পরগাছা নয়, শিকড়ের শিকড়।

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: মঙ্গল, ১৫/১২/২০০৯ - ১:১৮পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

বেশ কয়েকদিন অফিসে গিয়ে সালামকে পায়নি রহিম। অফিসে না পেয়ে মোবাইলে রিং দিয়ে প্রতিদিন রেকর্ড করা মুখস্থ কথা শুনেছে-"দুঃখিত, আপনার ডায়ালকৃত নম্বরটি এই মুহূর্ত বন্ধ আছে, অনুগ্রহ করে একটু পর আবার চেষ্টা করুন।" মোবাইলেও না পেয়ে রহিমের মেজাজ বেশ তিরিক্কি হয়ে আছে। একটা ব্যবসায়ের ধান্ধা করেছে, সেখানে সালামের সাহায্য দরকার। এই ব্যাপারে সালামের ভালো অভিজ্ঞতা আছে, এক সময় সে গার্মেন্টসে লেবেল সরবরাহ করত, আজ নিজেই “অনন্ত” গার্মেন্টসের কর্ণধার।

আজও সালামের অফিসে গেল রহিম। ফলাফল আগের মত, অফিসের বড় কর্তা আসেন নি। বেশ ক'দিন ধরে নাকি ঠিক মতো অফিসে আসছেন না। এলেও ঘণ্টা দু'য়েক থেকে কিছু না বলেই বের হয়ে যান, কোনদিন বিকালের দিকে ফিরেন, কোনদিন আবার ফিরেন না। মোবাইলেও পাওয়া যায় না। সব সময় বন্ধ থাকে।

গার্মেন্টসটি চালু হয়েছে প্রায়ই চার বছর হল। চালু হবার পর এমনটা কখনো ঘটেনি । নিয়মিত অফিসে আসা যাওয়ার ব্যাপারে সে ছিল খুব সচেতন। পরিশ্রম আর মেধা দিয়ে সালাম উন্নতি করতেছে, এই উন্নতির পেছনে তাঁর বাবা শাজাহান সাহেবের অবদান অনস্বীকার্য। তাঁর আর্থিক ও মানসিক সহায়তার কারণেই সালাম আজ প্রতিষ্ঠিত। বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুদের মাঝে সালাম আজ বেশ ভাল অবস্থায় আছে। টয়োটা করোলা গাড়ি কিনেছে, ভাড়া বাসা ছেড়ে নিজেদের ফ্ল্যাটে উঠেছে। নিজে বিয়ে করেছে, একমাত্র ছোট বোনকে ভালো পাত্র দেখে বিয়ে দিয়েছে। সুখের জীবন যাকে বলে সেটাই বিরাজমান। নিজের একমাত্র ছেলে অনন্ত আর বাবা-মাকে নিয়েই তাঁর সমস্ত ভাবনা।

সালামের হঠাৎ এমন পরিবর্তনে অফিসের সবার কাছেই বেখাপ্পা লাগছে, কপালে চিন্তার ভাজ পড়েছে, সবাই দুশ্চিন্তা করছে। রহিমের মনেও একটা খটকা লাগে, ঘটনা বুঝতে না পেরে কারণ উদঘাটনে মন স্থির করে। গুছানো সালাম কেন এলোমেলো হলো এটা রহিমকে ভাবায়, তাঁর খোঁজে নেমে পড়ে। নিজের স্বার্থের জন্যই সালামকে জরুরী প্রয়োজন, তাছাড়া বন্ধুর বিপদে সাহায্য করাও দায়িত্ব।

রহিম সালামের বাসায় গিয়ে আরো অবাক্ হয়। তাঁর এমন পরিবর্তন বাসার কেউ জানে না। কেউ বিশ্বাসও করে না। সবার বদ্ধমূল ধারণা অফিসের লোকজন ভুল বলেছে, হয়তো কোন শিপম্যান্ট নিয়ে ঝামেলায় আছে, তাঁরা জানে সালাম ভালোভাবে অফিস করছে, ব্যবসা পরিচালনা করছে, দায়িত্ব পালনে ওর মত ছেলে নাকি এই সময়ে পাওয়া যায় না। রহিম কোন প্রকার কথা না বাড়িয়ে বের হয়ে আসে। ভাবে অফিসের শিপম্যান্ট নিয়ে ঝামেলায় থাকলেতো ম্যানেজার সাহেব জানত, কিন্তু সেদিন যে ম্যানেজার সাহেব নিজেই বললেন-“স্যার যেন কেমন হয়ে গেছেন, আমাদের সাথে ঠিক মত কথা বলেন না, কাজে মন নেই, সকালে অফিসে এসেই বের হয়ে যান, আমাদের কোন প্রকার দিক নির্দেশনা দেন না, ফাইল স্বাক্ষর করেন না, স্যারের জন্য মনে হয় আমরা বড় একটা অর্ডার মিস করব।” বাসার লোক তাঁর ব্যাপারে অন্ধকারে আছে, কিন্তু রহিম সালামের এহেন পরিবর্তনের রহস্য উদঘাটনে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে। পরিচিত কয়েক জন বন্ধুর কাছে ফোন করে কৌশলে সালামের কথা জানতে চায়, সবাই একি উত্তর দেয়-"না দোস্ত অনেকদিন দেখা নাই, শুনেছি ও অনেক উন্নতি করেছে, ব্যবসা -বাণিজ্য নিয়ে ব্যস্ত থাকে ।” ভাবে রাতে আবার বাসায় যাবে, পরক্ষণেই মত পরিবর্তন করে, ভাবে বাসায় গিয়ে স্বাভাবিক পরিবেশটা অস্বাভাবিক করার মানে হয় না। অন্য চিন্তা করে।

বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে রহিমদের প্রিয় জায়গা ছিল কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন। সময় পেলেই ওরা সেখানে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আড্ডা দিত। তাদের আড্ডাটা বিশ্ববিদ্যালয়ে থেকে বের হওয়ার পরও বজায় ছিল। কিন্তু চাকুরি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ায় কেউ সময় দিতে পারত না বলে আড্ডার অপমৃত্যু ঘটে। রহিমের ধারণা সালাম হয়তো নস্টালজিক হয়ে সেখানে যেতে পারে। সেই ভাবনা থেকেই দুপুরের পর রহিম সেখানে হানা দেয়। রেলওয়ে স্টেশনের পূর্ব পাশে খোলা জায়গায় যেখানে ওরা বসে গল্প করত সেই দিকে হাঁটা শুরু করে। দূর থেকে একজনকে বসে থাকতে দেখে রহিম একটু আশান্বিত হয়। দ্রুত পায়ে হেঁটে গিয়ে দেখে সালাম চুপচাপ বসে আছে। স্বাভাবিক ভাবে সালামের পাশে বসে, কোন প্রতিক্রিয়া নেই। নিষ্প্রাণ চোখে দূর আকাশের দিকে অপলক তাকিয়ে কি যেন ভাবছে সালাম। একটা কাশি দিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করল, কোন কাজ হলো না। দূর আকাশের অনন্ত নীলের মাঝে ভাবনায় ডুবে ছিল, তাই ভাবনা থেকে ফিরিয়ে আনতে রহিম কথা বলে-"তুই এখানে আর আমি তোরে সারা শহর তন্নতন্ন করে খোঁজে বেড়াচ্ছি?" কথায় কাজ হল, সালাম বাস্তবে ফিরে এল।"তুই?" কিছুটা বিস্ময় নিয়ে বলল। "হুম, তোকে অফিসে না পেয়ে বাসায় খোঁজ নিলাম, বাসার সবাই বলল তুই অফিস থেকে ফিরতে ফিরতে রাত দশটা করিস, অফিসে খোঁজ নিয়ে যা জানলাম, তাতে আমি একটু চিন্তিত হলাম, কয়েক জনের কাছে ফোন করে নিশ্চিত হলাম ওদের ওখানেও যাওয়া হয়নি, তাই পুরাতন এই জায়গাটা কথা মনে হল। কিছুটা শঙ্কা নিয়ে চলে এলাম। আর এসে তোকে পেয়েও গেলাম।" কোন প্রকার বিরতি না নিয়ে, সাত-পাঁচ না ভেবে কথা গুলি বলে সালামের দিকে তাকাল। সালাম মনোযোগ দিয়ে শুনছিল, কথা শেষ হওয়ার পর কিছু না বলে একটা বাদাম বিক্রেতাকে ডাক দিল, "বাদাম খাবিতো?" রহিমের দিকে তাকিয়ে জানতে চাইল।

সূর্য পশ্চিম আকাশে হেলে পড়েছে সেটা পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া মানুষের দীর্ঘ ছায়া দেখে বুঝা যায়। বেশ কয়েকটা ট্রেন কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন ছেড়ে ছুটে চলছে গন্তব্যের উদ্দেশ্যে। বাদাম বিক্রেতা, পান-বিড়ি বিক্রেতাদের ভীড় বেড়ে চলছে, আশে পাশের ফাঁকা জায়গা গুলো আড্ডা প্রিয় মানুষের আনাগোনায় ভরে উঠছে। দুজনে চুপচাপ বসেছিল। একটা সিগারেট বিক্রেতাকে দেখে সালাম ডাক দিল, "সিগারেট খাবি?" রহিমের দিকে তাকিয়ে জানতে চাইল।
-তুইতো ধূমপায়ী ছিলি না?
-এখনো ধূমপায়ী না, তবে আজ খেতে ইচ্ছে করছে।
-যেটায় অভ্যাস নেই সেটা বাদ দে।
-আরে দু'য়েকটা খেলে কিছু হবে না।
-দোস্ত না খেলেও কোন ক্ষতি হবে না।

রহিমের নিরুৎসাহের কারণে সিগারেট কেনা হয় না। একটা ছেলে ফ্ল্যাক্সে করে চা-কফি ফেরি করছিল। পাশ দিয়ে যেতেই রহিম বলল-"দোস্ত চা খাওয়া যায়, কি বলিস?"
-হ্যাঁ অনেকদিন বাইরের চা খাই না।

রহিম ছেলেটাকে ডাক দিয়ে দু'কাপ চা দিতে বলে। ছেলেটা গরম পানি দিয়ে কাপ ধুয়ে চা দিয়ে নতুন ক্রেতা ধরার ধান্ধায় চলে যায়। এখানে এমনটাই হয়, কেউ কিছু বিক্রি করে টাকার জন্য বসে থাকেনা, নতুন ক্রেতার জন্য পাশের আড্ডা স্থলে ছুটে যায়। পরে এসে টাকা ও কাপ নিয়ে যায়।

-সালাম, তোর মনে আছে আমরা একদিন এখানে অনেক রাত পর্যন্ত আড্ডা দিচ্ছিলাম, পুলিস এসে আমাদের জেরা শুরু করেছিল?
-মনে নেই আবার, সেদিন ডিআইজির পোলা রফিক না থাকলেতো আমাদের চৌদ্দ শিকের জল খেতে হত।
-কেন বসে ছিলাম সেটা মনে আছে?
-না, কেন যেন?
-তুই শালা একটা মনভোলা। পিয়ালের জন্য।
-হ্যাঁ মনে পড়ছে, দোলার কাছ থেকে ছ্যাঁকা খেয়ে আত্মহত্যার জন্য তিন পাতা ঘুমের ট্যাবলেট কিনছিল । আমরা জোর করে ওর পকেট থেকে সেই গুলো নিয়ে ড্রেনে ফেলে দেই।
-আমরা অনেক হাসাহাসি করছিলাম। পিয়াল অনেক রেগে গিয়েছিল, তুই সবাইকে ধমক দিয়ে পিয়ালকে বাসায় নিয়ে গেলি।
-পিয়ালের খবর কি? অনেক দিন যোগাযোগ নেই, কোথায় আছে ও?
-ওতো এখন আমেরিকাতে । সবুজ কার্ডের আশায় সিটিজেন এক মেয়েকে বিয়ে করে ওখানেই আছে। মাঝে একবার এসেছিল, আগের মতোই ধান্ধাবাজ, স্বভাব পরিবর্তন হয় নাই।
-বাচ্চা -কাচ্চা আছে?
-পিয়ালের কথা বাদ দে, তোর কথা বল।
-আমার আবার কথা। (হতাশা নিয়ে বলে)
-কেন?এমন হতাশা নিয়ে বললি কেন?
-শিকড়হীন পরগাছার আবার জীবন!
-ভাবের কথা বলছিস যে?
-ভাবের কথা না, যা সত্য তাই বললাম।
-দোস্ত তোর মত প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী যদি হতাশা নিয়ে কথা বলে, তাহলে আমাদের মত ছাপোষা চাকুরিজীবিরা কী বলবে?
-তোরা চাকুরি করিস, নিজে উপার্জন করিস, নিজস্ব পরিচিতি আছে, তোরাতো আমার মত শিকড়হীন পরগাছা না।
-তোর কী হয়েছে বল তো?
-কিছু না।
-আমি মানলাম না। তোর মত ব্যস্ত, কাজ পাগল মানুষ, অফিস ছেড়ে এখানে এসে অহেতুক স্মৃতি রোমন্থন করবে সেটা আমাকে বিশ্বাস করতে বলছিস?
-দোস্ত মনটা খারাপ ছিল তাই শিকড়হীন মানুষের জীবন যাপন দেখার জন্য , আর বলতে পারছ একটু পেছনে ফিরে তাকানোর জন্য এখানে ছুটে এসেছিলাম।
-কেন মন খারাপ, জানতে পারি?
-এমনি।
-তুই বললি আর আমি বিশ্বাস করলাম? আসল ঘটনা বল। অবশ্য যদি তোর আপত্তি না থাকে।
-সেদিন দেখলাম মা-বাবা ঝগড়া করছে।
-এর জন্য মন খারাপ? দূর বোকা, বয়স হলে, দাম্পত্য জীবনে এমন একটু হয়েই থাকে, সেটা কানে তুলতে নেই। তোদের মাঝে কী কথা কাটা কাটি হয় না? এরকম কিছু একটা হবে, এই নিয়ে ভেবে সব ছেড়ে এখানে বসে আছিস, পাগল, উঠ, চল তোর অফিসে যাই, তোর সাথে আমার কাজ আছে।
-আরে এটা মামুলী ঝগড়া না। তুই যেটার কথা বলছিস সেটাতো ছোট বেলা থেকেই দেখে আসছি, কিন্তু সেদিন...
-থামলি কেন?
-মা-বাবার এই ঝগড়াটা যে আমাকে নিয়ে।
-তোকে নিয়ে? (বিস্ময় নিয়ে জানতে চাইল)
-হুম
-বুঝলাম না, যদি কিছু মনে না করিছ জানতে পারি?

সালাম চুপ হয়ে গেল, কিছুক্ষণ সময় নিল। সূর্য ডুবে গেছে, প্লাটফর্মের নিয়ন বাতি জ্বলে উঠেছে। বড় বড় মশা কানের সামনে ভোঁ ভোঁ শব্দ করছে। রহিম সালামের উত্তরের আশায় নিশ্চুপ বসে ছিল। চা বিক্রেতা এসে টাকা চাইতে রহিম টাকা দিয়ে দিল। চা বিক্রেতা টাকা নিয়ে চলে গেল।
-রহিম, এত দিন যাকে নিজের বাবা বলে জেনেছি, আসলে সে আমার বাবা না, আমার আশ্রয় দাতা।
-কি ফালতু কথা বলিস? পাগলামি করছিস কেন? আমি সেদিন বাসায় গিয়ে দেখেছি, সবাই তোকে কী রকম ভালবাসে, তুই তাদের একমাত্র ভরসা স্থল। চাচা তোর প্রশংসায় পঞ্চমুখ।
-আমি যা বলছি সেটাই বাস্তব, সেটাই আমার কাছে এখন চরম সত্য।
-মানে? এইসব আজগুবি কথা তোকে কে বলল?
-কেউ বলেনি, আমি নিজে শুনেছি।
-মানে? কি বলিস? রহিম আর কিছু বলতে পারল না। চুপ মেরে গেল। সালামের দিকে তাকিয়ে ছিল। নিয়ন আলোয় সালামের চোখের জল চিক্চিক্ করছে। পকেট থেকে রুমাল বের করে চোখ মুছে নিল। স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করে আবার বলল-
-সেদিন অফিস থেকে তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরে ছিলাম, বউ, মানে তোর ভাবী, ছেলেটাকে নিয়ে মায়ের বাসায় গেছে। আমি একা ড্রয়িং রুমে বসে টিভি দেখছিলাম। বাবা-মা তাদের রুমে কথা বলছিল, তাদের রুমের দরজা খোলা থাকায় আমি সব শুনছিলাম। আমি সাধারণতঃ তাদের কথাবার্তায় কান দেই না, তাদের ঝগড়াকে গুরুত্ব দেই না, জানি এই ঝগড়া করছে আবার একটু পরই একজন আরেক জনকে ছাড়া থাকতে পারবে না। কিন্তু সেদিন ঝগড়ার মাঝ খানে আমার নামটা কানে আসাতে টিভির ভলিউম কমিয়ে শোনার চেষ্টা করলাম, যা শুনলাম তাতে আমি আমার কানকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না, বাবা-মায়ের কথা গুলো আমার কাছে মনে হয়েছিল আণবিক বোমা, জাপানের সভ্যতা ধ্বংসের মত তাঁদের কথার আণবিক বোম যেন আমার বুকটা তছনছ করে দিচ্ছিল। আমার জীবনের চরম সত্যটি দু’জনের বাকবিতণ্ডায় বের হয়ে এল। আড়াল থেকে প্রকৃত ঘটনা শুনতে পেলাম।
-কী? সালাম কিছুটা আগ্রহ ও বিস্ময় নিয়ে জানতে চাইল।
-মা বাবাকে বলছিল "তুমি সব জেনে সালামকে ছেলে হিসেবে মেনে নিয়েই আমাকে বিয়ে করেছিলে। আজ কেন তুমি ওকে সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করতে চাও?" বাবা বলছিল-"যুদ্ধের পর তোমার কথা ভেবে আর শহীদ মুক্তিযোদ্ধা বন্ধুকে দেয়া কথা রাখার জন্যই বিয়ে করে তোমার অনিশ্চিত ভবিষ্যতটাকে নিশ্চিত করেছিলাম।" মা বলছিল-"আমি তোমাকে প্রথমেই বলেছিলাম আমার সালাম কে নিজের ছেলে হিসেবে মেনে নিতে পারলে, নিজের ছেলের মর্যাদা দিতে পারলেই বিয়ে করব, আর তুমি সেই নিশ্চয়তা আমাকে দিয়েছিলে বলেই বিয়ে করেছিলাম। আজ এত বছর পর তোমার এমন চেহারা দেখব, কোন দিন ভাবি নাই।" বাবা, মানে আমার আশ্রয় দাতা বলছিল-"ওর জন্য আমি কম করেছি? বড় করেছি, লেখা পড়া শিখিয়েছি, ব্যবসা শিখিয়েছি, আমার ব্যবসায়ের সমান অংশীদার করেছি, আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমার অর্ধেক পাবে আমাদের মেয়ে শাম্মী। এছাড়া ফ্ল্যাট, দেশের জমি, আশুলিয়ার জমি আর কোনাবাড়ির জমি সব আমি মেয়ে শাম্মীর নামে লিখে দেব।" আমি আর শুনতে পারছিলাম না, ঘর থেকে বের হয়ে ছাদে চলে গিয়েছিলাম, সেদিন থেকে আমার জীবনটা অর্থহীন মনে হচ্ছে, মনে হচ্ছে বাবার আদর নয় কারো করুণা নিয়ে, দয়া নিয়ে বড় হয়েছি। আমার জন্য যা করা হয়েছে সেটা মার কাছে দেয়া ওয়াদা রক্ষা, শহীদ বন্ধুর কাছে দেয়া প্রতিশ্রুতি রক্ষা করার চেষ্টা মাত্র। সেখানে ভালবাসা, মমতা, পিতৃস্নেহ অনুপস্থিত।
-দোস্ত আমি তোর অবস্থাটা বুঝতে পারছি, হয়তো তোর জায়গায় থাকলে আমিও এমনটাই ভাবতাম, তারপরও বিনা পয়সায় উপদেশ দেয়ার চেষ্টা করছি, ভেবে দেখ তোর বউ আছে, একটা ছেলে আছে, তুই যদি ভেঙ্গে পড়িস তাহলে ওরা কি ভাববে। ওদের মানসিক অবস্থাটা কী হবে? তাছাড়া ৩৭/৩৮ বছরের সম্পর্কের কী কোন মূল্য নেই? চাচাতো তোর ছেলের জন্য পাগল।
-হুম পাগল! আমার ছেলে হচ্ছে ওনার সময় কাটানোর খেলনা। মেয়ের ঘরে নাতি এলে এটাও তখন অন্যের ছেলে হয়ে যাবে।
-চাচা যেটা বলছে সেটাতো নাও করতে পারে? শাম্মীতো নাও মানতে পারে। পজিটিভ ভাবে চিন্তা কর।
-দোস্ত আমি টাকার জন্য, সম্পত্তির জন্য ভাবছিনা, আমি যা শিখেছি, আমার যা আছে তা দিয়ে ভালো ভাবে জীবন কাটাতে পারব। কিন্তু আমি এতদিন যাকে বাবা জেনেছি সে আমার বাবা না, এইটা আমি মানতে পারছি না। মনে হলেই আমি মানতে পারছি না। ওনার সামনে যেতে পারছিনা, ওনার কোন কিছু আমার আর ধরতে ইচ্ছে করে না, আমার কিচ্ছু ভালো লাগে না।
-দোস্ত আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধটাই আমাদের কাছ থেকে অনেক কিছু কেড়ে নিয়েছে, আবার ফিরিয়েও দিয়েছে অনেক কিছু। প্রাপ্তি আর প্রদানের হিসেব করলে হয়তো মেলাতে পারবো না, কিন্তু স্বাধীন দেশ আর পতাকাটা দেখলে কী সব হারানোর কথা মানুষ ভুলে যায় না? ভেবে দেখ তুইতো তবু বাবার স্নেহ পেয়ে ভালো ভাবে লেখাপড়া শিখে বড় হয়েছিস, নিজের পায়ে দাঁড়াতে শিখেছিস, একটা কিছু করে চলতে পারার মত যোগ্য হয়েছিস। এখনো বাংলাদেশের অনেক মুক্তিযোদ্ধা আছে যারা দু'বেলা খাবার পায় না, ছেলে-মেয়েকে লেখাপড়া শিখাইতে পারে না। দুর্বিষহ জীবন যাপন করছে। অনেকে আছে পরিচয়হীন ভাবে বেড়ে উঠেছে, বিপথে গিয়ে জীবন হারিয়েছে। অনেকে বীরাঙ্গনা উপাধি নিয়ে বেঁচে আছে। তাদের জীবন কী থেমে আছে? বীরাঙ্গনারা কী বেঁচে নেই? তাঁরা কেন বেঁচে আছে জানিস?
-কেন? শুষ্ক গলায় জানতে চাইল।
-এটা তাদের অহংকার, তাদের আত্মত্যাগের কারণেই আজ দেশ স্বাধীন, তোর জন্মদাতা বাবার রক্তের সাগর পেরিয়েই আমাদের স্বাধীনতা এসেছে। আমরা চাচাদের মত বীর সন্তানদের জন্য স্বাধীন বাংলাদেশ পেয়েছি, সবুজের বুকে লাল পতাকা পেয়েছি, ৫৬হাজার বর্গ মাইলের মানচিত্র পেয়েছি। শাজাহান চাচার মত মহানুভব মানুষের কারণেই তোর মত অনেক মেধাবী সালাম তৈরি হয়েছে। তাদের অবদানটাকে ছোট করে দেখে নিজেকে কষ্ট দেয়ার মানে হয় না। মনে রাখিস তুই একজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান। তুই এদেশের শিকড়ের শিকড়।
দু'জনেই কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকল। নীরবতা ভেঙ্গে রহিম বলল-"চল অফিসে যাই, আমার একটা কাজ করে দিতে হবে।"
=========
ডি, এম, কামরুজ্জামান (দলছুট)


মন্তব্য

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।