্জাদ বলল।
"শালায় চিনে খালি খাওয়ন আর টয়লেট।" তমাল বিরক্তি আর তাচ্ছ্বিল্য নিয়ে বলল।
"না চল, খেয়ে নেই, পরে বসা যাবে, তাছাড়া কাল সকাল সকাল উঠতে হবে, আমরাতো আছি, বসার অনেক সময় পাওয়া যাবে।" বিজ্ঞের মত বলল মিঠু।
মিঠুর কথায় শিপন সায় দিল।
"হ ক্লান্ত লাগছে, খেয়ে একটু ঘুম দিতে হবে।" জাকির বলল।
"বাইনচোদ সারা রাস্তা গাড়ি চালাইলাম আমি আর ক্লান্তি লাগছে ওনার, দিইমু একটা থাপ্পড়।" একটু রাগের স্বরে শিপন বলল।
"নে চল, সাড়ে নয়টা বাজে।" মিঠুও খাবারের জন্য তাড়া দিল। অগত্যা সবাই উঠল রাতের খাবারের জন্য। শিপন উঠে পাশের কপোত-কপোতীর দিকে আরেকবার আড়চোখে তাকাল, মনের মাঝে একটু খট্কা লাগল। ঠিক যেন নিভা।

(চলবে)


মন্তব্য

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।