হীরককুচি ভালোবাসা/ মধুবন্তী

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: মঙ্গল, ২২/১২/২০০৯ - ১২:২৯অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

গ্রীষ্ম তখন শুরু।
কৃষ্ণচূড়ার ডালে ডালে গ্রীষ্ম এসে জানান দিচ্ছে, আমি এসেছি।
এই পথে, দুদিকে দুটো কৃষ্ণচুড়া- লালে লাল, আর এই পথে-
ভোরের নরম আলো মাখা প্রহরে প্রথম দেখা দুজনার।
কেউ কাউকে চেনে না, কেউ জানে না কাউকে-
কিন্তু সে প্রথম দেখার দুজোড়া চোখে কি ছিল,
কৃষ্ণচূড়ার লালরঙ আবীর হয়ে ছড়িয়ে যায় দুজনার চোখে মুখে।
মেয়ে তুমি কাকে দেখলে! এ যে তোমার আজন্ম লালিত স্বপ্নপুরুষ।
কোথায় পালাবে এবার!

তারপর! সে দেখার পর তাদের কি কি হয়েছিল?

পাশাপাশি চলেনি তারা, চলতে পারেনি, ভাগ্যবিধাতা ভাগ্যে লিখেন নি বলে। গ্রীষ্মের দিনগুলো শেষ হবার আগেই তাদের প্রেম শেষ হয়ে যায়।সে প্রেম ছিল কাগজে শব্দ সাজানো মন মেলে দেওয়া প্রেম। কথার মালা গেঁথে গেঁথে একে অপরকে চেনা। কিন্তু সেখানেও কি ক্লান্তি জমেছিল? নইলে সে মেয়েটিকে ফেলে চলে গেল কেন। যাবার কথা তো ছিল না। কথা তো ছিলো পাশাপাশি হাতে হাত রেখে দুজনার একটি জীবন পার করার।ছেলেটির ক্লান্তি এলো কেন, কিছুই না বলে সে চলে গেল। মেয়েটি তখন অনেক খুঁজেও তাকে পায়নি। তার প্রথম ভালোবাসাকে পায়ে দলে যে চলে গেল, তাকে মেয়েটি ভুলতে পেরেছিল কি! ভুলে থাকার চেষ্টা কেবল। সময় তাতে প্রলেপ দেয়, ক্ষতটা শুকোয় হয়ত, কিন্তু তার দাগ থেকে যায়।

সেই দাগ নিয়ে চক্রাকারে ঘুরতে থাকে সময়। গ্রীষ্ম, বর্ষা, শীত, বসন্ত পারি দিতে দিতে ক্ষতচিহ্ন একসময় হালকা হতে থাকে। ক্রমশ আরো হালকা একটা চিহ্ন রয়ে যায়, কখনো সখনো সেখানে হাত বুলোতে বুলোতে মনে পড়ে সেই শুভক্ষণের প্রথম দেখার কথা। আঁজলা ভরা জলে হালকা করে ভেসে ওঠে কখনো সে মুখ।

দিন গড়াতে গড়াতে বহুকাল যায়। এবার গ্রীষ্ম নয়, আসে শীত। শীতের সন্ধ্যাগুলো কুয়াশা গড়ানো। কিছুটা ধূসর। এ কৃষ্ণচূড়ায় ছাওয়া সকাল তো নয়, শীতের মিহি কুয়াশার চাদরে ঢাকা সন্ধ্যা। হঠাৎ আবার দেখা তার সাথে। এ সেই ছেলে নয়, কিন্তু মন বলে যাকে আজন্ম নিজের করে চেয়েছিল, তার সাথে আবার কেন মিলে মিলে যায়। আবার কেন তার পদধ্বনি বাজে হৃদয়ে। দিন-রাত একাকার করে ভুলে থাকা নানা কাজের মধ্যে তার ছায়া পড়ে বার বার।

আবার শব্দমালা গাঁথা।
আবার নক্সীকাঁথা বোনা।
শীত আকাশে আলোর রঙ।
সে আলো আবার যেন ছড়িয়ে যেতে থাকে দুজনার মনে।
তবু মন খুলতে বেজায় ভয় দুজনেরই।
কে আগে বলবে?
কে আগে? কে কে কে?

বলবো না বলবো না ভাবতে ভাবতে একসময় নিজের সাথেই যুদ্ধ। সে তার শব্দাবলীতে অভয়বাণী পাঠায়। মন খোলার আশ্বাস দেয়। ততদিনে শীত পেরিয়ে গ্রীষ্ম এসে গেছে। নিজে নিজে গুমড়ে ওঠা মন নিয়ে আর নিজের সাথে যুঝতে না পেরে অগত্যা সে মেয়েটি আরেকবার,শেষবারের মত মন মেলে ধরে।
এবারে বোধহয় মেয়েটি তাকে পেল, শেষ অব্দি তার ভালোবাসার জয় হলো। স্বপ্নপুরুষকে কাছ থেকে দেখার সুযোগ নেই, দূর থেকেই তার পায়ের কাছে ভালোবাসার অর্ঘ্য পাঠানো। তাই বা কম কি। কিশোরবেলার মত উপচে ওঠে মন। চিলেকোঠা কোণে রেখে আসা সেইসব ভালোলাগা গুলো ফের মনে এসে বাসা বাধে। গ্রীষ্মের সেই সকালগুলো না বুঝতেই যেখানে ফুরিয়ে গেছিলো সেখান থেকেই আবার পথ চলা যেন শুরু। মন কেমন করে ওঠা দিনের শুরু আবার।

ওদের কি দেখা হয়েছিল?

নাহ্। ওরা কেউ কারো দেখা পায়নি। শুধু শব্দ দিয়ে একে অপরকে জেনেছে। দিনের পর দিন। রাতের পর রাত।

কাগজের দুটো পৃষ্ঠার মত প্রেম,
কোনদিন কেউ ছোঁবে না পরষ্পর।[নির্মলেন্দু গুণ]
তবু সেই ভালোবাসা এমনি দামী দুজনের কাছে,শব্দগুলো যেন হীরককুচি। মনের গোপন মণিকোঠায় রাখা সে অমূল্য ভালোবাসা। নক্ষত্ররাতে সে ভালোবাসাকে অনেক দূরে বসেও তারা অনুভব করে। ধীরে অতি ধীরে.... মনের মধ্যে জন্ম নেয়, আরও ধীরে মনে ডালপালা মেলে ধরে কিছু ইচ্ছে। সে ইচ্ছেঘুড়ি বিকেলবেলার আকাশে উড়তে চায়।শিহরিত হয় হৃদয় বারবার।স্পর্শহীন,শুধু শব্দ দিয়ে চেনা.. তবু কেন ভালোবাসায় কাঁপে হৃদয়।

তারপর? কি হলো ওদের..ওরা কি পেলো এবার আপন করে?
তারপর.....................শুনবে?
আমরা মিশিনি ভালোবেসে সব
মানুষ যেভাবে মেশে,
আমরা গিয়েছি প্রাজ্ঞ আঁধারে
না-জানার টানে ভেসে।
ভাসতে ভাসতে আমরা ভিড়িনি
যেখানে নদীর তীর,
বুনোবাসনার উদ্বেল স্রোতে
আশ্লেষে অস্থির।
আমরা দু’জনে রচনা করেছি
একে অপরের ক্ষতি,
প্রবাসী প্রেমের পাথরে গড়েছি
অন্ধ অমরাবতী।
আমরা মিশিনি বিহ্বলতায়
শুক্রে-শোনিতে-স্বেদে,
আমাদের প্রেম পূর্ণ হয়েছে
বেদনায়, বিচ্ছেদে।
[নির্মলেন্দু গুণ]

মধুবন্তী মেঘ
অতিথি লেখক


মন্তব্য

তিথীডোর এর ছবি

এককথায় চমত্‍কার!!
"আমরা মিশিনি..." ;আমার অসম্ভব প্রিয় একটা কবিতা..

আপনার নিকটাও কিন্তু ভীষণ সুন্দর!!

--------------------------------------------------
"সোনার স্বপ্নের সাধ পৃথিবীতে কবে আর ঝরে..."

________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ তিথীডোর। আপনার উপস্থিতি ভালো লাগল। "আমরা মিশিনি" কবিতাটা আমারও ভীষণই প্রিয়।
শুভেচ্ছা জানবেন।
মধুবন্তী মেঘ

স্নিগ্ধা এর ছবি

বাহ্‌, ভালো লাগলো, মধুবন্তী! স্বাগতম!

তিথীডোরের মত বলি - আমারও আপনার নিকটা খুব পছন্দ হাসি

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ স্নিগ্ধা। আমার লেখাতে আপনার মন্তব্য পাব, ভাবিইনি। ভালো লাগছে।

মধুবন্তী মেঘ।

পান্থ রহমান রেজা এর ছবি

লেখার প্রতি, শব্দের প্রতি এই তীব্র ভালোবাসাই তো জাগিয়ে রাখে আমাদের, কবিতা-শব্দপ্রেমীদের।
......................................................................
আমি অতো তাড়াতাড়ি কোথাও যেতে চাই না;
আমার জীবন যা চায় সেখানে হেঁটে হেঁটে পৌঁছুবার সময় আছে,
পৌঁছে অনেকক্ষণ ব'সে অপেক্ষা করার সময় আছে।

অতিথি লেখক এর ছবি

পান্থ, শুভেচ্ছা জানবেন।

তানবীরা এর ছবি

গুনের এই কবিতাটা আমারো খুব পছন্দের।

আপনার লেখার ভঙ্গীটাও দারুন।

*******************************************
পদে পদে ভুলভ্রান্তি অথচ জীবন তারচেয়ে বড় ঢের ঢের বড়

*******************************************
পদে পদে ভুলভ্রান্তি অথচ জীবন তারচেয়ে বড় ঢের ঢের বড়

অতিথি লেখক এর ছবি

তানবীরা, ধন্যবাদ আপনাকে।

তুলিরেখা এর ছবি

খুব ভালো লাগলো, লেখাটা আর এই খুব যত্নে তুলে আনা কবিতাটা।
শেষ লাইনটা... কি বলবো....
আমাদের প্রেম পূর্ণ হয়েছে
বেদনায়, বিচ্ছেদে।

এ বিচ্ছেদ আসলে মিলনের চেয়েও অনেক নিবিড় মিলন। এক কবি একদিন বলেছিলেন মাঝরাতে জেগে উঠে তিনি দেখেন পাশের মানুষটিকে তিনি হারিয়েছেন, এ কি বিপুল দুস্তর বিরহ! সবচেয়ে কাছের মানুষটির অনন্তের সঙ্গে তার অনন্তের বিরহ! তিনি দূরে চলে গেলেন এই প্রার্থনা নিয়ে, তার অনন্তের সঙ্গে আমার অনন্তের বিচ্ছেদ কখনো না হোক!

ভালো থাকবেন মধুবন্তী মেঘ।

-----------------------------------------------
কোন্‌ দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

অতিথি লেখক এর ছবি

তুলিরেখা, অসংখ্য ধন্যবাদ। আপনাকে আমার পোস্টে পেয়ে খুব ভালো লাগছে।
সচলে আমি প্রায়ই ভুলে যাই মন্তব্যের শেষে নিক লিখতে। আসলে অভ্যস্ত নই বলেই ভুল হয়। এর আগের মন্তব্যগুলোতে একই ভুল করেছি। এবার ঠিকঠাক থাকব।

ভালো থাকবেন আর আমার অসংখ্য ভালোলাগা জানবেন।
মধুবন্তী মেঘ
অতিথি লেখক

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।