নীল সংগীত

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: শনি, ২২/০৫/২০১০ - ১:১৮পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

১.
মাথা ঘুরছে। সত্যিকারে ঘুরছে না, মাথাটা আসলে ব্যাথা করছে। ইদানিং নতুন কোন কাজ হচ্ছে না। খালি দিন রাত শুয়ে বসে কাটাচ্ছি, আর ভাবছি কি করা যায়। একটা বিজ্ঞাপন চিত্রের জন্য যন্ত্র সংগীত রচনা করতে হবে। আমার সামনে ডিরেক্টর সাহেব বসে নানা নির্দেশ দিচ্ছেন। এই রকম করে সুর করবা, ওই রকম যেন অনুভুতি হয় শুনার পর। আজকাল এখানেই সমস্যা হচ্ছে, মাথা থেকে নতুন কোন সুর বের হচ্ছে না। এই বিজ্ঞাপনটা একটা কন্ডমের বাজার বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে নির্মান করা হচ্ছে, ভিডিও আগেই ধারন করা হয়ে গেছে, এখন ডিরেক্টর সাহেব চাচ্ছেন যন্ত্র সংগীতটা যেন অনেক যৌন উদ্দীপক হয়। শুধু আমি কেন অনুত্তেজনা বোধ করছি তা উনি বুঝতে পারছেন না।

" দেখ ইকবাল, তোমার কাজটার জন্য এডিটিং প্যানেলে নিয়ে যেতে পারছি না।"
" আপনারে না বলছিলাম, শুটিং এর আগে আমারে বলবেন। পুরানো সাউন্ড স্যাম্পলগুলো সব মুছে দিছি, একেবারে নতুন করে কাজ করতেছি, সেই জন্য তো একটু টাইম দিতে হবে নাকি? এইটাতো আর দুধেল গাই না যে দুধ ধরে টান দিবো আর মাল পড়তে থাকবো..."
" মুখ সামলে কথা বল..তুমি না পারলে রাজন রে দিয়া কাজ করামু..."
" তো যান গিয়া, আমার মাথা ব্যাথা করতেছে, আমি এইটার মিউজিক কম্পোজ করুম না.."
" আরে আরে এত ক্ষ্যাপ ক্যান, মাল পানি খাবা কিছু? কি খাবা? আমার কাছে এখনও আধা বোতল ভোদকা পড়ে আছে, এই রাত্রে কাজ উঠাইতে পারবা না?"

২.

সন্ধ্যা। অন্ধকার ঘরে মৃদু আলো। আলোটা জানালার বাইরে থেকে আসছে। মাথা ব্যাথাটা বৃদ্ধি পেয়ে এখন ঘাড় ব্যাথা করছে। আমি উপুড় হয়ে শুয়ে আছি, আমার পিঠের উপর তৃণা বসে আমার ঘাড় ম্যাসাজ করছে আর কী কী প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করছে ঠিক বুঝতে পারছি না। কালকে সারারাত জেগে কাজ করার পর, আজকে সকালে এডিটিং প্যানেলে গিয়ে তাপশ দার সাথে ব্যাপক ঝগড়া, মিউজিক ক্যানো ছোট হইছে উনি এডিট করবেন না। উনি ক্যামনে জোড়া দিবেন না কপি পেস্ট মারবেন তাই আমারে প্রশ্ন করছেন। দুরো আমি ক্যামনে কমু, তোমারা ইচ্ছে মত শুটিং করে এসে এডিটিং এর আগে আমারে উৎপাত করবা, ঠিক হইছে এখন বুঝ ঠেলা।

" ইকবাল আমার কথার উত্তর দিচ্ছ না কেন?"
" কই দিচ্ছি তো!"
" বল তাহলে কবে তোমার বাবা মা'র সাথে পরিচয় করিয়ে দিবা?"
" হুম.."

৩.

দুপুর বেলা। মাথার উপর রোদ। বকশীবাজারে একটা কাজ করে ফিরছি, ভাবছি বুয়েটের ভিতর দিয়ে হেটে টিএসসির দিকে যাব, রিকশায় উঠার টাকা নাই, শাহবাগে আজিজ সুপার মার্কেটে যাব। তাপশ দা'র সাথে বাকী ঝগড়াটুকু মিটিয়ে নিতে হবে।
" আরে ইকবাল না?"
" ওহ! মুশফিক! কিরে ভাই ....কি খবর?"
" এই তো ভালই, কিরে তোরে তো দেখাই যায় না, সেই কলেজের পর তোর সাথে আর দেখাই হয় নি, কি করিস তুই?"
" আমি কিছুই করি না, আজাইরা ঘুরি... তো তুই এখন ইঞ্জিনিয়ার? হয়ে গেছিস?"
" হা হা হা, ওই ভাবে বলছিস ক্যান? হুম..হ্যা হয়ে গেছি..সার্টিফিকেটের ঝামেলা চুকাচ্ছি.."
" ভালোই তো.. আমি ভাই তোদের মত অত মাথা ওয়ালা পাবলিক না.. তো কি করবি এখন চাকরি?"
" দুরো.. চাকরি করে কে? বাইরে যাব। জিআরই'র প্রস্তুতি নিচ্ছি.."
" জিআরই মানে কি?"
"..শুন আমি যাইরে আমার কাজ আছে..."

দুর শালা, যাও গা। তোমরাই তো যাবা বিদেশে। ওই খানে গিয়া শিখবা মানবতাবাদ, শিখবা বর্ণবাদ, তারপর যখন বাংলায় লিখতে ভুলে যাবা, তারপর শিখবা বাংলা বানান। আপাতত ইংরেজী বানানই শিখো।

৪.

কোথাও থেকে পানি পড়ছে। অনেক পানি, ঝরনা নিশ্চই। কিন্তু আমি দেখতে পাচ্ছি না। কাকগুলা কেন কা কা করছে? চোখ মেলতে পারছি না, এত ঘুম আসছে কোথা থেকে? আমি কোন একটা মাঠে শুয়ে আছি, ধড়ফড় করে উঠে বসলাম। ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি হচ্ছে, দুরে রাস্তায় জ্যামে আটকা গাড়িগুলো হর্ন দিচ্ছে, মনে হচ্ছে অনেক কাক কা কা করছে। বিকেল বেলার হালকা আলোতে কেমন জানি উদ্ভট লাগছে গাছগুলোকে। বৃষ্টির ফোটাগুলো এত কোমল কেন?

৫.

বাংলা মটর থেকে মগবাজার যাচ্ছি, হেটে হেটে যাচ্ছি। ব্রীজ পর্যন্ত হাটতে হলে অবস্থা খারাপ হয়ে যাবে কিন্তু কিছু করার নাই। পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেটা খুলে দেখি একটা মাত্র সিগারেট। ধরানোর জন্য থামলাম এক চায়ের দোকানে, ম্যাচ নাই আমার কাছে।

" ইকবাল ভাই?"
" আরে... অরু!"
" ভাই আপনারে কত দিন দেখি না, এই দিকে আর আসেন না তাই না?"
" আসলে এখনতো আর ব্যান্ড নাই, মানে আগে প্র্যাকটিসে আসতাম, মাঝে মাঝে রেকর্ডিং এ আসতাম কিন্তু .."
" ..বুঝেছি ভাল মানুষ পেয়েছেন তাই না?...দুপুরে ভাত খেয়েছেন? আপনার কি শরীর খারাপ?"
" না মাথাটা একটু ব্যাথা..ভাত খাওয়া হয়নি.. পরে খাব.."
" পরে খাবেন ক্যান, আসেন আজকে আমি আপনারে খাওয়াই.."
" শুনো আজকে আমার না হাত একে বারে খালি...মানে..খারাপ অবস্থা.."
" ছি ছি..ইকবাল ভাই..."
" সরি ...।...কোথায় যাবা.."
" আসেন ..পরিচিত যায়গা আছে.."

৬.

কিছু টাকা দরকার। এডের কাজের টাকা আসতে অনেক সময় লাগবে, অনেক মলামুলি করতে হবে। এখুনি কিছু টাকা দরকার। তৃণা নামক ঝামেলাটাকে গা থেকে ঝাড়া দিতে হবে। তাপশ দা'রা নতুন একটা ফিল্ম নিয়ে কাজ শুরু করবেন পরের মাসে, সেটার খোঁজ নিতে যেতে হবে। এইবার সাউন্ড ট্র্যাকের মাল-মশলা আগে থেকে পাকানো শুরু করতে হবে, স্ক্রীপ্টা ফটোকপি করা দরকার।

"..আরে ইকবাল যে..!"
" কিরে রাজন!"
" শালা তুই আমার কাজটাজ সব মেরে দিচ্ছিস..আমারেতো ডিরেক্টর আর কোন কাজই দেয় না"
" সেদিন মাহমুদ ভাই আমারে আধা বোতল ধরায় দিয়ে কয় যে তুই রাত্রেই কাজ শেষ কর, আমি তো তারে কইছিলামই যে এই কাজ রাজনই ভাল পারবে, ..শালা গীটার নিয়ে কই যাস?"
"যাই না এইখানেই আছি.. সামনে এক ছেলের কাছে আরেকটা গীটার আছে , জ্যামিং করবি?"
" চল..."
" কি বাজাবি?"
" ব্লুজ বাজাই?..কালোদের নীল সুর..?"
" টুয়েলভ বার ব্লুজ? তুই সলো দিবি?"
"নাহ.. আমি রিদম দিচ্ছি, তুই সলো দে..।"

মাথাটা হালকা লাগছে। আমি আর রাজন গীটার বাজাচ্ছি, শুধুই যন্ত্র সংগীত। কয়েকজন রিকশাওয়ালা রিকশা থামিয়ে আমাদের নীল সংগীত শুনছেন। তাদের দৃষ্টিতে মুগ্ধতার ছোয়া। মনে হচ্ছে তারা সব কিছু বুঝতে পারছেন, আমি নিঃসন্দেহ।




ছেড়া পাতা
ishumia@gmail.com


মন্তব্য

রুদ্রনীল দূর্লভ এর ছবি

বাস্তবতাটাকে এমন কঠিন ভাষায় না লিখলেও পারতি। তোর অনুগল্পের নামটা আমার খুব পছন্দ হইছে। "নীল সংগীত"

অতিথি লেখক এর ছবি

হা হা হা! কঠিন আর এইটা কি দেখলি!.. ধন্যবাদ, নামটা পছন্দ হওয়ার জন্য!


ছেড়া পাতা
ishumia@gmail.com

এস এম মাহবুব মুর্শেদ এর ছবি

ফাটফাটি লাগছে!!! নীল সঙ্গীত বাজান বুঝি। সচলায়তনে স্বাগতম।

====
চিত্ত থাকুক সমুন্নত, উচ্চ থাকুক শির

অতিথি লেখক এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ! মাঝে মাঝে নীল সংগীত কিভাবে বাজাতে হয় তা নিয়ে পড়ি, এখনও খুব একটা ভাল বাজাতে পারি না.. হাসি


ছেড়া পাতা
ishumia@gmail.com

নীল তারা  [অতিথি] এর ছবি

ব্যাপক লিখছেন৷

অতিথি লেখক এর ছবি

বিয়াফক লাগলো ভাই................ দেঁতো হাসি

চালায়া যান।

নবীন পাঠক

shahriarsajib@gmail.com

সুরঞ্জনা এর ছবি

আপনি সুর দিতে পারেন?
এর পরে আপনার তৈরী সুর সহ পোস্ট আশা করি। হাসি
লেখা ভালো লেগেছে ভাই, চালিয়ে যান।
চলুক
...................................................................................................
জগতে সকলই মিথ্যা, সব মায়াময়,
স্বপ্ন শুধু সত্য আর সত্য কিছু নয় ।

............................................................................................
এক পথে যারা চলিবে তাহারা
সকলেরে নিক্‌ চিনে।

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

নীল সঙ্গীত মানে কি Blues? তাহলে এরপর বাংলা মোটর থেকে মগবাজার যাবার পথে আমার বাসার কাছে এসে একটা হাঁক দেবেন। আপনাদের নীল সঙ্গীত শুনতে চাই।



তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

অনিন্দিতা চৌধুরী এর ছবি

খুব ভাল লাগল।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।