দমকা হাওয়া

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: সোম, ২৪/০৫/২০১০ - ৮:৪০পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

১।।
সোবহানবাগ মসজিদের ঠিক উল্টোপাশে আমি দাঁড়িয়ে আছি। আকাশের সূর্যটার তেজ বাড়ছে ধীরে ধীরে। সকাল প্রায় সাড়ে এগারটা। এরমধ্যেই ঘামে আমি একদম গোসল করে ফেলার মত অবস্থা। দ্রুত রাস্তা ক্রস করে এ আর প্লাজায় ঢুকি। প্লাজার এসি-টা বেশ ভাল। এতক্ষন বাইরের রোদে হেঁটে আসার পর এখন এই শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত শপিং মলের শীতল হাওয়া কেমন যেন একটা স্নিগ্ধ অনুভূতির সৃষ্টি করে। আমি উইন্ডো শপিং শুরু করি। কতক্ষণ যে এইভাবে সময় পার করতে হবে নিজেই জানি না। সবকিছু নির্ভর করছে নীপার আসার উপর। ও যে কখন আসতে পারবে!
নীপা কখনই তার আসার সময় ঠিক করে বলতে পারে না। একদিন তো সকাল এগারটায় দেখা করবে বলে দুপুর তিনটায় হাজির। ততোক্ষনে আমি ওই জায়গা থেকে ঘন্টাখানেক অপেক্ষা করে যথারীতি বাসায় চলে গেছি। পরে ও ফোন করার পর আমি আবার ওর সাথে দেখা করতে গেলাম। যাবার পর দেখি বেচারী ততোক্ষনে তার ভাইয়ের হাতে কট বিহাইন্ড। মুখচোখ কাল করে বেচারী তার ভাইয়ের হাত ধরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। হয়ত ভাইয়ার কাছ হাল্কা কিছু ঝাড়ি ও হজম করতে হয়েছে। আমাকে দেখেও অনেকটা না দেখার ভান করে পাশ কাটাল। আমি ওই দিন মনে মনে তার ভাইয়ের মুন্ডুপাত করতে করতে বাসায় ফিরি। এমনিতেই নীপার সাথে ইদানীং আমার দেখা সাক্ষাৎ খুব একটা হচ্ছে না। তার উপর দেখা করে একটুখানি গল্প করার সুযোগ হাতছাড়া হওয়াতে আমি স্বাভাবিকভাবেই কিছুটা রাগান্বিত, কিছুটা হতাশ। তবে এই রকম কখনো হয় নি, নীপা ‘আজ দেখা করব’ বলে আসে নি। যাই হোক, আমি নীপাকে কখনও টাইম বেঁধে দেই না। কারন, জানি ও সব সময় সেটা পারবে না। আজও তার ব্যতিক্রম নয়।
উইন্ডো শপিং করে ভালই সময় কাটছে। এম্নিতেই আমি কিছুটা ভবঘুরে টাইপ। ঘুরতে আমার খারাপ লাগে না কখনো। আর এখন তো বাসাতে সময় কাটানোই মুস্কিল – এক ঘন্টা পর পর লোড শেডিং। গরমে মারা পড়ার দশা। তার চেয়ে এই শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত মলগুলো বেশ ভাল। ঘন্টার পর ঘন্টা কাটানো যায়। তবে একা এক মার্কেটে বেশীক্ষন ঘোরাঘুরি করলে দোকানদারগুলো আবার কেমন যেন সন্দেহের চোখে তাকায়। ভাবখানা এমন যেন আমি ডাকাতি করার মতলব নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি। আমি মল চেঞ্জ করে রাপা প্লাজায় ঢুকি। দোতলায় উঠে ‘বিড়াল চক্ষু’ নামক দোকানে ঢুকতেই একটা সেলসম্যান আমার পিছনে লেগে গেল। আমি যেই শার্টের সামনে দাঁড়াই, পিছন থেকে সে ওটার গুণ বর্ণনা শুরু করে। মহা যন্ত্রনা! অনেকটা মেজাজ খারাপ করে দোকান থেকে বের হলাম। দুপুর প্রায় একটা। এখনো নীপার আসার কোন নাম নেই। পেটে খিদেটা ভালই টের পাচ্ছি। কত কিছুই না পরিকল্পনা করছিলাম... দুপুরে দুইজনে এক সাথে আজ ফখরুদ্দীনে খাব। হল না। আমি নীপাকে ফোন করি। গুনগুন বেজেই চলে, ‘ আমি কার, কে তোমার...’। এই ধরনের বিরহী মার্কা গান নীপা তার মোবাইলে কেন যে সেট করে! দুই তিনবার গুনগুন শোনার পর আমি বিরক্ত হয়ে ফোনটা রেখে দিই।
খিদে বেশ ভালই লেগেছে। রাপা প্লাজা থেকে বের হয়েই সোজা শর্মা খেতে দোকানে ঢুকি। এই দোকানের শর্মাটা আমার কাছে বেশ ভালই লাগে। শর্মার স্বাদে চোখ প্রায় বন্ধ হয়ে আসছে আমার। এমন সময় নীপার ফোন। সবেমাত্র দুই কামড় দিছি শর্মায়...আমি খাওয়া বন্ধ করে ফোনটা রিসিভ করি।
‘হ্যালো মিশু, কোথায় তুমি?’
‘তুমি এসে গেছ?’
‘না। আমি আর মিনিট দশেকের মধ্যে আড়ং –এর সামনে চলে আসব।’
‘ঠিক আছে, আমি আড়ং-এর সামনে থাকব।’
ফোন কেটে দিয়ে গ্রোগাসে শর্মা খেয়ে আমি আড়ং –এর দিকে ছুটি।
আমার আড়ং-এর সামনে যেতে যেতে প্রায় পনের মিনিট। কিন্তু নীপা এখনো এসে পৌঁছায় নি। আমি হাঁপাচ্ছি। কিছু দূরে নীপাকে রিক্সায় দেখতে পাচ্ছি। নীপা এমনিতেই দেখতে সুন্দর। আজ আরো বেশী সুন্দর লাগছে। এ কি দীর্ঘদিন পর নীপাকে দেখার ফল? কি জানি!

কিছু কিছু দিন আসে মানুষের জীবনে যা মানুষ কখনো ভুলতে পারে না। নীপার সাথে কাটানো সেই দিন আমার এতটুকু জীবনে সেই রকমই দিন। সেই দিনের সেই একসাথে কাটানো অল্প কিছু সময় মনের মধ্যে একটা আলাদা জায়গা করে নিয়েছে। সেই স্মৃতি শুধুই পূর্ণতার, সেইখানে শুধুই প্রাপ্তি।
এরপরের ঘটনাগুলো খুব দ্রুত ঘটে। সেই দিনের পর ঠিক তিন দিনের মাথায় নীপা আমার সাথে তার তিন বছরের সম্পর্ক ছিন্ন করে দেয়। ঠিক কি কারনে তা আমি হাজার জিজ্ঞেস করেও জানতে পারি নি। নারীর মন নিয়ে আমি আবার সন্দেহে পড়ি। নিজের ভিতর থেকে ভালবাসা নামক একটা অনুভূতি ছিল সেটাকে ঝেড়ে ফেলি। আড্ডার সেই প্রানোচ্ছল ছেলেটি, বন্ধুদের সাথে যখন তখন ঘুরতে সেই ছেলেটি আমার মাঝ থেকে হারিয়ে যায়। এই ঘটনার ঠিক ছয় মাসের মধ্যে আমি আমেরিকা চলে আসি। নিজের কষ্টগুলো থেকে দূরে পালানোর চেষ্টায় আমি আমার প্রিয় শহর ছেড়ে প্রবাসের যান্ত্রিক জীবনে অভ্যস্ত হয়ে পড়ি। যান্ত্রিক জীবনের পাল্লায় নিজের অনুভূতিগুলো ও কেমন যেন ভোঁতা হয়ে যায়।
২।।
নেভাদাতে খুব কম সময়ই বৃষ্টি হয়। আজ সকাল থেকেই বৃষ্টি। আমি জানুয়ারির বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে ল্যাবে যাচ্ছি। ঠান্ডায় প্রায় জমে যাচ্ছি! এরমধ্যেই মোবাইলটা বেজে ওঠে। এই সময়ে মা-র ফোন! আমি অবাক হয়ে ফোনটা রিসিভ করি।
‘মিশু, বাসায় নীপা নামে একটা মেয়ে বেশ কয়েকবার ফোন করে তোকে খুজঁছিল। আমি বললাম, তুই দেশের বাইরে চলে গেছিস। বিশ্বাসই করতে চায় না। তোর ফোন নাম্বার চাচ্ছিল ... কিরে মিশু, কথা বলছিস না কেন? তুই চিনিস না কি ঐ মেয়েকে? কই, আমাদের তো কখনো ঐ রকম ভাবে কিছু বলিস নি!’
আমি হতভম্ব। কিছুটা সামলে নিয়ে বলি,
‘মা, মেয়েটা আর কিছু বলেছে?’
‘না, তেমন তো বিশেষ কিছু বলে নি। শুধু বলছিল তোকে দরকার।’
‘মা, মেয়েটা পরে ফোন করলে আমার নাম্বারটা দিয়ে দিও। আচ্ছা মা, আমি তোমাকে পরে ফোন করব।’
ফোনটা নামিয়ে রেখে আমি অনেকটা বিচলিত মনে ল্যাবের দিকে ছুটে চলি। নীপা, নীপা আমাকে খুঁজছে! এতদিন পর আমার কাছে কি দরকার থাকতে পারে তার? এইসব চিন্তা করতে করতে কখন যে কাজের মধ্যে ডুবে গেলাম! বিকেলের দিকে কাজের অগ্রগতি নিয়ে কথা বলছি আমার অ্যাডভাইজার ডক্টর স্মিথের সাথে। ডক্টর স্মিথ খুব জটিল একটা মডেল আমাকে বোঝাচ্ছেন। আমি গভীর আগ্রহ নিয়ে তার কথা শুনছি। পকেটে রাখা ফোনটা হঠাৎ করে কাঁপতে থাকে। আমি বিরক্ত হয়ে ফোনটা বের করি। ফোনটার দিকে তাকাতেই আমার হার্টবিট বেড়ে যায়। এই তো সেই নাম্বার যেটাতে ফোন করে কথা বলতে বলতে এক সময় আমার রাত ভোর হয়ে যেত! ফোনটা কেঁপেই চলছে আর ঐ দিকে ডক্টর স্মিথের গলা শোনা যাচ্ছে,
‘ইউ আন্ডারস্ট্যান্ড হোয়াট অ্যা ম সেয়িং...’

নীল তারা।।


মন্তব্য

পল্লব এর ছবি

ফোনে কি কথা হল?! গল্পটা এইখানে থেমে গেল কেন?! মন খারাপ

কিন্তু নামকরণের সার্থকতা বুঝলাম না।

==========================
আবার তোরা মানুষ হ!

==========================
আবার তোরা মানুষ হ!

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।