কংচাইরী মারমা

বাউলিয়ানা এর ছবি
লিখেছেন বাউলিয়ানা [অতিথি] (তারিখ: বিষ্যুদ, ২৫/০২/২০১০ - ৬:১২অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

১৯৯০ সাল। পার্বত্য চট্টগ্রামের যে থানা সদরটাতে আমরা প্রথম থাকতে গেলাম তাতে বছর চারেক আগে শান্তি বাহিনী নামের এক অশান্ত মানুষের দল নজীরবিহীন ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। সেই ক্ষত মাত্রই শুকিয়ে এসেছিল। সরকারের এক আদেশে তখন সমতলভূমি থেকে হাজারে হাজারে মানুষ হিলট্র্যাক্টস মানে পাহাড়ী এলাকায় বসতি স্থাপন করছে। তাদেরকে সবাই বলে "সেটেলার", রাষ্ট্রীয় পরিভাষায় "অ-উপজাতি"। আমার আব্বার চাকরী সূত্রে আমাদের সবাইকে সেখানে কয়েক বছর থাকতে হয়।

সেই থানা সদরের একমাত্র উচ্চবিদ্যালয়ে আমি ভর্তি হই, আমি লক্ষ্য করলাম ক্লাসের অর্ধেকেরও কম পাহাড়ী (আমি সচেতন ভাবেই উপজাতি শব্দটা ব্যবহার করছিনা) ছাত্র। তাদের মধ্যে চাকমা কম বরং ত্রিপুরা আর মারমা-ই বেশি। তো আজকে যার কথা বলব সে হচ্ছে কংচাইরী মারমা। ক্লাসের সবচেয়ে লম্বা ছেলে, সুঠাম দেহের অধিকারী। অন্য পাহাড়ী ছাত্রদের স্বাস্থ্যের তুলনায় অনেক ভাল এবং স্বাভাবিকভাবেই টকটকে ফর্সা। আমি যে কয় বছর সেখানে ছিলাম সবসময় কংচাইরী ছিল সবার পিছনের বেঞ্চের ছাত্র। তাকে কোনদিন দেখিনি মাঝখানের বা সামনের কোন বেঞ্চে বসতে। সে ছাত্র হিসেবে যেমন খারাপ ছিল, তেমনি বসত গিয়ে একদম পেছনে। সে এটা বুঝত না যে সব স্যারই পড়া ধরবার সময় পেছন থেকে শুরু করে। আর কংচাইরী পড়া না পেরে মার খেয়ে যেত ক্লাসের পর ক্লাস, দিনের পর দিন।

এমন অনেক দিন গেছে কংচাইরী সেদিনের প্রত্যেক ক্লাসে মার খেয়েছে। যে মঞ্জুলা ম্যাডাম কারও গায়ে তেমন একটা হাত তোলেন না, তিনিও বিরক্ত হয়ে তাকে কয়েক ঘা লাগিয়েছেন। কংচাইরী অংক একেবারেই পারত না। হোমওয়ার্কগুলো অন্য কারও থেকে দেখে দেখে করত। সেই জন্য সে স্কুলে আসত সকালে সবার আগে। তারপর যে প্রথম ক্লাসে আসত, তার খাতা চেয়ে নিত। আমাদের মধ্যে অনেকের সাথে রেশারেশি ছিল, ভাল ছাত্রদের মাঝে প্রতিযোগিতা ছিল, একজনের খাতা আরেকজনকে দিতাম না। কিন্তু কংচাইরীর ব্যপারে সবাই উদার। কারন তার প্রতিদিনের মার খাওয়া দেখতে দেখতে আমরা স্যারদেরকে একরকম ভিলেন ভাবতে শুরু করেছিলাম আর কংচাইরী ছিল নিপীড়িত জনতা। তাকে অন্তত একজন স্যারের মারের হাত থেকে বাঁচানো ছিল আমাদের কাছে অনেক বড় কিছু।

তারপরও সে মার খেত, পড়া না পারলে, হোময়ার্ক না করে আনলে স্যারদের হাতে তাকে মার খেতেই হতো। প্রতিবার বেতের মার খাবার সময় সে মুখটা নিচু করে গেঁজ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকত। তার মুখ দেখে বোঝা যেতনা আসলে কি পরিমান ব্যাথা সে পাচ্ছে। তাকে খুব একটা কাঁদতেও দেখিনি। কংচাইরী লম্বায় অনেক স্যার থেকেও বেশী ছিল, সে সব স্যার তাকে মেরে সুবিধা করতে পারত না। একবার মোস্তফা স্যার ইংরেজী ক্লাসে তাকে কি একটা ট্রান্সলেশন জিজ্ঞেস করে, স্বভাবতই সে পারেনি। আর যায় কোথায় স্যার দিল মাইর। কিন্তু উনার প্রায় দিগুন লম্বা কংচাইরীকে মেরে সুবিধা করতে পারছিলেন না। তাই বোধহয় মনে মনে তিনি আরও রেগে উঠছিলেন। একটা পর্যায়ে কংচাইরীকে টেবিলের নীচে মাথা ঢুকিয়ে দিয়ে মারা শুরু করলেন। আমি জীবনে কখনই ঐ দৃশ্যটা ভুলবনা, একজন শিক্ষকের ক্রোধে উন্মত্ত চেহারা, চোখ দুটো দিয়ে ঠিকরে বেরিয়া আসা আগুনের আভা। আর উনি দিক্বিদিক শুন্য হয়ে মেরে চলেছেন তার ছাত্রকে।

সেদিন টিফিনের পরের ক্লাসে খায়ের স্যার আসলেন। উনি প্রায়ই ছাত্রদের ধরে ধরে বাসার খবর জিজ্ঞেস করতেন। কী দিয়ে ভাত খেয়েছি, ছোট বা বড় ভাইদের কী অবস্থা এইসব জিজ্ঞেস করতেন। তো কংচাইরীকে জিজ্ঞেস করলেন সকালে কী দিয়ে ভাত খেয়েছে। সে নিরুত্তর। আরও কয়বার জিজ্ঞেস করতে-সে বল্ল ভাত খায়নি। স্যার বললেন, তাইলে রাতে কী দিয়ে খেয়েছিস সেটা বল। সে বল্ল রাতেও ভাত খায়নি, তবে অন্য কিছু খেয়েছে। তখন স্যার তাকে তার পরিবারের অন্যদের কথা জিজ্ঞেস করলেন-যে আর কে কে আছে, তারা কী করে এইসব। কংচাইরীতো এমনিতেও মুখচোরা, কিছু বলতে চায়না। অনেক চাপাচাপিতে যা বল্ল তাতে বুঝলাম, তার আসল বাবা নেই। সে তার মায়ের দ্বিতীয় স্বামীর সাথে থাকে। সেই লোক এমনই বদ, তাকে কিছুতেই স্কুলে আসতে দেয় না। ভোরে উঠে সে জমিতে কাজ করে, সে কাজ শেষ করে তারপরই স্কুলে আসতে পারে। সেজন্য প্রায় দিনই তার সকালে খাওয়া হয় না। স্কুলে যে টিফিন দেয় সেটাই তার খাবার।

তারপরও কংচাইরী স্কুলে আসত। কিসের লোভে আসত জানিনা, কিন্তু তাকে আমি খুব কমই দেখেছি স্কুল কামাই করতে। অনেকদিন দেখেছি পায়ে কাদা লেগে আছে, পরনের স্যান্ডেলটা গুনা দিয়ে সেলাই করা। আমি কাছে গেলেই ধরা পড়ে যাওয়া অপরাধীর মত মুখ করে আরেকদিকে তাকিয়ে থাকত। আর কিছু জিজ্ঞেস করলে ছোট ছোট চোখগুলো আরও ছোট করে একটা হাসি দিত। আমি বুঝতাম স্কুলের প্রতি এই ছেলের অসম্ভব একটা টান আছে। না হয় এরকম অমানুষিক পরিশ্রম করে কেউ স্কুলে আসতে পারে? তাও আবার প্রত্যেকটা ক্লাসে মার খাবার জন্য!

তার কয়েক বছর পর সেই শহর ছেড়ে চলে যাই। যে কয়জনের সাথে যোগাযোগ ছিল তাদের কাছে শুনতে পাই কংচাইরী ক্লাস টেন অবদি পড়েছিল। প্রত্যেকবার যদিও সে দু-একটা বিষয়ে ফেল করত, স্যারদের বিশেষ বিবেচনায় সে ঠিকই প্রমোশন পেত।

অনেক বছর পর একদিন আমি সেই শহরটাতে বেড়াতে যাই। হাতে ক্যামেরা, পিঠে ব্যাগ, মাথায় ক্যাপ-পুরোদস্তুর টুরিস্ট। সেদিন ছিল হাটবার, বাজারের নির্দিষ্ট জায়গা ছাড়িয়ে অনেক দূর পর্যন্ত পাহাড়ীরা বিভিন্ন ফসল নিয়ে বসে থাকে বিক্রীর আশায়। আলু-পটল-চিচিংগা থেকে শুরু করে কলা-বাঁশের মোচা কী নেই সেখানে। আমি রং-বেরং এর ফল ফলাদির ছবি তুলি আর মনে মনে বলি আহা আহা। ক্যামেরার লেন্সে হঠাত একটা পরিচিত মুখ দেখে চেনার চেষ্টা করি। দেখি সে ঠিকই আমার দিকে তাকিয়ে মিটি মিটি হাসছে। ছোট ছোট কুতকুতে চোখ আর তামাটে বর্নের মুখটাতে এক অদ্ভুত সরল হাসি। আমি চিনতে পারি, এ হচ্ছে আমাদের কংচাইরী। আমি কাছে যেতেই সে আমায় জড়িয়ে ধরে।

আমি বলি, "আরে! কংচাইরী তুমি এখানে"?

সে বলে, "আলু বিচি"! কংচাইরীর মুখের হাসিটা একটুও ম্লান হয়নি।

(বাউলিয়ানা)


মন্তব্য

স্নিগ্ধা এর ছবি

একজন শিক্ষকের ক্রোধে উন্মত্ত চেহারা, চোখ দুটো দিয়ে ঠিকরে বেরিয়া আসা আগুনের আভা। আর উনি দিক্বিদিক শুন্য হয়ে মেরে চলেছেন তার ছাত্রকে।

কী নিয়ে মন্তব্য করবো বুঝতে পারছি না - কংচাইরীর পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ, না ঐ ধরনের 'শিক্ষক'দের অমানুষিক শিক্ষাদান পদ্ধতি, নাকি কংচাইরীর একরকমের প্রেডিকটেবল পরিণতি - জানি না ......

আচ্ছা, একটা প্রশ্ন - কংচাইরী পড়া পারতো না কি তার বোঝার ক্ষমতার সীমাবদ্ধতার কারণে, নাকি পড়ানোর মাধ্যম বাংলা (ধরে নিয়েছি সেটাই) হওয়ার জন্য তার বুঝতে অসুবিধা হতো?

ইয়ে, অনেক টাইপো আছে কিন্তু হাসি

বাউলিয়ানা এর ছবি

কংচাইরী পড়া পারতো না কি তার বোঝার ক্ষমতার সীমাবদ্ধতার কারণে, নাকি পড়ানোর মাধ্যম বাংলা (ধরে নিয়েছি সেটাই) হওয়ার জন্য তার বুঝতে অসুবিধা হতো?

-কংচাইরীর পড়াশুনার মাথাটা তেমন তৈরী হয়নি, তার প্রাথমিক শিক্ষায় দুর্বলতার কারনে। তবে মাধ্যম বাংলা হওয়াতে বুঝতে সমস্যা হবার কথা না। কারন আমাদের সাথের অন্য পাহাড়ী ছাত্রদের অনেকেইতো খুব ভাল করেছে কেউ ডাক্তার, কেউ পুলিশ কর্মকর্তা। সেদিনতো একজনের কথা বললামই- যিনি টিভি চ্যানেলের সংবাদ পাঠক!

স্নিগ্ধা এর ছবি

ওটা পড়িনি আগে।

মুস্তাফিজ এর ছবি

কংচাইরীর মাইর খাবার কথা শুনে খারাপ লাগলো। ভালো কথা হলো ইদানীং স্কুলে বাচ্চাদের তেমন পেটানো হয়না

...........................
Every Picture Tells a Story

বাউলিয়ানা এর ছবি

হা হা হা....মুস্তাফিজ ভাই, কোন স্কুল? ঢাকা-চিটাগং বা শহরের আধুনিক স্কুলগুলো হয়তো অনেক রয়ে সয়ে, কিন্তু আটষট্টি হাজার গ্রাম বাংলার অন্য সব স্কুলের কি হবে?

এখনও মফস্বল শহরের বইয়ের দোকানগুলোতে একটা চলতি আইটেম কিন্তু জালি বেত!

পড়ার জন্য অশেষ ধন্যবাদ।

অম্লান অভি এর ছবি

এতো সেদিন মানে মাস ছয়েক হবে বৈকি একজন হীনমন্য মাদ্রাসা শিক্ষকে দেখলাম কি আয়েশ করে ছাত্র পিটাছেন। কেউ নেই বলার এবং ভুল ধরিয়ে দেয়ার।
তাই মাথা নোয়ালাম....

মরণ রে তুহু মম শ্যাম সমান.....

বাউলিয়ানা এর ছবি

সেটাই, আমরা শিক্ষকদের মানোন্নয়নের ব্যপারটা একদম ভুলে আছি।

দেশের এতগুলো বিএড কলেজ আছে, টিচার্স ট্রেইনিং ইন্সটিটিউট আছে তারপরও কেন আমাদের শিক্ষকদের পাঠ দান পদ্ধতি এমন মধ্যযুগীয়-কে জানে।

অম্লান অভি এর ছবি

এতো সেদিন মানে মাস ছয়েক হবে বৈকি একজন হীনমন্য মাদ্রাসা শিক্ষকে দেখলাম কি আয়েশ করে ছাত্র পিটাছেন। কেউ নেই বলার এবং ভুল ধরিয়ে দেয়ার।
তাই মাথা নোয়ালাম....

মরণ রে তুহু মম শ্যাম সমান.....

দুর্দান্ত এর ছবি

অনেকদিন পর স্কুলবন্ধুর সাথে দেখা হয়ে যাওয়াটাই বেশ মধুর।

বাউলিয়ানা এর ছবি

ঠিক বলেছেন।

আরও মজার হয় একজন আরেকজনকে চিনতে পেরে জড়িয়ে ধরে, স্থান-কাল না ভেবেই !!

হাসান মোরশেদ এর ছবি

আমার এক বন্ধু ছিলো ক্যাবুচিং মারমা। ওর মতো এতো সুন্দর বাংলা হাতের লেখা আমি এখনো দেখিনি। বান্দরবন থেকে নিয়মিত বিরতিতে চিঠি লিখতো।
শান্তিবাহিনীতে যোগ দেয়ার আগে শেষ চিঠি পেয়েছিলাম ওর। ফিরে এসেছিলো কিনা জানিনা।
-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

বাউলিয়ানা এর ছবি

মোরশেদ ভাই, এই ব্যপারটা খুব অদ্ভুত।

আমি দেখেছি একটা ছেলে খুব ভাল, পড়ালেখায়ও মোটামুটি, ক্লাস নাইন বা টেনে উঠে হঠাত একদিন শুনি সে শান্তি বাহিনীতে যোগ দিয়েছে। আমাদের মাথায় তখন কিছুতেই ঢুকত না কেন সে এমন করল!

অনুপম ত্রিবেদি এর ছবি

পড়ে ভালো লাগলো। 'বন্ধু' - এই সম্পর্কটা আসলেই খুব ভিন্ন ধরনের।

তবে স্কুলের মার-ধর জিনিশটা যদি ভবিষ্যতে আমার বাচ্চার ক্ষেত্রে হয়, হয়তো আমি ঐ শিক্ষক কে গিয়ে কিছু 'শিখিয়ে' আসবো। আমার এইসকল আচরনকে 'মধ্যযুগীয় বর্বরতা' মনে হয়।

===============================================
রাজাকার ইস্যুতে
'মানবতা' মুছে ফেলো
টয়লেট টিস্যুতে
(আকতার আহমেদ)

==========================================================
ফ্লিকারফেসবুক500 PX

বাউলিয়ানা এর ছবি

তবে স্কুলের মার-ধর জিনিশটা যদি ভবিষ্যতে আমার বাচ্চার ক্ষেত্রে হয়, হয়তো আমি ঐ শিক্ষক কে গিয়ে কিছু 'শিখিয়ে' আসবো।

কি করবেন বলেন, বিএড কলেজে যখন শিক্ষকদের ট্রেইনিং দেয়া হয় তখন তাদেরও এই কথাটা শেখানো হয়। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। স্কুলের শিক্ষকরা বেত ছাড়া ক্লাস করবার কথা ভাবতেই পারেন না। অবশ্য ব্যাতিক্রমও আছে। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে চিত্রটা এমনই।

আমরা শিক্ষানীতি নিয়ে যত কথা বলি, তার কিয়দংশ যদি শিক্ষকদের মানোন্নয়নের জন্য বলতাম, তাহলে হয়ত ব্যপারটা অন্যরকম হতো।

ধন্যবাদ।

অতিথি লেখক এর ছবি

প্রান্তিক মানুষদের নিয়ে মন সহমর্মী লেখা পড়তে সবসময়েই ভাল লাগে।
এখানে "আলু বিচি" মানেটা কেউ বলবেন?

কৌস্তুভ

বাউলিয়ানা এর ছবি

আলু বিচি--> আলু বেচি--> আলু বিক্রী করি।

ধন্যবাদ

অতিথি লেখক এর ছবি

বুঝলাম। ধন্যবাদ।

কৌস্তুভ

অতিথি লেখক এর ছবি

সাবলীল লেখা।

মারধোর দেওয়া, বাড়ীতেই হোক কি স্কুলে, একদম পছন্দ নয়। মিশনারী স্কুলে পড়েছি, কাজেই স্কুলে মার খাবার তো প্রশ্নই আসে না। পরে নিজে যখন পড়াতাম তখন শুনতাম, বিশেষ করে ছেলেদের স্কুলে মার খাওয়ার কথা। শিক্ষানীতিতে এই প্রথা আইন করে বন্ধ করে দেওয়া উচিত। যে ক্ষত নিয়ে শিক্ষার্থীরা বের হয়, তা অনেকসময় মুছে দেওয়া সম্ভব হয় না।

আপনার আগের লেখাতে ''উপজাতি" লিখেছিলেন, দেখে ভাল লাগল যে সেটা আর লেখেননি। জাতি হিসেবে এরা কেউ ''উপজাতি" (মানে দাঁড়ায়, খন্ডিত জাতিস্বত্ত্বা, যা মোটেই নয়) না, "আদিবাসী" (indigenous)। ছোটবয়সে আদিবাসীদের নিয়ে কার যেন গবেষণা-সংকলন পড়েছিলাম, নামটা মনে করতে পারছি না, উনি প্রথম সবাইকে পাহাড়ীদের ''আদিবাসী" বলতে অনুরোধ করেন। বেশ ক'বার পার্বত্য চট্টগ্রামে গেছি, রাজার বাড়ী ঘুরেছি, 'বিজু' দেখেছি, 'বেইন টেক্সটাইল'-এ গেছি, আমার কাছে 'পিনন' আছে - আপনার লেখা পড়ে এসব মনে পড়ে গেল।

ভাল থাকবেন আর আমাদেরকে এরকম স্মৃতি থেকে গল্প শোনাবেন, কেমন?

- শরতশিশির -

আলমগীর এর ছবি

অস্ট্রেলিয়াতে ৬০% এর মতো অভিবাভক মনে করেন বাচ্চাদের মাঝেমধ্যে চটকানা দেয়া ঠিক আছে। (স্কুলে মার বন্ধ যদিও)।

অতিথি লেখক এর ছবি

আলমগীর ভাই, তাই নাকি? সর্বনাশ! আমার মা যেটা করতেন [এবং এখনও করেন, বাই দ্যা ওয়ে চোখ টিপি ], সেটা হলো 'চোখের প্রখর দৃষ্টি' আর 'গলার স্বরের ওঠানামা' করে শাসন। তাতেই আমাদের আত্মারাম খাঁচাছাড়া!

চটকানা দেওয়ার চেয়ে 'টাইম আউট' অনেক কার্যকর মনে হয় আমার কাছে। কিম্বা 'spanking on the butt'। চড়-টড় মারলে কিন্তু সাইকোলজিকালি বেশি এফেকটেড হয় বাচ্চারা, মনে রাখে সব। "উপায় নাই, গোলাম হোসেন" স্টেজে গেলে অন্য কথা! দেঁতো হাসি

- শরতশিশির -

বাউলিয়ানা এর ছবি

আপনার কথার প্রসংগক্রমে মনে পড়ল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সময় কোটা প্রথার কথা। উপজাতি কোটা তো একটা আছেই, আরেকটা ক্যাটাগরি আছে অ-উপজাতি কোটা।

আমরা পাহাড়ীদের "উপজাতি" বলতে না চাইলেও নিজেদেরই "অ-উপজাতি" বলি চোখ টিপি

পড়ার জন্য ধন্যবাদ।

অতিথি লেখক এর ছবি

হ্যাঁ, কোটা সিস্টেম ঢা.বি.-তে ভর্তি ফরমে দেখেছিলাম, মনে আছে। আরও ছিলো সম্ভবতঃ ধর্মে কোন সম্প্রদায়, তা উল্লেখ করার নির্দেশ। এই যুগে এসে এখনও এরকম মান্ধাতার আমলের আচরণ দেখে খেই হারিয়ে ফেলি। এখানে তো ''চটকানা" লাগিয়ে কোনো কাজ হবে না, যদি কোনো বুদ্ধিমান/ বুদ্ধিমতি উর্ধ্বতন কর্মকর্তা কিম্বা শিক্ষা মন্ত্রণালয় দেখে আদেশ আসে ''কোনো এক দিন", তাহলে যদি এই সাম্প্রদায়িক প্রথা বদলায়। আর, মার্কশিট/ সার্টিফিকেট তোলার প্রক্রিয়া তো বাদই দিলাম, মনে করলেও এখন মেজাজ খারাপ হয়ে যাবে।

আমাদের সাথে একটা চাকমা মেয়ে পড়তো, ভাল রেজাল্ট করে বেড়িয়েছিল, বিসিএস দিয়ে প্রশাসন ক্যাডারে ঢুকেছে, এখন AusAid নিয়ে পড়তে গেছে। ইনফ্যাক্ট, যারা ঢাকায় পড়তে আসে, বেশিরভাগই খুব ভাল করে। ডঃ অমিত চাকমার কথা নিশ্চয় জানেন, প্রথম বাংলাদেশী-ক্যানাডিয়ান ভিসি - ইউনিভার্সিটি অফ ওয়েস্টার্ন অন্টারিওতে। খুব গর্ব লেগেছিল সেদিন দেশের বাইরে থেকে। এই হলো লিঙ্কঃ

http://en.wikipedia.org/wiki/Amit_Chakma

ভাল থাকবেন।

- শরতশিশির -

আলমগীর এর ছবি

চলুক

বাউলিয়ানা এর ছবি

পড়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ। হাসি

সাবিহ ওমর এর ছবি

লেখাটা পড়ে খুব খুব ভাল লাগলো। গল্পের মত। অবশ্য আমাদের সবার জীবনই একেকটা নোবেল প্রাইজ পাওয়ার মত গল্প। বলে ফেল্লেই হল।

বাউলিয়ানা এর ছবি

আমাদের সবার জীবনই একেকটা নোবেল প্রাইজ পাওয়ার মত গল্প

বলেন কী! কাছা মেরে নেমে যাব কিনা ভাবছি!

কাকুল কায়েশ এর ছবি

কাছা মেরে নেমে যাব কিনা ভাবছি!

আবার জিগায়! খুব টাইট কইরা কিন্তু ভাই......দেঁতো হাসি

=======================
একটাই কমতি ছিল তাজমহলে,
......তোমার ছবিটি লাগিয়ে দিলাম

==========================
একটাই কমতি ছিল তাজমহলে,
......তোমার ছবিটি লাগিয়ে দিলাম!

জুলিয়ান সিদ্দিকী এর ছবি

টিচারের মার অনেক খেয়েছি। তারা চেয়েছিলো আমাকে মানুষ করতে।
একবার জননী্ও বেদম পিটিয়েছিলেন- মানুষ হইনি বলে। আর জ্যেষ্ঠ্যরা তো ছিলেনই।

এতজন মিলে শাসন করেছেন ঠিকই, কিন্তু ঘাটের কাছে এসে দেখি সত্যিসত্যিই আমি মানুষ হইনি।

পিটুনি খেয়ে মানুষ হলে হালের আর গাড়ি টানার বলদগুলো সবার আগে মানুষ হতো।

.
___________________________________________
ভাগ্যিস, আমার মনের ব্যাপারগুলো কেউ দেখতে পায় না!

___________________________
লাইগ্যা থাকিস, ছাড়িস না!

মৃদুল আহমেদ এর ছবি

চমৎকার একটা মন্তব্য।
--------------------------------------------------------------------------------------------
বললুম, 'আমার মনের সব কপাট খোলা ভোজরাজজী। আমি হাঁচি-টিকটিকি-ভূত-প্রেত-দত্যি-দানো-বেদবেদান্ত-আইনস্টাইন-ফাইনস্টাইন সব মানি!'

--------------------------------------------------------------------------------------------
বললুম, 'আমার মনের সব কপাট খোলা ভোজরাজজী। আমি হাঁচি-টিকটিকি-ভূত-প্রেত-দত্যি-দানো-বেদবেদান্ত-আইনস্টাইন-ফাইনস্টাইন সব মানি!'

বাউলিয়ানা এর ছবি

পিটুনি খেয়ে মানুষ হলে হালের আর গাড়ি টানার বলদগুলো সবার আগে মানুষ হতো।

আহা এই কথাটা যদি আমাদের শিক্ষকরা বুঝতেন !

পড়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ।

তিথীডোর এর ছবি

উদ্ধৃতি
"পিটুনি খেয়ে মানুষ হলে হালের আর গাড়ি টানার বলদগুলো সবার আগে মানুষ হতো।"
উত্তম জাঝা!
লেখায় চলুক

--------------------------------------------------
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

মৃদুল আহমেদ এর ছবি

কংচাইরী তো একটা খুব ভালো বন্ধু পেয়েছিল। যার সাথে স্কুলে পড়ার বহুদিন পরেও আলু বেচতে বেচতে উঠে এসে জড়িয়ে ধরা যায়। যে কিনা কংচাইরীকে নিয়ে এখনো ভাবে, লেখে, পরিচয় করিয়ে দেয় আমাদের সাথে।
পুরো লেখা জুড়েই দেখছি এক হৃদয়বান বন্ধুকে।
কামনা করছি, কংচাইরীর মতো আপনার হাসিও কখনো ম্লান না হোক।
কংচাইরী অনেক কষ্টে ক্লাস টেন পর্যন্ত পড়েছে, কিন্তু আমাদের মাস্টার্স করা উচিত ওর সামনে বসে। ও আমাদের শেখাবে, কী করে হাসিকে সতেজ রাখা যায় সারাজীবন।
--------------------------------------------------------------------------------------------
বললুম, 'আমার মনের সব কপাট খোলা ভোজরাজজী। আমি হাঁচি-টিকটিকি-ভূত-প্রেত-দত্যি-দানো-বেদবেদান্ত-আইনস্টাইন-ফাইনস্টাইন সব মানি!'

--------------------------------------------------------------------------------------------
বললুম, 'আমার মনের সব কপাট খোলা ভোজরাজজী। আমি হাঁচি-টিকটিকি-ভূত-প্রেত-দত্যি-দানো-বেদবেদান্ত-আইনস্টাইন-ফাইনস্টাইন সব মানি!'

বাউলিয়ানা এর ছবি

কংচাইরী অনেক কষ্টে ক্লাস টেন পর্যন্ত পড়েছে, কিন্তু আমাদের মাস্টার্স করা উচিত ওর সামনে বসে।

হা হা... দারুন মন্তব্য মৃদুল'দা।
অনেক ধন্যবাদ।

মাহবুব লীলেন এর ছবি

আমার জন্ম আর শৈশব আদিবাসী এলাকায়
শৈশবের বন্ধুরা ছিল পাত্র আদিবাসী। সবচে ঘনিষ্ঠ ছিল সুবই পাত্র

সুবইকে নিয়ে আমার দুটো লেখা

খুনিচক্র

আর

বিশ্বায়ন থিওরি কিংবা একটি আদর্শ খামার

আপনার গল্পের সাথে কোথায় যেন কী একটা মিল পেলাম আমার সাথে

বাউলিয়ানা এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ লীলেন ভাই।

আপনার লেখাগুলো পড়লাম। ভাল লাগল।

মৃত্তিকা এর ছবি

পড়তে গিয়ে খুব কষ্ট পাচ্ছিলাম। শেষে দুই বন্ধুর মিলনের মাধ্যমে সেই কষ্ট খানিকটা দূর করলেন! কাংচাইরীদের আশেপাশে সব সময় যেনো এরকম বন্ধু থাকে।

বাউলিয়ানা এর ছবি

মৃত্তিকা আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।

হাসি

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।