জন্মদিন

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: বুধ, ২১/০৪/২০১০ - ৯:১৯অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

[মুক্ত বিহঙ্গ]

ভদ্রলোক প্রায় দুই ঘন্টা যাবত হাসপাতালের রিসেপশনে বসে আছেন। তাঁর সাথে বিরাট সাইজের দুইটা সুটকেস। ভদ্রলোকের বয়স প্রায় ষাট, মাঝারি উচ্চতা, কাঁচা-পাকা চুল। চেহারা দেখে বোঝা যায়, বেশ আভিজাত্যে জীবন-যাপন করেছেন। দীর্ঘ প্রতীক্ষার পরেও তাঁর চোখে-মুখে বিরক্তির কোন ছাপ নেই। হাসপাতালের পরিবেশ খুব আগ্রহ নিয়েই উপভোগ করছেন মনে হচ্ছে।

গত দুই ঘন্টায় খারাপ কোন দৃশ্য দেখেননি তিনি। এই সময়টাতে তিনটা শিশুর জন্ম হয়েছে এই হাসপাতালে। সেই পরিবারগুলোর আনন্দ দেখার মত। প্রতিটা পরিবার থেকে প্রায় দশ-বারোজন আত্মীয়-স্বজন এসেছে। রিসেপশনের এখানে দাঁড়াবার জায়গা নেই। এদের মধ্যে একজনের আবার প্রথম সন্তান হয়েছে। যেই যুবকটি প্রথম বাবা হয়েছে, সে বাচ্চা হবার খবর শুনে কান্না শুরু করেছে। যুবকটির আনন্দ-অশ্রু দেখতে ভালো লাগছে।

একজন মহিলা এসে ভদ্রলোক-কে বললো, “আপনি আমার সাথে আসুন। আর সুটকেস দুটো এখানেই রাখুন। এগুলো নিয়ে স্যারের রুমে ঢোকা যাবেনা।” মহিলা তাঁকে একটা রুমের সামনে নিয়ে এসে বললো, “আপনার যা বলার পাঁচ মিনিটের মধ্যে বলবেন। স্যার অনেক ব্যস্ত।”

দরজায় নাম লেখা ‘ডাঃ আনিস চৌধুরী। চিফ মেডিক্যাল অফিসার’। দরজায় নক্ করায় ভিতর থেকে আওয়াজ আসলো, “ভিতরে আসুন!” ডাক্তার সাহেবের চেহারা যেমন চিন্তা করেছিলেন, তেমন নয়। মুখে হালকা কাঁচা-পাকা দাড়ি, চেহারায় একটা পবিত্র ভাব, আর চোখে সবসময় যেন এক ধরণের হাসি লেগে আছে। বয়স পঞ্চান্ন থেকে ষাটের মধ্যে। এমন ডাক্তারের দিকে তাকালে রোগীর অর্ধেক রোগ সেরে যাবার কথা। ডাক্তার সাহেব চেয়ার দেখিয়ে বসতে বললেন ভদ্রলোক-কে।

- শুনলাম আপনি আমার সাথে কথা বলবার জন্য অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে আছেন।
- আমি একটা বিশেষ অনুরোধ নিয়ে এসেছি।
- বলুন কি অনুরোধ?
- আজ এই হাসপাতালে যতগুলো শিশু জন্ম নেবে, সেই শিশুগুলো এবং তাদের বাবা-মা কে আমি কিছু উপহার দিতে চাই।
- আপনার এমন বিচিত্র ইচ্ছার কারণ জানতে পারি?
- জ্বি, আসলে তেমন বিশেষ কোন কারণ নেই। আজ থেকে ঠিক ষাট বছর আগের এই দিনে এই হাসপাতালে আমি জন্মেছিলাম।
- ও আচ্ছা! দেখুন এমন অনুরোধ আমাকে কেউ কখনো করেনি। তো আপনার পরিচয়টা জানতে পারি?
- আমার নাম শরীফ আহমেদ। পেশায় মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ার। দীর্ঘদিন অস্ট্রেলিয়ায় ছিলাম। কয়েক মাস আগে স্ত্রী মারা যাবার পর সবকিছু ছেড়ে আবার দেশে চলে এসেছি।
- আপনি কি সেই শরীফ আহমেদ যে এস. এস. সি. তে সেকেন্ড স্ট্যান্ড করেছিল?
- হ্যাঁ। কিন্তু আপনি কিভাবে জানলেন?
- আমাদের স্কুলের ইতিহাসে সাইন্সে একজন-ই সেকেন্ড স্ট্যান্ড করেছিল। আপনার নাম স্কুলের সবাই জানে। এখন তো আর সেই সিস্টেম নেই, এখন আছে গ্রেডিং সিস্টেম। কে জিপিএ ফাইভ পেলো, কেউ মনে রাখে না। আমি আপনাদের পরের ব্যাচ-এ ছিলাম। আমি নিজেও স্ট্যান্ড করেছিলাম, ষোল-তম। আমি সবসময় পড়াশুনায় আপনাকে আইডল ভাবতাম। অস্ট্রেলিয়া গিয়েছেন, এই পর্যন্ত জানতাম।
- শুনে খুশি হলাম।
- আপনার হয়তো মনে নেই, ক্লাস টেন-এ পড়বার সময় আমি একবার আপনার কাছে নোট চাইতে গিয়েছিলাম। আপনি বলেছিলেন, আপনি নোট করে পড়েন না। সেইদিন খুব রাগ হয়েছিলো আপনার উপর, মনে হয়েছিলো আপনি ভাব নিচ্ছেন।
- আমি দুঃখিত! কিন্তু আমি আসলেই নোট করে পড়তাম না! কিছু মনে করবেন না, আমি মনে হয় আপনার অনেক সময় নিয়ে নিলাম।
- হুমম… তা নিয়েছেন বটে। সমস্যা নেই, অনেক দিন পর আপনাকে দেখে ভালো লাগলো। আপনার ছেলে-মেয়ে …
- আমার এক ছেলে, এক মেয়ে। মেয়ের বিয়ের পর স্বামীর সাথে জার্মানী তে আর ছেলেটা ওর ফ্যামিলি নিয়ে কানাডা তে। তাই স্ত্রী গত হবার পর সব কিছু ছেড়ে দিয়ে দেশেই চলে এলাম। ভাবলাম, জীবনের বাকি কটা দিন নিজের দেশেই কাটিয়ে যাই। এখানে ভাই-বোন আর আত্মীয়-স্বজন আছে। এখানে একটা ফ্ল্যাট কিনেছি, একাই থাকি।
- এই নিন আমার কার্ড, বাসার ঠিকানা আছে এখানে। চলে আসবেন সময় করে। আসবার আগে শুধু একটা ফোন দেবেন, ব্যাস! বোঝেন-ই তো, ডাক্তার-এর জীবন। সবসময় ব্যস্ত থাকি। আমারো ছেলে-মেয়ে সবাই দূরে-দূরে থাকে। শুধু দুই ঈদে দেখা হয়। আপনি আসলে আমার স্ত্রী-ও খুব খুশি হবে, ও রান্না করে অন্যদের খাওয়াতে খুব পছন্দ করে।
- জ্বি অবশ্যই। আর আমার অনুরোধটা ….
- চিন্তা করবেন না। আমি ব্যাপারটা দেখছি।
- অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। আমি তাহলে এখন আসি। আপনার অনেক সময় নষ্ট করলাম …..
- না … না ... ঠিক আছে …… আবার দেখা হবে …..

এইমাত্র আরেকটা শিশু জন্মেছে। রিসেপশনে সেই পরিবারের মানুষগুলোর আনন্দিত চেহারা দেখতে খুব ভালো লাগছে। আনন্দিত মানুষের মুখ দেখা এই পৃথিবীর অন্যতম আনন্দময় অভিজ্ঞতা।


মন্তব্য

নিঃসঙ্গ গ্রহচারী [অতিথি] এর ছবি

পড়লাম।
কিন্তু কোন গল্প খুঁজে পেলাম না ইয়ে, মানে...

অতিথি লেখক এর ছবি

নিঃসঙ্গ গ্রহচারী,

আমি দুঃখিত মন খারাপ

- মুক্ত বিহঙ্গ

সাফি এর ছবি

গল্প হিসেবে সুন্দর আগাচ্ছিলো কিন্তু হঠাৎ শেষ হয়ে গেলো বলে একটা অতৃপ্তি রয়ে গেলো

অতিথি লেখক এর ছবি

সাফি,

মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ হাসি

- মুক্ত বিহঙ্গ

ধ্রুব বর্ণন এর ছবি

লেখা ভালো এগুচ্ছে। দৈর্ঘ্য নিয়ে দুশ্চিন্তা নাই। যতখুশি বড় হোক। গল্প শেষ হোক। প্রয়োজনে ০১, ০২, চলবে..., ইত্যাদি ব্যবহার করা যায়।

এই এক্সপেরিমেন্টকে সাধুবাদ। এখন বর্ণনায় জোর দিচ্ছো। এদিকটা পাকাপোক্ত হলে তখন আগের উপাদানগুলো যোগ করে অনেক ভালো লেখা হবে।

অতিথি লেখক এর ছবি

ধ্রুব বর্ণন,

অনেক ধন্যবাদ আপনার সুন্দর মন্তব্য এবং পরামর্শের জন্য হাসি

- মুক্ত বিহঙ্গ

চেনা পথিক [অতিথি] এর ছবি

ভাইয়া,

একটা জিনিস খেয়াল করেছি, এখন না, বেশ কিছুদিন আগের থেকেই। আমাদের মাঝে বেশির ভাগ মানুষ, যখন আমাদের বয়স খুব কম থাকে, তখন নিজেদের জন্মদিনটা নিয়ে আমরা যারপরনাই উত্তেজিত থাকি। একদম ছোটকালে চিন্তা থাকে কি উপহার পাব, একটু বড় হলে ভাবনা থাকে বন্ধু-আত্মীয়দের নিয়ে সুন্দর একটা সময় কাটানোর, আর ধীরে-ধীরে এমন একটা বয়স আসে যখন মনে হয় আমার নিজের এই "খানিক-বিশেষ" দিনটা যেন শুধু আমার একার না থাকে, বরং তখন মনে হয় এই দিনটাতে অন্যদের জীবনের ঘটে যাওয়া আনন্দটুকু উপভোগ করতে, সেটা দূর থেকে হোক আর কাছ থেকে হোক।

জীবন সম্পর্কে আমার কোন ধারণাই নেই বলতে গেলে, অথচ একটা ব্যাপার খুব অবাক লাগে--- একটা জীবন যখন পৃথিবীতে আসে, কত আনন্দ-সমারোহেই না আমরা তাকে বরণ করে নেই। আবার যখন সেই একই জীবন সব মায়া ছেড়ে চিরতরে চলে যায়, তখন বুকে পাথর বেঁধে সহ্য করা ছাড়া উপায় থাকে না। অথচ দু'টো ব্যাপারই ভবিতব্য। কিন্তু দু'টার মাঝে কতই না ব্যবধান! দু'টোই আমাদের জীবনের চরম-সত্য, অথচ পরিণাম দু'রকম, অনুভূতিতেও কত ব্যবধান ...।

আশা করি ভালো আছেন এবং ভালো থাকবেন। হাসি

[বিশেষ নোটিশ :- অনিবার্য কারণবসতঃ দেরিতে কমেন্ট করায় লেখক যেন ভেবে না বসেন যে তিনি এই ক্ষুদ্র-পাঠকের অত্যাচার থেকে মুক্তি পেয়েছেন !!! :-P]

অতিথি লেখক এর ছবি

চেনা পথিক,

জন্মদিন সম্পর্কে আপনার সুন্দর ভাবনাগুলো শুনতে ভালো লাগলো হাসি

[আপনার বিশেষ নোটিশ শুনে খুব খুশি হলাম। এই ক্ষুদ্র-পাঠকের অত্যাচার থেকে লেখক কখনোই মুক্তি চায় না দেঁতো হাসি ]

- মুক্ত বিহঙ্গ

অতিথি লেখক এর ছবি

ভাল হয়েছে।

মিতু
রিফাত জাহান মিতু
miturifat @gmail.com

অতিথি লেখক এর ছবি

মিতু,

আপনার ভালো লেগেছে শুনে খুশি হলাম হাসি

[তবে আর কারো ভালো লেগেছে বলে মনে হচ্ছেনা মন খারাপ ]

- মুক্ত বিহঙ্গ

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।